এই গল্পের কাহিনী কতটা সত্যি আর কতটা কিংবদন্তী তা জানা নেই। তবুও যুগ যুগ ধরে যা শুনে আসছে সবাই সেটার একটা আলেখ্য লিখছি মাত্র। জোড়াদীঘি নামটা কেন হল তা বলি। আসলে এই জায়গাটার নাম চৈতন্য পুর। শোনা যায় নবদ্বীপ থেকে নীলাচল যাবার পথে সন্ন্যাসী চৈতন্য এখানে কোন এক গোয়ালার বাড়িতে রাত্রিবাস করেছিলেন।
সমৃদ্ধ গোয়ালা রামকিঙ্কর তার বাড়িতেই বিরাট আয়োজন করলেন। সুন্দর বিছানা তৈরি করলেন মহাপ্রভুর জন্য। নানাবিধ খাদ্য প্রস্তুত করছেন। তখন শীতকাল। রামকিঙ্কর লক্ষ করলেন এই যুবক সন্ন্যাসীর পোশাক বলতে শুধুই দুটো বস্ত্রখন্ড। সহৃদয় এবং ভক্তিপ্রেম আশ্রিত রামকিঙ্কর মহাপুরুষ এর জন্য শিমুল তুলো দিয়ে বানালেন শীত বস্ত্র।
কিন্ত যখন রাতের বেলা মহাপ্রভুর জন্য নির্দিষ্ট ঘরে গেলেন দেখলেন অবাক কান্ড। ভগবান শ্রীচৈতন্য সেখানে নেই। কোথায় গেলেন তিনি! অথচ তাঁর পার্ষদরা ঘুমিয়ে আছেন।
এদিক ওদিক খুঁজে কোথাও পাওয়া গেল না। তখন রামকিঙ্কর তার অন্নপুন্নের মন্দিরে গিয়ে দেখলেন দেবীর মুখখানা ভীষণ প্রসন্ন। দেবীর এমন মুখমণ্ডল স্বপ্ন কল্পনার বাইরে।
কিন্তু সাধু কোথায় গেলেন দেখার জন্য বাইরে বের হতেই দেখলেন এক চাঁপাগাছের কাছে বসে হরিনাম করছেন। সেই দ্যুতি যা একটু আগে দেবীর অন্নপুন্নের মুখে দেখেছেন রামকিঙ্কর সেটা এই সন্ন্যাসীর দেহ থেকেও বিচ্ছুরিত হচ্ছে। নামগানের এত মাধুর্য । রামকিঙ্কর গলা মেলালেন “অতুল চৈতন্য হরি/মুখে বলে হরি হরি”। মধুমাখা হরিনাম করতে করতে রামকিঙ্করের মনে হল সচ্চিদানন্দ শ্রীকৃষ্ণ যেন বলছেন “রামকিঙ্কর! হরিনাম করো। ত্রিতাপ হরো। কলিযুগে নাম পরমব্রহ্ম ।পরমমুক্তি”। রামকিঙ্কর ভক্তি গদগদ হয়ে বললেন “প্রভু! আপনি এই শীতে বাইরে এমন ঠান্ডার মধ্যে আছেন। ঘরে আসুন প্রভু”। প্রভু বললেন “আমি সন্ন্যাসী। কোনও রাজকীয় সুখ আমার জন্য নয়। আমার সঞ্চয় চলে না। আমার ভোগ চলে না। এখন আমি ভিক্ষান্নে দিনপাত করি। তবে একান্তই যদি আমার হৃদয়ের কথা জানতে চাও তবে এই গ্রামের জল কষ্ট দূর করো। তোমার মঙ্গল হবে। মানুষের আশীর্বাদ পাবে তুমি। “
রামকিঙ্কর প্রভুর পারে লুটিয়ে পড়ল। বললে “হে প্রভু। এই দেশে আচার বিচারের শেষ নেই। ছোটো জাত বড় জাতের বিভেদ। সেখানে আমি যদি দীঘি কাটি তবে তো তা সাধারণ কে ব্যবহার করতে বাধা দেবে সমাজের শিরোমণি চূড়ামণিরা। তখন মহাপুরুষ বললেন “বেশ তো। জোড়া দীঘি খনন করো। যাতে সবাই এর সুবিধা পায়”। রামকিঙ্কর কালবিলম্ব করলেন না। শুরু হল দীঘি খননের কাজ।
