পরিবারের যাবতীয় বর্জ্য যেমন – মুড়ির ঠোঙা, ডিটারজেন্টের খালি প্যাকেট, মাছের কাঁটা, সবজির খোসা ইত্যাদি জঞ্জাল ফেলার জন্য সব পাড়াতেই একটি কিংবা দুটি ভ্যাট বা সরকার নির্দিষ্ট একটা জায়গা থাকে। তবু বহুতল বাসিন্দাদের একটি অংশ উপর থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে অনায়াসে সবার অলক্ষ্যে জঞ্জালের প্যাকেট প্রায়শই রাস্তায় ছুড়ে ফেলে। এ নিয়ে অনেকসময় পথচারিদের সঙ্গে তাদের বাদানুবাদ সৃষ্টি হলেও তারা নিজের স্বভাবে থাকে অনড়।
বাড়ির খাটের নিচে একটা ধেড়ে ইঁদুর মরে পড়ে আছে। দুর্গন্ধ থেকে রেহাই পাবার জন্য সেই ইঁদুরের লেজে দড়ি বেঁধে চুপিসারে রাতের বেলায় পাশের বাড়ীর দরজার সামনে ফেলে আসা হলো। – কে ফেলেছে – কে ফেলেছে ? সাড়া নেই! স্বভাবতই সেই ইঁদুরের লাশ সরানোর দায় বর্তালো পাশের বাড়ির ঘাড়ে।
জনৈক ডাবওয়ালা সাইকেলে ডাব বিক্রি করে। খদ্দেরকে সে কাটারি দিয়ে ডাবের মুখ ছাড়িয়ে দিল। খদ্দের পয়সা দিয়ে চলে গেলে, ডাবওয়ালাও হাতে সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে হাঁকতে হাঁকতে এগিয়ে গেলো। ওখানেই পরে রইলো ডাবের খোলা আর তার কাটা অংশ।
রাস্তার ফুটপাত দখল করে অপ্রত্যাশিতভাবে তৈরি হয়েছে হোটেল কিংবা খাবারের দোকান। তাদেরই খাবারের পাতা এবং হোটেলের সেইসব এঁটো বাসন রাস্তাতেই তারা মনের আনন্দে ধুচ্ছে আর তাতেই ছড়িয়ে পড়ছে উচ্ছিষ্ট এবং তাজা বাসি খাবার।
এইরকম সহস্ত্র উদাহরণ আছে। এইভাবে প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে আমাদের নগর ও শহরের পথের পরিবেশ। এই আবর্জনা পরিষ্কার করার দায়িত্ব কার ? সবাই সরকারের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে নিজেদের দায়মুক্ত করতে চায়। প্রশ্ন – এভাবে কি সত্যিই নিজেদের দায়মুক্ত করা যায় ?
পরিবেশ দূষণ যে শুধু এখানে সীমাবদ্ধ থাকে, তা নয়। যে সিউয়েজ (ঢাকা নর্দমা) বা খোলা নর্দমাগুলো শুধু জল নিষ্কাশনের জন্যই নির্মাণ করা হয়েছে, তাতে দিনরাত ফেলা হচ্ছে কঠিন বর্জ্য। ধুলোবালি তো আছেই, তার সঙ্গে কাগজ, ছাই, ন্যাকড়া, বস্তি অঞ্চলে কচিকাঁচাদের মলমূত্র, আরো কত কি। এগুলি নর্দমায় কিছুদুর গিয়ে তলদেশে জমে যায় এবং পাঁকে রূপান্তরিত হয়। তারপর সৃষ্টি হয় মশা। তারপর ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, চিকুনগুনিয়া ইত্যাদি ইত্যাদি রোগ ব্যাধি…
নর্দমার জল নিষ্কাশনের পক্ষে সবচেয়ে বড় বাধা সৃষ্টি করে যে জিনিস, তা হল প্লাস্টিক, পলিথিন আর থার্মোকল। এগুলি তলদেশে জমা না হয়ে নর্দমার জলের সঙ্গে ভাসমান অবস্থায় চলতে থাকে। পথে কিংবা বাঁকে সামান্য বাধা পেলেই আটকে যায়। এমতাবস্থায় এরা নিজেরা তো যায়ই না, উল্টে প্রবহমান জঞ্জালগুলোর পথরোধ করে দেয়। খোলা নর্দমায় অনেক জায়গায় এগুলি বহুল পরিমাণে স্তূপাকৃতি হয়ে থাকতে দেখা যায়।
চিকিৎসালয় কিংবা হাসপাতালের বর্জ্যগুলির অবাঞ্ছিত অবস্থান যে কত মারাত্মক হতে পারে তা অনেকেরই জানা নেই। চিকিৎসার সিরিঞ্জ, ব্যবহার করা ব্যান্ডেজ কিংবা প্লাস্টার (যা অস্থির সংযোজনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য) ইত্যাদিতে অনেকসময় খোলা পথে অথবা মাঠে ময়দানে পড়ে থাকতে দেখা যায়। এগুলিতে মারাত্মক রোগের জীবাণু থেকে যায়, যা সুস্থ পরিবেশের এবং সুস্বাস্থের পক্ষে খুবই বিপজ্জনক।
পরিবেশ দূষণের সঙ্গে ইলেকট্রনিক বর্জ্যগুলির ভূমিকা উল্লেখ না করলে বক্তব্য অসম্পূর্ণই থেকে যায়। ইলেকট্রনিক বর্জ্যগুলি আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ মনে হলেও অনেক ইলেকট্রনিক্স দ্রব্য যেসব রাসায়নিক দিয়ে তৈরি হয়, তা মানবদেহের পক্ষে অতি মারাত্মক। এগুলি সম্পূর্ণ ধ্বংস না হলে তা থেকে বেশ তেজস্ক্রিয়তা (Rediation) নির্গমন হয়, যা লোকচক্ষুর অন্তরালে পরিবেশকে নিরবিচ্ছন্নভাবে দূষিত করতে থাকে।
মানুষ সমাজ সৃষ্টি করেছে নিরাপদ এবং সুস্থ থাকার জন্য। অথচ মানুষই অজ্ঞতার বশে এবং অবহেলায় পরিবেশ দূষণ করে ডেকে আনছে নিজেদের বিপদ। ডেকে আনছে ভয়ঙ্কর বিপর্যয়। তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিত পরিবেশ দূষণ যাতে না হয় সে বিষয়ে নিজে সচেতন থাকা এবং সমাজের সকলকে সচেতন করা। পরিবেশ দূষণ নির্মূল করার লক্ষ্যে আমাদের উচিত সমাজে একে অপরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অগ্রসর হওয়া।