করুণ মুখ
মৌসুমী ঘোষাল চৌধুরী
**********
ত্রয়োদশী মেয়েটি। একটি গভর্নমেন্ট স্কুলে পড়ে। বাবা যজমানি করে যৎসামান্য পায়। মা শয্যাশায়ী। মেয়েটির নাম ” বনফুল “। মেয়েটির উপরে দুই দাদা। ছোড়দা কলেজে পড়ে। বড়দা সবে অফিসে চাকরি পেয়েছে। ছোট্টো বোনটি ভোরবেলায় উনুন জ্বালিয়ে ভাত, ডাল রাঁধে। তারপর ইস্কুল। শ্যামবর্না মেয়েটির চোখদুটি যেন আকাশের বুকে শঙ্খচিল উড়ে যাওয়া দুটি ডানা। কোমর ছাপানো এক ঢাল কালো পশমের মত চুল। কোনো পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হতে পারে নি। অথচ বাংলা বিষয়ে এম। এ। পাশ করে ওঠে। গানের গলাটি ও মাধুর্যপূর্ণ। কলাকুশলী মেয়েটি ভালো কবিতা লেখে, মোচার তরকারি রাঁধে।
এক সময় বিয়ের সম্বন্ধ আসে। মেয়েটি নিজ পছন্দেই একটি ছেলেকে বিয়ে করতে রাজী হয়। ছেলেটির একটি চোখ জন্মান্ধ। অনেকে আপত্তি জানায়। ” বনফুল ” জানায় ” তাতে কি হয়েছে? বিয়ের পরে ও তো চোখ নষ্ঠ হয়ে যেতে পারে। ” শ্বশুরবাড়িতে ঢুকতেই আত্মীয় স্বজনরা বলে ওঠে, ” এত সুন্দর মেয়ে, আর কোনো ছেলে জুটল না “। ” বনফুল ” একটা বেসরকারি ইস্কুলে চাকরি পায়। শ্বশুরবাড়িতে বৃদ্ধ শ্বশুর, ছোটো পড়ুয়া দেওর। একদিন চাকরি থেকে ফিরে দেখে সবাই মিলে ঘর রঙ করছে। দেওয়ালী আসছে সামনে। ” আলো হোক, ভালো হোক “। রোজগারের টাকা থেকে বাপের বাড়িতেও টাকা পাঠাত ” বনফুল “। শ্বশুরমশাইয়ের কোলে ” বনফুলের ” ফুটফুটে এক বছরের ছেলে। পঙ্গু মা উলকাঁটা দিয়ে বুনে দিয়েছে টুপি, সোয়েটার। ঘরে শৌখীনতা বজায় রাখতে বিছানার চাদর কেটে পর্দা ও তাতে নিখুঁত কাশ্মীরী স্টীচ।
এরকমই নদীর ধারার মত জীবন এগোচ্ছিল। হঠাৎই ” বনফুল ” এর বড়দার ক্যান্সার ধরা পড়ল। ঝড় বইছে মেয়েটির জীবনে। দাদা এসেছে বাড়িতে। ” বনফুল ” মাংসের দোকান থেকে মাংস কিনে এনে সকলের জন্য রান্না করে অগোছালো জীর্ন ছাপা শাড়ি পড়ে মাদুরের উপর পৌষের শীতে হাল্কা চাদর গায়ে দিয়ে আধো ঘুমে ঢলে পড়ল। মেয়েটির পেটে সামান্য মুড়ি ও বাতাসা।
পরের দিন সকালেই দাদার কেমো থেরাপি। ” বনফুল ” কাকামনির দেওয়া উপহারের সরুনেকলেসটি নাড়াচাড়া করে কিছুটা আশ্বস্ত হল। অভিমানী, ছলছল, করুণ চোখদুটি বহুকাল আকাশের সুগন্ধ ভুলে গেছে। মাটির মেয়েটি, মাটির স্পর্শে ঠিক যেন কোজাগরি লক্ষী।
—oooXXooo—