মহাপ্রভু কিছুকাল অবস্থান করলেন গ্রামে। রামকিঙ্কর তাঁর নামপ্রচারে যাতে বিঘ্ন না ঘটে সেদিকে সদা সতর্ক। একদিন মহাপ্রভু বললেন “অন্নপুন্নের মন্দিরে দেবী স্বয়ং বিরাজ করছেন। এর কারণে তুমি বিরাট সম্পদের মালিক হবে। তবে জেনে রেখো কলহ বিবাদ দেবী সহ্য করেন না। “ রামকিঙ্কর বললে “আমাকে কী আজ্ঞা করেন বলুন। আমি তাই করব”। মৃদু হেসে ভগবান শ্রীচৈতন্য বললেন “কাটোয়ার কেশব ভারতীর কাছে আমি মন্ত্রদীক্ষা নিয়ে সন্ন্যাস ব্রত গ্রহণ করেছি। আমার প্রথম পত্নী লক্ষ্মীদেবীর সর্পাঘাতে মৃত্যু ঘটে। তারপর পিতার পারলৌকিক কর্মের কারণে আমি গযাতে যাই। পায়ে হাঁটা পথ। অনেক ঘটনাই ঘটে চোখের সামনে। রামকিঙ্কর মন দিয়ে শুনতে থাকে। মহাপ্রভু বলেন “বর্ধমানে পৌঁছাতেই এক বিশাল মহাজন আমাকে অতিথি রূপে বরণ করেন। তাঁর ছিল বিশাল অন্নপুন্নের মন্দির। সেসব ই আমার পূর্বজন্মের কথা। তবে আজ তোমার কাছে বলার প্রয়োজন হল”।
রামকিঙ্কর বলল “আমার শুনতে ইচ্ছা হচ্ছে। কী ঘটনার কথা বলতে চান আপনি”। মহাপ্রভু বললেন “ওই মহাজন প্রথম জীবনে ছিলেন একেবারেই দরিদ্র। সারাদিনের শেষে বিকেলবেলা শুধুই খিচুড়ি খেত। শোবার জন্য একটা খাটিয়া ছিল মাত্র। আর গায়ে দেবার একটা কাপড় ই ছিল তখন শীতকালীন পোশাক। আর মাছ মাংস এসবের স্বাদ জানতো না”।
চোখ বড় বড় করে রামকিঙ্কর বললে “তাহলে তার অবস্থার পরিবর্তন ঘটলো কী করে?” মহাপ্রভু বলে চলেছেন “অভাবের তাড়নাতে সে ঘুঁটে কুড়ানি হয়েছিল। আর মনে মনে মা অন্নপুন্নেকে স্মরণ করতো। তখন তার অর্থ সম্পদ ছিল না। তবে সুন্দর শুদ্ধ একটা অন্তঃকরণ ছিল। “
রামকিঙ্কর বললে “তারপর”? মহাপ্রভু বললেন “দেবী প্রসন্ন হলেন। একদিন ঘুঁটের বস্তা সোনার হয়ে গেল দেবীর কৃপাতে। এত সোনার ঘুঁটের মালিক হয়ে সে হয়েছিল মহাজন। তবে বেশিদিন তার এমন থাকল না। অহঙ্কার এল। অনেক রমণীতে আসক্ত হল। ব্যাস!দেবীও তার সঙ্গ ছাড়ল। “
রামকিঙ্কর বুঝতেই পারল প্রভুর এই গল্পের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী। মহাপ্রভু বললেন “অহম এর ঠাঁই নেই পৃথিবীতে। সমগ্র পৃথিবীর মানুষ তোমার কৃতিত্ব গ্রহণ করবে। কিন্তু তুমি ,তোমার এই নশ্বর দেহ পঞ্চভূতে বিলীন হবে। বলেই প্রভুর মুখ থেকে বেরিয়ে এল গুরুগম্ভীর মন্ত্র “ক্ষিতি অপ তেজ মরুত্ব্যোম/ পঞ্চভূত শুদ্ধ হও/পঞ্চভূতাত্মা কোটী সূর্য সম/উত্তিষ্ঠত জাগ্রত/উত্তিষ্ঠত জাগ্রত “।
