দিবাকর বেলডাঙা গাঁয়ের কীর্তনীয়া। সেই কোন ছোটোবেলা থেকেই এ গাঁ ও গাঁ হরিনাম করতে যেত বাবার সাথে। সেসব দিন ছিল বটে। মানুষের শ্রদ্ধা ভক্তি ছিল। বাবার ছিল দুবিঘা জমি। তাতেই বারোমাস সব্জি ফলাতো বাপ।
ওরা জাতে পরামানিক। বাজারে দু দুটো মুদির দোকান এর পাশে এক টুকরো চালাঘরে বাপ লোকের চুলদাড়ি কাটতো। তাতে নুন তেলের পয়সা হয়েও কিছু বাঁচতো। একটা রেডিও কিনেছিল বাপটা। কীর্তন শুনতো জোরে জোরে।
দিবাকর ছোট্ট থেকেই কেমন করে কীর্তন গান করতে পারতো। গরুর গাড়িতে ধান বোঝাই করে যখন উপর মাঠ থেকে ধান উঠতো বাড়িতে তখন ধানের আঁটির উপরে বসে বসে গান জুড়তো দিবাকর। বাপ নিশানাথ ক্ষয়া ক্ষয়া দাঁতে হাসতো। সবাই বলতো “তোমার ছেলের গলা বটে নিশেকাকা। “ গর্বে নিশানাথ এর বুকটা গর্বে ভরে উঠতো।
রায়পুরের ঘোষেদের বাড়িতে প্রতি বছর জন্মাষ্টমীতে কীর্তন গানের আসর বসতো। নিশানাথ সেখানে প্রথম নিয়ে গেল দিবাকর কে। আসরের একপাশে চুপ করে বসেছিল দিবাকর। নারান ঘোষ বলেছিল “নিশানাথ। এই তো গৌরসুন্দর। তোমার আর চিন্তা কী”?
বাড়ি ফিরে দিবাকর বলেছিল “গৌরসুন্দর কে বাবা?” নিশানাথ বলেছিল “একই দেহে রাধা আর কেষ্ট ঠাকুর “। অবাক হয়েছিল দিবাকর। কী সব শুনছে মানে বুঝতেই পারে না।
সেদিন ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছিল। এমন ব্যাং ডাকানি জল অনেক দিন কেউ দেখে নি। দিবাকর সেদিন দেখলে ঘরের এক কোণে একটা বাক্স। বাবা এখন দোকানে। চুপিচুপি বাক্সটা টেনে আনলে ঘরের মেঝেতে। আস্তে করে সেটা খুললে। কিন্তু কী আশ্চর্য। এসব কী দেখছে সে।
একটা কী শব্দ হতেই তাড়াতাড়ি দিবাকর বাক্সটা সরিয়ে দিল। না। মনের ভুল। কেউ নেই তো। দিবাকর এর মনে একটা চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগল।
এই ঝড় বাদলার দিনে ঘরখানা একেবারেই অন্ধকার। কুপিটা জ্বাললো দিবাকর। ঘরের একপাশে ছোট্ট উনান। ভাত বসালে দিবাকর। এই তেরোবছর বয়সেই সে যেন অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছে। মাকে তার মনে পড়ে না। তবে বাক্সটার মধ্যে ওই যে ফটোটা। ওটাই কি তবে ওর মা! একঝলক দেখেছে দিবাকর। মনে হয়েছে ওর মুখ টা অনেক টা মায়ের মতো। মায়ের কথা মনে হলেই আবেগে ঠোঁট দুটো কেঁপে ওঠে দিবাকর এর। জন্ম থেকেই ওর বাপই সব। তবুও কেন যেন একটা টান কাজ করে মায়ের জন্য।
ভাতের মধ্যেই আলু দিয়েছে দিবাকর। আনাজের ঝুড়িতে কটা সিম আছে শুধুই। বাবাকে কী দিয়ে খেতে দেবে সে? ভাত নামিয়ে ফ্যান গাললো দিবাকর। তারপর ছোট্ট বাটিতে সিমগুলো সেদ্ধ করলে। তাতেই দুটো কাঁচালঙ্কা ফেলে দিলে। আলুভাতে আর সিমের সাথে লঙ্কা সেদ্ধ কষটালে। নুন তেল দিলে। এই খেয়েই বাপ বলবে “দিবাকর। যেন অমৃত খেলাম।”
আজকাল নিশানাথ কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে। শরীর আজকাল ভালো যায় না। কীর্তনীয়ার জীবন। রাতজাগা। একদিন এই লাইনে এসেছিল দুটো পয়সার জন্য। তখন ঘাড় পর্যন্ত চুল ছিল তার। গায়ের রঙ যেন আলকাতরা। তার উপরে সামনের দুটো দাঁত উঁচু। ওইজন্য ঠাকুরদা নাম রেখেছিল নিশানাথ। তামসী রাতের মতোই ছিল তার জীবনের গল্প।
