আজ রংপো’র এক প্রাচীন কালী মন্দিরে এসে উঠলাম। ভাঙাচোরা পাথরের মন্দির। মন্দিরের সামনে খানিকটা প্রশস্ত ফাঁকা জায়গা, যার মধ্য স্থলে একটা হাড়িকাঠ আছে। দু-চারজন ভক্তের সহায়তায় এক বৃদ্ধ পুরহিত পূজায় রত। পূজা পাট শেষে সকলে মিলিত ভাবে আমাকে স্বাদরে অভ্যর্থনা জানালেন। আমি দুই দিনের অতিথি হতে চাই শুনে সমস্বরে সকলে বলে উঠলেন যে, দুদিন কেন আমি আমৃত্যু থাকলেও তাদের কোনো আপত্তি নেই।
শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে। দুইদিন ধরে ক্ষেপে ক্ষেপে বৃষ্টি হয়ে চলেছে। তবে নাথুলাপাসের ঠাণ্ডার সিকি ভাগও এখানে নেই। কোনো গাছ তলায় দু’টো রাত কাটিয়ে দিতে পারতাম। সম্ভব হলনা বৃষ্টির জন্যে। ফলে মা কালীর চরণে ঠাঁই পাওয়ার সুযোগ হল। রাতে স্বল্পাহারের ব্যবস্থা মন্দিরের ভক্তরাই করে দিলেন। খাওয়ার রুচি নেই, ভক্তদের ইচ্ছে রক্ষার্থে সামান্য মুখে দিলাম। মনে হচ্ছে জ্বর আসছে। সারাদিনের ক্লান্তি, কিন্তু ঘুম আসছে না। ভক্তরা চলে গেলে শুনশান মন্দিরে একা আমি আগামী দুই দিনের একটা কর্ম পরিকল্পনা করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা।
ঘুম ভাঙল ‘জয় মা কালী ধ্বনিতে। চোখ মেলতেই যা দেখলাম তা নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছি না। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায়ও আমি গলগল করে ঘামতে লাগলাম, আমি কি সত্যি কিছু দেখছি না সব চোখের ভুল!
হাড়িকাঠের চারদিকে অর্ধ চন্দ্রাকারে দাঁড়িয়ে আছে গোটা দশেক ষণ্ডামার্কা লোক। হাতে বর্শা, কপালে সিঁদুরের তিলক, মশালের আলোতে মনে হচ্ছে যেন সাক্ষাৎ যমদূত। কালী মূর্তির সামনে রুপোলী রঙের এক পেল্লাই খাঁড়া হাতে দাঁড়িয়ে এক তান্ত্রিক। হাড়িকাঠের পাশে ষণ্ডামার্কা দুটো লোক এক অর্ধনগ্না গৌর বর্ণা ষোড়শীকে ধরে জোর করে হাড়িকাঠে মাথা গলানোর চেষ্টা করছে, এবং
ষোড়শী বাঁচবার জন্য মরিয়া চিৎকার করে যাচ্ছে। সেই চিৎকারের ধ্বনিকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে ‘জয় মা কালী’ ধ্বনিতে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমি, চাক্ষুষ করে চলেছি। একা আমি, ওরা অতজন শক্তিশালী মানুষ, কি করব বুঝতে পারছি না, আবার চুপ করে এমন মর্মান্তিক ঘটনা চাক্ষুষ করতেও পারছিনা।
পাষণ্ড দুটো বলপূর্বক ষোড়শীকে হাড়িকাঠে মাথা ঢুকিয়ে দিল এবং তান্ত্রিক গোছের লোকটি হাতের খাঁড়াতে প্রণাম করে জয় মা কালী ধ্বনিতে ষোড়শীর মুণ্ডচ্ছেদ করতে উদ্যোত হল। আমার ষষ্ট ইন্দ্রিয় কখন যে প্রকট হয়ে গেছে আমি বুঝিনি। ‘এটা হতে পারেনা’ বলে এক লাফে আমি হাড়ি কাঠের সামনে চলে আসি। কিন্তু কোথায় কি!! আলো আঁধারি শুনশান মন্দির চত্তর, টিপটিপ করে মা কালীর সামনে একটা প্রদীপ জ্বলছে, সেই আলোতে মা কালীকে দেখে মনে হচ্ছে অগ্নি চক্ষুতে তিনি আমাকে দেখছেন, যেন আমি-ই সব পণ্ড করে দিলাম। আমি একা দাঁড়িয়ে শুনতে পাচ্ছি, কানের পাশ দিয়ে একটা পৈশাচিক সোঁ সোঁ শব্দে বাতাস বয়ে চলেছে। এখানে চিৎকার করে সাহায্য চাইলে শুধু নিজের স্বর প্রতিধ্বনিত হয়ে নিজের কানেই আঘাত করবে।
