“অবশেষে আসা হল । কি বল?” অতীনের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে চারদিকটা দেখছিল উষ্ণীষ। বিতানপুর রাজবাড়ী। এক অদ্ভুত সুন্দর গণেশ মুর্তি আছে এদের। উচ্চতায় এক বিঘত। নিরেট সোনার। ডানদিকে শুঁড়। কপালে এক বিশাল সাইজের হীরে। শুঁড়ে চুনি, পান্না, প্রবাল , মুক্তো ইত্যাদি বসানো। চোখ দুটিতে অত্যন্ত মূল্যবান নীলকান্ত মনি। বহু প্রাচীন ইতিহাস আছে এই গণেশকে জড়িয়ে। দেখার ইচ্ছা বহুদিনের। এতদিন পর আসা হল। একটু পরেই ষষ্ঠীর বোধন শুরু হবে। এই একটা দিনই গণেশকে সবাই দর্শন করতে পারে। একচালার প্রতিমা। সবেকিয়ানার সঙ্গে আভিজাত্যের মেলবন্ধন। প্রতিমার সামনে নৈবেদ্য সাজাতে ব্যস্ত বাড়ির মহিলারা। চারদিকটা ঘুরে ঘুরে দেখছিল উষ্ণীষ। বাড়ির প্রায় ভেতরদিক ঘেঁসে একটা ছোট্ট জমায়েত। কথাবার্তা হচ্ছে। কিন্তু কোথাও একটা চাপা উত্তেজনাও যেন টের পেল। ফিরেই আসছিল। হঠাৎ একজনকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। “ দ্যাখ অতীন। আমাদের বিনোদ ঘোষাল না?” “কই? আরে ! তাই তো!” বিনোদ ওদের সঙ্গে স্কটিশে পড়ত। পুলিশে যোগ দিয়েছিল। অনেকদিন যোগাযোগ নেই। “ বিনোদ –” ডেকে ওঠে উষ্ণীষ। মুখ ফিরিয়ে তাকিয়েই উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে বিনোদ ঘোষাল। “ আরে উষ্ণীষ ! একেই বলে যোগাযোগ। তুই এখানে?” “ পুজো দেখতে এসেছি। তুই?” “ আমার তো এখন এখানেই পোস্টিং। আয় আয় আলাপ করিয়ে দি । ইনি হলেন সুবর্ণ রায় চৌধুরী। এই রাজপরিবারের বর্তমান অভিভাবক।এই হল রাজর্ষি। ওনার ছেলে। কলকাতায় ব্যাংকে চাকরি করে। আর সুবর্ণবাবু এই আমার বন্ধু। উষ্ণীষ চ্যাটার্জি। রহস্য সন্ধানী।ভাগ্যক্রমে আপনাদের এই বিপদের মুহূর্তে ও উপস্থিত।” “ কিসের বিপদ ?” “ আর বলিস না। এই পরিবারে একটা বিখ্যাত গণেশ মুর্তি আছে। সেটা —” “ যেটা কিছু মাস আগে কলকাতায় একজিবিশনে দেখানো হয়েছিল?” “ আপনি জানেন ?” বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করেন সুবর্ণ রায়চৌধুরী। “ অবশ্যই। ওটা দেখার জন্যই তো আমার আসা।” “ আর !” হতাশায় হাত ওল্টালেন ভদ্রলোক। “ সেই গণেশই চুরি হয়ে গেছে মিস্টার চ্যাটার্জি।” “ সেকি ! কবে ? কখন ?” “ আজ সকালে বোধন হবার আগে সিন্দুক থেকে বার করতে গিয়ে দেখি গণেশ নেই।” “ তারপর?” “ এর পরেরটুকু তোমাকেই করতে হবে বন্ধু। পুজো বাড়িতে পুলিশ দিয়ে খানা তল্লাশি করানো একটা বিশ্রী ব্যাপার। আমি শুধু বাড়িতে ঢোকা এবংবেরোনোর পথ বন্ধ রেখেছি।”বিনোদ ঘোষাল পাদপুরণ করে। “ কিন্তু আমি কাউকে চিনি না। এই অবস্থায় সকলে আমার সঙ্গে সহযোগিতা করবেন?” “ নিশ্চয় করবে। আপনি দয়া করে দায়িত্ব নিন।” হাত জোড় করেন সুবর্ণবাবু।