‘গল্পে গল্পে শেখা’
–:: সোমনাথ প্রামানিক ::–
এখন তো আর শিশু বয়সটা ঠাকুমা দাদুদের কাছে গল্প শুনে কাটানোর ভাগ্য হয়ে ওঠে না, কিন্তু আমাদের ছোট বেলাটা ঐ ভাগ্যের যথেষ্ট অধিকারী ছিল। তখন তো এখন কার মতন এতো বই আর কম্পিউটার গেম ছিল না তাই ছুটির দিন গুলো তো বটেই অন্য দিনে ও পড়াশোনার পর প্রায় রাত্রি বেলায় ৮টা/৯টার সময় বায়না করলে দাদু ঠাকুমারা এমনকি বাড়িতে বেড়াতে আসা আত্মীয়রা এক আধটা গল্প শোনাতো।
আমরা ছিলাম মফঃশলের মানুষ, বিদ্যূৎ তো তখন সন্ধাবেলায় প্রায় ই থাকত না আর সেই সুযোগ কে কাজে লাগিয়ে গল্প শোনার বহর তো ছিল বেশ! বাড়িতে আত্মীয়রা বেড়াতে আসলে তো আর কথায় নেই। তখন আষাঢ় শ্রাবন মাস হবে, একদিন আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল আমার এক দুঃসম্পের্কের মামা, আমরা তাকে ডাকতাম গোপাল মামা বলে। গোপাল মামা ছিল গল্পের রাজা, আর তার গল্পের মধ্যে যেমন থাকত মজা তেমন থাকত নিতীকথা। সেইজন্য তার কাছে গল্প শুনতে চাইলে বাড়ির অন্য বড়ো সদস্যরা তেমন একটা রাগ করত না। গোপাল মামা কে দেখে আমরা বাড়ির ছোটরা খুব খুশী একেবারে আনন্দে আত্মহারা। আমরা তো জানি উনি যখন এসেছেন দিন কয়েক তো থাকবেনই, আমরা প্লান করলাম “বর্ষাকাল সন্ধাবেলায় যদি বৃষ্টি হয় কারেন্ট তো অফ হবেই আর তখনি সটান গল্প শুনতে হাজির হবো গোপাল মামার কাছে”। সারাটা দিন কাটার পর সন্ধা বেলায় সব ভাই বোনেরা পড়তে বসেছি, আর ঝমঝম করে তো বাইরে বৃষ্টির আওয়াজ।ওমনি বাল্বটা তিক্ তিক্ করে গেল কারেন্ট টা অফ হয়ে, তখন বই গুলোকে কোন প্রকারে গুছিয়ে সবাই তো মামার কাছে গিয়ে উপস্থিত। গোপাল মামা তখন আমার ছোট কাকার সঙ্গে বারান্দায় বসে কি একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিল। আমাদের দেখে তো ছোটকা এক ধমক দিয়ে বলল” ওমনি কারেন্ট টা অফ হয়েছে কি পড়াশোনা সব লাটে, কেন হ্যারিকেন জ্বেলে পড়া যায় না?” আমরা তো সবাই ভয়ে চুপ! গোপাল মামা কিন্তু আমাদের পক্ষ নিয়ে বলল “আহা ছোট ভাই বকছ কেন? বাচ্চারা যদি গল্প শুনতে চায় এতে খারাপ কিছু নেই, এতে ওদের শিশু মনের বিকাশ হয়, ওরা অনেক কিছু শিখতে ও যানতে পারে”। ছোটকা কিন্তু এবার চুপ কারন আমরাও জানি সেও কিন্তু গোপাল মামার গল্প শুনতে বেশ ভালোই বাসে। আমরা আমাদের অভ্যাস মতয় বক্তা কে ঘিরে ধরে বসে গল্প শোনার জন্য প্রস্তুত হলাম।