তিস্তা পারের রহস্য (আন্তিম পর্ব)
সলিল চক্রবর্ত্তী
বৃদ্ধা লক্ষ্মী ছেত্রি কপালে হাত দিয়ে মহা বিস্ময়ে বলে ওঠেন- “হা ভগবান সাধুবাবা আপনার জ্যাঠামশাই ছিলেন!!” অরুন রায় কৃতজ্ঞ চিত্তে করজোড়ে বৃদ্ধাকে বললেন-“আপনি অজান্তে আমার যে কতোবড় উপকার করলেন সেটা আমি আপনাকে বোঝাতে পারব না। জ্যেঠিমা যখন শয্যাশায়ী, মৃত্যু পথযাত্রী, একবার জ্যাঠামশাইকে চোখের দেখা দেখবেন বলে ঈশ্বরের কাছে আকুল প্রার্থনা করছেন,তখন আমরা জ্যাঠামশাইকে হন্নে হয়ে খুঁজে বেড়িয়েছি, কিন্তু কোথাও তাঁর খোঁজ পাইনি। আজ মেঘ না চাইতে বৃষ্টি পাওয়ার মত—–। “অরুন রায়ের কথা শেষ করতে না দিয়ে বৃদ্ধাও করুন অনুরোধে অরুন রায়কে বললেন-” বাবু, সাধুবাবার জিনিসপত্র গুলো আপনি নিয়ে যান, আর কোলকাতায় ফিরে ওনার শ্রাদ্ধ শান্তির ব্যবস্থা করুন।”
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, এমতাবস্থায় অরুণ রায় বাসায় না ফেরায় বাড়িতে সবাই চিন্তায় পড়ে গেল। তৃষা ও সুশোভন বেরিয়ে পড়লো অরুণ রায়কে খুঁজতে।
বেশিদূর যেতে হল না, ফ্ল্যাট থেকে নেমে পূর্ব দিকে অগ্রসর হতেই ওরা দেখে তিস্তা নদীর পার ধরে অরুণ রায় শম্বুক গতিতে বাড়ির দিকে ফিরছেন। কাছে যেতেই তৃষা সুশোভন অবাক হয়ে যায়। উস্কোখুস্কো চেহারা, অবিন্যস্ত মাথার চুল গুলো। হাতে একটা মলিন পুরানো পেটমোটা কাপড়ের ঝোলা। মনে হচ্ছে, একরাশ চিন্তা মাথায় নিয়ে দুর্বল শরীরে বাসায় ফিরছেন। তৃষা অবাক হয়ে বলে, ” সেই দুপুরে বেরিয়েছ, কোথায় গিয়েছিলে? আর হাতেই বা কী এ-সব?” অরুণ রায় ধীরস্থির ভাবে শুধু বললেন, ” বাসায় চল সব বলবো।”
চা পান করতে করতে জামাই, কন্যা স্ত্রীর সাথে জ্যাঠামশাই এর গৃহত্যাগ থেকে আজ পর্যন্ত সমস্ত ঘটনা আদ্যোপান্ত বর্ণনা করলেন। তৃষার ভীষণ ভুতের ভয়, ভয়ার্ত চোখে একমুখ বিস্ময় নিয়ে বলেই ফেলল, ” এ-তো ভৌতিক রহস্য উপন্যাস!” তৃষার মুখের কথা শেষ হতে না হতেই অরুন রায়ের মুখ থেকে আলটপকা বেরিয়ে গেল, ” হ্যাঁ, যবনিকাপতনটাই বাকি থেকে গেল।”
রাত হয়েছে, সুশোভনের আবার আগামী কাল মর্নিং শিফটে ডিউটি। হালকা শিতের আমেজ, চাদর মুড়ি দিয়ে সবাই শুয়ে পড়লো।
অরুণ রায় চোখ বন্ধ করে শুয়েই আছেন। ক্লান্ত শরীর, দুপুরে বিশ্রাম হয়নি তবুও চোখে ঘুম নেই। পাশেই অর্ধাঙ্গিনীর নাসিকা গর্জন, তাঁর হিংসার উদ্বেগ হওয়াই স্বাভাবিক। ঘুম আসবে কি করে, স্মৃতির ঘনঘটায় অরুন রায়ের মস্তিষ্ক জর্জরিত। মনে পড়ছে ষাটোর্ব্ধ জ্যাঠামশায়ের মুখখানা। অরুন রায় তখন বছর পঁচিশের উদ্যমী তরতাজা তরুণ। লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে চাকরীর খোঁজ খবরে আছেন। জ্যাঠামশাই তাঁকে বললেন,” দ্যাখো অরুন, আমি চাকরি করি ঠিকই তবে পছন্দ করি না। আমি পরাধীন, ইচ্ছের বিরুদ্ধচারী হয়ে অনৈতিকতার পক্ষপাতিত্ব করতে হয়, কারন ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষের নির্দেশ অমান্য করা যায় না। নিজের শিক্ষা, মনুষ্যত্ব, কর্তব্য, দায়বদ্ধতার কোনো মূল্য থাকে না। কিন্তু ব্যবসা স্বাধীন, তোমার শিক্ষা, দীক্ষা, চরিত্র দিয়ে গড়ে উঠবে