বিরাট বিরাট দুটি দীঘি কাটতে কত মজুর এলো। বাড়ির পুরদিকে তিন একর জমিতে দুটো দীঘি খনন হচ্ছে। জনগণের কত আগ্রহ। আর জল কষ্ট থাকবে না। জায়গাটা রামকিঙ্কর দিয়েছিল। তার নামে জয় জয়কার পড়ল। এদিকে এত মজুর কে খাওয়ানোর দায়িত্ব নিলেন রামকিঙ্কর এর স্ত্রী। কিন্তু জমিদার বাধ সাধলে। বললে “আমি জমিদার নাকি ওই গোয়ালার পো জমিদার। সমস্ত প্রজাকে আমার কাজে যেতে হবে। এখন আমি হাতি শিকারে যাবো। গারো পাহাড়ের জঙ্গলে মালা বাঁধা হযেছে। প্রজাদের হাজির হতে হবে বেড় দেবার জন্য।
জমিদার এক অলিখিত নিষ্ঠুর আইন করেছে বটে। রক্ষক রক্ষা করে না। এই অঞ্চলের চাষের আর্ধেকের বেশি চলে যায় জমিদার বাড়িতে। পাইক বরকন্দাজ কত অত্যাচার যে করে তার ইয়ত্তা নেই।
জমিদার রূপকুমার জাতিতে ব্রাহ্মণ। বললেন “রামকিঙ্কর এর এত স্পর্ধা হয় কী করে? ও দীঘি আমার। আমার রাজত্বে কারো ট্যাঁ পোঁ করতে দেবো না। এই বলে রাখলুম”।
মহাপ্রভু চলে গেলেন নীলাচলের পথে। যাবার সময় চোখের জলে বিদায় দিলে রামকিঙ্কর। বললে ‘প্রভু! আপনার দেওয়া গুরুভার আমি কি সম্পন্ন করতে পারবো?” মহাপ্রভুর আজানুলম্বিত হাত জড়িয়ে ধরল রামকিঙ্কর কে। কী অপরূপ এক স্পর্শ রামকিঙ্কর কে যেন অমৃতের সন্ধান দিল। প্রভু বললেন “পৃথিবীর মঙ্গল কর্মে যাঁরা লিপ্ত তাদের প্রতিরোধ করতে কেউ পারবে না।” মহাপ্রভু বললেন “আমি দিব্যচক্ষুতে দেখতে পাচ্ছি রামকিঙ্কর দেবী অন্নপুন্নে তোমার গৃহে অধিষ্ঠান করছেন। এতদিন তিনি জমিদার রূপকুমার এর প্রতিষ্ঠিত মন্দিরেই অবস্থান করছিলেন।আমার একান্ত ইচ্ছা তুমি এই গ্রামের জমিদার হবে। আর গ্রামের নাম হবে জোড়াদীঘি।”” নব উদ্যমে দীঘি কাটার কাজে মাতলো রামকিঙ্কর। আর এই কাজে তার পরিবারের সবাই মেতে উঠল। তবে প্রবলের সাথে পেরে ওঠা খুব মুশকিল। জমিদারের তহশীলদার হাজির। এরা আবার আরও ভয়াবহ। কথাতেই আছে বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দর। চোখ রক্তবর্ণ করে বললে “দীঘির জন্য নতুন কর লাগবে। বাড়তি কর। “ রামকিঙ্কর চুপ করে রৈলো। তহশীলদার এই নীরবতাকে ভয় খেলে। বললে “আমি বেতন ভুক কর্মচারী। আমার আর কী ক্ষমতা। জমিদার বললেন যে সুলতানের টাকা দিলে তবেই জমিদারির রক্ষা। এখন সেটা প্রজাদের থেকেই আদায়ের কথা”। রামকিঙ্কর বললে “এটা মানুষ এর প্রয়োজন। এখানে নিয়ম খাটে না।” তহশীলদার বললে “এগারো লক্ষ টাকার জমিদার রূপকুমার। সে যখন দীঘি কাটতে পারলে না তখন তুমিও কী করে পারো ? তোমার ঘরে কত সম্পদ?”
