আজ খেলা ভাঙ্গার খেলা
রেখায় : অরিত্র দাস
ও
লেখায় : সৌপর্ণ পাল
রাই আর শ্যামের প্রথম দেখা, না কোনো কুঞ্জবনে নয়, ওটা বড় প্রেডিক্টেবল। ওদের দেখা হল বি.টি. রোডের ধরে রবীন্দ্রভারতীর ক্যাম্পাসে। এমনি এক বসন্ত সমীরণে, লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইটের সমীকরণ মেনে প্রথম দর্শনেই একে অপরকে মনে ধরে। দুজনেরই মনে হয় ঐ মানুষটা বেশ অন্যরকম…সবার থেকে আলাদা। তারপর কখন যে ভালোবাসার চোরাস্রোতে একটু একটু করে তলিয়ে গেল ওরা… সাক্ষী রয়ে গেল ক্যাম্পাসের কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া গাছগুলো। ফুল ফুটুক বা না ফুটুক আজ যে বসন্ত।
পুরুলিয়া থেকে স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে আসে শ্যাম টুডু। শহুরের আদব কায়দায় অনভ্যস্ত শ্যাম যেন কষ্টি পাথরের গড়া কালো মানিক। সবার সাথে মিশতে পারে না কিংবা হয়তো ইচ্ছে করেই মিশতে চায় না। নিজের মতো করে নিজের মধ্যে বাঁচিয়ে রেখেছে গ্রাম্য সরলতা, ওটুকুই যে এই শহুরে জীবনে ওর একান্ত নিজস্ব। ক্লাসের সময়টুকুর বাইরে নিজের পড়াশোনা নিয়েই থাকে শ্যাম। আর অবসরে রাখালিয়া বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে বাজায় মন কেমনিয়া সুর। সেই সুর শুনে তন্ময় হয়ে যায় ধবধবে ফর্সা, পাকা গম রঙা রাইকিশোরী। উত্তর বঙ্গের রাজপরিবারের মেয়ে সে। আভিজাত্য থেকে বংশ মর্যাদায় রাই ছিল ইউনিভার্সিটির একমাত্র আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। ক্যাম্পাসের স্টাইল আইকন মানেই রাই। ওর জন্য কলেজ ক্যান্টিনে প্রায়শই মল্লযুদ্ধ লাগে। এমন মেয়ের যে এই গাঁইয়া ছেলেতে কি করে মন মজেছে সেটাই চরম বিস্ময়! এসব দেখে শুনে কেউ ব্যথিত হলো, কেউবা হল ঈর্ষান্বিত। কেউ বা আরো এক ধাপ এগিয়ে হাতের শিরা কাটতে গেল। আর ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা বললো ”ঔ দ্যাখ, এ’যুগের ওথেলো-ডেসডিমনা”।
রাই কিন্তু এক ফুঁতে উড়িয়ে দিয়েছিল সিডিউল ট্রাইব শুনে নাক সিঁটকানো বন্ধুগুলোকে। সে যে অরূপ রতন খুঁজে পেয়েছে, ওরা তার কি বুঝবে! এমন কষ্টিপাথর ছেড়ে দিলে আর সে পাবে না। সত্যিই সবার মুখে ঝামা ঘষে ফার্স্ট সেমিস্টারে ইউনিভার্সিটি টপার হলো শ্যাম। ব্যাস, কলেজ ক্যান্টিন থেকে পি.এন.পি.সি, সবার মুখে মুখে তখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ওরা… শুধু ওরা। দেখতে দেখতে একটি বছর যেন স্বপ্নের মতো কেটে গেল।
রীণা ব্রাউন আর কৃষ্ণেন্দুর মতো ওদের প্রেমের সুবাস সুদূর উত্তরবঙ্গে চলে গেল ফাইনাল পরীক্ষান্তে রাইয়ের বাড়ি ফেরার আগেই। হায় রে কালা একি জ্বালা… ইয়াগোর অভাব আছে নাকি বন্ধু মহলে!