“ রাজু — সকলকে জানিয়ে দাও ব্যাপারটা।” রাজর্ষি নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে প্রশ্ন শুরু করে উষ্ণীষ। “ আপনি শেষ কখন গণেশকে দেখেছেন ?” “ গতকাল রাত সাড়ে দশটা নাগাদ। শুতে যাবার আগে। ” “ রাতে কোন আওয়াজ বা কিছু কানে এসেছে?” “ না” “ গণেশ কোথায় ছিল ?” “ সারা বছর তো ব্যাংকের ভল্টে থাকে। এই পুজোর সময় আনা হয়। আমার সিন্দুকে থাকে।” “কবে আনা হয়েছে ?” “ পরশু। মানে শুক্রবার। শনিবার পঞ্চমী। ব্যাংক বন্ধ থাকবে। তাই –” “ কে কে জানত গণেশের কথা?” “ বাড়ির লোক সবাই।” “ বাড়িতে মেম্বার কতজন ?” “ আমরা স্বামী স্ত্রী। দুই ছেলে। রাজু কলকাতায় থাকে। ছোট ছেলে বিদেশে। আমার বিধবা বড় বোন। তার ছেলে। আমার স্ত্রীর দাদা আর তার মেয়ে। এছাড়া রান্নার বামুনদি, সবসময়ের লোক পরেশ আর শেফালি। ড্রাইভার ভুবন।” “ সিন্দুক কোথায় থাকে ?” “ আমার শোবার ঘরে। দোতলায়।” “ চলুন। সিন্দুকটা দেখা যাক।” উঠে দাঁড়ালো উষ্ণীষ। দোতলায় এক সারি ঘর। তারই একটায় সুবর্ণ রায়চৌধুরীর শোবার ঘর।ঠিক পালঙ্কের পাশেই রাখা সিন্দুক। সামনে গিয়ে দাঁড়ালো উষ্ণীষ। বেশ খুঁটিয়ে দেখল। বিশেষ করে চাবির গর্তটা। তারপর প্রশ্ন শুরু করল। “ চাবি কোথায় থাকত?” “ আমার পালঙ্কের গদির নিচে। ” “যখন সিন্দুক খুললেন চাবি কোথায় ছিল?” “ গদির নিচে।” “ এটা কে কে জানতো?” “ আমি, আমার স্ত্রী, ছেলেরা । এছাড়া আর কেউ জানত কিনা বলতে পারব না।” “ খুলুন সিন্দুক।” সুবর্ণবাবু বিনা বাক্যব্যয়ে সিন্দুক খুললেন। “কোথায় ছিল গণেশ?” “ এই। এইখানে।” আঙ্গুল দিয়ে জায়গা দেখলেন সুবর্ণবাবু। ভালো করে খুঁটিয়ে দেখল উষ্ণীষ। আর চোখের পলকে কি একটা তুলে নিয়ে পকেটে পুরলো। চাবির গোছাটাও একবার দেখল। সাধারণ বিশেষত্ব হীন বেশ কিছু চাবি একটি রুপোর রিং এ লাগানো। “ গণেশ এই জায়গায়ই রাখেন সব সময়?” “ না। তার কোন ঠিক নেই। কিন্তু সিন্দুকেই রাখি। ” ” হুম। আচ্ছা আপনার স্ত্রীকে পাঠিয়ে দিন। ।” “ কি তুললি রে?” সুবর্ণবাবু বেরোতেই প্রশ্ন করে অতীন। “ পরে বলছি।” “ নমস্কার। আমি রাজুর মা।” ভদ্রমহিলা সম্ভবত বাইরেই অপেক্ষা করছিলেন। “ নমস্কার। বসুন। আচ্ছা গণেশকে আপনি শেষ কখন দেখেন?” “ শুক্রবার সকালে । উনি ব্যাংক থেকে এসে আমাকে ঘরে ডাকলেন। আমি গদির তলা থেকে চাবি বের করে দিলাম। উনি গণেশকে রাখলেন। সেই দেখেছি।” “ওপরতলার কে কে থাকে?” “ আমরা দুজন আর ছেলেরা। বাকিরা সব নিচে।” “ আপনার কাজের লোকরা?” “ আমি দাঁড়িয়ে থেকে ঘর পরিষ্কার করাই।” “ ও। কাল রাতে আপনি কটায় শুতে এসেছিলেন?” “ সাড়ে বারোটা নাগাদ।” “ এসে ?” “ দরজা দিয়ে শুয়ে পড়লাম।” “ আচ্ছা। আপনি আসুন। রাজর্ষিকে একবার পাঠিয়ে দিন।” “ তার মানে রাত সাড়ে দশটা থেকে সাড়ে বারোটার মধ্যেই চুরি হয়েছে।” অতীন মন্তব্য করে। “ হুঁ। এবার দেখতে হবে ওই সময় কে কোথায় ছিল? ” “ আসুন রাজর্ষিবাবু।” অতীন কিছু বলতে যাচ্ছিল ।