মিনিট খানিক মায়ের মূর্তির দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকলাম কেন এমন দৃশ্য দেখলাম! এখানে অতিতে সংগোপনে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা মা কি আমাকে জানাতে চাইছিলেন! নাকি অসুস্থ শরীরে যা দেখলাম সব চোখের ভুল! তাই বা কি করে হয়! আমি তো পরিষ্কার সব কিছুই দেখলাম। তবে কি দোঙ-জঙ-পা লামা আমাকে পরীক্ষা করছেন? আমি আমার সাধনায় সিদ্ধিলাভ করতে পারব কিনা! হয় তো হবে। পেতে রাখা কম্বলটায় এসে আবার মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম।
১৩/০৯/১৯৮৫
খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল। সময় নষ্ট না করে বেরিয়ে পড়লাম তিস্তা ও রঙ্গিত নদীর মিলন স্থলে।
সত্যিই চরম নির্জনতা বর্তমান। মোহনার কাছেই ছোট্ট একটা শ্মশান। অনতিদূরে একটা বসতি দেখা যাচ্ছে,তবে লোকজনের আনাগোনা তেমন নেই। তিস্তা নদীর প্রায় বুকের উপর একটা জঙ্গল দেখে আমার তার ভিতরে যেতে ইচ্ছা হল। ইচ্ছা নিবারণের উদ্দেশ্যে জঙ্গলে ঢুকে পড়লাম।
শান্ত প্রকৃতি, বৃষ্টি হচ্ছেনা। দুই একটা পাখির ডাক ছাড়া নিঃস্তব্ধতা বিরাজমান। এমন স্থানে ধ্যানে বসার লোভ সামলাতে পারলাম না। একটা পাথরে উপবিষ্ট হয়ে প্রথমে নিজের শরীরকে মন্ত্রবলে বেঁধে ফেল্লাম। তারপর ধ্যান মন্ত্রে নিজেকে শুদ্ধ করে আত্মস্থ করলাম।
সম্ভবত ঘণ্টা খানেক পর কিছু জংলী পশুর ডাকে আমার ধ্যান ভঙ্গ হল। চোখ মেলতেই দেখি আমাকে ঘিরে বৃত্তাকারে দুই পায়ে ভর দিয়ে বসে আছে বার চোদ্দটা নেকড়ে জাতীয় হিংস্র প্রাণী। যারা ক্রূর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ভাল করে চোখ মেলে তাকাতেই ধীরে-ধীরে সব কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেল। উঠে দাঁড়ালাম, মনে কয়েকটি প্রশ্ন জাগল– নেকড়ে গুলো সত্যি, না কি মায়া? গত কাল রাতের মতো লামা দোঙ-জঙ-পা আমাকে আবার পরীক্ষা করছেন না-তো? আর যদি সত্যিই হয় তবে জন্তুগুলো অনায়াসেই পার্শ্ববর্তী বসতিতে গিয়ে আক্রমন করতে পারে? কিন্তু সেটা তো মনে হচ্ছে না। তাহলে কি এখানে অশরীরী আত্মার অস্তিত্ব আছে? এটা কি তাদেরই মায়া বিস্তার? জানতে হবে!! যোগ ও তন্ত্রসাধনা বলে আমি অতিতে কতটা বিচরণ করতে শিখেছি এখনি তার পরীক্ষা করব।
পুনরায় পদ্মাশনে উপবিষ্ট হয়ে ধ্যানস্থ হলাম। আমার শরীর লঘু থেকে লঘুতম হয়ে উঠল। মন চলে গেল অতিতে, মুদিত চোখে দিনের আলোর মতো খণ্ড চিত্র ভেসে উঠল— তুষার ঝড়, জমাট বাঁধা বরফের ধস, গাড়ি খাদে পড়ে যাওয়া, ভূমিকম্প। এই বিপর্যয় গুলো ঘটে চলেছে এবং তাতে প্রচুর মানুষ মারা যাচ্ছে। আমি সামনে দাঁড়িয়ে যেন সব দেখতে পাচ্ছি। অতিতটা আমার চোখে বর্তমান হয়ে দেখা দিচ্ছে। বিপর্যয়ের স্থানে উত্থিত কালো কুণ্ডলীকৃত ধোঁয়া ভাসতে ভাসতে এই জঙ্গলে এসে মিলিয়ে যাচ্ছে। এরা’ই সেইসব মৃত মানুষের কিছু আত্মা, যারা মুক্তির জন্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এবং এই জঙ্গলে অবস্থান করছে!