একটা স্বাধীন স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। সেখানে তুমিই এক এবং অদ্বিতীয়ম। চোখ ভরা স্বপ্ন দেখেও অনভিজ্ঞ অরুন রায় আমতাআমতা করে বলেছিলেন, ” কিন্তু জ্যাঠামশাই সে তো অনেক অর্থের প্রয়োজন!! ” জ্যাঠামশাই অরুন রায়ের পিঠ চাপড়ে স্বচ্ছন্দে হেঁসে বলেছিলেন,”লাগুক অর্থ,আমি দেব। তোমার অন্তর থেকে ইচ্ছা শক্তিটাকে প্রকট কর। নিজের শরীরটাকে যেমন ভালোবাসো, তেমন ব্যবসাকেও অভিন্ন হৃদয় মনে করবে।”
সেদিনের জ্যাঠামশায়ের দেওয়া পঞ্চাশ হাজার টাকা আর্শীবাদ হয়ে আজ পঞ্চাশ লাখ পার হয়ে গেছে। পিঠ চাপড়ে যে আর্শীবাদ নামক শক্তিটা চারাগাছের মতো জ্যাঠামশাই রোপন করে গেছেন, আজ তা মহীরুহে পরিনত হয়েছে। যার ফল খেয়ে অরুন রায় ছাড়া আরো পাঁচটা মানুষ বেঁচেবর্তে আছে। তিনি ব্যবসায়ী না হয়েও একটা মন্ত্র অরুণ রায়ের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকিয়ে দিয়ে বলেছিলেন- “সুচিন্তিত সৎ ব্যবসায়ীকে মনে রাখতে হবে, খরিদ্দার ব্যবসার লক্ষ্মী নয়, তারা সুবিধা ভোগী, যেখানে সুবিধা পাবে সেখানে গিয়ে ভীড় করবে। মহাজন হল ব্যবসার লক্ষ্মী, তাঁর অর্থেই প্রতিষ্ঠানর সমৃদ্ধি প্রাপ্তি হয়। তাঁর সাথে আর্থিক লেনদেন ঠিকঠাক থাকলে কখনোই পিছন ফিরে তাকাতে হয় না। ” এই মন্ত্রেই অরুন রায় আজ এতদুর আসতে পেরেছেন।
ঠক্, ঠক্, ঠক্ শব্দে দরজার কড়া নড়ল। কেউ এলো মনে হয়, অরুন রায় দরজা খুলে বাইরে এলেন। কেউ নয়তো, হয়ত কুকুরটা। রাতের অন্ধকার সবেমাত্র কেটেছে। অরুণ রায় দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে ফ্লাট থেকে নিচে নেমে এলেন।
এখনো লোকজন ওঠেনি। একটা “কলকল” শব্দ কানে আসছে, রঙ্গিত নদীর জল পাথরে ধাক্কা খেতে-খেতে প্রবাহিত হচ্ছে তিস্তা নদীর দিকে, এ শব্দ তারই। নির্মল পরিবেশে ‘কলকল’ শব্দের ভেতর যেন একটা মায়াবী ডাক আছে। সেই ডাকের টানে অরুন রায় গুটি- গুটি পায়ে এগিয়ে গেলেন রঙ্গিত নদীর পারে। ওখানে গিয়ে দেখেন, পূর্বদিকে যে রাস্তাটা তিস্তা নদীর দিকে চলে গেছে তার কিছুটা দূরে সেই লোমশ কুকুরটা তাঁর দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। তাকানোর ধরনটা যেন তাঁকে ডাকছে। অরুণ রায় লোমশ কুকুরটাকে অনুসরণ করে তিস্তা নদীর মোহনার দিকে এগুতে থাকেন। মোহনার কাছাকাছি গিয়ে দেখেন, একজন সাধুবাবা পাথরের উপরে পদ্মাসনে বসে ধ্যান করছেন। কিন্তু কুকুরটিকে আর দেখা যাচ্ছে না। সাধু বাবাকে দেখার সাথে সাথেই কুকুরটি কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেল। যাইহোক, সাধু বাবার কাছাকাছি আসতেই অরুন রায় চমকে উঠলেন। দেখেন গৃহ ত্যাগের সময় জ্যাঠামশাই শারীরিক ভাবে যেমন ছিলেন, ঠিক তেমনই বিস্ময়কর রূপে ধ্যান মগ্ন। অরুন রায় রীতিমতো বিস্মিত হয়ে বললন, ” জ্যা-ঠা-ম-শা-ই, আ-প-নি!!” জ্যাঠামশাই বন্ধ চোখ মেলে বললেন,” অরুন এসেছিস! আমি কতদিন থেকে তোকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। “
অরুন রায় রীতিমতো অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন—“আপনি এখানে থাকেন জ্যাঠামশাই?”
