ভূগর্ভস্থ জল প্রায় শেষ। এই বিষয়ে আজকের লেখাটি দয়া করে সম্পূর্ণ পড়বেন। “সবুজ স্বপ্ন” -এর সাথে যুক্ত হতে visit করুন – https://sabujswapna.org আমাদের Website-এ “জল সংকট” সম্পর্কিত একটি প্রশ্ন দেওয়া আছে। আমাদের Email-এ তার সঠিক উত্তর পাঠান এবং একাধিক ভাগ্যবান বিজেতারা পেয়ে যেতে পারেন একটি বিশেষ আকর্ষণীয় পুরস্কার। পুরস্কারের দিনটি Website-এ জানিয়ে দেওয়া হবে।
আমাদের পৃথিবীতে জলের কোন অভাব নেই। পৃথিবীতে আনুমানিক ৩২৬ মিলিয়ন ট্রিলিয়ন গ্যালন জল আছে। ৩২৬ -র পরে ১৮ টি শূন্য। এই বিপুল পরিমান জল পৃথিবীর বিভিন্ন সাগরে তরলাকারে, কিছু বরফ এবং কিছু বাতাসের জলীয় বাষ্প আকারে রয়েছে। কিন্তু এত জল থাকলেও, প্রধান সমস্যা হলো এই জলের ৯৭ শতাংশই লবণাক্ত। যা পান করার যোগ্য নয়। বাকি জলের ২% শতাংশ মিষ্টি জল বরফ আকারে জমে আছে এবং সমগ্র মানবজাতি টিকে আছে মাত্র ১% তরল মিষ্টি জলের উপর। এই জলও অতি দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে আমাদের অপচয়ের জন্য।
পৃথিবীর জল শেষ হয়ে যাচ্ছে মানে, ১০০ ভাগের ১ ভাগ মিষ্টি জল শেষ হয়ে যাচ্ছে। এই ১ ভাগ মিষ্টি জলের বেশিরভাগই রয়েছে মাটির নিচে। যা উত্তোলন করা সহজ নয়। তাই অতীতকাল থেকে মানুষ সেইসব অঞ্চলে বসতি গড়ে তুলেছে, যেখানে মাটির উপরে জল পাওয়া যায়। যেমন নদী বা হ্রদ। বর্তমানে পৃথিবীর ৯০% লোক এমন সব এলাকায় বাস করে, যার কমপক্ষে ১০ কিলোমিটারের মধ্যে মিষ্টি জলের ব্যবস্থা আছে। দিন-দিন পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। সেই সাথে বহুগুণে বাড়ছে মিষ্টি জলের চাহিদা। শুধুমাত্র গত ১০০ বছরে পৃথিবীতে জলের ব্যবহার বেড়েছে ৬১ গুণ। শহরাঞ্চলে বিপুল জলের চাহিদা মেটাতে তাই মাটির নিচ থেকে জল উত্তোলন করা হচ্ছে। মাটির নিচে যে জল থাকে তাকে বলা হয় (Aquifers) বা ভূগর্ভস্থ জলস্তর। মাটির নিচ থেকে ইচ্ছামতো জল তোলার অনেক ধরনের ক্ষতিকর দিক আছে। এর ফলে কোন অঞ্চলের মাটি ডেবে যেতে পারে। প্রচুর জল উত্তোলনের কারণে মেক্সিকো শহরের কোন কোন জায়গা প্রতিবছর ৯ ইঞ্চি করে ডেবে যাচ্ছে। ভারতের উত্তরাঞ্চলে মাত্র ১০ বছরের ২৯ ট্রিলিয়ন গ্যালন ভূগর্ভস্থ জলের মজুদ কমে গেছে। পৃথিবীর সকল অঞ্চলেই জলের অধিক ব্যবহারের কারণে আর কিছুদিনের মধ্যেই ভূগর্ভস্থ মিষ্টি জল শেষ হয়ে যাবে। সেই সাথে বৃষ্টি এবং তুষারপাতও কমে গেছে আশঙ্কাজনক হারে। এর ফলে বিশ্বের সকল অঞ্চলের নদী এবং হ্রদ শুকিয়ে যাচ্ছে। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে অনেক এলাকায় স্বাভাবিকের চেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলছে শুস্ক মৌসুম।
