হুইলচেয়ার
মৌসুমী ঘোষাল চৌধুরী
পূর্ব কোলকাতায় বেলেঘাটা অঞ্চলে নিয়োগীদের ভাঙাচোরা
তিনতলা বাড়ী । একটি পোষ না মানা টিয়াপাখি ,ছটফট করে ।
খাচাটাও জঙ পরা ।
ঐ বাড়ীর ছোটো সদস্যা ,সুদর্শনা নবনালন্দা স্কুলে পড়ে ।একদিন সুদর্শনার সহপাঠী রাহুল ওদের বাড়ী আসবে বলে
টেলিফোন করে । তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল ।সেদিন সকাল থেকেই আকাশ বেশ মেঘলা ।রাহুল ওদের বাড়ীর সামনে একটি পানের দোকান থেকে কয়েকটা ফাইভস্টার কিনে নিল ।কিন্তু
আশ্চর্য ভাবে পুরো রাস্তাটাই পাকা হওয়া সত্বেও ওদের বাড়ীর
সামনের গলিটা ভীষন সরু ,কাচা ও আবর্জনা যুক্ত । রাহুল দেখল ,সদর দরজাটা উন্মুক্ত ।ঢুকতে যাবে ,এমন সময় মনে হল
অদৃশ্য একটা ছায়ামূর্তি রাহুলকে সরিয়ে দিয়ে সিড়িতে মিলিয়ে গেল । সদর দরজার শুরুতেই ,অন্ধকার সিড়ি ।রাহুলের গলাটা
শুকিয়ে গেল । ক্ষীন স্বরে সুদর্শনাকে নাম ধরে ডেকে উঠল ।
সুদর্শনা এগিয়ে এসে বলল ,” আয়ে আয় ,ঘরে আয় “।
ওরা দোতলার ঘরে বসে গল্প করছে , এমন সময়ে সুদর্শনার মা
লুচি তরকারি নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল ।গল্প করতে করতে রাহুল বলে উঠল ,” জানো তো কাকিমা তোমাদের বাড়ী ঢুকতে যাব ,হঠাৎ ই ….” সুদর্শনা ও তার মা চোখাচুখি চাইল ।যেন কিছু লুকাতে চায় । একটু পরে সুদর্শনা তিনতলার ঘরে রাহুলকে
নিয়ে গেল । সেখানে ওর ঠাকুমা থাকে । প্যারালাইজড্ ।রাহুলের দুটো চোখ ছলছল করে উঠল । ঠাকুমা অসং লগ্ন
ভাঙা ভাঙা গলায় বলে উঠল , ” আমার নাত জামাই এসেছিস ।
তারপর বুকে হাত বুলিয়ে দিল ।
একটা হুইল চেয়ার এনে দিবি । আমি কতদিন আকাশটা দেখিনি । গলাটা কেমন শুকিয়ে যায় ।কুজোটার কাছে যেতে পারি না রে ।”
এরপর বহুদিন কেটে গেছে । রাহুল কর্পোরেট
সেক্টরে বড় চাকরি করে । একদিন বৃষ্টির সন্ধেয় রাহুল গড়িয়াহাট অঞ্চলে টাইটান শো রুমে গেছে । সুদর্শনা ও ঘড়ির ব্যান্ড চেঞ্জ করতে এসেছে ।অনেক রোগা হয়ে গেছে সুদর্শনা ।
বাবা মারা গেছেন ,সং সারের যাবতীয় দায়িত্ব পালন করতে হয় । চাটার্ড আকাউন্ডেসি পাশ করেছে ।
দুজন দুজনাকে পেয়ে ভীষন খুশি । রাহুল সুদর্শনাদের বাড়ী যেতে চাইল । এদিকে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে। সুদর্শনাদের বাড়ীতে ঢুকতে যাবে আবার সেই অদৃশ্য
ছায়ামূর্তি রাহুলকে যেন ধাক্কা মেরে আগে এগিয়ে গেল ।
সুদর্শনার মা ও যথেষ্ঠ অসুস্থ ।
পুরোনো অনেক গল্প করতে করতে ওরা ছাদে গেল । বৃষ্টি থেমে গেছে । রাহুল দেখল ছাদের এক কোনে একটা ভাঙা হুইলচেয়ার পরে রয়েছে ।রাহুলের মনে পড়ে গেল ঠাকুমার কথা । বুকের ভিতরটা কেদে উঠল ।
সেই রাতে সুদর্শনার ফ্ল্যাটেই রাহুল থেকে গেল ।
হঠাৎ মাঝরাতে মনে হল একটা হাত রাহুলের বুকে হাত বুলিয়ে
দিচ্ছে ।আচমকা ঘুম ভেঙে গেল রাহুলের । কারোকে কিছু না বলেই একা ছাদে উঠল । সামনেই দুর্গোপূজো ।শিউলি ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে । বৃষ্টি মাঝরাতেই থেমে গেছে । ছাদ প্রায় খটখটে । কিন্ত সারা ছাদে স্পষ্ট দেখতে পেল হুইল চেয়ারের দাগ ।কেউ যেন সারা রাত এই ছাদে হুইল চেয়ার নিয়ে ঘুরেছে ।
—ooXXoo—