অর্ধ মেলিত নয়নে সাধুবাবা বলেন- “একমাত্র এখানেই তা নয়,হিমালয়ের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াই।”
অরুন রায় জ্যাঠামশায়ের পঞ্চান্ন ঊর্ধ্বের বয়স দেখে অবাক হয়ে আমতাআমতা করে বললেন-” কিন্তু আপনার তো অনেক বয়স—-!!!”
সাধুবাবা এবার চোখ সম্পূর্ণ মেলে অরুন রায়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেঁসে বললেন-“দেখে সেটা মনে হচ্ছে না তো? সব যোগতন্ত্র সাধনা’র ফল। আমি যোগ সাধনার দ্বারা বয়সকে বেঁধে ফেলতে পারি। যাক ওসব কথা, তোমার ব্যবসা কেমন চলছে?”
—- আপনার আর্শীবাদে ভালই, যে মন্ত্রবলে আপনি আমাকে দীক্ষিত করেছিলেন তার হাত ধরেই আজ আমার মান, সন্মান, অর্থ, প্রতিপত্তি। কিন্তু জ্যাঠামশাই, আপনি বাড়িতে যাবেন না? জেঠিমা আপনার ফেরার অপেক্ষায় থেকে থেকে এক সময় নিজেই পরপারে পাড়ি দিলেন।”
—- জানি, আমার সেই পাপের জন্যেই তো তার কাছে যাওয়া হচ্ছে না। তবে, আমার কিছু দায়বদ্ধতা আছে, যেটা এখনো সমাধান করে উঠতে পারিনি। তোমার সহায়তায় সমাধান করেই ফিরব। তোমার সাথে আমার অনেক কথা আছে।
—- নিশ্চই, বলুন?
—-বলব, কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্য উদয় হবে। সেই সন্ধিক্ষণে আমি তিস্তা রঙ্গিত নদীর সঙ্গমস্থলে তিনটি ডুব দিয়ে এসে তারপর। সাধুবাবা উঠে দাঁড়িয়ে কাঁধের ঝোলা, হাতের কমণ্ডলু, ত্রিশলাযুক্ত লৌহদণ্ডটি পাথরের উপর রাখলেন। অরুন রায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে এগিয়ে এসে বললেন-“আমি জিনিস পত্রগুলো ধরবো জ্যাঠামশাই? “
—-না,না,তার প্রয়োজন হবে না, এসব ছোটখাটো কাজে আমি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। তুমি শুধু একটু অপেক্ষা কর, আমি অতি সত্তর তিনটি ডুব দিয়ে আসি।”
সাধুবাবা ছোটো ছোটো পাথরের বাধা অতিক্রম করে রঙ্গিত ও তিস্তা নদীর সঙ্গম স্থলের দিকে এগিয়ে চলেছেন।
অরুন রায় সুউচ্চ সবুজ বনানীতে আবৃত পর্বত শৃঙ্গের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বালক ভানু তার আলোর কণা ছড়িয়ে উদিত হবে। সেই রশ্মী পর্বত শৃঙ্গের সাথে আলিঙ্গন সেরে এসে পড়বে ধরণীর বুকে।
সূর্য,পাহাড় শৃঙ্গের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারতেই ধরণীতলের রূপ বদলে গেল। সাধুবাবাও ত্বরিত গতিতে সঙ্গম স্থলে নেমে পড়লেন ডুব দেওয়ার নিমিত্তে। অক্ষি পল্লব পড়তে না পড়তেই অরুন রায় দেখতে পেলেন জ্যাঠামশাই তিস্তার চোরা স্রোতে তলিয়ে যাচ্ছেন, এবং অরুন রায়ের সাহায্য প্রার্থী হয়ে চিৎকার করে বলছেন-” অরুন আমাকে বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও, আমার মোক্ষলাভ যে এখনো পূর্ণ হয়নি।” অরুন রায়ও ছুটে সঙ্গম স্থলের দিকে যেতে যেতে চিৎকার করে বলতে থাকে -” আমি আসছি জ্যাঠামশাই, আমি আসছি।”