তার আগেই ডেকে ওঠে উষ্ণীষ। “ সকলকে ডেকে এসেছি। এক এক করে আসবে।” “ ধন্যবাদ। কাল রাত সাড়ে দশটা থেকে সাড়ে বারোটা পর্যন্ত আপনি কোথায় ছিলেন ?” “ আমি কাল রাতেই এসেছি। ক্লান্ত ছিলাম। সাড়ে নটায় খাওয়া দাওয়া শেষ করে ঘরে চলে আসি।” “ হুম। আপনি কোন ব্যাংকে আছেন ?” “ স্টেট ব্যাংক। এলগিন রোড।” “ শেষ কখন গণেশকে দেখেছেন ?” “ গত বছর। পুজোর সময়।” “ ও। এবার দেখেন নি?” “ না।” “ আপনি জানতেন চাবি কোথায় থাকে ?” “ জানতাম।” “ আর গণেশ ?” “ দ্বিতীয় তাকে দুটো মোটা খাতার মাঝখানে।” কয়েক মিনিট চুপ করে থাকে উষ্ণীষ। তারপর বলে “ আচ্ছা। আপনি আসুন।” এবার এলেন সমরেশ দত্ত। রাজর্ষির মামা। বেশ চোখে পড়ার মত মিল মামা ভাগ্নের চেহারায়। কিন্তু এর চোখের তলায় কালি। হাতের আঙুলে নিকোটিনের বাদামি ছোপ। চেহারায় ভাঙনের ছাপ স্পষ্ট। কথাবার্তাও চাঁছাছোলা। “ কি করেন আপনি?” “ ব্যবসা।” “ কিসের ?” “ এক্সপোর্ট ইমপোর্ট।” “ কতদিন এই বাড়িতে আছেন ?” “ প্রায় বাইশ বছর।” “ জানেন তো গণেশ চুরি হয়েছে ?” “ এইমাত্র জানলাম !” সপাট জবাব এল। “ আপনি এই ব্যাপারে কি জানেন ?” “ অত দামী জিনিস সিন্দুকে রেখে গদির তলায় চাবি রাখলে চুরি হবে না তো কি হবে? এতদিন হয় নি কেন এটাই আশ্চর্যের !” “ ও। আপনি জানতেন চাবি গদির তলায় থাকে? “ না। মানে সবাই আলোচনা করছে শুনেছি। ” একটু থমকে যান সমরেশ দত্ত। “ হুম। কাল রাতে সাড়ে দশটার পর কোথায় ছিলেন ?” “ ঘরে ।” “ আর আজ সকালে কখন উঠলেন?” “ এই তো । এখনও চা খাইনি।” “ যান। খেয়ে নিন।” একটু নিশ্চুপ তাকিয়ে থেকে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন সমরেশ দত্ত। “ লোকটাকে সন্দেহ হয় কিন্তু।” “ হুঁ। নেশা করে। মদ, সিগারেট।” উষ্ণীষের কথা শেষ হয় না। বাইরে থেকে ভীরু গলায় আওয়াজ আসে। “ আসব?” “ আসুন।” “ নমস্কার আমি শর্বরী দত্ত। রাজুদা বললেন –” “ হ্যাঁ। আমি ডেকেছি।” বছর কুড়ি বাইশের তরুণী। সুশ্রী। কিন্তু মুখে ভয়ের ছাপ। সমরেশ দত্তর মেয়ে। “ শর্বরী দেবী কাল সাড়ে দশটা থেকে সাড়ে বারোটা পর্যন্ত আপনি কোথায় ছিলেন ?” “ আমি পিসিমার সঙ্গে রান্নাঘরে ছিলাম। নাড়ু বানানো, আরো সব গোছগাছ। পিসিমা বললেন –” “ হুম। রান্নাঘরটা কোথায় ?” “ এই ঘরের উল্টোদিকে । একতলায়। ” সেখান থেকে থেকে এই দোতলার ঘর দেখা যায়?” “ বারান্দা দেখা যায়।” “ আর