অরুণবাবুর কপাল
ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
অরুণবাবুকে তোমরা চেনো তো?সেই যে গো লম্বা শ্যামলা লোকটা।ওকে অবিশ্যি আমি অরুণ দা বলি।কতদিন বলে এবার বড়লোক হতেই হবে।আমি একদিন বলেও ছিলাম “চিন্তা কোরো না দাদা।এই নিষ্ঠা তোমাকে সঠিক পথ দেখাবেই।
অরুণ দা বিয়ে করেছিল সতের বছর বয়সে।বলা নেই কওয়া নেই পাড়ার একটা মেয়েকে নিয়ে সোজা তারকেশ্বরের মন্দিরে।পরের দিন কানমুতোয় একটা চড় খেয়েছিল।তারপর রেশনদোকানে মাল ওজন করার কাজটা পেলে।আর বাপ দিল ছোট্ট একটা ঘর।যা হোক করে একটা তক্তা ঢুকিয়ে দরজার সামনে স্টোভ জ্বেলে রাঁধতো ওর বৌ।কী জীবন সংগ্রাম টাই না করছে তখন থেকেই। এখন পঞ্চাশ বছর বয়স হয়ে গেল। মেয়েটাও পরের ঘরে গেছে।আর ছেলে বৌ নিয়ে ছোট্ট সংসার। কিছুতেই ধনী হতে পারল না।আর এখন ভরসা লটারির টিকিট।একবার যদি পড়ে যায় এক কোটি তবে মানবজীবন সার্থক হয়।
অরুণ দার বৌ হার্টের রুগী।আর ছেলেটা পার্টি করে।মানে নেতাদের পিছনে ঘোরে।আর বেঢপ একটা শরীর খাটতেও পারে না।মনে মরা অরুণ বাবু কতদিন ভাবে এবার নিশ্চয়ই একটা সুরাহা মিলবে।তেইশ নম্বর রুটের ধারে একটা চা এর দোকান হয়েছে।ওখানেই চা খেতে যায় অরুণ দা।ওর পাশেই মা মনসা লটারি।মাঠের ধারে এক সাধু বিরাট জটা নিয়ে ঘুরত।কদিন আগে এককোটি পড়েছে ওর।বিরাট মন্দির তৈরি করবে।অরুণ দা রাগান্বিত হয়।এই ভগবান টাও কানা।একটা নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ নেই। যাকে খুশি টাকা পাইয়ে দেয়।আর অরুণ কুমার কে দেখেও দেখে না।অরুণ দার ছেলে বাপের হাল হকিকত জানে।সেদিন বললে “ভগবানের দোষ নয়।প্রতিদিন কত নকুলদানা খাবেন উনি।প্রসন্ন করতে গেলে আপেলটা আঙুরটা দিতে হয়”।
এই কুলাঙ্গার ছেলেটা এক পয়সার ধান্দা করে না।অথচ জ্ঞানের বাহার প্রচুর।
সেদিন ঘুম আসছিল না অরুণ দার।একটা বিড়ি ধরিয়ে বাইরে এসে পুকুরের ধাপে বসলে।আর আমি তো নিষ্কর্মা অবতার। অতএব পুস্করিণীর মৎস্য ধরছিলাম।অরুণ দাকে দেখে বললাম “কী ব্যাপার গো।অমন ব্যাজার মুখো কেন?
মৃদু হাসলে অরুণ দা।বললে “আমার ঠাকুর দা একটা কথা বলতো জানিস।কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ/পাকায় করে টাঁসটাঁস”।
আমি বললাম “তার সঙ্গে তোমার কী সং?”
