প্রেতিনী
*********
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
এ নদীর বুকেতে জল নেই। কবেই ধূ ধূ চরা পড়ে গেছে। আর সেই নিষ্প্রাণ ভূমিতলটি ভাসছে এক মায়াবী জ্যোৎস্নায়।সাদাটে বালির ওপর এই চাঁদের আলো নেশা ধরিয়ে দেয়।
নদীর একপাশে শ্মশান আর রঙ্কিনী দেবীর মন্দির। মাধু পাগলী তারই একপাশে কাঠ কুটো গুঁজে ঝোপড়া বেঁধে থাকে। মাধু যে ঠিক কবে থেকে এখানে ঠাঁই নিয়েছে তার কোনও খোঁজ ইদানীংকার কোনো মানুষের জানা নেই।
একমাথা রুক্ষচুলের অযত্নলালিত জটা, তেলতেলে মুখখানিতে চোখদুটি বাঘিনীর মত সর্বদা জ্বলন্ত থাকে তার সাথে কপালে দগদগে সিঁদূর লেপা। বেশীক্ষণ চেয়ে দেখলে ভয় হয়।
মাধু’কে ভয়ে হোক কিংবা ভক্তিতে গাঁয়ের লোকে সিধে সাজিয়ে দিয়ে যায়। যদিও তার ওসবে কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। চোখ বুজে বিড়বিড় করে কিসব বকছে দিনরাত। গত আষাঢ়ে অম্বুবাচীর সময় গাঁয়ের মোড়ল নিবারণ চাকলাদারের স্ত্রী নিত্যবালা মায়ের মন্দিরে বংশধর কামনায় গেরো বেঁধেছিলেন। চৈত্রের শেষভাগে তাঁর পুত্রবধুটির পুত্রসন্তানের জন্ম দেওয়ায় তিনি পয়লা বোশেখের দিনে নিজের হাতে চাল আর ফল মিষ্টির সিধের সাথে চওড়া লাল পাড়ের কাপড় একখানা মাধু’র জন্য পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। খেপী এদ্দিন ধরে ওখানাই পড়ছে বলে তা ময়লা হয়ে গেছে, স্থানে স্থানে ফেঁসেও গেছে খানিক। তবুও সে আলুথালু করে ওখানাই কেন জানি গায়ে জড়িয়ে রাখে।
আরো দু একখানা কাপড় ব্রত -পূজোয় ওকে বউ ঝি রা দিয়ে গেছে। সেগুলো মোটেও ছোঁয় না মাধু।
প্রত্যেক অমাবস্যায় মাধুর ভর হয়। তখন সে হঠাৎ হঠাৎ করে যাকে যা বলে ওঠে তা বেশ ফলে টলে যায়। ওই দিনটায় মাধু গাঁয়ের সকলের একটা দ্রষ্টব্য হয়ে ওঠে। জলপড়া আর মাদুলির জন্য যেমন লোকে এসে হত্যে দেয় আবার স্থানীয় দু’একজন ফড়ে শ্রেণীর মাতব্বরও হঠাৎ এসে ঠিক জুটে যায়।
আসলে ফেঁসে যাওয়া কাপড়ের আড়াল থেকে তারা উঁকি মেরে দেখে মাধু’র ফলন্ত পুষ্ট যৌবনটাকে। সেটা তাদের চোখে গোলাপী নেশা ধরায়। মাধু পাগলী হলেও তার দেহে এখনো সূর্যাস্ত নামেনি।
নন্দ পাটোয়ারী আঙুল দিয়ে একটা অশ্লীল ইঙ্গিত করে নিতাই এর দিকে আর বলে
– ” নিতে, দ্যাক দ্যাক মাগী গায়ের কাপড় সামলাতে পারতেছে না রে ! যৌবন কেমনি ফাঁক দ্যে ঝন্না হয়ে ঝরে পর্ছে!”