ঘরে কেউ ঢুকলে বেরোলে ?” “ বিশ্বাস করুন আমি দেখি নি কাউকে ঢুকতে। বারান্দায়ও কাউকে দেখিনি। ” “ হুম। কাল রাতে কখন শুতে গেলেন ?” “ পৌনে বারোটা হবে তখন।” “ আপনার বাবা তখন কোথায় ছিলেন ?” গুলির মত প্রশ্ন ছুঁড়ল উষ্ণীষ। “ বাবা ! আ — আমি জানি না। আমার ঘর আলাদা।” “ আচ্ছা। আপনি এখন যেতে পারেন।” “ মেয়েটা খুব ভয় পেয়েছে।” শর্বরী বেরিয়ে যেতেই মুখ খোলে অতীন। “হুম। সম্ভবত কাউকে আড়াল করতে চাইছে।” এবার এলেন মীনাক্ষী বসুরায়। সুবর্নবাবুর দিদি। আর সঙ্গে তার ছেলে সৌমাল্য। ঘিয়ে রঙা গরদের শাড়ি। কপালে চন্দনের টিপ। ছেলেটির বয়স চব্বিশ পঁচিশ। চোখে সতর্ক চাহনি। “ শুনেছেন তো গণেশ চুরি গেছে?” “ হ্যাঁ। কি কান্ড ! সিন্দুক থেকে চুরি !” “ কাল রাত সাড়ে দশটা থেকে সাড়ে বারোটা পর্যন্ত আপনি কোথায় ছিলেন?” “ আমি ঠাকুর দালানে ছিলাম। পুরোহিত মশাইয়ের সঙ্গে কথা বলছিলাম।তারপর এগারোটা নাগাদ শুতে চলে যাই।” “ রাতে কোন আওয়াজ বা কিছু শুনেছেন বা দেখেছেন ?” “ না সেরকম কিছু না। তবে —” “ তবে ?” “ বেশ গরম লাগছিল। উঠে জানালা খুলতে গিয়ে শর্বরীকে দেখলাম। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠছে।” “ বাজে কথা বল না তো ! শর্বরী তো তখন রান্নাঘরে !” রীতিমত প্রতিবাদ করে সৌমাল্য। “ আপনি কি করে জানলেন ? আপনি রান্নাঘরে ছিলেন?” দুম করে প্রশ্ন করে উষ্ণীষ। কেমন যেন ঘাবড়ে যায় ছেলেটা। তারপর বলে “ না। আমাকে বলেছে।” “ কখন?” “ কাল রাতেই।” “ ও। দেখা হয়েছিল?” “ ইয়ে। হ্যাঁ। মানে –” “ তুই ওর সঙ্গে দেখা করতে বেরিয়েছিলি রাত্রে?” ভর্ৎসনার চোখে তাকালেন মীনাক্ষী। মাথা নিচু করে সৌমাল্য। “ তখন ক’টা বাজে ?” “ সাড়ে এগারোটার পর ।” “ কাউকে দেখেছেন ওপরের বারান্দায় ?” “ না। মানে হ্যাঁ। কে একজন যেন চট করে সরে গেল।” “ কে?” “ না। ঠিক –” “ ভাল করে ভেবে দেখুন। আপনারা যদি সহযোগিতা না করেন এই রহস্যে্র কিনারা হবে না। ” “ আমি ঠিক জানিনা। ” “ জানেন। ভালো করে ভেবে বলুন। ” “ আমার ভুল হতে পারে। মনে হল যেন সমরেশবাবুকে দেখলাম। এক ঝলক। ভুল হতে পারে আমার।” “ ভুল কিসের ? নির্ঘাত ওই। লোভী, জুয়াড়ি।” চাপা রাগত সুরে বলে ওঠেন মীনাক্ষী। “ব্যবসা তো লাটে উঠেছে। বোনের ঘাড়ে বসে খাচ্ছে আর বাবুয়ানি করছে। আর মেয়েটাকে লেলিয়ে দিয়েছে আমার ছেলেটার পিছনে।” “ আহ্ ! মা ! থামো।” “ থামব কেন ? আপনি ওকেই ধরুন। ওই চুরি করেছে গণেশ।” “ আচ্ছা। আপনারা এবার আসুন।” “ ব্যাপার গুরুচরণ রে। মেয়েটা ছেলেটা প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।”