সেবার নিশানাথ গিয়েছিল বারুইপাড়া। সেই প্রথম বড়ো আসরে ডাক পেল সে। কাতার দড়ি দিয়ে ঘেরা আসর। গানের জন্য দুহাজার টাকা পাবে। সাথে গান ভালো হলে পোশাকের উপর সেপটিপিন দিয়ে টাকা আটকে যাবে লোকেরা। আবার শ্রীখোলের সম্মান বাবদ আরও দুশো টাকা। সত্যিই সেদিন খুব লাভ হয়েছিল। সাথে কলাটা মূলোটা আর ভুখাদানা।আর উদাত্ত কন্ঠে গৌরবন্দনা করে পালা ধরলে নিশানাথ।
নিশানাথ দেখলে আসরে লোকে লোকারণ্য। সামনের সারিতে বেশ কিছু মহিলা বসেছে। পঁচিশ বছরের যুবক নিশানাথ একটু লজ্জা পেলে। এই আসরে তাকে নিয়ে এসেছে পঞ্চানন। ওর আবার দালালি চাই। নিশানাথ আজ রাগানুগা ভক্তি আর সাধ্যসাধন তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে লাগল। বেশ নেচে নেচে তার বলার ভঙ্গী। স্বকীয়া আর পরকীয়ার ব্যাখ্যা তখন জমে উঠেছে। নিশানাথ বললে “মায়েরা শুনুন। রুক্মিনী আর সত্যভামা কৃষ্ণের স্বকীয়া। আর রাধে হল পরকীয়া। যা কিছু নিষেধ তাতেই যে আমাদের মন ধায় গো।
মাঝে মাঝেই উলুধ্বনি আর হরিবোল চলছে। কেউ কেউ টাকা ছুঁড়ে দিচ্ছিল নিশানাথ এর দিকে। নিশানাথ ওসব দিকে লক্ষ্য না দিয়ে বলে চলেছে “ভগবানকে পেতে গেলে সাধনা করতে হয়। রাধিকা সেই পরম সাধিকা। কত প্রতিকূলতার মাঝে ও রাধিকা আমাদের কৃষ্ণপ্রেমে পাগলিনী। আর কৃষ্ণ রাধিকার রূপ বর্ননা করতে গিয়ে কী বলছেন? বলেই গোবিন্দদাসের পদ সুর করে গাইতে লাগল নিশানাথ। “যাঁহা যাঁহা নিকষয়ে তবু তনু জ্যোতি/ তাঁহা তাঁহা বিজুরি চমকময় হোতি। যাঁহা যাঁহা অরুণ চরণ চল চলই তাঁহা তাঁহা থলকমল দল খেলই”
কৃষ্ণের জীবন নিয়ে খেলা করছে রাধিকা। কৃষ্ণের মনে পূর্বরাগ। আহা এমন ব্যাখ্যায় মানুষ আপ্লুত। ঠিক এইসময়ই ঘটে গেল ঘটনাটা। দড়ির ভিতরে যে টাকা পড়েছে সেখানে হাত বাড়িয়ে একটা মেয়ে একশ টাকা নিয়ে নিয়েছে। আর কয়েক জনের নজরে পড়ায় শুরু হয়ে গেছে চিৎকার চেঁচামেচি। আসর উত্তপ্ত। নিশানাথ গান থামিয়ে দেখতে লাগল একটা ষোলো বছরের মেয়ের চুলের মুঠো ধরেছে একটা মাঝবয়সী। গলা ফাটিয়ে বলছে “অসভ্য মেয়ে। চোরের বেহদ্দ চোর। লজ্জা ঘেন্নার মাথা খেয়ে বসে আছো। ছ্যা ছ্যা।” নিশানাথ দেখলে কৃষ্ণের মনের কথা আজ তার মনেও বাজছে। সত্যিই এই তন্বী রূপ স্থলপদ্মের মতো। যেন একটা জ্যোতি বের হচ্ছে তার শরীর দিয়ে। নাকে একটা নথ। একমাথা চুল। আয়ত চোখের করুণ চাহনি।নিশানাথ মুগ্ধ হয়ে দেখছে মেয়েটাকে। সবাই বলছে মেয়েটা চোর। আর নিশানাথ এর মনটা সে চুরি করে নিলো কী করে।
আসর শেষ হল বটে। নিশানাথ এর অস্থিরতা কমলো না। পঞ্চানন বললে “কী ব্যাপার রে তোর! বাড়ি যাবি না?” নিশানাথ মুচকি হেসে বললে “ওই মেয়েটার একটা খবরাখবর নে পঞ্চানন। চুরি করেছে আমার টাকা। তা করুক। আমার একটুও দুঃখ নেই। বড়ো সুন্দর মেয়েটা। কী সুন্দর চোখদুটো”।
পঞ্চানন বললে “ও বাবা। তোর পেটে পেটে এতো!! এ মেয়েটার এলেম আছে বলতে হবে। শুধুই কীর্তনীয়ার টাকাতে হাত দেয় নি।একেবারে হৃদয়টাও চুরি করেছে”।