গোপাল মামা বলল শোন তাহলে আজ তোদের একটা জঙ্গলের গল্ল শোনায়। বহুদিন আগে দূর দেশে একটা জঙ্গল ছিল, জঙ্গল টা ছিল বেশ গভীর এবং সুন্দর। তাতে হাতি, গন্ডার, বাঘ, ভাল্লুক, হরিন, শেয়াল, হায়না, হরিন, ইঁদূর, পিঁপড়ে আরোও অনেক পশুপাখী ও সরিসৃপরা থাকত, আর তারা বেশ স্বাভাবিক ভাবে মনের আনন্দে বিচরণ করত। বছরের প্রতিটা ঋতু ছিল তাদের কাছে উপভোগের।হঠাৎ একবার গ্ৰীষ্মকালটাই তাদের কাছে ভীষন বিপদ ডেকে নিয়ে এলো, প্রচন্ড গরম আর সূর্যের তাপে গাছপালা, জলাশয় সব শুকিয়ে আসতে লাগল। একদিন বিকালে শুরু হল শুকনো ঝড়, লেগে গেল দাবানল! প্রচন্ড বিপদের মধ্যে পড়ল সমস্ত পশুরা ও ছোট ছোট প্রানীরা। পাখীরা তো উড়ে বনের বাইরের দিকে গিয়ে কোন প্রকারে রক্ষা পেল, কিন্তু বনের অন্যরা বেশীর ভাগই পড়ল দাবানলের রোষানলে। সামান্য কিছু বাঘ ভাল্লুক হাতি গন্ডার শিয়াল কুকুর ইঁদূর আর পীঁপড়েরা বনের বাইরে গিয়ে দেখল তাদের সুন্দর জঙ্গল টা পুড়ে ছাড় খার হয়ে গেল। তারা অঝরে কাঁদতে লাগল আর বলতে লাগল “হায়! আমাদের স্বাদের জঙ্গল,হায় আমাদের স্বাদের জঙ্গল”। কাঁদতে কাঁদতে এক সময় ওরা সবাই নিঃশ্চুপ হয়ে গেল, রাত্রী ও গভীর হতে হতে এক সময় ভোড় হয়ে সকাল হল। নতুন সূর্যর আলোয় প্রচন্ড ক্লান্তি আর অসহয়তায় বেঁচে থাকা পশু পাখী, সরিসৃপ, পিঁপড়ে ও সমস্ত প্রানীরা এক জায়গায় জড়ো হল। কারো মুখে তো কোন কথা নেই, সবাই বিষাদগ্ৰস্থ, এ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রোইল ফ্যাল ফ্যাল করে। ওদের মধ্যে শেয়াল যাকে ওরা পন্ডীত বলে মনে করত, সেএকটু ধাতস্ত হয়ে সবাই কে বলল “দেখো যা হওয়ার তো হয়ে গেছে এবার আমাদের নতুন করে শুরু করতে হবে, আমাদের স্বাদের জঙ্গল আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে এবার আমাদের সুযোগ এসেছে ঐ জঙ্গলের জন্য কিছু করার, আমাদেরই গড়তে হবে জঙ্গল কে”। সবাই এবার এক সাথে বলে উঠল “আমরা আবার আমাদের স্বাদের জঙ্গল ফিরে পাবো”? শেয়াল বলল “হ্যা পাবে, কিন্তু তার জন্য অনেক কষ্ট আর পরিশ্রম করতে হবে, আমাদের যার যেমন সাধ্য সে তেমন ভাবে আমরা সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেব”। সবাই প্রস্তুত হয়ে বলল “শেয়াল ভাই বলো আমাদের কী করতে হবে”? শেয়াল পন্ডীত বলল “পুড়ে যাওয়া গাছ পালা গুলো যত সম্ভব সাফ করতে হবে আর যেখান থেকে পারো গাছপালার চাড়া, জল, গাছের বীজ সব জোগাড় করে এনে রোপন করো”। বনের সমস্ত শক্তিশালী পশুরা যথেষ্ট পরিমাণে পরিশ্রম করে জঙ্গল সাফ করে নতুন করে জঙ্গল গড়ার কাজ করতে লাগল, ছোট ও দূর্বল জীব জন্তুরা ও তাদের সাধ্য মতন সাহায্য করতে