স্মৃতির দহন
✍️শিব প্রসাদ হালদার
১৯৬৮ সাল। তখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। এই প্রথম স্কুল ম্যাগাজিন প্রকাশ হবে জেনে ভীষণ খুশি হলাম। বাংলা শিক্ষক শ্রদ্ধেয় রাখাল দেবনাথ মহাশয়ের নির্দেশ মতো দুটি ছোট্ট গল্প লিখে জমা করলাম। পত্রিকা প্রকাশ হ’লে দেখলাম সেই দুটি গল্পই প্রকাশিত হয়েছে। একটা- “আমার ছোট্ট শাশুড়ি” আর অন্যটি ‘বন্ধু’। এই প্রথম আমার লেখা মুদ্রিত আকারে দেখে ভীষণ অনুপ্রাণিত হলাম। প্রশংসা পেলাম অনেকেরই। শুরু হল সেই থেকে লেখা। সে লেখা আজও থামেনি। পঞ্চান্ন বছরের সাহিত্য সাধনায় রচিত হয়েছে অসংখ্য লেখা। সমাদর পেয়েছি দেশ-বিদেশ থেকে। দিনে দিনে নতুন নতুন লেখায় আগ্রহ বেড়ে গেল বহুলাংশে।
সেই সময় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ডাকযোগে লেখা পাঠিয়ে অপেক্ষায় থাকতাম প্রকাশিত হবে কিনা! অবশেষে সৌজন্য সংখ্যা প্রাপ্তিতে উল্লসিত হয়ে লেখার আগ্রহ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ডাকযোগে প্রাপ্ত সেইসব সৌজন্য সংখ্যা আজও সযত্নে অক্ষত অবস্থায় সজ্জিত রয়েছে আমার সংগ্রহে। মাঝেমধ্যে সময় পেলে সেগুলি নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখি আর ভাবি—–!এখন পত্রিকায় লেখার আর তেমন সময় পাই না। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে ফেসবুকের সঙ্গে যুক্ত হই। সেখানে সাহিত্যচর্চার বন্ধুদের সন্ধান পেয়ে সানন্দে আমন্ত্রণ জানিয়ে সাহিত্যের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে দিনে দিনে এগিয়ে যেতে থাকি। ফেসবুকের সৌজন্যে হয়েছে অনেক পরিচিতি- পেয়েছি অনেক সম্মান! সেজন্য ফেসবুক কর্তৃপক্ষের কাছে আমি চির কৃতজ্ঞ!
সেই সময় একশত দশ বছরের ঐতিহ্যমন্ডিত দমদম লাইব্রেরী ও লিটারারী ক্লাবের উদ্যোগে ২০১৭ সালের ২২শে এপ্রিলে আয়োজিত স্বরচিত কবিতা পাঠের আসরে আমার লেখা “সংকটের সংস্কার” কবিতাটি প্রথম হিসাবে ঘোষিত হলে বিস্মিত হয়ে পড়ি! এমনটা ছিল যেন আমার কাছে অপ্রত্যাশিত! আমার হাতে স্মারক সম্মাননা তুলে দিলেন বিশিষ্ট কবি সাহিত্যিক ছড়াকার শ্রদ্ধেয় বিনয় দেব মহাশয়। এবং পদক প্রদান করলেন বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাঃ অলোক গুহ মহাশয়। হলঘর ভর্তি সকল সাহিত্যানুরাগী সুধীজনদের মাঝে উক্ত সম্মাননা স্মারক হাতে নিয়ে নিজেকে ভীষণ গর্বিত মনে হচ্ছিল। তখন সেখানে উপস্থিত অনেকের সঙ্গেই নতুনভাবে হ’ল যোগাযোগ। ওই দিন রাত্রেই সুসংবাদটি সহ অনুষ্ঠানের কিছু ছবি ফেসবুকে পোস্ট করলে অসংখ্য সাহিত্যরাগী বন্ধুদের কাছ থেকে পেলাম অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন বার্তা।