উঁচুদাঁত নিয়ে হাসলে নিশানাথ। স্কুল বাড়ির একটা ঘরে সে থাকলে। স্কুল এর দুদিন ছুটি। স্থানীয় মেলা বসেছে। পঞ্চানন খবর আনল। মেয়েটার ডাক নাম লালি। ওরা জাতে তোদের পাল্টি ঘর বটে তবে বিহারী। ওর বাপ নিত্যানন্দ ঠাকুর। জাত ব্যবসার পাশাপাশি মাংস কাটে। ওর মামার বাড়ি সেই রাজগৃহ। ওর দিদির বিয়ে হয়েছে বাঙালির সাথেই। এর বিয়েও ওরা বাঙালির সাথেই দিতে চায়। মেয়েটার ব্যাপারে পাড়ার লোক কিন্তু বীতশ্রদ্ধ। ও চুরি করে। সুযোগ পেলেই এর ওর জিনিস নিয়ে হাওয়া।”
পঞ্চানন যখন মেয়েটার চুরির প্রসঙ্গ আনে তখন নিশানাথ বলে “ও কথা ছাড় তো। ছোটো মেয়ে। তাছাড়া মেলা বসেছে কি না। হয়ত তাই একশ টাকা নিয়েছে। তা নিক। আমার টাকাই তো নিয়েছে”। পঞ্চানন অবাক হয়। বলে “তোর কী হোলো রে নিশে। চোখে সরষেফুল দেখছিস “। নিশানাথ বললে “তুই বাড়ি যা পঞ্চু। আমি এই রাধামাধব এর মেলা দেখে তবে যাবো”।
বারুইপাড়ার এই মেলা নামকরা। পরেরদিন মেলাতে গেল নিশানাথ। আজ আর রাঁধবে না।মেলাতে ঘুগনি আর পরোটা খেয়ে নেবে। সাথে একটা ডিমসেদ্ধ। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই সে অবাক। আসরের সেই লালি একেবারেই তার সামনে। ওর সাথে আর কেউ নেই। জয়গুরু। বলেই এগিয়ে গেল নিশানাথ। মেয়েটাও ওর দিকে তাকিয়ে। উফফ।একেবারেই ড্যাবড্যাব করে দেখছে নিশানাথ কে। নিশানাথ কখনও নারী সান্নিধ্যে আসে নি। তবুও এই মেয়েটার জন্য সে যেন জীবনপণ করেছে। লজ্জা ভেঙে বললে “খাবে? পরোটা আর ঘুগনি”। মেয়েটা মুখটা ব্যাঁকালো। বললে “বয়ে গেছে”। নিশানাথ বললে “অ্যাই! বয়ে গেছে কেনে। আমি তো তোমাকে খাওয়াতে চাই “। মেয়েটার কোনও ভাবান্তর নেই। চোখ টেরিয়ে বললে “তোমার টাকাটা চাইবে না কি!” নিশানাথ জোরে হেসে উঠল। বলল “না না। একদম না। কিন্তু তুমি ওরকম টাকা নিতে গেলে কেনে। সবাই যে চোর বলল!” লালি হঠাৎই বিদ্যুত চমকের মতো চমকিত হয়ে বলল “ওই দেখো দেখো। কাচের চুড়ি। পরিয়ে দাও না। আমার হাতে চুড়ি নেই দেখো!” নিশানাথ যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেলে।নিশানাথ এর কী যেন মনে হল। গুনগুন করে বলল “তুমি যা চাও সব দেবো। তুমি খুব মিষ্টি একটা মেয়ে”! মেয়েটা নিশানাথ এর হাত ধরে টান দিলে। একেবারেই চুড়ির দোকানে। আর নিশানাথ। মনে মনে গেয়ে উঠল
“রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর”
কাচের চুড়ি পরিয়ে বুক পকেট থেকে টাকা নিতে গিয়ে নিশানাথ দেখলে টাকা নেই। যা বাবা! বুকপকেটে একশ টাকা ছিল। নিশ্চয়ই পঞ্চানন নিয়েছে। যাইহোক প্যান্ট এর পকেট থেকেই টাকা দিলে নিশানাথ।
কাচের চুড়ি পরার আনন্দ যেন ঠিকরে পড়ছে লালির চোখে মুখে। পরোটা ঘুগনিও খেয়েছে। তারপর নিশানাথ কে বলেছে “তুমি মানুষ খুব ভালো। তবে মিঠুনের মতো নয়। কোথায় মিঠুন আর কোথায় তুমি”। নিশানাথ এর মনে সন্দেহ। এই মিঠুন আবার কে রে বাবা! বললে “মিঠুন আবার কে?” লালি আবার নিশানাথ কে দেখতে থাকে। বললে “তোমার মোতো ভ্যাবা গঙ্গারাম তো একটাও দেখিনি গো। তুমি মিঠুন কে চেনো না!”
