জুতো জোড়া হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলো সুবল। সোলটাতে আর কিছু নেই। তাপ্পি মারতে মারতে শেষ অবস্হায় এসে গেছে। বেচারী তাপ্পির ভারও আর বইতে পারছে না। নাঃ। এবার জুতোটা না বদলালেই নয়। কিন্তু …… কী করে…….. ” কী এত ভাবছো বল তো জুতো হাতে নিয়ে? দুর্গার ডাকে চমকে চোখ তোলে সুবল। ” বলি কী এত ভাবছো? কেনো কেনো একজোড়া জুতো এবার কেনো। পুরুষ মানুষ বাইরে বেরোতি হয় ।ওতে আর চলে না কী?” ধাঁ করে অকারনে খিঁচিয়ে ওঠে সুবল। যেমন ওর স্বভাব। ” এঃ! কেনো কেনো! টাকা কী তোর বাপ দেবে?” প্রথমটা থতমত খেয়ে যায় দুর্গা।এই কথাতেও এমন ঝাঁজ আশা করেনি। পরক্ষনেই চিল চীৎকার করে ওঠে ও। ” কেনে? আমার বাপ দিবে কেনে? উনি জুতো পরবে আর আমার বাপ টাকা দিবে! ইল্লি! শখ কত! “ “তাইলে চুপ মেরে থাক”, আবার ধমক দেয় সুবল। ” কেনে? চুপ করব কেনে?কাল যে অতগুলো টাকা পেলে উড়িয়ে এলে বুঝি? ওই শুঁড়ি ফটকের দোকানে?” “দুগ্গা! আর একটা কথা কইলে থাবড়া খাবি । কাজে বেরোবার সময় মাতা গরম করবি না” থাবড়ার ভয়ে চুপ করবে এ বদনাম দুর্গার কোনকালেই ছিলো না। কিন্তু তবু ও সুবলের চিন্তিত ,ঝাঁজালো মুখের দিকে চেয়ে থমকে গেল ও। উনুনে তরকারি চাপিয়ে এসেছে সেটাও স্মরনে এলো। একই সঙ্গে অনেকদিন পরে একটা অভিমান বুক ঠেলে উঠল ওর! নিঃশব্দে রান্নার ছোট্ট দাওয়াটায় ফিরে গিয়ে তরকারিতে হাতা ডোবায় । কী এমন কথা এটা! এর জন্য এত ধমক! জুতোটা না কিনলে চলে আর! টাকা ক’টা হাতে এসেছে বলেই তো বলা! নইলে মাসের মাঝমধ্যিখানে জুতো কিনতে বলবে দুর্গাকে কী ভুতে পেয়েছে? সংসার কী করে চলছে জানেনা ও! ভালো কথার যুগ নেই। করুক যা খুশী! আর দেখতেও যাবে না, বলতেও যাবে না। করবে আর কী! এককাঁড়ি ইয়ার বন্ধু নিয়ে ওই চোলাইতেই ওড়াবে। গায়ে যেন বিচুটির জ্বালা ধরে। গজগজ করতে করতে আসন পেতে জল গড়িয়ে ভাত বেড়ে দিয়ে ছেলেকে দিয়ে ডাক করায় সুবলকে। ডাকার অবশ্য কোন দরকার ছিল না। স্নান করে এদিকেই আসছিলো সুবল। ভাত বাড়া দেখে গম্ভীর মুখে খেতে বসে যায়। টাকার ইতিহাসটা এইরকম। মোটামুটি একটা প্লাস্টিকের কারখানায় কাজ করে সুবল। মাইনে যা পায় ডাঁয়ে আনতে বাঁয়ে কুলোয় না। তবু তারই মধ্যে চলে একরকম। দু এক বাড়ি কাজের কথা বলে ধমক খেয়েছে দুর্গা। বউ লোকের বাড়ী কাজ করবে এ তার সম্মানে লাগে। বউ মানুষ ঘরে থাকবো। পুরুষ মানুষ খেটে রোজকার করবে। সেইরকমই চলছিলো। গত পরশু কারখানায় পৌঁছে সবে মেশিনে হাত লাগিয়েছে ম্যানেজার সাহেব এসে হাজির।একগাদা কাজের ফিরিস্তি দিয়ে চলে যাবার সময় কী করে প্যান্টের পকেট থেকে মানিব্যাগটি পড়ে গেছে তা সুবলও বলতে পারবে না। ম্যানেজারবাবু তো নয়ই। দিনের শেষে ঘেমে নেয়ে নিজের জামা নিতে গিয়ে মেশিনের খাঁজের মধ্যে মানিব্যাগটা খুঁজে পায়.