অভিসার
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
মন ভাল নেই সত্যেনবাবুর। আর সেটার কারণগুলোও আবার আপাতভাবে খুবই অদরকারি। বাজার থেকে ফেরার সময় দুম্ করে আঠাশটা টাকা পকেট থেকে কখন যে পড়ে গেল! তার ওপর রাস্তার ওপর পাথরে একটা হোঁচট খেয়ে পায়ের চটীটাও ফস্ করে ছিঁড়ে গেল। ডানপায়ে একটা পেরেক বা কাঁচের টুকরো ফুটেছে বোধহয়।তাই হাঁটতে গেলে একটু লাগছে।
এই বয়সে আসতে গিয়ে যে কত ব্যাথাই পেয়েছেন সেটা অবশ্য নিজে ভালো করেই জানেন আর তার কিছুটা জানে মঞ্জু!
বাজারের ব্যাগটা নামিয়ে বাড়ি এসে একটু বসলেন। আজ মনখারাপের সাথে সাথে একটু রাগও আস্তে আস্তে ঘনীভূত হচ্ছে। মঞ্জু ওঁর কাছে না এসে এখন রান্নাঘরে লুচি আর আলুচচ্চড়ি বানাচ্ছে। যদিও এই বয়সে এসে ওর ঋণটাকেই এখনো বুকের মধ্যে সযত্নে লালন করে আছেন।
রিটায়ারমেন্টের ঠিক পরেই করবী হঠাৎ চলে যাওয়ার পর নিজের সংসারে পরগাছা হয়ে গেছিলেন। দুটি সন্তানের জ্যেষ্ঠটি নিজেকে বেশ ভালো গুছিয়ে নিয়েছে। বৌ আর মেয়েকে নিয়ে তার ভরা সংসার। আর একজন যদিও ঠিকমত দাঁড়িয়ে ওঠেনি তার জন্য যেন নিজেকেই দোষারোপ করেন। বুবাইএর একটা ছোটমতন মণিহারী দোকান আছে স্টেশনের কাছে। সেটা যদিও খুব একটা যে চলেনা সেটা নিজেও বোঝেন। এখন দোকানটাকে বাড়াতে লাখ তিনেক লাগবে। সেটা এক্ষুণি দিতে গেলে সর্বস্ব সেভিংস ভাঙতে তো হবেই উল্টে ধারও করতে হবে। তাই নিজের ছোটছেলেটাকে এই টাকাটা না দিতে পারাটাই জ্বালা ধরায় বুকের মধ্যে থেকে থেকেই। সে ছেলেও আত্মমর্যাদার ব্যাপারে তার বাপের মতন। নিজে এসে যদিও কোনদিন তাঁর কাছে আর কিছুই চাইবেনা সেটা জানেন। আসলে মনটা ক্ষমতার সাথে সাথে যে ছোট হয়ে আসে এটাতো জানাই ছিল।
মঞ্জু ওঁর প্রথম যৌবনের আবেগের নাম। বেড়াচাঁপা হাইস্কুলের সেই দ্বাদশ শ্রেণীর সেদিনের ছাত্রীটিকে আর চাইলেও এতদিনে এসে আর কখনোই ভুলতে পারলেন না। উল্টে ওর কাছেই এই বয়সে এসে বেঁচে আছেন যদিও।
নদেরচাঁদ মেমোরিয়াল হসপিটালে তখন মৃত্যুর সাথে লড়ছিলেন। একটা বাস এ্যাকসিডেন্ট তখন ওঁর করবীর কাছে যাওয়াটাই হয়তো ভবিতব্য করে তুলেছিল। স্যালাইন আর ওষুধপত্রে তখন জেরবার অবস্থা। মঞ্জু তখন ছিল সেখানকার হেড নার্সের চাকরিতে। হঠাৎ করে আবার শেষবয়সে এসে এই দৈব যোগাযোগটার পর তার সেবাটুকুর সাথে ও নিজের আয়ুটুকুও কি তবে ওঁর জন্য মিশিয়ে দিয়েছিল? মনে হয় ওর সেই ক্ষমাসুন্দর আঙুলগুলো কেবল সহস্রদল পদ্মের মত ছড়িয়ে দিয়েছে মঞ্জু।
সারাজীবনের পর এসে এখন সব ভবিতব্যই তবে ওর কাছে জমা দিয়ে তিনি এখন যদিও নিশ্চিন্ত! আজ বলতে দ্বিধা নেই মধ্যবয়সিনী একা একজন অবিবাহিত রিটায়ার্ড নার্স শুধু লোকলজ্জ্বা আর বদনামকে পরোয়া না করে সত্যেনকে সেদিন নিজের কাছেই আশ্রয় দিয়েছিল ! ব্যাপারটা আসলে এতটা সোজা সেটা নয় মোটেও ! আসল কথাটা হল ওকে নিজে বরং আবার বাঁচতে ‘বাধ্য’ করেছিল মঞ্জুই নিজে।