নিজের অজ্ঞতায় নিশানাথ বোকা বোকা হাসে। বললে “নামটা খুব শোনা শোনা। আসলে আমি তো কীর্তনীয়া। পালাগান সাজাতে দিন যায়। “ লালি বললে “মিঠুন সিনেমার নায়ক।” নিশানাথ জিভ কাটে। বলে “কার সাথে কার তুলনা। বায়োস্কোপের নায়কের সাথে আমি। এরকম বলে না গো”। মেলা দেখা শেষ হলে লালি এক ছুটে পালিয়ে যায়। নিশানাথ এদিক ওদিক তাকায়। কোথায় গেল মেয়েটা। বড়ো নিষ্পাপ মনে হল মেয়েটিকে। সহজ সরল।
কিন্তু সেই সময়ই ওই গাঁয়ের পালিতবাবু নিশানাথ এর কাঁধে হাত দিলে। লোকটা এতক্ষণ ওদের লক্ষ করেছে। বললে “ওই মেয়েটার খপ্পরে পড়েছ। ও একটা চোর । যত শীঘ্র পারো ওই সঙ্গ ত্যাগ করো”।
নিশানাথ বললে “একবার চুরি করেছে বলে বারবার কি আর করবে? “ পালিত বললে “একবার নয়। বারবার এই কাজ করে ও। দুপুরে দুচোখের পাতা এক করতে পারি না। কত শখ করে ভালো জেতের পেয়ারা লাগালাম। একটা পেয়ারা চেখে দেখার জো আছে ওই ছুড়িটার জ্বালায়। শুধুই কী তাই। সময় বুঝেই হাতসাফাই করে দেবে। আর হবে নাই বা কেনে। ওর বাপটা তো এদেশের নয়। উড়ে এসে জুড়ে বসা যাকে বলে। কথাতেই আছে বীজগুণে বেগুন। “
পালিত অত কথা বললে বটে। তবে নিশানাথ এর ওসবে কিছুই মনে হোলো না। কী যেন একটা টান,মেয়েটার মিষ্টি মিষ্টি কথা,চোখের অঙ্গভঙ্গি নিশানাথ কে যেন কোন এক কল্পনার রাজ্যে নিয়ে গেল। রাতে স্বপ্ন দেখলে নিশানাথ। তার ছোট্ট ঘরে ঘোমটা দিয়ে পায়ে মল বাজিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে লালি। মাথার সিঁদুর জ্বলজ্বল করছে। সাঁঝের বেলায় প্রদীপ জ্বালছে। নিশানাথ এর গায়ে ঠেস দিয়ে বলছে “একটা কেত্তন গান করো তুমি”।
হঠাৎই ঘুমটা ভেঙে গেল। ভোর হয়ে গেছে। নিশানাথ এর ভোরে উঠে হাঁটতে যাওয়া অভ্যাস। রাস্তায় লোকজন কম। একটা পুকুর এর ঘাটে একটা পরিচিত মুখ দেখতে পেয়ে আহ্লাদে গদগদ হল নিশানাথ। বললে “আরে লালী! তুমি এই ভোরে এখানে কী করছো?” লালী চুপ করে আছে দেখে এগিয়ে গেল নিশানাথ। কিন্তু এ কি! লালীর চোখ ভর্তি জল। নিশানাথ কে দেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। আর কোন পুরুষ প্রেয়সীর চোখে জল দেখলে ঠিক থাকতে পারে! সে স্নেহ পরিপূর্ণ কন্ঠে বললে “বলবে না আমাকে। কে কী বলেছে”? লালী বললে “আমাকে সবাই বলে আমি নাকি চোর। কাল আমার কাছে একশ টাকা ছিল। আমার দিদি বলছে ওটা ওর টাকা। জোর করে নিতে চায়”। নিশানাথ এর একবার সন্দেহ হল। তার মানে বুকপকেটের সেই একশ টাকাটা নয় তো! পরক্ষণেই বললে “তোমার বাড়ি কোনটা?” লালি দেখালে পুকুর সংলগ্ন তার বাড়ি। নিশানাথ বললে “তুমি খুব ভালো মেয়ে। “ শুনেই লালি খিলখিল করে হাসতে লাগল।
স্কুল বাড়ি কাল ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু লালীর সাথে আর যদি দেখা না হয়। ফিরে এসে এসব ভাবছিল নিশানাথ। কিন্তু মেঘ না চাইতেই জল। লালী স্কুল বাড়ির মধ্যেই প্রবেশ করল। সাথে আর একটা মেয়ে। লালী বললে “এর নাম খেন্তি। তোমার আন্না করে দেবো আজ”। নিশানাথ আগ্রহ নিয়ে বললে “তাহলে তোমরাও এখানেই খাবে”। লালী এই কথাটাই শুনতে চাইছিল। বললে “ঠিক আছে’।
লালী বললে “এই খেন্তি। তুই হরিনাম এর আসর থেকে পাওয়া ভালো চাল বের কর। আর কল থেকে জল তোল। আমি এখনই আসছি।” নিশানাথ চোখ পাকিয়ে বললে “আসরে গান গাইলে সিধে পাই। আলু,তেল,সব্জি সব আছে”।