ধ্যান ভঙ্গ হল একটা কোলাহলে। ভোরের নির্জনতা ততক্ষণে কেটে গেছে। জঙ্গল থেকে বেরিয়ে দেখতে পেলাম, শ্মশানে শব এসেছে, কোলাহল হচ্ছে সেইজন্য। প্রয়োজনের তাগিদে কাছাকাছি বসে শব দাহের প্রস্তুতি দেখছি এরই মধ্যে টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হল। নিতান্ত বাধ্য হয়েই কালী মন্দিরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম।
কালী মন্দিরে ঢুকতেই উপস্থিত বৃদ্ধ পুরহিত এবং কিছু ভক্ত আমার দিকে কেমন অবাক বিশ্বয়ে তাকিয়ে আছে। যেন তারা আমাকে দেখবে আশা করেনি। পূজারী এগিয়ে এসে আমাকে আমতাআমতা করে বললেন-” আমরা ভাবলাম আপনি চলে গেছেন!” আমি বললাম, নানা চলে যাব কেন, আমিতো আপনাদের কাছে দুই রাত থাকার অনুমতি চেয়েছি। ওনারা নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়া-চায়ি করে আমার কাছে জানতে চাইলেন যে আমি কখন মন্দির থেকে বেড়িয়েছি। আমি প্রত্যুষে জানাতে ওনারা আরও অবাক হলেন। আমি বিষয়টা অনুমান করে জানতে চাইলাম কোন সমস্যা!! পূজারী বললেন-” আপনি কাল রাতে মন্দিরে কিছু দেখেন-নি?” আমি আমার কথা না বলে তাদের অবাক হওয়ার কারন জানতে চাই। পূজারী কিছু একটা ভেবে বললেন-” আপনি সাধক মানুষ, আপনার কাছে গোপন করা মহা পাপ হবে। এই মন্দিরের একটা ইতিহাস আছে। যেটা সত্যি মিথ্যার মিশেলে কিংবদন্তি হয়ে আছে। আপনি যদি শুনতে চান তো বলব। আমি সম্মতি জানালে তিনি বলেন-” আসুন বসি, আপনাকে মন্দিরের ইতিহাসটা বলি।” পুরোহিত মন্দিরের এক ধারে আমাকে বসিয়ে শুরু করলেন সেই স্থানের ইতিহাস —
” অজ থেকে আনুমানিক দেড়শ বছর আগের ঘটনা। দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্শিয়াং, রংপো সহ এই বিরাট পার্বত্য অঞ্চল তখন ছিল সিকিমের অংশ। চোগিয়াল ( Chogyal) রাজ পরিবার এই সব পার্বত্য অঞ্চল শাসন করত। ১৮৩৫ খ্রীস্টাব্দে এই সব পার্বত্য অঞ্চল সিকিম থেকে বৃটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে যায়। সেই সময়ে এই হিন্দু কালী মন্দিরটি তৈরি। সেই হিসাবে মন্দিরের বয়স আনুমানিক দেড়শ বছরের কাছাকাছি। ভৈরব তান্ত্রিক এই কালী মন্দিরের পত্তন করেন বলেই জনশ্রুতি আছে। লোকে জানত ভৈরব তান্ত্রিক একজন বড়ো তন্ত্রসাধক ছিলেন। আসলে তিনি তন্ত্রসাধনার আড়ালে ছিলেন দুর্ধর্ষ ডাকাত। যাইহোক সেকালে মানুষের যে কোনো সমস্যায় এই ভৈরব তান্ত্রিকের কাছে আসত, এবং অনেকে ফল-ও পেত বলে শোনা যায়। যদিও সেটা মানুষের বিশ্বাস। ওর বারোজন শিষ্য ছিল, আসলে তারা ছিল ভৈরবের সাগরেদ। দিনে ভিক্ষার আছিলায় চারদিকে বেরিয়ে পড়ত খোঁজ খবর আনতে। ভৈরব তান্ত্রিক বহু নিরিহ মানুষ মেরে সর্বস্ব লুঠ করে লাশগুলোকে তিস্তার জলে ভাসিয়ে দিত। কথিত আছে প্রতি বছর কৌষিকী অমাবস্যায় ভৈরব তান্ত্রিক মায়ের সামনে একটা করে নরবলি দিত। এইভাবে মানুষের চোখে ঠুলি পরিয়ে তার লুন্ঠনকর্ম চলত।