অতীন মুখ খোলে আবার। “ হুম। কিন্তু সমরেশবাবু ! তাহলে চাবি ?” “ দরজা খোলা ছিল। ঢুকে চুরি করেছে।” “ হুম।” কি যেন ভাবছিল উষ্ণীষ। কয়েক পলক চেয়ে রইল। তারপর যেন ঘুম থেকে জেগে উঠে বলল, “ একটা কাজ কর বিনোদ। অতীনকে নিয়ে সবার ঘরগুলো সার্চ কর। আমাকে একটা জরুরী ফোন করতে হবে।এক্ষুনি আসছি। ” বলতে বলতেই দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ও। অবাক চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইল অতীন। দুই বোধনের আর মিনিট কুড়ি বাকি। উষ্ণীষ ফোন করে ফিরে এসে সবার ঘরে গিয়ে কি জানি কেন ছেলেদের ওয়ার্ডরোব হাতড়ালো তারপর রাাজর্ষিবাবুর ঘরে বসেই ডেকে পাঠালো সবাইকে।শেষে নাটকীয় ভাবে বক্তৃতা শুরু করল। “ এটা পরিষ্কার যে রাত সাড়ে দশটা থেকে সাড়ে বারোটার মধ্যে চুরি হয়েছে। কারণ সুবর্ণবাবু শেষ গণেশকে দেখেন সাড়ে দশটায় আর শ্রীময়ীদেবী সাড়ে বারোটায় ঘরে আসেন। মীনাক্ষী দেবী নিজের ঘরে ছিলেন। শর্বরীর রান্নাঘর থেকে ফেরার পথে সিঁড়ির কাছে দেখা হয় সৌমাল্যর সঙ্গে। তারা দুজনেই দোতলার বারান্দায় একজনকে দেখেন। “ কে?” স্খলিত কণ্ঠে উচ্চারণ করেন শ্রীময়ীদেবী। “ তিনি, যিনি সেই সময় একমাত্র ওপরে ছিলেন। যার পক্ষে সুবিধে ঘর থেকে চাবি নিয়ে গণেশ সরানোর। আর এই জিনিসটি যার।” সামনে হাত প্রসারিত করে উষ্ণীষ। “ এটা তো একটা জামার বোতাম।” “ হ্যাঁ। জামার হাতার বোতাম। লুজ ছিল সম্ভবত। চোর খেয়ালই করে নি কখন এটা খুলে পড়ে গেছে।” “ কার?” বিস্মিত চোখে চাইল অতীন। “ যিনি ইদানিং খুব টাকার সমস্যায় ভুগছেন। আর ভোগাটা স্বাভাবিক। রেসের মাঠে যেতে রেস্ত লাগে। তাই না রাজর্ষি বাবু?” “ কি বলছেন যা তা! কি প্রমাণ আছে আপনার কাছে?” “ এই যে আপনার জামার পকেট থেকে পাওয়া রেসের কাগজ আর আপনারই জামার হাতার বোতাম। শতানিক স্যান্যাল ? আপনার কলিগ তো। আমার কলেজের সহপাঠী। ।তার কাছ থেকেই শুনলাম। অফিসে সবার কাছে ধার করেছেন। আর এরকমও বলেছেন খুব শিগগিরই শোধ করে দেবেন। তো কিভাবে করবেন? গণেশটা বেচে?” “ how dare you?” দাঁত মুখ খিঁচিয়ে উষ্ণীষকে তেড়ে এলেন রাজর্ষি। কিন্তু মুহূর্তেই বাঁধা পড়ে গেলেন বিনোদ ঘোষালের শক্ত হাতে। “ কি প্রমাণ আছে আপনার কাছে? এত বড় কথা বলছেন আপনি?” “ নতুন কেউ সিন্দুক খুললে চাবির গর্তে ঘষার দাগ থাকতো। কারণ চাবি তার কাছে অজানা। এক্ষেত্রে সেটা ছিল না। সুবর্নবাবু বলেছেন তিনি গণেশকে প্রত্যেকবার জায়গা বদলে রাখতেন। এবারে কোথায় রেখেছেন সেটা একমাত্র তিনিই জানতেন। অথচ রাজর্ষিবাবু গড়গড় করে বলে দিলেন গণেশ কোথায় ছিল? কি করে? তিনি তো তখনও এ বাড়িতে এসেই পৌঁছোননি। আর লাস্ট বাট নট দ্য লিস্ট এই বোতাম। সকলের ঘর তল্লাশি করে এই ঘর থেকেই সেই জামাটি খুঁজে