লালীর মুখ ভার। অভিমানের সুরে বললে “বয়ে গেছে সব্জি দিয়ে ভাত খেতে।” বলেই সে একছুটে পালাল। নিশানাথ অনুভব করলো এই মেয়েটার জন্য সে সবকিছুই করতে পারে। মনটা তার উড়ু উড়ু। অন্য দিন হলে গায়ে মাথায় সর্ষের তেল দিয়ে চান করে নিতো সে। আর আজ মাথায় সুগন্ধি তেল দিলে। গায়ে সাবান দিয়ে নতুন পাঞ্জাবী পরলে। চুলটা টিরি বাগালে আজ সমস্ত পৃথিবীর মানুষ কে তার গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছিল। আমাদের নিশানাথ প্রেমে পড়েছে।
খালপাড়ের দিকে ছুটছে লালী। ওখানেই তো জায়গাটা নিরালা। ফটকের ঠাগমার রাণীহাঁসগুলো ওখানেই সাঁতরে বেড়ায়। রোজ বিকেলে ফটকের ঠাগমার সোই সোই আওয়াজ শুনে হাঁসগুলো উঠে আসে। খোলে ঢোকে। কত ডিম বিক্রি করে ফটকের ঠাগমা। একটা ফুটের কৌটো ভর্তি টাকা।লালীর সব দেখা।
আস্তে আস্তে জলের কাছে গিয়ে লালী ডাকছে “সোই সোই “। ডাক শুনে রাণীহাঁস গুলো ডাঙার দিকে আসছে। উইই!খুশিতে ডগোমগো লালীর হাতে একটা হাঁস। অনেক টা মাংস হবে। ওই কীর্তনীয়াকে সে আজ নিজের হাতে হাঁসের রান্না করে খাওয়াবে। ওই লোকটার মনটা খুব ভালো। কখন কোথা থেকে মাংস এলো নিশানাথ বুঝতেই পারলো না। বলল “মাংস কোথায় পেলে?” লালী বললে “বারে! কোথায় আবার পাবো? কিনে আনলাম। সেই যে একশ টাকা ছিল আমার “।
খেন্তি ওপাড়ার বাউরিদের মেয়ে। একটু হাবাগোবা। তবে লালীর কাছে এই কারণেই তার কদর। আর কলাটা মূলোটা লালীর কল্যাণেই তার পেটে যায়। আজকাল স্কুলে শিলনোড়াও থাকে। মাস্টার মশাই রা খায়।রসুন পেঁয়াজ দিয়ে গরম রানীহাঁসের মাংস। ভাবা যায়। নিশানাথ কে খাওয়ানোর সময় কত যত্ন করলে লালী। মেয়েটার এত মায়া মমতা দেখে নিশানাথ একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। এবার বাড়ি ফেরার পালা। লালী চলে গেছে। এখান থেকে চলে যাওয়া মানে লালীর কাছ থেকেই চলে যাওয়া। আবার নিশানাথ লালীর কাছে আসবেই। সব জিনিস গুছিয়ে নিচ্ছে নিশানাথ। কিন্তু কীর্তনের আসরে যে রুপোর মেডেল পেলে সে। সেটা তো এখানেই ছিল। কোথায় রাখল সেটা! এই স্কুলবাড়িতে কত বড়ো বড়ো ইঁদুর। নিশ্চয়ই ওরা নিয়ে পালিয়েছে। ব্যাগ পত্তর গুছিয়ে এগোতে লাগল নিশানাথ। লালীর চোখ দুটো ভাসছিল মনের মধ্যেই ।নিশ্চয়ই কখনও কেউ ভালোবাসে না। তাই অমন দুষ্টুমি করে। হঠাৎই একটা আওয়াজ এর শব্দ এল। এক বয়স্ক ভদ্রমহিলা চিৎকার করছে। বলছে “লোভের বশে আমার রাণীহাঁস মেরে খেলি। কবে যাবি শ্মশান ঘাটে। “ নিশানাথ দেখল হাঁসের পালক বৃদ্ধার হাতে।নিশানাথ বুঝতেই পারলো এই কাজ লালী করেছে।কিন্তু বৃদ্ধা কী জানে এই মাংস নিশানাথ ও খেয়েছে। তাহলে তো অপমানের শেষ থাকবে না। বাড়ির অভিমুখ ত্যাগ করলো নিশানাথ। লালী বললে মাংস কিনে আনলাম। কিন্তু এখানে নিমেষের মধ্যে কোথা থেকে কিনলে সে! পুকুরের হাঁস ধরে মাংস কীভাবে জোগাড় করল লালী। আর যদি সত্যিই লালী হাঁস চুরি করে ধরা পড়ে তবে হাঁসের দাম ওই বৃদ্ধাকে দিয়ে দেবে নিশানাথ। লালীর বাড়ির দিকেই চলল নিশানাথ।
নিশানাথ লালীর বাড়ির পাঁচিল দিয়ে ভিতরে চোখ দিতেই অবাক হয়ে গেল। দুদিকে বেনী ঝুলিয়ে চোখে কাজল দিয়েছে লালী। কী সুন্দর ই না দেখাচ্ছে। আর সবথেকে আশ্চর্য লালী রোয়াকে বসে সহজপাঠ পড়ছে। এই বয়সে সহজপাঠে আটকে আছে কেন! এখন তো আরও উঁচু ক্লাসে পড়ার কথা।
সত্যিই। কতদিন শোনা হয় নি গল্প টা। গুপ্তিপাড়ার বিশ্বম্ভরবাবু আর তার চাকর শম্ভুর গল্প। কুম্ভীরার জঙ্গলে শম্ভুকে ভাল্লুকে ধরেছিল। একমনে প্রেয়সীর পড়া গল্প শুনছিল নিশানাথ। কিন্তু এখানেও ফটকের ঠাগমার চিৎকার শোনা গেল। ভিরমি খেল নিশানাথ। এবার কী হবে!