কোনো কথা বলল না রামকিঙ্কর। শুধুই ঈশ্বর কে স্মরণ করলে। পরের দিন আবার শুরু হল দীঘি কাটার কাজ। গ্রামের কামারশালাতে তৈরি হচ্ছিল ধারাল মাটি কাটার কোদাল। রামকিঙ্কর সন্ধ্যার মুখে দীঘির ওখানে গেল। তখন সবাই কাজ সেরে বাড়ির দিকে। মনে মনে ভাবতে লাগল জোড়াদীঘি কাটার অনেক খরচ। শেষ রক্ষা কি সে করতে পারবে? সে সমৃদ্ধ গোয়ালা মাত্র।
এসব যখন চিন্তা করছে রামকিঙ্কর ঠিক তখনই একটা আশ্চর্য কান্ড ঘটল। একটা সুন্দরী ওই যেখানে দীঘি কাটা হচ্ছিল সেখানেই বসে আছে। বেশ ভদ্রঘরের কূলবধূ। হাতে শাঁখা পলা, মাথায় একমাথা সিঁদুর। পট্ট বস্ত্র পরে আছে। রামকিঙ্কর তার কাছে গিয়ে বলল “কে মা তুমি? এই তিন সন্ধ্যা এক হল। এই নির্জন স্থানে থেকো না মাগো। কখন যে কী বিপদ হয় কে বলতে পারে”?
মেয়েটা বললে “আমার এই জায়গাটা ভীষণ ভালো লাগছে। আমার বাড়িতে শান্তি নেই গো। বৃদ্ধ স্বামী। নেশাভান করে। বন্ধুদের কী ছিরি। সব ভূত একটা। বন্দ্যোপাধ্যায় বংশ। কিন্তু জানো। আমি ভীষণ ভালোবাসি সবাই কে। আমি চাই মানুষ মানুষের পাশে থাকুক। বাড়ি থেকে পালিয়ে ওই জমিদার বাড়িতে ছিলাম। তবে কী জানো। ওরা সাতখুনে জমিদার। “
রামকিঙ্কর ঘাড় নাড়ল। বললে “সাতখুনে জমিদার বটে। তবে কত খুন যে করে তার ইয়ত্তা নেই। খুব খতরনাক”। মেয়েটা বলল “সে আর বলতে! ওই যে মন্দির ওর নীচেতেও লাশ পোঁতা আছে। আমার ওসব পছন্দ নয় “। রামকিঙ্কর বললে “তুমি আজ আমার বাড়িতেই চলো গো মা। “মেয়েটা বলল “তোমার বাড়িতেই তো থাকব। আমি পরে কাশীতে চলে যাবো। ওখানে চৈত্র মাসের শুক্লা অষ্টমীতে বিরাট পুজো আছে”।
অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে দেখে বাড়ির দিকে আঙুল তুলে দেখাতে গেল রামকিঙ্কর। শুধুই ওইটুকু সময়ের ব্যবধান। তার মধ্যেই মেয়েটাকে আর দেখতে পেল না রামকিঙ্কর। কতবার চিৎকার করে ডাকল “মাগো!কোথায় গেলি!” কোনও উত্তর নেই। রহস্য বটে। এখানে ফাঁকা জায়গা। লুকিয়ে কোথায়। কিন্তু আশ্চর্যের উপর আশ্চর্যে। যে জায়গাতে মেয়েটা বসেছিল সেখানে প্রচুর গহনা। এত ভারী ভারী গহনা রামকিঙ্কর কখনও দেখে নি।
