হাড়োল
কাকলি ঘোষ
এই দুপুরের সময়টা সাধারণত কেউ আসে না। থানা ফাঁকাই থাকে। বাইরে কনস্টেবল রাম সিং চেয়ারে বসে ঝিমোয়। ভেতরেও কেউ কেউ টেবিলে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে যায়। আগে এই সময়টা ভেতর বাড়িতে গিয়ে ভাত খেয়ে গিন্নির পাশে শুয়ে এক ঘুম দিয়ে নিতেন এস. আই. অমিয় পাত্র। কিন্তু ইদানিং আর সেটা হয়ে উঠছে না। ওই নতুন ডি.এস. পি. ব্যাটা জ্বালাচ্ছে ভীষণ। কথা নেই বার্তা নেই থেকে থেকেই ভিজিলেন্সে চলে আসে। অল্প বয়সী ছোকরা। ডব্লিউ বি সি এস পাশ করে সরাসরি ঢুকেছে কাজে। নতুন তো । তাই জোশও বেশি। কখন কি কেস দিয়ে দেয় ? তাই একটু সাবধানেই চলতে হচ্ছে আজকাল। আজও খেয়ে দেয়ে এসে সবে নিজের জায়গাটিতে বসে একটা দাঁতে একটা কাঠি লাগিয়েছেন তখনই দেখলেন লোকটাকে।
ভয়ে ভয়ে যেন খুব সংকোচের সঙ্গে ভেতরে ঢুকছে । পরনে আধ ময়লা ট্রাউজার ,গায়ে রংচটা একটা হাফ শার্ট। এক গাল দাড়ি। কোটরে ঢোকা চোখ। মুখে স্পষ্ট অস্বস্তির ছাপ। সঙ্গে আবার বছর কুড়ি বাইশের একটা মেয়ে ! ভয়ার্ত চোখ মেলে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে লোকটা। কোনদিকে কার কাছে যেতে হবে বুঝতে পারছে না বোধহয়। চেয়ে রইলেন অমিয় পাত্র। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় স্পষ্ট বুঝে গেলেন জীবনে এই প্রথমবার থানার ভেতরে পা রেখেছে লোকটা। চোখে চোখ পড়তেই এক পা দু পা করে সামনে এগিয়ে এলো । নমস্কার করল দুহাত তুলে।
“ কি চাই ? “ হালকা করে একটু ঘাড় হেলিয়ে অভ্যস্ত ভঙ্গিতে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন অমিয় পাত্র।
“ আমার নাম নিতাই দাস স্যার। ওই বাজারের কাছে দীনবন্ধু স্টোরে কাজ করি। “
“ হুম। তো ? এখানে কি মনে করে ?”
“ আমি এসেছি স্যার ইয়ে মানে “ একটা ঢোক গিলে নেয় লোকটা। তারপর শেষ করে কথাটা “ একটা ডায়রি করতে স্যার “
“ ডায়রী ? অ। তা কি কেস ?”
কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে এবার ভালো করে তাকান এস.আই. অমিয় পাত্র। সেই চাউনির সামনে কেমন ঘাবড়ে যায় নিতাই। তারপর বিড়বিড় করে বলে,
“ স্যার কাল রাতে আমার মেয়েটাকে ওই মানকে গুন্ডা আর ওর দলবল তুলে নিয়ে গিয়ে —“
নিমেষে মাথা নিচু করে সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার দিকে চোখ ঘুরে যায ডিউটি অফিসারের। শ্যামলা রঙ। কিন্তু স্বাস্থ্যটি বেশ নজরধরা।দু গালে অশ্রুর ছাপ স্পষ্ট।
“ সেকি ! রাতে কখন ? কটার সময় ?”