হ্যা হ্যা করে হাসতে হাসতে নিতাই বলে ওঠে
– “দাঁড়াও তো খুড়ো! রেতের বেলা ধুতরো খাইয়ে এক দিন চরেই ওকে…..”
নিতাই এর কথা শেষ হয়না, মাধু জ্বলন্ত চোখে ওদের দিকে একবার চেয়ে থাকে।
তারপর তারস্বরে চিৎকার করে ওঠে,
– ” ওই গু-খোর দের বাচ্চাগুলোর মরণ হয়না ক্যানে ! সব আঁটকুড়ির ব্যাটাদের সব্বোনাশ হবে গো এবার….”
আচম্বিতে টলোমলো পায়ে এবার উঠে দাঁড়ায় মাধু। ছেঁড়া আঁচলটা খসে পড়েছে গা থেকে। অযত্নলালিত হলদেটে জটার ভার ছড়িয়ে পড়েছে পিঠ জুড়ে। টলতে টলতে সে নিজের ঝুপড়ির ভিতর চলে যায়। যেতে যেতে খালি বিড়বিড় করে আর থুঃ থুঃ করে থুতু ছেটায় চারপাশে।
বাগদী পাড়ার লক্ষ্মীমণি হাতের চুবড়িতে কটা চাঁপা কলা এনেছিল। খানিক পরে ভয়ে ভয়ে সেটা মাধুর ঝোপড়ার কাছে সেটা নামিয়ে রাখতে রাখতে আক্ষেপের গলায় বলে ওঠে
– ” আজ পাগলী খেপেছে। এ বেলা আর কিছু মুকে তুলবেনি। পাগলী মানুষ, যা হোক! আহা রে তাই বলে রাত উপোসী থাকবে!কটা কলা রেখে গ্যালাম মা ইচ্ছে হলে সেবা কোরো…”
———————————————————–
রাত তখন গভীর। মায়াবী জ্যোৎস্না এসে চর ধুয়ে বয়ে যাচ্ছে নদীর মত। মাধু চুপিচুপি ঝোপড়া থেকে বের হয়ে আসে। তার পরণের কাপড়টি খসতে খসতে সাপের খোলসের মত বালির ওপর একসময় কুন্ডলী পাকিয়ে পড়ে থাকে। একটু হাওয়া দিচ্ছে আজ। মাধু উলঙ্গিনী হয়ে ধপ্ করে চরায় উবু হয়ে বসে পড়ে।
হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে হু হু করে সে কাঁদতে থাকে। সেই তীব্র কান্নার আওয়াজ প্রেতিনীর ডাকের মত নিঝুম রাত্রিতে নদীর চরে ফুকরে ওঠে। কান্নার সময় তার মনে পড়ে যেতে থাকে তাকে উপুড় করে কাছারি ঘরে কাঠের পাটাতনের ওপর শুইয়ে তার সাত মাসের গর্ভস্ফীত পেটের ওপর লাঠিয়াল কুঞ্জ মোটা রায়বেঁশে লাঠিটা ডলছে। মাধু’ র হাত পা পিছমোড়া করে বাঁধা আর মুখে ন্যাকড়া গোঁজা। লম্পট জমিদার নবকান্ত রায়ের পাপের বীজটিকে আর পৃথিবীর আলো দেখতে দেওয়া যাবেনা। নিস্তেজ হতে হতে ক্রমশ শরীর ছেড়ে দিচ্ছে। তলপেটে অসহ্য যন্ত্রণা আর রক্তে ভাসতে ভাসতে মাধু’র চেতনা লুপ্ত হচ্ছে ক্রমশ….