রামকিঙ্কর সমস্ত গহনা বাড়িতে আনলে। হিসাব করে দেখলে প্রায় পঁচিশ লক্ষ টাকার গহনা। কী যে করবে ভাবতে লাগল রামকিঙ্কর। কিন্তু স্বপ্নে দেবী অন্নপুন্নে বলল “বাছা। ও গহনা আমি তোমাকে দিলাম। জোড়াদীঘি খনন করো। আমি কাশীর অন্নপুন্নে। আর দীঘির ঈশান কোনে আমার মন্দির প্রতিষ্ঠা করো”।
রামকিঙ্কর ভাবলে দেবী প্রসন্না হয়েছেন। এখন জমিদার রূপকুমার কে ছাপিয়ে গেছে রামকিঙ্কর। তবুও রামকিঙ্কর কিছুই প্রকাশ করলে না। দীঘির কাজ চলতে লাগল জোরকদমে। জমিদার রূপকুমার যেভাবে শোষণ আর অত্যাচার করছেন প্রজাদের উপর তাতে প্রজাদের অসন্তোষ বাড়ছে। গারো পাহাড়ের গায়ে জঙ্গলে আগুন লাগিয়ে ফসল এনেছিল যারা তাদের অর্ধেক ধান কেটে নিলে জমিদার। সম্বৎসর খাবে কি? তবে অত্যাচার মাত্রা ছাড়াল যেদিন আতু মণ্ডল হাতিবেগার আইন অমান্য করলে। বললে “জমিদার রক্ষক হয়ে ভক্ষক। মাচাতে বসে থাকবে। একেবারেই নিরাপদ বেষ্টনীতে। আর মরতে মরব আমরা। “ জমিদারের কানে একথা পৌঁছাতেই রেগে টঙ। বলে “আসবে না ওর ঘাড় আসবে। কান টানলে মাথা আসে। নিয়ে আয় ওর ছেলেকে বেঁধে”।
আতু মণ্ডলের ছেলেকে ওরা বেঁধে নিয়ে গেল। জমিদারের করাল গ্রাস থেকে কারো মুক্তি নেই। ভীষণ জঙ্গল। সেখানে বেড় দিয়ে দাঁড়াল। কতটুকুই বা বয়স। এই সেদিন বিয়ে হয়েছে। অষ্টমঙ্গলা থেকে ঘুরে এসেই জমিদারের তলব। ছেলের নাম খগেন। বোঝদার ছেলে। বাপকে বললে “দশদিন এর ব্যাপার। ও ঠিক হয়ে যাবে। তুমি জমিদারের সাথে পারবে না কি!” জমিদার বহাল তবিয়তে আছে। খাদ্য রসদ সব মাচার মধ্যেই। সঙ্গে আনন্দ বিনোদন চলছে। আর অন্য দের সাথে জঙ্গলের মধ্যেই দাঁড়িয়ে আছে খগেন। নতুন বৌটার মুখখানা মনে পড়ছে। আসার সময় কত অভিমান। ঠোঁট ফুলিয়ে কান্না। গামছাতে বেঁধে দিয়েছে চালভাজা চিঁড়েভাজা। কতদিন পেটে ওদের ভাত পড়েনি। ওদিকে নিষ্ঠুর জমিদার গান্ডে পিন্ডে গিলছে। মানুষ না নররাক্ষস কে জানে?