লাগল, ঈশ্বর ও তাদের প্রতি সদয় হয়ে বৃষ্টি দিয়ে সাহায্য করতে লাগলেন। কয়েক মাসের মধ্যে জঙ্গল যেন আবার প্রান পেতে লাগল। এক দিন বিকালে সমস্ত পশু, পাখী, সরীসৃপ, পিঁপড়েরা সবাই আবার এক যায়গায় জড়ো হোলো। চোখে মুখে সবার খুব আনন্দ, সবাই খুব খূশী, এবার তো শেয়াল পন্ডিত সবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল “কী সবাই খুব খূশী খুশী মনে হচ্ছে”। সবাই বলল “হ্যা হ্যা ভাই তোমার বুদ্ধী আর অনুপ্রেরনায় তো আমাদের আবার নতুন করে বাঁচতে শেখালো”। তখন সবাই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে লাগলো নতুন ভাবে জঙ্গল গড়তে কে কী কাজ করেছে, আর কী ভাবে করেছে। কর্মের বিবরন দিতে দিতে একজন পীঁপড়ের দলের দিকে তাকিয়ে বলল, “হ্যা ভাই পীঁপড়েরা তোমরা কী করেছো একটু শুনি”। পীঁপড়ে সর্দার একটু লাজুক চোখে বলল “ভাই আমরা একটা ক্ষুদ্র প্রানী, কিই বা আমাদের ক্ষমতা, আমরা দূরের ঐ বন থেকে একটা একটা করে ঘাসের বীজ এনে এই জঙ্গলে ফেলেছিলাম”। এই কথা শুনে তো সমস্ত জীব জন্তুরা নিজেদের মধ্যে প্রচন্ড হাসাহাসি করতে লাগলো।আর তাদের এই হাসাহাসি, বিদ্রূপে পীঁপড়ের দল লজ্জায় দুঃখে অশ্রুসিক্ত নয়নে নীরব হয়ে মাথা নীচু করে দাড়িয়ে রইল। এতক্ষন কিন্তু শেয়াল পণ্ডিত সমস্ত ব্যাপারটা লক্ষ করছিল, সে এবার রেগে মুখ ভাড় করে ধমক দিয়ে বলল “অনেক হয়েছে এবার সবাই চুপ করো, পীঁপড়ে একটা ছোট্ট প্রানী ও ওর থেকে অনেক বেশী ওজনের ঘাসের বীজ অতো দূর থেকে বয়ে নিয়ে এসে আজ জঙ্গল কে কত সবুজ করেছে, আর ঐ ঘাস খেয়ে সমস্ত তৃনভোজী প্রানীরা তাদের ক্ষুদা নিবারণ করছে আর ঐ হৃষ্টপুষ্ট তৃনভোজী প্রানীদের দেখে মাংসাসী প্রানীরা ক্ষুদা নীবারণের চেষ্টা করছে। শোনো সৃষ্টিশীল কাজে যে কোনো জীব কূলের ছোট্ট একটা সহয়তা ও কম নয়, তাই কাউকে অপমান ও ঘৃনার চোখে না দেখে, তার কর্মের মূল্যায়নে প্রশংসা করার চেষ্টা করো”। শেয়াল পন্ডীতের এই কথা শোনার পর সবাই তাদের ভুল বুঝতে পেরে পিঁপড়ে সর্দারের কাছে ক্ষমা চেয়ে এক এক করে নিরবতায় গভীর বনের মধ্যে মিলিয়ে গেল।
এবার আমরাও জঙ্গলের গল্পের থেকে বেরিয়ে আমাদের বাস্তব অবস্থায় ফিরে এলাম। ছোটকা তখন আমাদের গল্পের মর্মার্থটা বুঝিয়ে দিয়েছিল, আর অজানা একটা জিনিস শিখিয়ে দিয়েছিলো “পিঁপড়েরও তাদের ওজনের চেয়ে অনেক বেশী ওজন বহন করতে পারে”। গল্পের মর্মার্থ তখন বুঝতে পারিনি কিন্তু যত বড় হয়েছি বাস্তব অভিজ্ঞতায় একটু একটু করে বুঝতে শিখেছি।
—ooSwSoo—