বর্তমানে পৃথিবীর প্রতি ১০ জনের ৭ জনের বাড়িতেই জলের লাইনের সংযোগ আছে। এত সহজে জল পাওয়ার ফলে আমরা ভুলেই গেছি ট্যাপকল ছেড়ে জল পাওয়ার জন্য মানব সমাজকে অপেক্ষা করতে হয়েছে হাজার হাজার বছর। অতীতের সকল সভ্যতা গড়ে উঠেছিল জলের উৎসকে কেন্দ্র করে। অতীতে এবং বর্তমানের বহু বসতি বিলীনও হয়ে গেছে শুধু জলের অভাবে। জলের জন্য বিভিন্ন অঞ্চলে ইতোমধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত তৈরি হয়েছে। সুদানের দারফুরে যুদ্ধের অন্যতম কারণ ছিল জল। সিরিয়ার গৃহ-যুদ্ধেও ২০০৬ সালের খরার অনেক প্রভাব ছিল। ধারণা করা হচ্ছে ২০৩০-৪০ সালের মধ্যে পৃথিবীর মানুষের চাহিদা পূরণের জন্য পর্যাপ্ত জল থাকবে না। বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকস ভবিষ্যত্বাণী করেছে, একবিংশ শতাব্দীতেই জল পেট্রোলিয়াম এর চেয়ে দামী হয়ে উঠবে। অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এখন থেকে বিপুল পরিমাণ জলের মজুদ করতে শুরু করেছে, ভবিষ্যতে অধিক দামে বিক্রি করার আশায়। পৃথিবীর বৃহত্তম শহরগুলোর মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে সবার আগে জল ফুরিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। ২০১৮ সালের ৯ই জুলাই-এর পর শহরটির বাড়িঘরগুলিতে চিরতরে জল সরবরাহ বন্ধ হবার কথা ছিল। জল ফুরিয়ে যাওয়ার এই দিনটিকে বলা হচ্ছিল Day ‘0’, বিষয়টি আলোচনায় আসে Day ‘0’ এর মাত্র ৯২ দিন আগে। এরপর থেকে কেপটাউনের প্রত্যেকেটি নাগরিকই সচেতনভাবে জল খরচ করেছে। ২০১৪ সাল থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে কেপটাউনের বাসিন্দারা তাদের জলের ব্যবহার অর্ধেকের বেশি কমিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। শুধু কেপটাউন নয় লন্ডন, টোকিও, ইস্তাম্বুল, মেলবোর্ন, সাওপাওলো, বার্সেলোনা, কলকাতা, ঢাকা, জাকার্তা, বেইজিং, মেক্সিকো শহরের মতো বহু শহরে অচিরেই জলের সংকট তীব্র হবে। এমনকি সকল শহরেই একদিন জল ফুরিয়ে যাবে। এখন দেখার বিষয় হচ্ছে কার জল আগে ফুরায়?
জলের সংকট যদি এখানেই শেষ হত তাতেও সমস্যা ছিল না। আসল সমস্যা হলো আমরা পৃথিবীর মাত্র ১ ভাগ জলের কিভাবে ব্যবহার করছি? মানুষের প্রতিদিন প্রায় ৪ লিটার জল পান করা উচিত। এছাড়া দাঁত মাজা, স্নান করা, হাত ধোয়া, খাবার রান্না করা, থালা-বাসন মাজায় জনপ্রতি আরও ৫০ লিটারের বেশি জল খরচ হয়। একবার টয়লেট ফ্লাশ করলে ৫ থেকে ৮ লিটার জল চলে যায়। পৃথিবীর মানুষের বাৎসরিক জলের ব্যবহারের মধ্যে দৈনন্দিন কাজে খরচ হয় মাত্র ৮ শতাংশ জল। বেশির ভাগ জল ব্যবহার হয় কৃষি এবং শিল্প কারখানায়। সেচ কাজ করতে পৃথিবীর ৭০ শতাংশ এবং শিল্প কারখানায় ২২ শতাংশ জল ব্যবহৃত হয়। বিভিন্ন দেশ ও তাদের সবচেয়ে শুষ্ক অঞ্চলেই এমন সব কৃষিপণ্য চাষ করে যেগুলোতে জলের চাহিদা অনেক বেশি। বিশ্বের বেশির ভাগ কৃষি জমিতেই সেচ করা হয় খুবই অদক্ষ উপায়ে। জলের লাইন চালু করে ক্ষেত জলে তলিয়ে দেওয়া হয়। জলের যদি আমরা মূল্য দিতে জানতাম তাহলে এভাবে জলের অপচয় করা হতো না। এবার তাকাই শিল্প কারখানার