সুবল। অমন দামী ব্যাগ আর যে কারুর হতে পারে না তা বুঝতে সময় লাগে নি ।তাই ব্যাগ হাতে সোজা ম্যানেজারের টেবিলে। বৃত্তান্ত শোনা মাত্রই সাহেবের হাত নিজের প্যান্টের পকেটে আর পরক্ষনেই চোখ সুবলের হাতে। ব্যাগটা হাতে দিয়ে ছোট্ট একটা নমস্কার করে চলেই আসছিলো সুবল ডেকে ফেরালেন উনি ই। অবাক চোখে দেখল সুবল তিনটে একশো টাকার নোট বাড়িয়ে ধরেছেন উনি। না। নিতে চায়নি সুবল। উনি ই জোর করে জামার পকেটে গুঁজে দিলেন। মাসের মাঝখানে তিনশো টি টাকা নেহাৎ কম নয়। সংসারে অভাব তো হাঁ করে আছে। যেদিকে তাকাও কেবল ফুটো। বসে বসে জুতো মেরামত না কী সংসারের ফুটো মেরামত সেটাই যে ভাবছিলো মানুষটা তা বুঝতে বাকী নেই দুর্গার। মাঝখান থেকে কোথাও কিছু নেই খামোখা ঝগড়া লেগে গেল। মুখ বেজার করে ছেঁড়া জুতোতেই পা গলিয়ে বেরিয়ে গেল লোকটা। কলতলায় এক বালতি জামাকাপড় নিয়ে কাচতে বসে সেদিকেই চেয়ে বুকে মোচড় পড়ে দুর্গার। এত মেজাজ মানুষটার! রাগ যেন অষ্টপ্রহর মাথায় চড়ে বসে আছে। প্রথম দিন থেকে একই রয়ে গেল।বিয়ের পর থেকে দুটো মিষ্টি কথা পর্যন্ত বলল না। একেবারে রসকসহীন পাথর যেন। না একটু সোহাগ না কিছু। কী পেয়েছে দুর্গা? চেয়েছেই বা কী? তবু তাই নিয়ে একটা কথাও কখনও বলেছে?একটা মাত্র ছেলে। না দিতে পারে তার হাতে একখানা ভালো বিস্কুট না পাতে এক টুকরো মাছ। সব তো মানিয়ে নেয় ও। তবু কেন মানুষটার মন পায় না কে জানে! কথায় কথায় মেজাজ! এত রুক্ষ কথা বাপের ঘরে কখনো শোনেনি । তার বাপ ও তো গরীব। কত ঠান্ডা! অভাব ছিলো ,অশান্তি ছিলো না।.দেখে দেখে এক কসাইয়ের হাতে.তুলে দিল বাপ। বিয়ের এত বছর পরে অভিমানে বুক ফুলে ফুলে ওঠে ওর।.নাই বা হোত বিয়ে। কী একেবারে সাতটা হাত পা বেরিয়েছে বিয়ে করে! “ওরে ও দুগ্গা ওই অত জোরে আছাড় মারছিস !/ওই পুরোনো জামা —ওর আর কিছু থাকবে?” মাতুখুড়ীর চীৎকারে সম্বিৎ ফেরে। ভেতরের অবরুদ্ধ রাগ ,অভিমান কখন যে হাতের কাপড়জামার ওপর পড়তে শুরু করেছে টের পায়নি ও। লজ্জায় জিভ কেটে তাড়াতাড়ি কলপাড় থেকে উঠে পড়ে।.কতক্ষন নিজের মনে বকছে কে জানে।সব কাজ পড়ে রইল।ছেলেকে ইস্কুলের ভাত দিতে হবে। সে ছোঁড়া আবার গেল কোথায়! এখন ইস্কুলে যাবার সময়! কাপড়জামা গুলো তারে মেলে দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকে আসে দুর্গা। অ. .মা! ছেলে তো ঘরেই! ওই তো বইয়ে মুখ গুঁজে । নাঃ। বর যেমন ই হোক। ছেলে দুর্গার একেবারে সোনার টুকরো। লেখাপড়ায় কত মন! দূর কী যে ছাইপাঁশ ভাবছিলো। মিছিমিছি সময় নষ্ট। সুবল তো ওরকমই। এ নিয়ে এত ভাবারই বা কী আছে! সব কী আর মনের মত হয়! হ্যাঁ । মাঝে মধ্যে একটু নেশাভাঙ করে বটে বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে পড়লে তবে সে তো কমই। পয়সা কড়ি নষ্টও করে না তেমন। সংসারের দিকে খুব মন। টাকাটা