রাই আর ফিরল না ইউনিভার্সিটিতে। পড়াশোনায় ছেদ পড়ল। সবাই বললো রাই নাকি তার বাবার বন্ধুপুত্রের বাগদত্তা। এই ফাল্গুনেই ঘোষাল পরিবারের পুত্রবধূ হয়েছে সে। তবে কোথায় বিয়ে হয়েছে সেটা কেউ ঠিক বলতে পারল না। সব কিছু নাকি তলে তলে ঠিক হয়েই ছিল, শুধু রাইয়ের বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় ছিল নাকি সবাই। রক্ষনশীল বনেদী শ্বশুড়বাড়িতে নববধূ দেখতে এসে পাড়াপড়শীরা একবাক্যে স্বীকার করল, ”অয়ন ঘোষালের ঘরণী সাক্ষাৎ রূপে লক্ষ্মী গুণে সরস্বতী”। শুধু রাই নিজের মনে মনেই জানল, বাবার কথায় লক্ষ্মী হতে গিয়ে চিরবিদায় দিতে হল সরস্বতীকে। আর কোনদিন ফেরা হবে না বি.টি. রোডের ধারে। বসন্তকুঞ্জে সবার মাঝে বড় একা হয়ে গেল শ্যাম। কে জানে এই আঘাত সে কাটিয়ে উঠতে পারবে কিনা! যা মুখচোরা ছেলে … হয়তো ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের এক কোণে বসে আপন মনে গাইছে,”তরী আমার হঠাৎ ডুবে যায়…” এসব মনে করলেই রাইয়ের দুচোখ ঝাপসা হয়ে আসে। পাটভাঙ্গা নতুন তাঁতের শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মোঝে সে।
অষ্টমঙ্গলায় ফিরলে, বাবা এসে বলল, “তোমার শ্বশুর মশাইয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে, তুমি চাইলে ডিসট্যান্স কোর্সে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করতে পারো, ওনাদের কোনো আপত্তি নেই। চুপ করে বসে থাকে রাই। মা এসে মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেন, ”মন খারাপ করিস না। চাইলেই যদি সব পাওয়া যেত তাহলে জীবনটা বড় ফ্যাকাসে হতো রে মা। আসতে আসতে দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।” ম্লান হাসিতে নিজের মনকে ঢাকা দেয় রাই। খুব ভালো করেই সে জানে, ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে বসে ওদের একসাথে বোনা স্বপ্নগুলো আর কোনোদিন সত্যি হবে না। কোনো কিছুই আর ঠিক হবার নয়। আর কোনদিন রাই আবীর ছড়িয়ে বসন্ত উৎসবে গাইতে পারবে না, “রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও যাও গো এবার যাবার আগে…”
সব ছেড়ে এবার শুকনো চোখে চিরকালের জন্য বাপের বাড়ি ত্যাগ করল রাই। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, তাকে ঘাড় থেকে নামানোই যখন পিতৃদায় , আর কোনোদিন এ বাড়িতে সে পা রাখবে না, কোনো অবস্থাতেই না। তবে একটাই মনোকষ্ট, শ্যাম হয়তো কখনো বুঝতে পারবে না ওর অসহায়তার কথা। চাইলেই তো সবাই প্রতিবাদ করতে পারে না। মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়াই এখন তার ভবিতব্য। সে কিন্তু কোনো ছলনা করেনি, মনপ্রাণ দিয়ে ভালো বেসেছে , তাই তো এখন সবার অলক্ষ্যে চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে সে।
ফোনের সিম বদলে গেছে। মেয়েদের যে কোনো অতীত থাকতে নেই। শুধু বর্তমানে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যতের রঙ্গীন স্বপ্ন। তবু যে চোখ ভিজে যায় এতো সুখের হাটেও ..…”তুই ফেলে এসেছিস কারে মন মন রে আমার…”
