হিমশীতল কান্না
মৌসুমী ঘোষাল চৌধুরী
একই পাড়ায় মৌশ্রী ও বিশুমাষ্টার থাকে। মৌশ্রীর সবে বিয়ে হয়েছে। ছোটো ছোটো ট্যাংরা মাছের ঝাল রান্না করে উল্টো দিকের বাড়িতে বিশুমাষ্টারের বাড়ির জন্য এক বাটি তুলে রাখে। পথেঘাটে টিউশনির পথে বিশুদার সাথে মৌশ্রীর
খানিকটা পথ হেঁটে যাওয়া ও চাকরি সংক্রান্ত নানা কথা অনুষঙ্গ। বিশুদার বয়স ত্রিশ পেরিয়ে গেছে। নিম্নবিত্ত ঘরের ছেলে। সরকারি চাকরি একসময় পাকা হয়ে যায়। হঠাৎই ভিতর মহল থেকে ঘুষ চাওয়া হয়। দিতে পারে না। দেওয়ার জন্য নৈতিকতা ও সামর্থ্য কোনোটাই নেই। বাবা, মা এবং একটি ছোটো ভাই ও বোন এই নিয়ে বিশুদাদের জমজমাট ক্রীসমাস ট্রী টা সাজানো। পৌষের সন্ধ্যায় বিশুদার মা পিঠে পুলি রাঁধে। নতুন বৌ মৌশ্রী তার বরের সাথে যায়। বিশুদার মা যেন কাঁচের পুতুল। দুধে আলতা রঙ। মুখখানা প্রস্ফুটিত পদ্মফুলের মত পবিত্র। কথায় কথায় মৌশ্রী জিগ্যেস করে, ” কাকিমা, বিশুদার বিয়ে দেবেন না? ” বিশুদা ফিক করে হাসে, ” না রে মা, বয়স তো গড়িয়েই যাচ্ছে। দু ছটাক জমি কিনেছি
সুভাষগ্রামে। এই সামনে ভীতপূজো। সবাইকে নিয়ে চলে যাবো বড় আশা। ” বিশুদার বড় ভাইটি বহু বছর ফেরারী। ছোটো বোনটি ও মায়ের মতই সুন্দরী। পুঁই তার ডাক নাম। পুঁইয়ের কোলে মাস তিনেকের ছেলে। ছোট্টো পুঁই এর যত্নের তুলনা হয় না। বিশুদাদের টালির ঘরে ফ্রীজের মাথায় যত্নে রাখা একটি বছর উনিশের তন্বী, সুশ্রী হলুদ শাড়ি জড়ানো মেয়ের ছবি। মৌশ্রী বলে ওঠে, ” কে গো, ভারি সুন্দর তো। ” বিশুদার বাবা ঘর থেকে আসতে করে বেরিয়ে গেল। বিশুদার মা বলে উঠল, ” এই ছোটো ছেলের সাথে আলাপ। বাড়িটা হলে বাপীনের সাথে বিয়ে দেবো। ছোটো ছেলে টাটা কোম্পানিতে কাজ করে। যদি প্রোমোশন হয়। দেখি দীনবন্ধুর কি ইচ্ছে ! ”
এরপর বহুদিন কেটে গেছে, মৌশ্রীর সেই নিশ্চিন্ত
নরম তুলোয় সাজানো সন্ধ্যার পৌষালী মেঘলা তরুচ্ছায়া আলাপন।
একদিন জানতে পারল, বিশুদার মা লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত। চলে ও গেলেন।
কিছু পায়রা ওড়ে ভোরবেলায় সামনের মসজিদে।
সবাই হয়ত সামলে উঠেছিল। ছোট্ট বাপীন পারে নি। এক বছরের মধ্যেই আত্মহত্যা করে চলে গেল।
শীতের সন্ধ্যা। কালো চাদরে নিজেকে মুড়ে বিশুদা থরথর কাঁপছে, তিরতির লোম খাঁড়া। অতি ক্ষীণ স্বরে বলে উঠল, ” মেয়েটা আমাদের ঘরের মত ই নিম্নবিত্ত। আহামরি কিছুই না। বিট্রে করল ভাইয়ের সাথে। আমি দু মিনিট আগে ঘরে ঢুকলে ও বাপীন বেঁচে যেত। গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহনন করেছে বাপীন। নিথর দেহ আর নিষ্পাপ বকুল ফুলের মত মুখটার দু চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া জলকণা।
হেঁটে যায় বিশুদা আজো। বিশুদার বাবা ও চলে গেলেন। দু হাতে বাবার সেবা করেছিল। ফেরারী
দাদা ফিরেছে। ইঁট পেতে বিশুদা রাঁধে। দলবদ্ধ
ভাবে ছাত্রছাত্রীরা পড়তে আসে।
হিমশীতল হয়ে আসছে পৌষ সংক্রান্তির গঙ্গা স্নান।
মৌশ্রীর সাথে পথে দেখা হঠাৎ। ” সুভাষগ্রামের
বাড়িটার ছাদের ঢালটা আজো ভঙ্গুর। জল জমে রাস্তায়। ছোটো বোনের ছেলের জন্য এটুকুই গোছাতে পেরেছি। করোনায় মৃত্যুর সাথে লড়াই ও করেছি। ” অম্লান হাসি মুখে জারুল ফুলের মত মুখাবয়বে সমুদ্র চোখ নিয়ে মৃত্যুর কাছাকাছি হেঁটে যায় বিশুদা। অনেকটা পথ। হয়ত পিছুটান আছে।
অশ্লেষা নক্ষত্রটি জ্বলজ্বল করে ওঠে।
—oooXXooo—