সেদিন আকাশে মেঘ ঘিরে এলো। এমনিতেই জঙ্গলের মধ্যে অন্ধকার। কৃপণ আলো ।তার উপর আরও অন্ধকার হয়ে গেল ।পাশের দশহাত দূরে শুধুই দুদিকে দুটো মানুষের অবয়ব। হঠাৎই একটা যন্ত্রণা অনুভব করলো খগেন। পাতার মধ্য দিয়েই সরসর করে চলে যাচ্ছে প্রাণীটা। খগেন চিৎকার করে উঠল “আশু কাকা গো। আমাকে সাপে কেটেছে। আমি আর বাঁচবো না কাকা। খুব ভয় করছে আমার “। আশু মোড়ল আতুর খুড়তুতো ভাই। বললে “কোথায় সাপ দেখি”! আশু মোড়ল দেখলে দুধ খরিশ। এই পাহাড়ের মধ্যে দুর্যোগের রাতে কী করবে ভেবেই পেল না সে। লুঙ্গির প্রান্ত ছিঁড়ে বাঁধন দিলে তড়িঘড়ি। হায়!নির্জন পর্বত গাত্রে সেদিন খগেনের মৃত্যু হল। কেউ ভ্রূক্ষেপ করতেও পারলে না। জমিদার এর কাজ আগে। নধর একটা দেহ পড়ে আছে। জমিদার রূপকুমার যখন শুনল খগেন মরেছে তখন অট্ট হাস্য করে বললে “পুঁটি মাছের ছটফটানি থামবে”।
বিভিন্ন চাকলাতে খবর পৌঁছে গেল। আগুন জ্বলে উঠল প্রজাদের মধ্যে। আতু মোড়ল এর বিধবা পুত্রবধূ আছড়ে পড়লে খগেন এর শবের উপর। আর আড়াল থেকে আর একজন এই অনাচার দেখলে। সাধারণ একটা ভাগচাষী মরেছে। জমিদার বললেন “ওরা কে এমন। জন্মাবে মরবে। ওসব নিয়ে মাতামাতির আছে টা কী?” রামকিঙ্কর এর কাছে এসে প্রজারা ভেঙে পড়ল। অস্থির হল রামকিঙ্কর। বললে “যে জমিদার এমন করে মানুষ খুন করে তাকে হঠাতে হবে। আমি তোমাদের নিয়েই যাবো হোসেন শাহের দরবারে। গৌড়েশ্বর হোসেন শাহ প্রজাবৎসল”। মানুষের জীবনের আকাশেও কত মেঘ জমে। তারপর একদিন সব কেটে গিয়ে নতুন সূর্য উঁকি দেয়। জোড়াদীঘির প্রজাদের জীবনে কী ঘটবে তা হয়ত দেবী অন্নপুন্নে ই জানেন।
বন্ধুগণ! মধ্যযুগের অন্ধ কুসংস্কারে আচ্ছন্ন সমাজকে পটভূমি করে এই গল্পের অবতারণা। এটিকে মনগড়া গল্পের মান্যতা দিলে বাধিত হবো।
ভাগচাষীদের চাকলায় চাকলায় চলছে মিটিং। আতু মোড়ল, আশু মোড়ল ফুঁসছে। কিছুতেই আর তারা জঙ্গলের পথে যাবে না। ওরা শেষ দেখে ছাড়বে। এক আত্মা আজ। রামকিঙ্কর আজ সন্ধ্যার সময়ই আতুর চাকলাতে এল। কিন্তু অবাক হল এদের জীবন দেখে। কী নিদারুণ দুঃখ কষ্ট এদের। কখনও এই পল্লীতে আসাই হয় নি।
রামকিঙ্কর দেখলে ঘরে ঘরে কুপি জ্বলছে। বাচ্চাগুলো কাঁদছে। নিশ্চয়ই ওদের খিদে পেয়েছে। আর এক জায়গাতে দেখলে পুজো করছে কিছু মানুষ। কৌতুহল নিবৃত্ত করতে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল রামকিঙ্কর। সুলতান রাজা বাদশারা ইমারত গড়ছে। ইষ্টক প্রস্তরে খোদাই করে যাচ্ছে নিজেদের নাম। কিন্তু কাদের ঘাম,অশ্রু আর রক্ত মিশে আছে ওই বিশাল অট্টালিকার পিছনে। ?পৃথিবীর আগামী মানুষ জানতেও পারবে না।