অরুণ দা দীর্ঘশ্বাস ফেললে।বললে” জীবনটা মরুভূমির মতো লাগে”।
আমার আবার এসব ভারী কথা হজম হয় না।বললাম “মাঠের সাধুটা এককোটি টাকা পেয়েছে।তুমিও একটা টিকেট কাটো।কপালটা যাচাই করো”।
অরুণ দা বললে “গতকাল একটা টিকিট কেটেছি।আজ তার রেজাল্ট”।
আমার চোখ মার্বেল হয়ে গেল। বললাম “তোমার স্মার্ট ফোন নেই। মিলিয়ে দেখো নম্বর টা।
অরুণ দা বললে “আমার আবার টাকা ।ওসব স্বপ্ন দেখাস না”।
ইতিমধ্যেই অরুণ দার ছেলে এল।বললে “একশ টা টাকা দাও বাবা।হোটেল হিন্দুস্থান এ ছেঁড়া পরোটা খাবো”
অরুণ দা কী একটা ছেঁড়া বলতে গিয়েও থেমে গেল। বললে “ঠিক আছে।দিচ্ছি।তবে ধম্মের ষাঁড় না হয়ে এই টিকেট টা ফোনে মেলা।দেখ টাকা কিছু আমদানি হল কি না”।
ছেলে গোমড়া মুখে বসে পড়ল উঁচু জায়গাটায়।অনেক ক্ষণ মিলিয়ে বললে “ওসব তোমার কপালে নেই। তোমার কপাল মূলোতোলা ।কতদিন বলেছি কপালে হাতি মার্কা বোরোলীন লাগাবে।তবে যদি এককোটি পড়ে”।বলেই একশ টাকা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে চলে গেল। আর অরুণ দা বিড়বিড় করে বললে “সে আর বলতে।নৈলে অমন আহাম্মক আমার ছেলে হয়ে জন্মায়”।
অরুণ দার মুখটা বিষাদময়।খুব মায়া লাগল।বললাম “চলো দাদা।আর মাছ ধরে কাজ নেই। তোমাকে আজ চা খাওয়াবো বিশুর দোকানে”।
ছিপ গুটিয়ে দুজন বেরোলাম।তখন ও টিকিট টা বাচ্চাদের মতো মুঠোয় ধরা অরুণদার।সিনেমা তলার কাছে এসে তবে ফেললে।বিশুর দোকানের কাছে পৌঁছে বললাম “বিশু দা।দুটো ইসস্পেশাল চা করো।সাথে বাদাম বিস্কুট।”
দেখলাম পাশেই মা মনসা লটারী।ধূপ জ্বলছে ঠাকুরের কাছে।এদিকে আকাশে মেঘ ঘনিয়ে আসছে।হঠাৎই লটারী ওলা বললে “অরুনদা।আপনার টিকিট টা আনুন।আপনার বারো হাজার টাকা পড়েছে”।
অরুণ দাঁত বাড় করে বললে “ইয়ার্কি মারছ।আমার আবার লটারির টাকা”!
টিকিট বিক্রেতা বললে “আমার খেয়ে দেয়ে কাজ নেই। বলছি বারো হাজার পড়েছে।আমার ঠিক লেখা আছে কে কোন টিকিট কেটেছে।আকাশ এর অবস্থা ভালো নয়।ঝড় উঠল বলে।তাড়াতাড়ি টিকিট টা আনুন”।
চমকে শিউরে উঠল অরুণ দা।এবার কী হবে।ওই কুলাঙ্গার ছেঁড়া পরোটা খেয়ে আসুক আজ।কী দেখতে কী দেখলে।এখন বারো হাজার হাতছাড়া হতে বসেছে।মনে পড়ে গেল সিনেমাতলায় টিকিট টা ফেলেছে।ছুটছে।অরুণ দা ছুটছে।এদিকে ঝড় উঠেছে।আমার মনে পড়ল “রুপাইয়া ইতনা চিজ/খোদা কা উনিশ বিশ”
আমি চিৎকার করছি “অরুণ দা।দোকানের ভিতরে এসো”।
অরুণ দা তখন সিনেমাতলায়।বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে।কিন্তু অরুণ দা বাতাসের গতি লক্ষ করে ছুটছে।
না।টিকিট আর পাওয়া গেল না।তারপর তিনদিনেও শোক কাটে নি অরুণ দার।আমি দেখতে গিয়ে দেখি ওর ছেলে একটা হাতি মার্কা বোরোলীন অরুণ দার কপালে লাগাচ্ছে।আমি বললাম “চিয়ার আপ অরুণ দা।কপাল এবার খুলবেই।”
—oooXXooo—