চোগিয়াল (Chogyal) রাজার জায়গিরদার ধর্মাধরের প্রাসাদ ছিল কালী মন্দির থেকে এক ক্রোশ দূরে। মানুষটি ছিলেন যেমন রাশভারি তেমনি অত্যাচারী। তাঁর ছিল একটি মাত্র কন্যা, নাম ভানুমতী। অমন রূপবতী কন্যা দেশে মেলা ভার। ভানুমতীর বয়স যখন ষোলো বছর পূর্ণ হল, ধর্মাধর বংশ কৌলিন্য রক্ষার্থে ভানুমতীকে পাত্রস্থ করবেন বলে মনঃস্থ করলেন। যথারিতি চোগিয়াল রাজবংশের এক যুবরাজের সাথে বিবাহ স্থির হল। এদিকে ভানুমতী ততক্ষণে প্রাসাদের এক যুবক কর্মচারী উদয়রাজকে মনদিয়ে বসে আছে। কথায় বলে দেওয়ালেরও কান আছে। সেই মুতাবেক পাঁচ কান হতে সময় লাগল না। শেষ পর্যন্ত খবরটা ধর্মাধরের কাছে পৌছে গেল। রাশভারি জায়গিরদার ধর্মাধর রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উদয়রাজকে বন্দী করে তিস্তা পারে এক বধ্যভূমিতে মুণ্ডচ্ছেদ করতে নিয়ে যান। এদিকে উদয়রাজের বাবা মা দুঃসংবাদটি শুনে ছুটে গিয়ে ধর্মাধরের পায়ে পড়ে একমাত্র ছেলের প্রাণ ভিক্ষা করেন, এবং কথা দেন চিরতরের জন্যে এই মুলুক ছেড়ে তারা অন্যত্র চলে যাবে। হয়েছিল ও তাই, কিন্তু নিয়তি যে কথা বলে।
ভানুমতী হল গৃহবন্দী। পরিচারিকাদের নজরে তার দিন কাটে। তাদের কাছ থেকেই সে জানতে পারে তার ভালো বাসার মানুষটির বর্তমান অবস্থা। ভানুমতী যখন জানতে পারে উদয়রাজ জীবিত, তখন তার সাথে দেখা করার বাসনায় ভানুমতী উদগ্রীব হয়ে ওঠে। এমতাবস্থায় এক পরিচারিকা তাকে ভৈরব তান্ত্রিকের ক্ষমতার কথা জানায়। তাঁর কাছে যেতে পারলে তিনি নিশ্চয়ই দুজনের সাক্ষাৎ এবং মিলনের একটা পথ বলে দেবেন।
কিছু উপঢৌকনের বিনিমযে ভানুমতী গোপনে সেই পরিচারিকার সহায়তায় গেল ভৈরব তান্ত্রিকের কাছে। তার কাছে আদ্যোপান্ত বর্ণনা করে উদয়রাজকে ফিরে পাবার বাসনা প্রকাশ করল। ভৈরব তান্ত্রিক সমস্ত ঘটনা শুনে একটু ধ্যানমগ্ন হয়ে বললেন -” আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, তোর ভালো বাসার মানুষ যে তোর আশায় দিন গুনছে। নেপাল সীমান্তে পাহাড়ী উপত্যকার একটা ছোট্ট গ্রামে আত্মগোপোন করে আছে। তবে, মিলন অবশ্যম্ভাবী কিন্তু বাধা প্রবল। ” ভানুমতী আবেগে বিহ্ববল হয়ে বলল যে সে সমস্ত বাধাই অতিক্রম করতে রাজি আছে। ভৈরব তান্ত্রিক ভানুমতীর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাকে এক সপ্তাহ পর একা এসে দেখা করতে বললেন।