আসলে এক একটা হাত এমন থাকে যেটাকে ধরতে ইচ্ছা হয় অবুঝপনায়।
না! তারপর সত্যেনবাবু আর ফিরে যাননি নিজের বাড়িতে। আপদ বিদায়ের পালা মিটেছে বলে ছেলে আর বৌমা প্রথম প্রথম এ বাড়িতে হঠাৎ করে মঞ্জুর অবর্তমানের ছুতোয় এসে দেখা টেখা করে যেত। তবে আজকাল ওরাও আর আসেনা।
সত্যেনবাবু নিজেই প্রতিমাসে একদিন করে এখনো যান। নিজের নাতনীটাকেই যা একটু দেখে চলে আসেন। ঐ বাড়িটা এখনো ওঁর নামে আছে বলে এখন তাই আর ওরা কথা বাড়িয়ে নিজেদের সময়ের অপচয় করেনা সেই অযথা পারিবারিক বিবাদে বা মানভঞ্জনে।
মঞ্জু কিন্তু দূর থেকে দেখেই বুঝে গেছে যে সত্যেনবাবুর পায়ে কিছু একটা হয়েছে। মানুষটা একটু খোঁড়াচ্ছিল বলে মনে হচ্ছিল যেন । একটু পরেই নিজে জলখাবার বানিয়ে থালায় সাজিয়ে এসে দাঁড়াল। সত্যেনবাবুর পায়ের কাছে তখনো একটু ফোলাভাব আর সাথে একটু রক্তের রেখা।
” ওমা, কি করে হল বলবে তো একবার এসে! ইসসস্”!
ওর এই স্পর্শটা আজীবনের জন্য পেতে বড় লোভ হয়। হ্যাঁ, এই বয়সেও এসেও ইচ্ছে হয়। এটাই তো একটা যত্নের আশ্রয় ! যার নামটা হল ভালবাসা।
কানে কানে শুধু একটা সুর এসে ধুয়ো দিয়ে গেল যেন। চেয়ারে বসে থাকতে থাকতে সত্যেনবাবুর বুকে হঠাৎ যেন ব্যথা করছে। সঙ্গে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। এ বয়সে এসে একটা অন্ধকার লম্বা পথ এবার বোধহয় একাই পাড়ি দিতে হবে। আর সেই যাত্রাটা নিঃসঙ্গ ও চেতনার বিপরীতেই। মঞ্জুকে কি ডাকবেন একবার? সে যে একমাত্র মানুষ সারাটা জীবন ধরেই দিয়েই গেল তাঁর সেই অমোঘের সাধনাকে। যদিও সেটা একরকম অপচয়ের সাধনাই….
মৃত্যু কি পরেও মঞ্জুর মত এরকম প্রিয় সান্নিধ্য আর কখনোই ফেরত আনতে পারবে? এটা একবার শুধু মনে এসে কোথায় যেন হারিয়ে গেল।
গানের কথা আর সুরটা আরো স্পষ্ট হতে হতে কানের কাছে এগিয়ে আসছে। ওটা সেই থেকে কে যেন গেয়ে যাচ্ছে সমানে তাঁর অবচেতনের মতন। কথাগুলো যদিও কানে আসছে ঠিকই আবার কখনো কখনো যেন বোঝা যাচ্ছেনা একদম। তাহলে কি করবীর গলার আওয়াজটায় কেউ ডাকছে একান্তে …না..না ঠিক তা তো নয় ! এখন এই গানটা শুনলে যেন মনে হচ্ছে সেটা মঞ্জুশ্রীর গলাই। হঠাৎ করে এসে সেকি তবে বলে যাচ্ছে সেই নিয়তির অমোঘ ভাষা !
” যার বাঁশরি-ধ্বনি শুনিয়ে
আমি ত্যজিলাম গেহ।
যারে সঁপিলাম
এই প্রাণ মন দেহ।“
এতোক্ষণের পর এবার সুর টুর আর নয়। বরং তাঁর দু-চোখে তন্দ্রার মতন একটা প্রবল ঘুমঘোর এসে আচ্ছন্ন করেছে তাঁকে ! তমিশ্রার সেই অন্তহীন পথের প্রান্তে আকূল করছে একটা তীব্র বিচ্ছেদবোধ যেন।
দ্বিধাহীন সেই নির্বান্ধব পথে এবারে বরং হোক তাঁর একলা চলার সেই অনন্ত অভিসার!
—oooXXooo—