ফটকের ঠাগমার বাক্যবাণ। “এককাঁড়ি টাকা দিয়ে রাণীহাঁস কিনে পুষিচি। তা হারামজাদা গুষ্টি র সবাদিকে লোভ। কোনও দিকে একটা কিছু করার উপায় নেই। গাঁয়ে বসে সবার রক্ত শুষে খাচ্ছে। মরেও না। এত লোক মরে। মরলে খই ছড়াবো, শাঁখ বাজাবো। আমার অমন সুন্দর রাণীহাঁস। আবাগীর বেটি কম নাকি। চোরের বেহদ্দ চোর। হাতে নাতে যেদিন ধরবো সেদিন অন্নপ্রাশনের ভাত বার করব। তোদের কখনও ভালো হবে না”। লালীর মা কী একটা বানাচ্ছে উনানের কাছে। ফটকের ঠাগমার কথা গুলো শুনে মেয়েটার কাছে এলো। বললে “কাকে গাল দিচ্ছে ফটকের ঠাগমা। কী করিচিস। রাণীহাঁস চুরি করেছিস। তাই বলি সারাদিন কোতায় ছিলি। দিনরাত টোকলা হয়ে টো টো করো আর অনাছিস্টি কান্ড করো। আজ যদি প্রমাণ হয় তুই হাঁস চুরি করিচিস তো ওই যে রান্নার শালে চ্যালাকাঠ দেখিচিস তোর পিঠে ভাঙবো”।
লালীর কোনও ভাবান্তর নেই। সে এমন কাজ করতেই পারে না এমন ভাব নিয়ে বললে “ভারী তো হাঁস।আমার বয়েই গেছে চুরি করতে। আমি তো স্কুলবাড়িতে” বলেই জিভ কাটলো লালী। তার মা বললে “বল বল। থামলি কেনে। স্কুলবাড়িতে আবার কী মরতে গিয়েছিলি?” লালীর একমুখ হাসি। বললে “ওই যে গো। ওই লোকটা। আন্না করতেই পারে না। আমি আন্না করে দিলাম “। তার মা বললে “ঘর জ্বলানে পর ঢলানে আর কাকে বলে? কোনও দিক দিয়ে তো সংসারের কুটো নেড়ে দুটো করো না। বুঝবি। বুঝবি। শ্বশুর ঘরে গেলে টের পাবি কত ধানে কত চাল “। এরমধ্যেই ফটকের ঠাগমা ওদের বাড়িতে ঢুকলো। আর নিশানাথ। সেও পিছন পিছন এগিয়ে গেল।
ফটকের ঠাগমার মুখ নয় যেন ক্ষুর। বললে “আমার রাণীহাঁস কেন মেরেছিস।” হঠাৎই প্রত্যক্ষ আক্রমণে হতচকিত লালীর মা। গম্ভীর হয়ে বললে “আমার লালী স্কুলবাড়িতে কীর্তনীয়ার রান্না করছিল। সে কী করে হাঁস মারবে”। ফটকের ঠাগমা বললে “গাঁয়ের মধ্যে কটা চোর বাস করে শুনি”?
নিশানাথ দেখল লালী চুপ করে আছে। যদি সে সত্যিই হাঁস চুরি করতো তবে একটা অপরাধবোধ কী থাকতো না! তবুও কোথাও যেন একটা কিছু গোলমাল তো আছেই। আর হাঁস এর মাংস তার পেটেও প্যাঁক প্যাঁক করছে। তাই বাধ্য হয়ে লালীর বাড়ির ভিতর ঢুকলো নিশানাথ। ফটকের ঠাগমার উদ্দেশ্যে বললে “আপনার হাঁস কেউ মেরেছে। আপনার কষ্ট হচ্ছে। তাই আমি হাঁস এর দাম দিয়ে দিচ্ছি। আর লালীর কোনও দোষ নেই। সে স্কুল বাড়িতে আমার রান্না করে দিচ্ছিল। “
ফটকের ঠাগমা টাকা নিয়ে চলে গেল বটে। কিন্তু সন্দেহের দৃষ্টি হানলে।বলে গেল “বাবা!একেই বলে কলিকাল। শেয়ালে চাটে বাঘের গাল।”লালীর মা বললে “ঘরে এসো বাবা।ওই ফটকের ঠাগমার মুখের আকঢাক নেই। এই ঠেকুয়া বানাচ্ছি। কটা খেয়ে যাও “। প্লেটে ঠেকুয়া দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল লালীর মা। বললে “এই মেয়েটার জন্য আমার মরণ হয়েছে বাবা। ওর জন্য কথা শুনে শুনে মরতে হয়। সবাই বলে “যেমন মা তেমন ছা। আমি কখনও কারো জিনিসে লোভ করি না বাবা। কার ঘরে যাবে। ওকে পিটিয়ে মারবে”। নিশানাথ দেখলে লালী তার দিকে বড়ো বড়ো চোখে তাকিয়ে। কাজলপরা চোখের ভাষা নিশানাথ বুঝতেই পারছে।
বাস্তবিক নিশানাথ কে লালীর মায়ের খুব ভালো লেগেছে। হাসিমুখ করে বললে “গরীবের ভিটেতে যখন এসেই পড়েছ তবে দুদিন থেকেই যাও না কেনে। লালীর বাপ মানুষ ভালোবাসে খুব। আর আজ গাঁয়ের রাধামাধব মেলায় যাত্রার আসর বসবে। আমার বড়ো মেয়ে এসেছে। আজ জামাই আসবে। খুব মজা হবে। “
নিশানাথ যেন এই নিমন্ত্রণ এর অপেক্ষাতেই ছিল। বললে “আচ্ছা বেশ বেশ। থেকেই যাবো”।লালীর আনন্দ আর ধরে না।যেন এতদিন পর বাড়িতে ওর সুবাদে একটা মানুষ এসেছে। নিশানাথ বললে “আজ আমি বাজারে যাই। সকলকে আজ আমি খাওয়াবো”। বাড়ির মানুষ গুলোর মুখ চকচক করে। নিশানাথ বাজার থেকে একটা মোরগ কিনে আনে। আজ রাতে যাত্রার পর সকলে একসাথেই খাবে। লালী নিশানাথ এর শোবার ব্যবস্থা করতে গেল। ওদের দখিন মুখো ঘরটা সাজালে। কাচা একটা বিছানার চাদর পেতে দিলে। আজ পাড়ায় এসেছে যাত্রার ফিমেল রা। লালীর আজ ঘরের দিকে মন নেই। চলে গেছে তাদের কাছে। বাইরে থেকে আসা মেয়ে সব। লালীর সাথে তাদের খুব ভাব হয়ে গেল।সবসময়ই ওই মেয়েদের রূপের কথা নিশানাথ এর কানের কাছে বলে যাচ্ছে লালী। ওরা নাকি স্বর্গের পরী। যাত্রাপালা দেখে সবাই ধন্যি ধন্যি করলে। রাতের বেলা খেতে বসে বড়োজামাই কথাটা তুললে। বললে “সাবিত্রী সত্যবান” পালা কেমন দেখলে গো ভাই “। নিশানাথ ঘাড় নাড়লে। এমন যাত্রা সে কখনও দেখেনি। জামাই বললে “তা তোমার ও তো একটা সাবিত্রী দরকার। তা আমার শালীকে বিয়ে করবে নাকি?”