তবে কী করল? দুর্গার হাতেও তো দিল না। দূর থাক ওসব ভাবনা। জানতে ঠিকই পারবে। এখন ছেলেকে ভাত খাইয়ে ইস্কুলে পাঠাতে হবে। এই সময়টা ঝড়ের বেগে কাজ করে যায় ও। ছেলে ইস্কুলে গেলে বাসন মাজা,ঘর মোছা,চান সেরে ঠাকুরের সামনে দুটো ফুল ফেলে দিয়ে নিজের কাজটা নিয়ে বসে। মাসখানেক হল সুবলকে লুকিয়ে একটা কাজ ধরেছে ও। ধরালো মাতুখুড়ীই। শাড়ীতে পাড় বসানো। প্রতি শাড়ীতে পনেরো টাকা থাকে। এই প্রথম নিজের উপার্জন। বেশী আনতে সাহস করে না। ঘরে লুকিয়ে রাখবে কোথায়! দেখলে যদি অনর্থ করে মানুষটা। কাজে লাগছেও টাকাটা! ইস্কুলে মাইনে বই লাগেনা বটে কিন্তু কী যে সব হাতের কাজ করতে দেয় তাতেও খরচ কম নয়। সেগুলো কিনতে টাকা লাগে না! সুবলকে বললে কবে এনে দেবে ,কবে হাতে টাকা থাকবে! ছেলে শুকনো মুখে ঘোরে। মন ভালো লাগে না।.হপ্তায় দু তিনটে শাড়ী করে এই খরচগুলো এখন নিজেই চালায় দুর্গা। ইচ্ছা আছে সুবলকে সময় সূযোগ বুঝে নিজেই বলবে। মত দিলে আর একটু বেশী বেশী করতে পারবে। কে জানে সংসারের সুসার দেখলে মানুষটাও হয়ত একটু বদলাবে। নিঃশ্বাস তো নিতে পারবে সহজ করে। “দুগ্গা” ভয়ানক চমকে উঠে হাতে সূঁচ ফুটিয়ে ফেলে দুর্গা। এই সময় মানুষটা ফিরে এলো যে! “ঘরে দোর দিয়ে কী করছিস? খোল। “ কোনরকমে শাড়ীটা মশারির ভাঁজে চালান করে ধড়ফড় করতে করতে গিয়ে দরজা খোলে দুর্গা। “তুমি কারখানায় যাওনি?” “যাব। একবেলা ছুটি করেছি। ” ওকে একরকম ঠেলেই ঘরের ভেতর ঢুকে আসে সুবল। আর তখনই চোখ পড়ে দুর্গার।জুতোর ছবিআঁকা প্লাস্টিকের প্যাকেটখানা। ও। জুতো কিনেছে তবে। তাও ভালো কথাখানা রেখেছে। স্খলিত আঁচল কাঁধে তুলে পিছু ফেরে ও। আর পরক্ষনেই ভারী একখানা হাত এসে পড়ে ওর পিঠে। “দ্যাখ তো কেমন হয়েছে?” প্যাকেট থেকে একখানা বাক্স বার করে সুবল। খুলতেই “ওমা! এ কী গো! এ যে হাওয়াই চপ্পল! জুতো কই?” সবিস্ময়ে তাকায় দুর্গা।. ততক্ষনে হাসতে হাসতে প্যাকেটের ভিতর থেকে আরো একখানা বাক্স বের করেছে সুবল। আর তার থেকে বেরিয়ে এল হালকা নীল একখানা হাওয়াই স্যান্ডেল। হাঁ করে চেয়ে আছে দুর্গা। সুবল হাসছে। এও তো চেয়ে দেখবার।. “তোর জন্যও একখানা হাওয়াই চপ্পল নিয়ে এলুম বুঝলি। তোরও তো পায়ে চটি নেই। সেপটিপিন লাগিয়ে পরিস।.এই বেশ ভালো হল না? দুশো টাকায় দুজনের হয়ে গেল। একশো টাকা রেখে দিলুম। বুঝলি। ছেলেটা কদ্দিন মাংস মাংস করছে । কাল একটু মাংস নিয়ে আসব। জমিয়ে রাঁধিস তো। কী হল রে! অমন হাঁদার মত চেয়ে আছিস কেন? চটি পছন্দ হয় নি বুঝি?” গলার কাছে দলা পাকানো একটা অব্যক্ত ব্যথা। বুকের মধ্যে টলমল করছে এক সমুদ্র জল। উথলোচ্ছে—–পাড় ভাঙছে । চোখের কোন শির শির করে বেরিয়ে আসতে চায় বুঝি। তবু চেয়ে আছে দুর্গা।.চেয়েই আছে। চোখ টান করে চেয়ে আছে ওর চোদ্দ বছরের পুরোনো স্বামীর দিকে। (সমাপ্ত)