দিকে। মাত্র ৬০০ মিলি কোকাকোলা তৈরি করতে বিভিন্ন ধাপে ২৮ লিটার জল খরচ হয়। আর এর বোতল তৈরি করতে লাগে ৭ লিটার জল। ১ কাপ কফি তৈরি করতে জল লাগে ১৩০ লিটার। আপনি হয়তো ভাবতে পারেন ১ কাপ কফি বানাতে তো একটাই কাপ জল লাগে। কিন্তু না। সেই কফির জমিতে চাষ হওয়া থেকে শুরু করে ফেক্টরীতে প্রক্রিয়াজাত হওয়া পর্যন্ত হিসেব করলে পরিমাণটা এমনই দাঁড়ায়। একটি T-Shirt তৈরি করতে ২৫০০ লিটার জল খরচ হয় । এরকম ভাবে প্রতিটি শিল্পকারখানাতেই বিপুল পরিমাণ জলের ব্যবহার হয়। আমাদের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে শিল্পোৎপাদনও বেড়েই চলেছে। আমরা যেহেতু প্রয়োজনের তুলনায় অধিক ভোগ করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। তাই এর চরম মূল্য আমাদের দিতেই হবে।
চিন্তা করুন তো আপনার বাড়িতে যদি মাত্র একদিন জল না থাকে? জল যে কতটা মূল্যবান আমাদের তা উপলব্ধি করতে হবে এবং জল শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই এর পরিকল্পিত ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। আমরা অনেকেই হয়তো ভাবছি জল ফুরিয়ে গেলেও আমার কি ? আমি বেচে থাকতে শেষ হবেনা। সেই ধারণাও ভুল। বর্তমান পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক মানুষ তাদের জীবদ্দশায় জলের চরম সংকট দেখার সম্ভাবনা অনেক বেশি। আমরা জলের কষ্ট ভোগ না করলেও আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম নিশ্চিত জলের সংকট দেখবে। কয়েকদিন আগেই নীতিআয়োগ জানিয়েছে মাত্র ২ – ১ বছরের মধ্যে ভারতে ২১ টি বড় বড় শহরের ভূগর্ভস্থ জল একদম শেষ হয়ে যাচ্ছে। আপনি এই কথাটার বাস্তবতা কতটা কঠিন হতে পারে, হয়তো ভাবতেও পারছেন না। সময় হাতে একদম নেই। মাত্র ১ বছরে কত কিছু শেষ হতে দেখবেন চোখের সামনে। নিজেও পস্তাবেন এক বোতল জলের জন্য। আমরা অনেকেই জানতাম রাজস্থানে গরমকালে জল পাওয়া যায়না কিন্তু বেশ কয়েক বছর হলো মহারাষ্ঠ সে খাতায় নাম লিখিয়েছে, সেটা বোধহয় অনেকেই জানিনা। মহারাষ্টে এমন কিছু এলাকা আছে, যেখানে পানিও জল আনতে ট্রেনে করে চোদ্দ কিলোমিটার যেতে হয়। মানুষ কাতরাচ্ছে। এবছর নতুন করে সে খাতায় যোগ দিয়েছে চেন্নাই, বেঙ্গালুরু, দিল্লী, গুরুগাঁও সহ আরো কয়েকটি শহর। চারিদিকে একটু জলের জন্য হাহাকার চলছে, সোনার দামে বিকোচ্ছে জল। নোংড়া জলই খেয়েই মানুষকে থাকতে হচ্ছে। আগামী বছর বা আগামী কয়েক বছরের মধ্যে আমাদেরও একই হাল হবে। এখনও হয়তো সময় খুবই সামান্যই আছে – তাও বাঁচান, জল বাঁচান। সামান্য হলেও বাঁচান। শেষ দশ বছরেই আমরা ভুগর্বস্থ জলের ৬১ শতাংশ শেষ করে দিয়েছি। এভাবেই চলতে থাকলে বাকিটা শেষ করতে ২ বছরও সময় লাগবেনা। হয়তো আপনি ভাবছেন আপনার এলাকায় কিছু হবেনা, কিন্তু আপনি জানেননা যে কোনোদিন আপনার পাইপে কালো জল আসা শুরু করবে, তার 2 – ১ দিন পর থেকে জল আসাই বন্ধ হয়ে যাবে। নীতিআয়োগ বলছে ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে সংকটময় সময় এটা। আমরা জানতেও পারবোনা কখন একফোঁটা জলের জন্য পস্তাতে হবে।