সম্মাননা প্রাপ্তির ঠিক দুইদিন পর আমার এক তিক্ত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হলো। এতদিনে জানতাম না আমাদের এলাকায় কিছু কিছু অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী তথাকথিত বেশ কিছু মাকাল কবি সাহিত্যিক আছে। তাদের বিশেষ প্রতিনিধি হয়ে হাতে গোনা দুইজন এসেছিলেন “সংকটের সংস্কার” কবিতাটি স্বচক্ষে দেখে যাচাই করবার উদ্দেশ্য নিয়ে। লেখাটি আমার স্বরচিত- নাকি অন্যের লেখা আমার বলে চালিয়ে দিয়ে বাজিমাত করলাম।অবমূল্যায়নের চিন্তা ভাবনায় হয়তো আমার সম্পর্কে না জেনেই এমনটা ভাবার সাহস পেয়েছে। তবে এহেন চিন্তাভাবনার স্পর্ধা দেখে স্তম্ভিত হলাম।তাই বাধ্য হয়েই শুরু করলাম আমার সাহিত্য জীবনের পঞ্চান্ন বছরের ইতিহাস—। সবকিছু জেনে শুনে এবং আমার সযত্নে গচ্ছিত পান্ডুলিপি গুলি দেখে একজন তো বলেই ফেললেন- “বাহ্ চমৎকার! প্রথম পুরস্কার উনি পাবেন নাকি অমুক পাবে——?” তখন বুঝলাম সমালোচনা কত গভীরে হয়েছে আলোড়িত। তখনই আমার সামনেই বিচারকদের যথার্থ বিচার বিবেচনার জন্য যথেষ্ট প্রশংসা করলেন। তারপর থেকে শুরু হলো নানারকম সমালোচনা।ওই সময়ে দুর্গানগরে এক সাহিত্যানুষ্ঠানে দেড় ঘন্টা ধরে মূল অনুষ্ঠানকে বাদ দিয়ে হয়েই চললো আমার সম্পর্কে বিরূপ সমালোচনা। সেখানে যারা উপস্থিত ছিল তাদের মন মানসিকতার বিবরণ আজ নাইবা দিলাম।পরে এসব শুনে আমি মোটেও বিচলিত হলাম না বরং হলাম ক্রমাগত সমৃদ্ধ। উল্টে বুমেরাং হয়ে বৃদ্ধি পেল, সত্যতার উন্মোচনে সুখ্যাতি।
তখন ফেসবুকে প্রতিদিনই একটা করে লেখা পোস্ট করতাম। তাতে আবার তখনকার দিনের সেই অন্তরঙ্গ সাহিত্যানুরাগী বন্ধুটির জোরালো বক্তব্য ছিল- ” রোজ কেন লেখা পোস্ট করেন?”সগর্বে প্রত্যুত্তরে বলেছি- দেখুন মা সরস্বতীর আশীর্বাদে এই মুহূর্তে দিনে দশটা লিখে দশটা পোস্ট করার সক্ষমতা আমার আছে। ভবিষ্যতে কি হবে জানি না। সত্যি কথা বলতে কি- বলতেও বাধা নেই তথাকথিত ঐ ‘মাকাল’ সাহিত্যিক কিন্তু কোন মাসে হয়তো একটা লেখাও পোস্ট করতে পারেনি। করলেও অজস্র ভুলে-ভালে ভরা যা আমার দৃষ্টিগোচরে এলে ফোন করে দিতে হয়েছে সংশোধনের বার্তা। যার সঙ্গে বন্ধুত্বের এমন অটুট বন্ধনে দীর্ঘদিন আবদ্ধ ছিলাম হঠাৎ তার কোন এক বন্ধুর- “আমার দ্বারা সাহিত্য জগতে