ঠিক এক সপ্তাহ পর ভানুমতী গোপনে ভৈরব তান্ত্রিকের সাথে দেখা করলেন। ভৈরব তান্ত্রিক খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন, যে সে যেন কোনো চিন্তা না করে। উদয় রাজের সাথে তার মিলন ঘটাবেই। ভানুমতী আবেগে আপ্লূত হয়ে প্রণাম করতে গেলে ভৈরব তান্ত্রিক বলে -” সব ফিরে পাবি তবে তোকে দুটো কঠিন শর্ত পালন করতে হবে। সেকি তুই পরবি!!” ভানুমতীর সাত পাঁচ ভাববার সময় নেই। সে রাজি হয়ে শর্ত দুটো জানতে চাইল। ভৈরব তান্ত্রিক জানাল, শর্ত এক আগামী কৌষিকী অমাবস্যা পর্যন্ত তাকে খুব সাবধানে থাকতে হবে শরীরে যেন রক্তপাত জনিত কোনো আঘাত না লাগে। এবং দু-নম্বর শর্ত আগামী কৌষিকী অমাবস্যায় সারাদিন উপবাস থেকে কাউকে না জানিয়ে সন্ধ্যার পর মন্দিরে আসতে হবে। এখানে এসে স্নান করে সুদ্ধ শরীরে মায়ের সামনে নিজ হাতে হোম যজ্ঞ করতে হবে।
ভানুমতী সব কিছু বুঝে নিয়ে ঠিক সময় মতো আসার কথা দিয়ে ভৈরব তান্ত্রিকের কাছ থেকে বিদায় নেয়।
ভৈরব তান্ত্রিকের দশম নরবলি আগের কৌষিকী অমাবস্যাতেই সমাপন হয়ে গেছে। মা কালীর কাছে মানত করা একাদশ নরবলি দেওয়ার। সাঙ্গ হলে তবেই তার মনস্কামনা পূর্ণ হবে। সেবার তার একাদশ নরবলি সাঙ্গ হবে। এমন ষোড়শী না চাইতে পেয়ে যাবে ভৈরব সেটা কল্পনাও করতে পারেনি। তার ধারনা মা নিজের অর্ঘ্য নিজেই সংগ্রহ করে নিয়েছেন।
দিনক্ষণ মোতাবেক, ভানুমতী সারাদিন উপবাস থেকে সন্ধ্যার অন্ধকারে কাক পক্ষিকে না জানতে দিয়ে জঙ্গলাকীর্ণ পথ অতিক্রম করে ভৈরব তান্ত্রিকের এই মন্দিরে এসে উঠল।
ভৈরব ততক্ষণে পূজা পাঠের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে। মা’য়ের ইচ্ছে ছাড়া এমন সুযোগ আসেনা, সেই জন্য নিজেও এক মিনিট বিলম্ব করতে চায় না। দুজন সাগরেদর উপর দায়িত্ব দেয় ভানুমতীকে তিস্তা নদী থেকে স্নান করিয়ে এনে বলির জন্য প্রস্তুত করতে। সেই সাথে সকলকেই সতর্ক করে দেন ভানুমতীকে মায়ের কাছে উৎসর্গ করা হয়েছে। এই কথাটা যেন প্রত্যেকের মাথায় থাকে।
ভানুমতী স্নান সেরে আসলে ভৈরব তান্ত্রিক তাকে ভিজে শরীরে পূজা পাটে বসায়। পূজা পাটের নিয়ম কানুনে ভানুমতীর সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে। ঘন্টা খানিক পূজা পাটের পর দুই জন সাগরেদকে নির্দেশ দেন ভানুমতীকে বিবস্ত্র করতে। ভানুমতী তখন সম্পূর্ণ চক্রান্তটা বুঝতে পারে, এবং ভৈরবের কাজের প্রতিবাদ করে। ক্ষুদ্র শক্তি দিয়ে কি আর বৃহত্তর শক্তির মোকাবিলা করা যায? চিৎকার-ই একমাত্র ঢাল, ওই জনমানবহীন জঙ্গলে সে-ও যে বড় ঠুনকো। ‘জয় মা কালী’ উচ্চ স্বর অস্ত্রই ভানুমতীর করুন আর্তনাদকে দমিয়ে রাখল। ভৈরব তান্ত্রিক দেখল মা’কে উৎসর্গ করা ষোড়শীকে বলপ্রয়োগে পুরুষ হস্তে বিবস্ত্র করা ঠিক হবে না, মা তাতে রুষ্ট হতে পারেন। ফলে ভানুমতীর বাঁচবার সমস্ত রকম আকুতিকে নস্যাৎ করে কৌষিকী অমাবস্যার সন্ধিক্ষণে ভানুমতীকে অর্ধ নগ্না অবস্থায় মা কালীর সম্মুখে নিজ হস্তে বলি দিলেন।