পুজোতে বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে। তবুও রামকিঙ্কর এগিয়ে গেল। কুর্মাকৃতি দেবতা। রামকিঙ্কর বলল “এই দেবতার নাম কী? পুজোর নৈবেদ্য দেখে অবাক রামকিঙ্কর। বিভিন্ন পাত্রে মদ । এরা কত পিছিয়ে। অথচ এরাই মানুষের জাতভাই। শিক্ষা নেই। ভক্তি নেই। শুধুই বেঁচে থাকা। এদের মেরুদন্ড ভেঙে গেছে। কী নিদারুণ একটা সমাজ। মহাপ্রভুর কথা স্মরণে এল রামকিঙ্কর এর। হরিনাম তো অবলম্বন। ওর মধ্যে দিয়ে সমগ্র জাতিকে এক করতে চাওয়ার বাসনাটাই আসল উদ্দেশ্য।
আতু মোড়ল আর আশু মোড়ল কে সাথে নিয়েই রামকিঙ্কর গৌড়েশ্বর এর দরবারে যাবে। আর কেউ যদি যায় তবে বাধা দেবে না। এদিকে জমিদার রূপকুমার আইন জারি করেছে তার রাজত্বে অন্য কেউ দীঘি কাটতে পারবে না।
দীঘির কাজ স্থগিত রইল। তবে আর থেমে থেকে কাজ কী? ওরাও চলল হোসেন শাহের দরবারে। বেশ কিছু চাষী ওদের অনুগামী হল। রামকিঙ্কর বললে “জমিদারের কানে গেলে অত্যাচার তিনগুণ বাড়বে। অতএব এখন চুপচাপ থাকো সব। আগে কাজ হাসিল হোক। কিন্তু সেদিন যাওয়ার পথে পাহাড়ের নদী সোমেশ্বরীতে ঘটে গেল একটা ঘটনা। জঙ্গলের আড়ালে দাঁড়িয়ে ওরা দেখলে জমিদার রূপকুমার আর তার মোসায়েব রা একটা মেয়েকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারবে । রামকিঙ্কর দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে গেল যেন। ওরা ঢাক ঢোল বাজিয়ে নৃত্য করছে। আর মেয়েটাকে কনে সাজিয়ে এনেছে। তার পুনর্বার বিবাহ হবে যেন।
আনন্দে মদ গেলানো হয়েছে মেয়েটাকে। নেশায় বুঁদ হয়ে আছে মেয়েটা। তারপর বেশ কয়েকজন চিতার মধ্যে বেঁধে ফেললে মেয়েটাকে। আগুন টা দিতেই ঘটে গেল আজব ঘটনা। আতু মোড়ল এক নিমেষের মধ্যেই দিয়েছে চিতা ভেঙে। সব শুদ্ধ পড়েছে সোমেশ্বরী নদীতে। পাহাড়ের নদী এমনিতেই রেগে টঙ। সবশুদ্ধ কোথায় যে সব ভেসে গেল জমিদার টের পেলে না। আর রামকিঙ্কর এর দলে মেয়েটাও সঙ্গী হল।
নৃপতি তিলক হোসেন শাহ যখন সব শুনলেন তখন অস্থির হয়ে পড়লেন। হুকুম দিলেন “কেড়ে নেওয়া হোক রূপকুমার এর জমিদারী। হাতি বেগার বন্ধ আজ থেকে।নদীয়া নাগরের ইচ্ছা আমার ইচ্ছা। আজ থেকে জমিদার হল রামকিঙ্কর। প্রজারা তাকেই চায়”। সিকান্দার লোদীকে পরাজিত করে দশ হাজার সোনার প্লেট পেয়েছিলেন গৌড়েশ্বর। রামকিঙ্কর কে তার কয়েকটা দিলেন। আর বললেন “জোড়াদীঘি তে আর অভাব থাকবে না। দেবী অন্নপুন্নের মন্দির করো তোমরা। আমার কোনও আপত্তি নেই। আর রূপকুমার কে শূলে চরাবো আমি”।
জোড়াদীঘির মানুষ গুলোর কালরৃপ দুর্দশা দূর হল। দেবী অন্নপুন্নের আশীর্বাদ আর মহাপ্রভুর ইচ্ছা তে জোড়াদীঘিতে আজ আনন্দের বন্যা।