তার জায়গা নষ্ট হয়ে যাবে—-” এই কুবুদ্ধিতে সে হ’লো প্রভাবিত। সেই সময়ে এই কথা কোন এক বন্ধুর ফেসবুক পোস্টেও প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় তার আসল মুখোশ উন্মোচিত হয়ে মান সম্মান ম্লান হতে শুরু করল। ঠিক এই সময়ে পাশে পেয়ে গেল এক সময়কার মতের অমিলের এক কুচক্রী মদতদাতা কুঞ্জুস প্রাক্তনীকে। নতুন করে নতুনভাবে উভয়ের মাঝে ফিরে এলো হারানো সম্প্রীতি। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তা হয়ে উঠল আরো মাখামাখি—–। আমার প্রতি চরম অশালীন অসম্মানজনক মন্তব্য ব্যক্ত করার অপরাধকে আড়াল করতে সে পক্ষপাতে দ্বিচারিতা করে দিল তাকে উৎসাহ। তবে যে যা করেছে তা তাদের নিজ নিজ বুদ্ধিতে করে ফেলেছে। কিন্তু প্রতিফলে যা হয়েছে তা আজ সাহিত্যের দরবারে প্রায় সর্বজনের নজর কেড়েছে। ছড়িয়ে গেছে সেই কুকীর্তি এপার বাংলা থেকে ওপার বাংলাতেও।ঘৃণায় আজ অনেকেই তার দিকে বাঁকা দৃষ্টিতে দ্যাখে। চলন্তাবস্থায় আজও তাকে শুনতে হয়- “দ্যাখ কেমন লাগে——!” এমতাবস্থার মাঝেও ভুলের মাঝে ভুল—–।অনেকটা যেন মতিভ্রম। শত্রুর শত্রুকে আপন করে সমর্থন পাবার প্রত্যাশায় প্রকাশ্য পথের মাঝে সেই পাগলের পদধুলি মাথায় তোলার কথা প্রচার হওয়ায় হয়ে উঠল আরো নিন্দিত! আশেপাশে আলোড়িত এমন কুকর্মের সমালোচনায় তার পথ চলা হয়ে গেল দায়। পরের কুবুদ্ধিতে সুফল পাওয়ার প্রত্যাশায় আজ পেয়েই চলেছে নিন্দিত কুফল। তার কৃত কুকর্মের পরিপ্রেক্ষিতে অনেককেই বলতে শুনেছি -অকারনে কাউকে ব্যথা দিলে সে ব্যথা একদিন বুমেরাং হয়ে ফিরে আসবেই। আজ তেমনটাই অনেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। সম্পর্কের বনাবনিতে যখন হল অবনতি তখন আগের সুসময়কার উভয়ের মাঝে ম্যাসেন্জার ও হোয়াটসঅ্যাপে যে সমস্ত অত্যন্ত প্রয়োজনীয় জরুরী গোপন কথাবার্তা হয়েছে সেগুলি মাঝে মাঝে দেখেছি আর ব্যথা অনুভব করেছি। তখন ভেবেছি সেদিন আর এদিন——! মনের অজান্তে এক সময় সেই সব কথাবার্তার প্রতিলিপি প্রিন্ট করে স্মৃতি স্বরূপ সযত্নে আমার সংগ্রহে রেখেছি। এখনো মাঝে মাঝে সেগুলি বের করে দেখি আর ভাবি ——-। কিন্তু ভুলেও ক্ষোভে, দুঃখে কিংবা ব্যথায় কখনও তা সোশ্যাল মিডিয়ায় এখনও অবদি প্রকাশ করিনি।