এদিকে ততক্ষনে প্রসাদে ভানুমতীর অনুপস্থিতি সকলে টের পেয়ে যায়। সংবাদটা যখন ধর্মাধরের কানে যায়, তখন তিনি রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে চিংকার করে বলেন-” মেয়ে সহ চারজনকেই আমি শুলে চড়াব।” তাঁর ধারনা উদয় রাজ-ই তাঁর মেয়েকে ফুসলিয়ে নিয়ে গেছে।
এদিকে যে দুই পরিচারিকার নজরদারিতে ভানুমতী থাকত তাদের বেত্রাঘাতের নির্দেশ দিলে ধর্মাধর জানতে পারেন ভানুমতীর কোথায় যাওয়া আসা ছিল। তিনি তন্ত্রমন্ত্র কে স্বার্থ সিদ্ধির বুজরুকি মনে করতেন। কাল বিলম্ব না করে লোকলস্কর নিয়ে অতর্কিতে ভৈরব তান্ত্রিকের এই আখড়া ঘিরে ফেলেন। ওই সল্প সময়ের মধ্যে ভৈরব ভানুমতীর শরীরটা জঙ্গলের অন্ধকারে সরিয়ে ফেলে। এবং মস্তকটা মায়ের পায়ের সামনে রাখা ফুলের স্তুপের মধ্যে লুকিয়ে রাখে। ভাবখানা যেন তারা কিছুই জানেনা,আর জায়গিরদারের লোকেরা নিরীহ পূজারীদের উপর অকারনে অত্যাচার চালাচ্ছে। তল্লাশী ও জিজ্ঞাসাবাদ চলা কালিন একজন প্রহরী দেখতে পেল হাড়িকাঠের গোড়া দিয়ে টাটকা রক্ত গড়িয়ে যাচ্ছে। আর সন্দেহের অবকাশ রইল না। ধর্মাধর ভৈরব সহ বারোজন সাগরেদকে পিছমোড়া করে বেঁধে চাবুক মারার নির্দেশ দিলেন। ‘চিরকাল নিরিহ মানুষ ধরে অত্যাচার করেছ আজ সেই অত্যাচার নিজের কাছে ফিরলে দেখো কেমন লাগে। ‘ চাবুকের কয়েক ঘা পিঠে পড়তেই ভৈরব ধর্মাধরকে সমস্ত ঘটনা বলে প্রাণ ভিক্ষা চাইল।
তারপর জঙ্গলের ভিতর থেকে ভানুমতীর মুণ্ডহীন নিথর শরীরটা এনে চাতালে রাখা হল। এবং ঠাকুরের সামনে থাকা পুষ্প স্তুপের ভিতর থেকে মস্তক এনে যখন ধড়ের উপর রাখা হল, রাশভারি প্রশাসক ধর্মাধর তখন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না, শিশুর মতো হাউহাউ করে কেঁদে ফেললেন। সর্বোপরি তিনি তো একজন পিতা। তারপরই রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ভৈরব সহ বারো জনকেই এই হাড়িকাঠে নিজ হাতে বলি দেন।
সেই শেষ বলি, তারপর থেকে মায়ের পূজা হয়, চাল কুমড়ো ফল বলি দিয়ে, পশু-ও নয়। এত গেল মন্দিরের জন্ম লগ্নের ইতিহাস।