‘জ্যাঠামশাই’, ‘জ্যাঠামশাই’ চিৎকারে বন্দনা রায়ের আচমকা ঘুম ভেঙে যায়। দেখেন শবাসনে ঘুমন্ত অবস্থায় অরুন রায় জ্যাঠামশাই, জ্যাঠামশাই বলে চিৎকার করছেন। বন্দনা রায় তাঁর শরীরটা নাড়িয়ে ঘুম ভাঙিয়ে দেন। অরুন রায় ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেন। ভাবছেন, কোথায় ছিলেন এতক্ষণ তিনি, বিছানায়? না—! এই শীতে সমস্ত শরীর ঘেমে-নেয়ে একাকার। আওয়াজে পাশের ঘর থেকে সুশোভন, তৃষাও চলে এসেছে। বন্দনা রায় মৃদু শাসনের সুরে বললেন- “এখানে আসা থেকেই বেড়ানোর আনন্দটুকু শিকেয় তুলে শুধু সাধুবাবা আর জ্যাঠামশাই! এখন ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও তার জের চলছে।”
অরুন রায়ের কারোর কোনো কথা কানেই আসছে না, শুধু ভবছেন কেন তিনি এমন স্বপ্ন দেখলেন! জ্যাঠামশায়ের আত্মা তাঁকে কি কিছু বোঝাতে চাইছেন! চেতনে অবচেতনে কেনোই-বা তিস্তা রঙ্গীত নদীর সঙ্গম স্থলটাই তাঁকে জানান দিচ্ছে। তাহলে জ্যাঠামশাই এর অতৃপ্ত আত্মা কি এই তিস্তা পারেই ঘুরে বেড়াচ্ছে?? দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখা জ্যাঠামশায়ের ঝোলাটার দিকে নজর গেল। কারোর কোনো কথার উত্তর না দিয়ে অরুন রায় বিছানা থেকে নেমে সোজা ঝোলার কাছে গিয়ে তার ভিতর থেকে জ্যাঠামশাই এর ফটোটা বার করলেন। তারপর ফটোটা চোখের সামনে দুই হাতে ধরে উচ্চ স্বরে বললেন-” আমি কথা দিচ্ছি জ্যাঠামশাই, যত শীঘ্র সম্ভব আমি আপনার শ্রাদ্ধশান্তির ব্যবস্থা করছি।”
মাঝ রাতে অরুন রায়ের কাণ্ডকারখানা দেখে ঘরের বাকি তিনজন রীতিমতো ঘাবড়ে গেল। ঠিক সেই মুহুর্তে রাতের নীরবতা খানখান করে দরজার বাইরে এক পৈশাচিক চিৎকার শোনা গেল। সুশোভন তড়িৎ গতিতে দরজার আইহোলে চোখ রেখে দেখে, সেই লোমশ কুকুরটা ডাকতে ডাকতে বেরিয়ে যাচ্ছে। সুশোভন দরজা খুলতে গেলে অরুন রায় বাধা দিয়ে বললেন- ” দরজা খোলার দরকার নেই, তাঁকে যে আমি কথা দিলাম। উনি নিশ্চিন্ত হয়ে ফিরে যাচ্ছেন।”
আধ ঘন্টার মতো চললো স্বপ্ন পর্বের জের। অরুন রায়ের উপর বাকি তিনজনই অল্পবিস্তর বিরক্তও বটে। বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছেন শুধু সহধর্মিণী। তৃষা তো ভূতের ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে আছে।
পুনরায় সবাই শুতে গেল। বিছানায় শুয়ে চাদর মুড়ি দিতে দিতে বন্দনা রায় শাসনের সুরে অরুন রায়কে বললেন- ” ঘুমানোর চেষ্টা করো, তোমার জ্যাঠামশাই এর আত্মা নিয়ে কিছু চিন্তা করবে না।” কথা গুলি বলতে যতক্ষন, তারপর সামান্য ব্যবধানে বন্দনা রায়ের নাসিকা গর্জন শুরু হয়ে গেল। অরুন রায়, স্ত্রী-আজ্ঞা পালনের নিমিত্তে চোখ’টা বন্ধ করেছেন বটে, কিন্তু মন’টা বন্ধ করতে পারছেন কই!! চিন্তা তো কেউই করে না, সে-যে বড় বেহায়া, বিনা আমন্ত্রণে মাথায় এসে মাথা ব্যাথার কারন হয়ে দাঁড়ায়।