এতো মেঘ না চাইতেই জল। নিশানাথ ভিতরে ভিতরে আনন্দে আটখানা। লজ্জা লজ্জা মুখ করে বললে “তা আপনাদের আপত্তি যদি না থাকে আমার কোনও আপত্তি নেই “। গোটা বাড়ি আনন্দে ফেটে পড়ল। বললে “তাহলে দিনক্ষণ ধরা হোক “। নিশানাথ বললে “আমার আবার দিনক্ষণ। আমার বাপ মা কেউই বেঁচে নেই। কাল গোধূলিলগ্নে আমি লালীকে বিয়ে করবো”। পরের দিন গোটা গাঁয়ে ঢি ঢি পড়ে গেল। ওই চোরনি লালীর বিয়ে হবে কীর্তনীয়ার সাথে। তার মানে লালীর পরিচয় এখন কীর্তনীয়ার বউ। সকাল থেকেই লালীকে দেখতে পায় নি নিশানাথ। মনের মধ্যে গুণগুণ করছে কীর্তণের সুর “দেখিতে যে সুখ ওঠে /কী বলিব তা। দরশ পরশ লাগি আউলাইছে গা।।”
আজ নিশানাথ এর মনে হচ্ছিল লালী আর সে আসলে একই। বিধাতা ভুল করে দুটি দেহ সৃষ্টি করেছে। বিয়ের দিন দধিমঙ্গল হল । ফটকের ঠাগমা বললে “বর বাবাজীবন আমার বাড়িতে থাক। এখেন থেকেই বিয়ে করতে যাবে”। সবাই রাজী হল। নিশানাথ এর গায়ে ছোঁয়ানো হলুদ যাবে লালীর গায়ে। একটা টিনের বাক্সে কয়েক টা ছাপা কাপড় আর একটা ঝাঁ চকচকে চিড়িক চম্পা কাপড় দেওয়া হল। নিশানাথ এই টাকা দিয়েছে। তার সাথে পাউডার ,টিপ আর চুল বাঁধবার কাঁটা। লালী ড্যাবড্যাব করে দেখলে। এত জিনিস সে কখনও কারো কাছে পায়নি। এই প্রথম তার চোখ ভিজলো।সাথে সাথেই মনে হল তার বাবা গরীব।তারপর কোথায় যে চলে গেল কেউ জানে না। এদিকে হৈ হৈ রৈ রৈ। লালীকে পাওয়া যাচ্ছে না। তার গায়েহলুদ এখনও হয় নি।
লালীর যত অভিমান নিশানাথ এর উপর।আর এখন তো ওরা তিনজন। লালী বললে খুব ধূমধাম করে আমার ছেলের অন্নপ্রাশনের ব্যবস্থা করো। আমার দিবাকর কে সোনার চেন দেওয়া চাই। নিশানাথ বললে সময় হলে সব হবে বউ ।ঈশ্বর কাউকেই ফেরান না। পৃথিবীর অন্য কারো প্রতি লালীর কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। যত আবদার স্বামীর কাছে।
তারপর বৈশাখী পূর্ণিমায় বেলডাঙার রায়েদের বাড়ি কীর্তন করার ডাক এল নিশানাথ এর। এতদিন গেঁয়োযোগী বলে ভিখ পেতো না। কিন্তু এবারে অষ্টপ্রহর হরিনাম। নিশানাথ কীর্তনীয়া হিসাবে এমনিতেই নিমন্ত্রিত। রায় গিন্নিমা নিজে নিশানাথ এর বাড়িতে এসে লালীর হাত দুটো ধরে বলে গেছে যাবার কথা। লালীর ছেলেকে আদর করে বলেছে “তোমার ছেলের মতো আমার নাতি আছে একটা।” লালী ঘাড় নেড়েছিল। নিশানাথ বলেছিল “অবশ্যই যাবে মা ঠাকরুণ। কেন যাবে না”?