“ দশটা নাগাদ স্যার। মেয়েটা ওই হারু ঘোষালের আমবাগান দিয়ে ফিরছিল। ওরা অনেকদিন থেকে ওকে বিরক্ত করে স্যার। বারণ করলে শোনে না। কাল — “
আর বলতে পারে না নিতাই। এক ঝলক কান্না এসে গলায় আটকে যায় ওর।
“ রাত দশটা অব্দি তোমার মেয়ে বাইরে কি করে ? “
“ ও তো পড়াতে যায় স্যার। তিন চারটে টিউশনি করে। নিজেও কলেজে পড়ে। আমার মেয়ে খুব ভালো স্যার।ও সেরকম মেয়ে নয়। “
“ হুম। তো ডায়রি করতে চাও ?” আপনি থেকে সরাসরি তুমিতে নেমে আসেন অমিয় পাত্র। “মানকের এগেনস্টে ? ওর পরিচয়টা জানো তো?“ “জানি স্যার। এম. এল. এ. হরিসাধনবাবুর পোষা গুন্ডা ও। হেন খারাপ কাজ নেই যা করে না। “
“ ব্যস ব্যস । যতটুকু দরকার ততটুকু বল। ডায়রি করবে ? বলি মেয়েটার যে বদনাম হবে সে খেয়াল আছে ? বিয়ে দিতে পারবে ? শুধু তাই নয়। বাঁচতে পারবে আর এখানে ? ”
মাথা নিচু করে নিতাই। দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে ওর চোখ দিয়ে।
“ ভালো কথা বলি শোন। চলে যাও। চেপে যাও। মানকের বিরুদ্ধে গিয়ে টিকতে পারবে না এই তল্লাটে ? ”
“ তার মানে আপনি মানকের এগেন্সটে ডায়রি নেবেন না ?”
মাথার ওপর বাজ পড়লেও বোধ হয় এতটা চমকাতেন না এস আই অমিয় পাত্র। বাপ নয় এবার মুখ খুলেছে মেয়ে।
“ ইয়ে — মানে আমি তো সেকথা বলিনি।“ কেমন একটু থতমতও খেয়ে যান যেন প্রথমটায়। তারপর সামলে নিয়ে বলেন ,” আমি বলছিলাম এই বুদ্ধিটা কে দিল ?
“ বুদ্ধিটা আমার। “
দু চোখে আগুন ছড়িয়ে আবার মুখ খোলে মেয়েটা। “ আমি বলেছি বাবাকে এখানে আসতে। কেন বলুন তো ? “
কয়েক মুহুর্ত চুপ করে থাকেন অমিয় পাত্র। তারপর পচাৎ করে একদলা থুতু ঘরের কোনার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে মুখ মচকে হাসেন।
“ অ । তুমি তো আবার কলেজে পড়া শিক্ষিত মেয়ে।তোমাকে তো কিছু বলারই নেই। তো কিসের ডায়েরি করবে ? রেপ না শ্লীলতাহানি? “
“ রেপ। “ অকম্পিত গলায় আওয়াজ ভেসে আসে। স্তম্ভিত হয়ে যান অমিয় পাত্র। এতদিনের চাকরি জীবনে বহু দেখেছেন এমন কেস। মেয়েরা তো এসব নিয়ে বলতে আসেই না। যদিও বা পুলিশ কি উকিল অথবা পরিবারের কারুর চাপে পড়ে আসতে বাধ্য হয় —- তো তাদের মুখ খোলাতে কাল ঘাম ছুটে যায়। আর এই মেয়ে _
“ ও। তো এসব কেসের ডায়রী করার নিয়ম কানুন জানা আছে কিছু ? সব বলতে হবে কিন্তু । সব মানে স —-ব। “ বলতে বলতে সামনে রাখা খাতাটা মেলে ধরেন সামনে।
“ বল । নাম কি ?
“ মালতী দাস। “
“ হুম। তো মালতী কবে ? কোথায় ? কখন ঘটনাটা ঘটেছিল ?
কতজন ছিল ?
একে একে রেপ করেছিল ? না একসাথে সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ?
কাপড় পুরো খুলে দিয়েছিল ?
ব্লাউজ ?
শরীরের কোথায় কোথায় হাত দিয়েছিল ? বল। বল। চুপ করে থাকলে হবেনা। “
দু চোখ তুলে তাকায় মালতী। এতক্ষণ যারা অন্য কাজে ব্যস্ত ছিল সকলের নজির এখন এদিকে। জোড়া জোড়া চকচকে চোখ। লোভে, বিকৃত কামনায় জ্বলজ্বল করছে । বাইরের মুখোশ খুলে বেরিয়ে এসেছে এক একটা হিংস্র শ্বাপদ। মাপছে ওর সর্বাঙ্গ। ক্লেদাক্ত , গলিত কামনা চুঁয়ে চুঁয়ে বেরিয়ে আসছে ওই চোখ মুখ দিয়ে। নারীর সব চাইতে অপমানের বিবৃতি শোনার জন্য কী ভীষণ উদগ্রীব ! কি বলবে ও ? কাদের বলবে? কিভাবে বলবে ?
রেপটা কি শুধু কালই হয়েছে ? আর আজ ? এখানে? এখন যেটা হচ্ছে ? সেটা —?
–~০০০XX০০০~–