পরবর্তী কালে এখানে এক অলৌকিক ঘটনা কিছু মানুষের নজরে এসেছে। সেই দৃশ্য যারা চাক্ষুষ করেছে, হয় তারা পাগল হয়েছে বা জ্ঞান হারিয়েছে নয়তো হৃদ স্পন্দন বন্ধ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। ফলে এই মন্দিরে কেউ আর রাত্রি বাস করেনা। কিন্তু ঈশ্বরের কি অপার মহিমা কৌষিকী অমাবস্যা আসলেই অচেনা অজানা কেউ না কেউ এখানে রাত্রি যাপন করতে আসে, এবং কিছু একটা দুর্ঘটনা ঘটে। সত্যি বলতে কি আপনার ক্ষেত্রে সেটা ঘটেনি বলে স্বস্তি পেলাম, তবে সাবধানে থাকবেন সময় এখনো পার হয়নি।”
সম্পূর্ণ করুন কাহিনিটা শুনে ব্যথিত হলাম। যা শুনলাম আর গত রাতে যা দেখেছি তাতে আমার একটা সম্যক ধারণা তৈরি হয়ে গেছে। আমি যে ভৈরব তান্ত্রিক সহ বারোজন সাগরেদের আত্মার উপস্হিতির প্রমাণ পেয়েছি তা না জানিয়ে বললাম যে আমার কপালে কি আছে দেখা যাক।
বিকালের দিকে বসে বিগত কয়েক দিনের দিনলিপি ডায়েরিতে নথিভুক্ত করলাম। এদিকে কয়েক জন ভক্ত সহ পূজারী এসে সন্ধ্যার আগেই পূজাপাট সেরে চলে গেলেন। জঙ্গলে সন্ধ্যা নামতেই মনে হয় মধ্য রাত্রি আগত। শরীরটা অবার ম্যাজম্যাজ করছে, মনে হয় জ্বর আসছে। খেপেখেপে বৃষ্টি হয়ে চলেছে, হয়ত শরীরের উপর তার প্রভাব পড়ছে। সারাদিনের ক্লান্তি, আর নির্জনতার কারনে তন্দ্রা এসে গেছে। শরীরকে মন্ত্র বলে বেঁধে ফেললাম, যাতে তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় কোনো অপশক্তি আমাকে স্পর্শ করতে না পারে।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা, একটা পাশবিক শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। কম্বলের ভিতর থেকে বাইরে মুখ বার করে চাতালের দিকে তাকাতেই চমকে উঠলাম। দেখি,খানিকক্ষণ আগে বৃষ্টি হয়ে জাওয়া ভিজে চাতালটায় বারো তেরো টা নেকড়ে পায়চারী করছে। চাতালের মাঝখানে বসানো হাড়িকাঠের গোড়া শুঁকছে আর গরগর শব্দে চিৎকার করছে। মায়ের সামনে জ্বলা টিমটিমে প্রদীপের আলো আঁধারেতে অস্পষ্ট সেই টুকু দেখা যাচ্ছে। বাতাসের একটা পৈশাচিক সোঁ সোঁ আওয়াজ চারদিক মুখরিত করে রেখেছে। মা কালী, মন্দির থেকে যেন নেকড়ে জাতীয় হিংস্র প্রাণী গুলোর উপর অপলক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছেন। আর নেকড়ে গুলো যেন গন্ধ শুকে কিছু খোঁজার চেষ্টা করছে। পেলে হয়তো কয়েক মিনিটের মধ্যে আমাকেই ছিড়ে খেয়ে ফেলবে। এমনি একটা ভয়াল পৈশাচিক পরিবেশে কোনো সাধারন মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। এমতাবস্থায় আরো এক অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী হলাম– ছায়া মূর্তির মতো বড়ো যে নেকড়েটি, তার মস্তকটি মাঝে মাঝেই মানুষের মস্তকের রূপ ধারন করছে। সম্ভবত মুখমণ্ডল টি আগের রাতে দেখা তান্ত্রিকের মুখের মতো। এটা দেখার পর আমি অনুমান সাপেক্ষে কম্বল থেকে বেরিয়ে হিংস্র জন্তু গুলোর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বললম– তোরা ফিরে যা, আগামী কালই আমি তোদের মুক্তির ব্যবস্থা করবো।