অনেক দেশে মিষ্টিজলের চাহিদা পূরণ করার জন্য গত ১০ বছরে সমুদ্রের জল Desalination বা লবনমুক্ত করার প্রক্রিয়া দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু আমরা যে পরিমাণ জল ব্যবহার করি, তার ১ ভাগও এই প্রক্রিয়ায় উৎপাদন করা সম্ভব হয়নি। সমুদ্রের জল লবণমুক্ত করতে প্রচুর পরিমাণ জ্বালানি এবং অর্থ খরচ হয়। যা কিছুতেই প্রাকৃতিক মিষ্টিজলের বিকল্প হতে পারে না। আমাদের বাড়িতে আজকে জল আছে বলে আমরা এর মূল্য উপলব্ধি করতে পারছি না। অনেক বাড়িতে জলের ট্যাংক ভরার পরে জল উপচে পড়ে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ লিটার জল অপচয় হচ্ছে। শুধু ভারত বা বাংলাদেশে নয় পৃথিবীর সকল দেশেই জলের লাইনে অনেক lickage আছে। এইসব জলের যেন কোনো মূল্যই নেই।
আজকে থেকে আমরা প্রত্যেকে সকল কাজে আগে যে পরিমাণ জল ব্যবহার করতাম তার চেয়ে কম জল ব্যবহার করার চেষ্টা করবো। এর পরেরবার সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার সময় জলের ট্যাপকল ছেড়ে রাখবো না। হাত ভিজিয়ে ট্যাপকল বন্ধ করে সাবান মাখা শেষ হলে তারপর আবার জল ঢালবো। আমরা খুব ভালো করে জানি এক বালতি জল একটি ব্যাক্তির স্নানের জন্য যথেষ্ঠ, তাই অযথা সাওয়ারে দাঁড়িয়ে বাথরুমের জল অপচয় করবো না। কলের জলে পাইপের সাহায্যে নিজের শখের গাড়িটি ধোব না, প্রয়োজনে সুতির কাপড় ভিজিয়ে গাড়িটি মুছে নেব। সকালে ঘুম থেকে উঠে ঝপাঝপ রাস্তা ধোব না, সেটা নিজের বাড়ির সামনে হোক বা দোকানের সামনে এতে প্রচুর জল নষ্ট হয়। প্রয়োজনে ঝাড়ু বা মোছার জন্য সুতির কাপড় ব্যবহার করবো। ট্যাপকলের ছেড়ে রেখে জামা কাপড় কাঁচবো না, প্রয়োজনে বালতি ব্যবহার করবো। আমরা যতটা পারবো বৃষ্টির জল সংরক্ষণ অথবা জলাশয় বা পুকুরের জল ব্যবহার করবো। কারণ মাটির তলার জল একবার উঠে এলে আর ফেরানো যায়না।
আবারো হাত জোড় করে বলছি। পরবর্তী প্রজন্মকে বাঁচান, পৃথিবীকে আসন্ন ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচান। যেটা শুধুমাত্র আপনার সচেতনতাই একমাত্র হাতিয়ার। সর্বোপরি নিজেকে বাঁচান। জল বাঁচান, জীবন বাঁচান। জলের একটি ফোটা একটি প্রাণ।।
“সবুজ স্বপ্ন”-এর সাথে যুক্ত হতে visit করুন – https://sabujswapna.org
এই আশা রাখি যে, সবুজ স্বপ্নের পরিবেশ সংক্রান্ত বিভিন্ন কর্মসূচিতে আপনাদের সবাইকে পাশে পাবো। আসুন সবাই মিলে এই জনসচেতনতার আন্দোলনে সামিল হই নিজেদেরই বাঁচাতে।
Ranjit Chakraborty (প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক – সবুজ স্বপ্ন) Office – A/2, Subhasnagar Super Market, 2nd floor, Beside Dum Dum Cantonment Rly Station, Kolkata – 700065.