এমতাবস্থায় তাদের কর্মফল অনুযায়ী যা হবার তা হতেই থাকলো। আমি কিন্তু ফেসবুককে মাধ্যম করে লিখেই চলেছি প্রতিনিয়ত।বন্ধু সংখ্যা বাড়তে বাড়তে আজ বন্ধু তালিকায় বন্ধুর সংখ্যা পাঁচ হাজার পূর্ণ হয়ে গেছে। স্বরচিত লেখায় বিভিন্ন পরিবার থেকে হাজার হাজার লেখনি সম্মাননা স্মারকপত্র প্রাপ্তির ডালিতে জমা হয়ে চলেছে। তাতে কেউ বা হয়েছে অত্যন্ত আনন্দিত আবার কেউবা হয়েছে ঈর্ষান্বিত। কারো বা হয়েছে ভীষণ গাত্রদাহ। হাতে গোনা কটা লোক মুখোশের অন্তরালে করেছে কত কটুক্তি–। চালিয়েছে অপপ্রচারে অমূলক ভিত্তিহীন যুক্তি। নিজের ঢোল নিজে পেটানো তথাকথিত অখ্যাত এক কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক তথা ‘ভন্ড ব্রহ্মচারী’ আবার কেউ কেউ বলে কুচক্রী সাহিত্যের কাঁকড়া–। তার মনগড়া অকল্পনীয় অশালীন মন্তব্যে হয়েছি স্তম্ভিত! তার থেকে প্রাপ্ত তীব্র সম্মান হানির আঘাতে আত্মহত্যার উদ্যোগ থেকে অলৌকিকভাবে উদ্ধার হয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে সময় লাগে বেশ কয়েকটা দিন। পারিনি তা কারো কাছে ব্যক্ত করতে। নীরবে নিভৃতে অবিরত করেছে মনকে ক্ষতবিক্ষত।অত্যন্ত হিতাকাঙ্খী আমার দুজন সুহৃদের হিতোপদেশে নিজের মনকে শক্ত করে ঘুরে দাঁড়ালাম। শুরু করলাম সেই ব্যথা প্রকাশ করা আমার লেখনীর মাধ্যমে আমারই ফেসবুকের টাইমলাইনে। ২০শে সেপ্টেম্বর ২০১৯ থেকে সেই অপ্রিয় সত্যকথা সম্বলিত লেখা প্রকাশ হতে থাকে। সেই থেকে এই অব্দি এই বিষয়ে প্রচুর লেখা আমার প্রোফাইলে এখনও বিদ্যমান। সেই সমস্ত লেখায় দেশ-বিদেশের অসংখ্য গ্রুপ থেকে পেয়েছি বিশেষ লেখনি সম্মাননা স্মারকপত্র। তাতে ওই প্রতিপক্ষের ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে জ্বলন মাত্রা। কিন্তু আমি চলেছি আমার স্থির লক্ষ্যে- “আমৃত্যু লিখেই আমি জানিয়ে যাব আমার বুকফাটা বেদনায় প্রতিবাদ !” অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয়- সেই সব দেখেও অনেক মিউচুয়াল ফ্রেন্ড করেছে পক্ষপাতে দ্বিচারিতা। থেকেছে নূন্যতম কর্তব্যের কার্পণ্যতায় নীরব। তাই বারবার আহত হৃদয়ে প্রশ্ন জেগেছে ওরাও কি তবে সত্যিকারের নিরপেক্ষ কবি সাহিত্যিক? “ছাপের তলে জল ছাপ” দেখে দেখে ক্রমাগত বেড়েই চলেছে আক্রান্ত হৃদয়ে স্মৃতির দহন! তাই আজও মাথা উঁচু করেই সগর্বে বলে চলেছি – অনুতাপে একদিন ওদের হবেই অনুধাবন——!!
—oooXXooo—
“সবুজ স্বপ্ন ” ওয়েব ম্যাগাজিনে “স্মৃতির দহন” প্রকাশ করার জন্য সম্পাদক মহাশয়কে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ। পত্রিকার উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি কামনা করি
আমাদের পত্রিকার পক্ষ থেকে অসংখ্য ধন্যবাদ 🙏🙏