আমার কথা শেষ করতেই, হিংস্র প্রাণী গুলো সবকটাই আকাশের দিকে মাথা তুলে একসাথে বিভৎস ভাবে ডেকে উঠল। সেই পৈশাচিক ডাক খুশির না হিংস্রতার তা বোঝা গেল না। তবে অবাক করে দিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে সব কটা নেকড়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। সেই সাথে পৈশাচিক পরিবেশটাও আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে উঠল। তারপর হঠাৎ একটা দমকা বাতাস এসে মায়ের সামনে জ্বলা প্রদীপটা নিভিয়ে দিয়ে জায়গাটা নিকষ কালো অন্ধকারে গ্রাসে আচ্ছন্ন করে ফেলল। তারপর মুশলধারায় বৃষ্টি নামল।
১৪/০৯/১৯৮৫
সকালে বৃদ্ধ পুরহিত জনা দুয়েক যজমানকে নিয়ে মন্দিরে এলেন, এবং আমাকে স্ব-শরীরে সুস্থ দেখে যৎপরোনাস্তি উৎফুল্ল হয়ে আমার কাছে জানতে চাইলেন, যে অলৌকিক ঘটনার জনশ্রুতি আছে তা কি সত্যি? আমি, সব সত্যি জানিয়ে বললাম -জায়গিরদার ধর্মাধর ভৈরব তান্ত্রিক সহ যে তেরো জন কে বলি দিয়েছিলেন ওরা তদেরই অতৃপ্ত আত্মা, মুক্তির জন্য আজ দেড়শো বছর ধরে তাদের অস্তিত্বের প্রমান দিয়ে যাচ্ছে যা চাক্ষুষ করে মানুষ ভয় পাচ্ছে।
ওনাদের ধারনা সমস্ত রকম অলৌকিক ঘটনার মোকাবিলা করে আমিই এখানে থাকতে পারবো। ফলে ওনারা আমাকে অনুরোধ করলেন। আমি যতদিন বাঁচব ততদিন যেন এই মন্দিরে থেকে যাই। থাকতে পারলে তো খুশিই হতাম, কিন্তু সেটা যে সম্ভব নয় তা জানিয়ে বললাম, তাঁরা যে অলৌকিক ঘটনার কথা ভেবে আমাকে থাকতে বলছেন সেটা যাতে আর না ঘটে আমি সেই চেষ্টা করব।
সারাদিন নির্জলা উপবাস করে গন অন্তেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে পূজা পাট হোম যজ্ঞ কর্মগুলো মন্দির থেকেই সেরে নিলাম, কারন আমার গায়ে প্রচন্ড জ্বর,আবার সারাদিন বিরামবিহীন বৃষ্টি হয়ে চলেছে। তেমন তো ভিজিনি, তবে এমন জ্বর আসার কারন বুঝলাম না। মনে হয় অবচেতনে গত দুই দিনের ঘটা ঘটনা গুলো আমার মন কে দুর্বল করে দিয়েছে। অমার এই মুহূর্তে এ-ও মনে হচ্ছে মন্দিরে আমি একা নেই। আমি তিস্তা পারের মোহনায় যাব বলে লক্ষ লক্ষ আত্মা চাতক পাখির মতো আপেক্ষা করছে। যাইহোক কার্যোদ্ধার আমাকে এই কৌষিকী অমাবস্যার রাতে করতেই হবে। তিমি যেমন অনন্ত জলরাশীতে ভয় পায় না, আমিও তেমনি চিত্ত দৌর্বল্য ত্যাগ করে সন্ধ্যার পর শ্মশানের উদ্দেশ্যে কালী মন্দির ছাড়লাম।
(পরের অংশ পঞ্চম পর্বে…)