মূল কথা পুনরায় অরুন রায়ের ভাবনায় চলে এল জ্যাঠামশাইকে নিয়ে দেখা স্বপ্নের চুল চেরা বিশ্লেষন। অরুন রায় অনুভব করছেন, জ্যাঠামশাই এর আত্মার প্রতি তাঁর একটা অমোঘ আকর্ষণ ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। স্বপ্ন দেখাটা হয়ত তারই প্রতিক্রিয়া। অরুন রায়ের মনে প্রশ্ন জাগল, কুকুরটা দু’বার স্বপ্নে এবং বাস্তবে তাঁকে মোহনার কাছে টেনে নিয়ে যায়। আবার বৃদ্ধার কাছে শুনেছেন, মোহনার ঘূর্ণিতই জ্যাঠামশায়ের সলিলসমাধি হয়। হয়তো সেই জন্যেই তাঁর আত্মা মোহনার কাছেই মুক্তি পেতে চাইছেন। এদিকে স্বপ্নেও জ্যাঠামশাইকে মোহনার জলে তলিয়ে যেতে দেখেছেন। সাত পাঁচ ভাবনা থেকে অরুন রায় চটজলদি একটা গুরু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন– জ্যাঠামশাই এর অন্তেষ্টিক্রিয়া কোলকাতায় নয়, এই তিস্তা পারেই সম্পন্ন করবেন। আগামী কাল গোর্খা বস্তিতে গিয়ে বৃদ্ধা লক্ষ্মী ছেত্রির সাথে দেখা করবেন। কারন তাদের সহযোগিতায় শ্রাদ্ধশান্তি করে বস্তির গরীব মানুষ গুলোকে তৃপ্তি করে খাইয়ে পিতৃ কর্ম সমাধান করবেন।
অকস্মাৎ অরুন রায় অনুভব করলেন, বাইরে যেন মৃদু মন্দ শান্ত শান্তির একটা বাতাস বয়ে চলেছে,যেটা শীতের শেষের দক্ষিণা বাতাস বলে মনে হচ্ছে। সেই বাতাস যেন বোঝাতে চাইছে শান্তি, শান্তি, শান্তি—-।
একই সাথে গোর্খা বস্তির দিক থেকে পাহাড়ী মোরগের ডাক শোনা গেল। নিশ্চই পূর্বাকাশ ফরসা হতে শুরু হয়েছে। কারন হেতু মোরগের ডাক। পাশে বন্দনা রায় অকাতরে ঘুমোচ্ছে। প্রায় রাত তিনটে থেকে নিদ্রাহীন অবস্থায় অরুন রায়ের আর বিছানায় থাকতে ইচ্ছা করল না। কোমর ব্যাথা করছে, গাত্রোত্থান করে এক গ্লাস জল খেয়ে বাথরুমে প্রাতঃক্রিয়া সারতে ঢুকলেন। বেশ ক’দিনের দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনায় শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে, তার উপর না শেভ করতে পারা একমুখ খোচাখোচা কাঁচা-পাকা দাড়ি, অরুন রায়ের যেন এক বিধ্বস্ত অবস্তা।
প্রাতঃক্রিয়া সেরে চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিয়ে আয়নার সামনে দাড়াতেই অরুন রায় চমকে উঠলেন। আয়নায় যে মুখটা দেখছেন সেটা তো তাঁর নয়, জ্যাঠামশায়ের। মুখে চিমটি কেটে দেখলেন, হ্যাঁ অনুভব করছেন, তবে এমন দেখছেন কেন? এ-ও কি সম্ভব!! জীনগত ভাবে মিল থাকতে পারে, তাই বলে ষাটোর্ধ জ্যাঠামশায়ের মুখমন্ডলের অবিকল অবয়ব!!! অরুন রায় পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন জাজ্জ্বল্য দৃষ্টিতে তাঁর চোখে চোখ রেখে জ্যাঠামশাই যেন কিছু বলতে চাইছেন। নির্বাক অরুন রায় পাথরের মতো সেই দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছেন। চোখ থেকে চোখ সরাতে পারছেন না। জ্যাঠামশায়ের চোখ দু’টো যেন বোঝাতে চাইছে, যে কাজ আমি সম্পন্ন করতে পারলাম না সেটা তুমি কোরো। অজান্তে অস্ফুটে পাথর সম অরুন রায়ের মুখ থেকে আলটপকা বেরিয়ে গেল-” চে-ষ্টা ক-র-ব জ্যা-ঠা-ম-শা-ই।”
+++++//////////+++++