আজ তো হোলি। হ্যাঁ এই বাড়িতে দোলকে সবাই হোলি বলে। এতে রাইয়ের আপত্তি নেই। দোলের আগের দিন ন্যাড়াপোড়ার গল্পে ছোটো বেলায় ঠাকুমার কাছে হোলিকা দহনের কথা সে শুনেছে। তবু দোল আসলেই মন কেমন করে। এখানে অবশ্য দোল মানেই ধর্মীয় উৎসব। তার বাইরে ভাবার মতো মুক্ত আকাশ এখানে নেই। বড্ড মিস করে বসন্ত উৎসবের সেই ফেলে আসা দিনগুলো। শেষবার বৈকালিক অনুষ্ঠানে চিত্রাঙ্গদা, লিড রোল করেছিল রাই …
“আমি চিত্রাঙ্গদা, আমি রাজেন্দ্রনন্দিনী।
নহি দেবী, নহি সামান্যা নারী।
পূজা করি মোরে রাখিবে ঊর্ধ্বে সে নহি নহি,
হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে সে নহি নহি।
যদি পার্শ্বে রাখো মোরে সঙ্কটে সম্পদে,
সম্মতি দাও যদি কঠিন ব্রতে সহায় হতে
পাবে তবে তুমি চিনিতে মোরে…”
এখন মনে হয় এসব গতজন্মের কথা। এবাড়িতে সুখেই আছে সে, কোনো কষ্ট নেই। তবু কি যেন এক চিনচিনে ব্যথার চোরাস্রোত বয়ে চলে অহর্নিশ। “যদি জানতেম আমার কিসের ব্যথা তোমায় জানাতাম…”
আজ আরো একটা দোলপূর্ণিমা। ঘোষাল বাড়িতে রাধাকৃষাণজীর মহোৎসব চলছে। নতুনবৌমা রাইকিশোরীর কাঁধে আজ ভোগ রান্নার দায়িত্ব।
ব্রজধামও আজ রঙীন হবে। ছোটো বেলায় একবার মথুরা বৃন্দাবন গিয়েছিল রাই। সবাই যখন হোলির ফাগে রঙীন, ওখানে আশ্রিত বিধবারা সাদা থান কাপড়ে এক কোণে জড়সড় হয়ে আছে, ওরা যে এই রঙের উৎসবে ব্রাত্য। আজকে কেন যে এসব কথা মনে পড়ছে। সেই কবেকার কথা। কিছু স্মৃতি বোধহয় ভোলার নয়। মনের মণিকোঠায় তোলা থাকে সঙ্গোপনে। শ্যামের স্মৃতি যেমন আজো মুঝতে পারেনি অয়ন।
আজ সকাল থেকে ঘোষাল বাড়িতে সাজসাজ রব। দু একজন রিপোর্টার নিউজ কভার করে এই ঐতিহ্যবাহী রাস উৎসবের। ভোগ রান্না হয়ে গেছে। এখন শ্বশুর মশাইয়ের আব্দারে এ বাড়ির নতুন বৌমা বিগ্রহের সামনে গান গাইতে বসেছে। সেই ভক্তি রসধারা ছড়িয়ে পড়ছে নাটমন্দিরের প্রতিটি কোনায় কোনায়। সুরের মূর্ছনায় সবাই তখন মোহিত হয়ে গেছে।
হঠাৎ ঘোষাল বাড়িতে কর্কশ শব্দে ল্যান্ড লাইনে টেলিফোন বেজে উঠল। থানা থেকে এসেছে। অয়ন ঘোষালের রয়্যাল এনফিল্ড পিষে গেছে ট্রাকের তলায়। রং লাগার আগেই সব রং মুছে গেল ঘোষাল বাড়ির নববধূর জীবন থেকে। কান্নার রোল উঠল অন্দরমহলে। পড়শীরা কানাঘুষো করল, ‘কি অপয়া মেয়ে…রে বাবা!’ রাই কিশোরীর কানে আসেনি এসব কোনো কথাই। তখনো চোখ বুজিয়ে তন্ময় হয়ে গেয়ে চলছে,
“আমার সকল দুখের প্রদীপ জ্বেলে দিবস গেলে করব নিবেদন, আমার ব্যথার পূজা হয়নি সমাপন।”
পুনশ্চ: এরপর রাইয়ের কি হল, সে খবর আর কেউ রাখেনি, রাখার প্রয়োজন হয়নি। তাই তো মথুরাপতি গোকুল ছেড়ে চলে যাওয়ার পর , সবার নজর শ্যামের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে। তার কীর্তি ও যশস্বীতে বিভোর সবাই। কাজেই আমরাও জানি না রাইকিশোরীর অন্তিম পরিণতির কথা। কি দরকার এসব কথা জেনে? তাই না!!
–~০০০XX০০০~–