বার করেছি আমি যার হাতার বোতাম নেই। এই হল সেই জামা। ” “ উফ ! ভগবান !” দুহাতে মুখ ঢেকে ফেললেন শ্রীময়ী দেবী।। “ ছি: রাজর্ষিবাবু। নিজের বাড়ির এমন একটি জিনিষ সরিয়ে বিক্রি করে দেবার মতলব করছিলেন?” “ কিন্তু সৌমাল্য যে বললেন সমরেশবাবুকে ওপরে দেখেছে ?” “ ওইখানেই একটা চমৎকার গন্ডগোল। সমরেশবাবু এবং রাজর্ষি বাবুর চেহারায় এত মিল যে চট করে এক পলক দেখে ভুল হয়ে যায়। রাত্রি বেলা। তার ওপর দোতলার বারান্দা অন্ধকার। ওরা দুজনেই রাজর্ষিবাবুকেই দেখে সমরেশ বাবু বলে ভুল করেছে। পরে সকালে গণেশ চুরি হয়েছে জেনে শর্বরী ভয় পেয়েছিলেন।” আকস্মিক বাজ পড়ে পুড়ে যাওয়া গাছের মত দেখাচ্ছিল সুবর্ণবাবুকে। স্তম্ভিত। বাক্যহীন। সেদিকে তাকিয়ে দুঃখিত ভাবে ঘাড় নাড়ল উষ্ণীষ। “ এমন স্নেহময় বাবা , মা থাকতে এমন কাজ কেন করতে গেলেন? এখনও সময় আছে। ক্ষমা চেয়ে নিন। আর ভবিষ্যতে এই কাজ কখনো করবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করুন। সুটকেস খুলুন। মুক্ত করে দিন গণপতিকে। বোধনের আর সময় বাকি নেই। ” “কিন্তু তুই রাজর্ষিকেই সন্দেহ করলি কেন ? অতীন এতক্ষণে প্রশ্ন করার সুযোগ পায়। “ প্রথম কারণ সিন্দুকের চাবির গর্ত মসৃণ। অর্থাৎ চোর চাবি খুব ভালো করে চেনে। দ্বিতীয় কারণ একমাত্র রাজর্ষি বাবুই তখন পাশের ঘরে। তৃতীয় সমরেশ বাবু এবং তার ভাগ্নের চেহারায় আশ্চর্য মিল। আর শেষ কারণ শতানিককে ওর সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করতে জানালো ওর আজকাল টাকার খুব টান চলছে। আর শেষ হল জামার বোতাম। যার হাতের জামার বোতাম ছিঁড়েছে সেই চোর।” “ বোতাম সুবর্নবাবুরও হতে পারত। হয়ত রাখতে গিয়ে ছিঁড়েছে।” “ না। প্রথমত এরকম হাল ফ্যাশনের বোতাম সুবর্ণবাবু ব্যবহার করেন না। ওনার পোশাকের স্টাইল আলাদা। আর দ্বিতীয়ত বোতামটা সদ্য ছিঁড়েছে। আর সেটার গায়ে হালকা ডিওর গন্ধ। আজ এই ঘরে ঢুকতেই সেই গন্ধ পেয়েছি।” “ সুটকেসে আছে জানলি কি করে?” “ আন্দাজ। কেউ নিজের বাড়িতে এসে নিজের ঘরে সুটকেসে চাবি দিয়ে রাখে? কখন রাখে? যখন মূল্যবান কিছু থাকে। কই রাজর্ষিবাবু বার করুন।” “ আমি করছি।“ বলে লাফিয়ে উঠলেন সমরেশ। “ চাবি দে।” মাথা নিচু করেই পকেট থেকে চাবি বার করে দিলেন রাজর্ষি। স্যুটকেস খুলে জামা কাপড়ের ভাঁজ থেকে পলিথিন মোড়া গণেশ বার করতে মিনিট খানেকও লাগল না। প্যাকেট থেকে বার করে সামনের টেবিলের ওপর রাখতেই চোখ ঝলসে গেল যেন ! কি অনবদ্য শিল্প কলা ! নিরেট সোনার ওপর রত্ন খচিত অতি সুন্দর বিনায়ক মূর্তি । সৌন্দর্যের সঙ্গে ঐতিহ্যের এক অপরূপ মেল বন্ধন ! “ সিদ্ধিদাতা গণেশ। ” “ হ্যাঁ। অবশেষে কার্যসিদ্ধি। ”