রায় গিন্নিমা লালীর প্রশংসাতে পঞ্চমুখ। বলেছিল “নিশানাথ। কেমন লক্ষ্মীমন্ত বউ তোর।” উঁচুদাঁত বার করে হেসেছিল নিশানাথ। সত্যিই। যখন নিশানাথ কীর্তন করবে আর সিঁদুর আলতা পরে লালী যখন বসবে সামনের সারিতে ,গর্বে বুক ফুলে উঠবে নিশানাথ এর। সবাই বলবে “ওই যে সুন্দরী বসে আছে দেখছিস ওটা আমাদের কীর্তনীয়ার বউ। লালীর মাথায় ঘোমটা থাকবে তখন।
আনন্দিত মনে পালা সাজাচ্ছে নিশানাথ। এবারে সবাই কে কাঁদিয়ে ছাড়বে। প্রথমে গৌরচন্দ্রিকা করবে। নবদ্বীপ ছেড়ে শচীনন্দন চলে যাচ্ছে। সন্ন্যাস ব্রত নিয়েছে সে।নবদ্বীপ চন্দ্র চলে যাচ্ছেন। বিষ্ণুপ্রিয়া বিরহাকুল। প্রিয়জনের বিরহে মনের অবস্থা ভালো নয়। আর এই ভাবে কৃষ্ণ চলে যাচ্ছেন মথুরায়। কেমন করে প্রাণ ধরবে রাধিকা। সে যে জীবাত্মা। পরমাত্মার সাথে তাকে মিলতেই হবে। রায় গিন্নি প্রত্যেক বছর এই পুজো করেন। তার শাশুড়িও করতেন। এটা আসলে যমরাজকে তুষ্ট করতেই করা হয়। টাকা পয়সার অভাব নেই। এখন যাতে পরিবারে অকালমৃত্যু না হয় সেইজন্য এই পুজো। সারাদিন উপবাস করে আছেন। একেবারেই নির্জলা। বাড়িতে লোকে লোকারণ্য। আজ দান ধ্যান করতে হয়। পুজোর পর কলসী ছাতা আর ঘি দান করা হবে। সন্ধ্যার সময় বসবে কীর্তনের আসর। একমাত্র নাতি নিয়ে তার আহ্লাদের শেষ নেই। একটা মোটা সোনার চেন নাতির গলায় পরিয়ে দিলে। নাতিটা উত্তর পুরুষ। এত দানধ্যান সে তো ওর জন্যই। লালী দেখলে ওদের ছেলেটা কত সুন্দর একটা সোনার চেন পরেছে। আর ওর দিবাকরের জন্য কতবার নিশানাথ কে বললে লালী। এনে দিলেই না।
কীর্তন শুরুর আগেই ঘটে গেল ঘটনাটা। রায়গিন্নির নজরে পড়ল নাতির গলায় হারটা নেই । সারা বাড়ি হৈ হৈ রৈ রৈ। এই তো ছিল হারটা। এতো একেবারে দিনেডাকাতি। কীর্তনীয়া নিশানাথ এর কানে এল কথাটা। তবে কি আবার সেই! লালীকে দেখতে পাচ্ছে না নিশানাথ। এই হুল্লোড়ের মধ্যেই সে ছুটল বাড়ির দিকে। রায়গিন্নি যে সে লোক নয়। অপমানের শেষ থাকবে না ধরা পড়লে।
চুপিচুপি বাড়ির মধ্যে ঢুকলে নিশানাথ। হঠাৎই নিশানাথ কে দেখে হতভম্ব হয়ে গেল লালী। তাকে ভীষণ অস্থির লাগছিল। নিশানাথ সরাসরি বললে “হারটা দাও”? লালী বললে “বারে। আমি কী করে জানবো হার কোথায়”? নিশানাথ আজ পাগল হয়ে গেল। দেখলে তার ছেলের গলায় সোনার হার। রাগান্বিত হয়ে সপাটে একটা চড় বসালে লালীর গালে। আর লালী তীব্র অভিমানে ডুকরে কেঁদে উঠল। একটা অপরাধবোধ পর্যন্ত তার নেই। নিশানাথ এর কীর্তন শুরু হবে। কীর্তন শুরুর আগে রায়গিন্নিকে প্রণামের নাম করে গিয়ে বললে “হারটা কুড়িয়ে পেলাম মা জননী। “ সবকিছুই স্বাভাবিক হয়ে গেল। ঝড় ওঠার আগে প্রকৃতি যেমন শান্ত হয়ে যায়। উদাত্ত সুরে গান ধরেছে নিশানাথ
“সো গুণনিধি যদি প্রেম হাতে ছোড়। তিল এক জীবইতে লাজ রহু মোর।।”
সত্যিই তো।প্রেম যে অঙ্গের ভূষণ।তাকে ছেড়ে কি বাঁচা যায়!” কীর্তন শেষ করে বাড়ি যাওয়ার জন্য ছটফট করছিল নিশানাথ। রায়গিন্নি খুশি হয়ে সোনার চেন দিয়েছে। তার ছেলের জন্য। লালীর কত শখ। আজ লালীর গায়ে হাত তুলেছে। সব আবার ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কী দেখছে ঘরে এসে নিশানাথ। বাড়িতে এত লোক কেন!লালীর মৃতদেহ পড়ে আছে। মুখে ফেনা। আর অবোধ শিশু মৃত মায়ের বুকের উপর খেলা করছে। নিশানাথ কীর্তনীয়ার বউ বিষ খেয়ে মরেছে। সবাই কাঁদছে লালীর জন্য। সকলের হৃদয় চুরি করে পালিয়েছে লালী। আর নিশানাথ সারাজীবন কেঁদে চলে।
দিবাকর জানে তার বাপের মাথুর দশা কখনও কাটবে না। ডাক্তার সব শুনে বলেছিলেন ওটা মানসিক রোগ ছিল একটা।