তারপর এই রকমই এক মায়াবী জ্যোৎস্নার রাতে নদীর চরে কেয়াঝোপ থেকে তাকে মৃতপ্রায় অবস্থায় একসময় উদ্ধার করেন মন্দিরের বৃদ্ধ পুরোহিত আগমবাগীশ মহাশয়।
কাছেই বলিদানের জন্য আনা পাঁঠাদের বেঁধে রাখার একটা ঝোপড়ায় তিনি পাঁজকোলা করে আস্তে আস্তে তুলে নিয়ে যান মাধু’কে। এরপর পিতৃস্নেহে তিনি ভেষজ ওষধি প্রয়োগ করে একরকম লোকচক্ষুর আড়ালেই ধীরে ধীরে সুস্থ করে তোলেন মাধুকে। কিন্তু মাধু প্রাণে বাঁচলেও মাথাটা খারাপ হয়ে যায়। তখন থেকেই সময়ে খাওয়া দাওয়া করেনা, উদভ্রান্ত হয়ে কখনো সখনো আবার কখনো তার পরণের কাপড়টাও……
মাধু তার সেই মরা বাচ্চাটার জন্য কেবল কেঁদে কেঁদে ঘুরে বেড়ায়….নিয়ম করে মাঝরাত্তিরের পর উলঙ্গিনী পাগলী রাতের অন্ধকারে ভয়াল প্রেতের মত নদীর চরে উবু হয়ে কাঁদতে বসে।
————————————–
বালির মধ্যে কাঠি দিয়ে একটা গর্ত খোঁড়ে মাধু। আবার সেটাকে বালি দিয়ে ভরাট করতে করতে তার মৃত সন্তানটির শেষশয্যাকে কল্পনা করে ঝরঝর করে আবার কেঁদে ওঠে।
তার সারা গায়ে এখন ধূলোমাখা। যারা ওর পেটের বাচ্চাটাকে বাঁচতে দেয়নি, আজও তাদেরকে মাথা খুঁড়ে শাপমন্যি করে, গাল পাড়ে।
কুঁই কুঁই একটা ডাকে মাধুর সম্বিৎ ফেরে। শ্মশানের একধারে একটা কালো কুকুর তিনটে বাচ্চা দিয়েছে। তারই একটা কখন চলতে চলতে মাধুর কাছে এসে ডাকছে। সে চঞ্চল চোখে শাবকটিকে দেখে একবার। মুহূর্তে তাকে কোলে তুলে নেয় চারপাশে চোখ বোলাতে বোলাতে।
কেউ নিশ্চয় দেখতে পাচ্ছেনা তাকে!
মাধু পাগলীর উলঙ্গ বুকের বৃন্তটাকে কুকুরছানাটা মুখ দিয়ে একবার ঢুঁ মারে। সে তার কোলের মধ্যে উসখুস করে আচমকা এভাবে চেপে ধরার জন্য।
খলখল শব্দে এবার পাগলী হেসে ওঠে। জ্যোৎস্নার মায়াবী আলোয় তার ধূসর নারীদেহ সঞ্জীবিত হয়ে ওঠে হঠাৎ। একছুটে ছানাটাকে নিয়ে সে ঝোপড়ার ভিতরে ঢুকে যায়। অজস্র চুমোয় সে কুকুরছানাটাকে আদরে ভরিয়ে দিতে থাকে। আর সেই শাবকটিও তার ক্ষুদ্রকায় বন্য স্পর্শের উষ্ণ ওম ছড়িয়ে দেয় মাধু পাগলীর বাহুমূলে….. গলায়….স্তনসন্ধিতে…..
এরপর তিন প্রহরে চাঁদ অস্ত গেলে নিকষ অন্ধকার চরের চারপাশটাকে একসময় আদিম দিগন্তে মিশিয়ে দেয়।
তখনো মাধু পাগলীর ঝোপড়ার ভিতর থেকে চাপা হাসিকান্নার গোঙানির সাথে একটি মনুষ্যেতর ক্ষুদ্রকায় প্রাণীর ডাক মিলে গিয়ে এক অনিবর্চনীয় পরিবেশ সৃষ্টির নেশায় মেতে উঠে চরাচর বিদীর্ণ করে এক অস্ফূট শব্দে।
—oooXXooo—
প্রতিনী গল্পটি প্রতিভা সরকারের লেখা। শ্যামাবাবু প্রকাশ্যে ক্ষমা চান