পুজোর সেই দিনগুলো
ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
পুজো এলেই আমার মনে পড়ে আমার প্রিয় মানুষ গুলোর কথা।যাদের প্রশ্রয় পেয়ে আমি একটা আস্ত গাধা হয়েছি। কী ফাঁকিবাজ যে ছিলাম বলে বোঝানো মুশকিল। দাদু বলতেন “স্কুল কামাই করলে হাড় মাস আলাদা করে দেবো”।কিন্তু এই স্কুল মাঝে মাঝেই কামাই দিতাম। তবে সেদিন টা সুখকর হোতো না।আমাদের তিনতলার ছাদে ঘাপটি মেরে বসে থাকতে হোতো।দাদু দিবানিদ্রাতে গেলে তবে সদরবাড়ির চৌকাঠে আসতাম।আমরা শুধুই ব্রাহ্মণ বললে ভুল হবে।একেবারেই কট্টর বলা যেত।রান্নাঘরে মাংস রান্না হোতো না।আর মোরগ এর মাংস অনেক পরে খেয়েছি।তবে বাড়ির সদস্য সংখ্যা ছিল দেড়শ।
বুড়ি ঠাকমা মানে দাদুর মা ছিলেন একুশ টা সন্তানের জননী।আমার কোন দাদু কত নম্বরের তা আমি অনেক পরে জেনেছি।এদের মধ্যে আবার যমজ ছিল। কানাই বলাই,জগাই মাধাই এমন মেলানো নাম সব।এদের মাঝেই বড় হয়ে ওঠা আমি বুঝেছিলাম একসাথে থাকার কত সুখ।
এখন অনেক বড় হয়ে গেছি।মানে বুড়ি হয়েছি বললেও অত্যুক্তি হবে না। কত কী কিনেছি পুজোতে।তবে মনটা চলে গেছে কিশোরী বেলায় চতুর্থীর দিন রিক্সা আসতো ।আমার ডাক পড়তো।দাদুর দেওয়া ডাকনাম। আমি আসতেই দাদুর হুকুম “বৌমা।মেয়েটাকে পরিস্কার করে দাও। ওর হাঁটু পর্যন্ত ধুলো”।
মা আমাকে ভালো করে সাবান মাখিয়ে চুল আঁচড়ে টেনে টেনে কাজল পরিয়ে দিতো।সত্যিই বলছি নিজেকে খুব সুন্দর লাগতো।
রিক্সা করে জামা কিনতে যাওয়া।অনেকেই বলতেন “নাতনি বুঝি?”
নিজের গর্ব হোতো।দাদুর কত নামডাক।আর আমি তার নাতনি।তারপর জামা কেনা।পকেট দেওয়া জামা।ভাবা যায়?”আমার দাদুর একশ বিঘা জমি চাষ হোতো।বিরাট খামার বাড়িতে ফসল উঠতো।বড় বড় পালুই ।গোয়ালভর্তি গরু।বড় বালতিতে দুধ দোহা হোতো।এই খামার বাড়িটা ছিল আমার মুক্তির জায়গা।রাজ্যের ছেলেমেয়েদের জুটিয়ে আনতাম পুজোর দিন গুলোতে।চলত দল লুকোচুরি খেলা।
খুব সকালে ওঠার অভ্যাস টা ছোটো থেকেই ছিল। পুজোর দিন গুলোতে ঘুম থেকে উঠে কোঁচল ভরে শিউলিফুল কুড়াতাম।কী একটা আনন্দে মনটা পূর্ণ থাকতো।এমনি করে সুন্দর ধরা দিত আমার প্রাণে মনে।গান গাইতাম।রবি ঠাকুরের গান।
“প্রাণের মাঝে সুধা আছে চাও কি?
হায় বুঝি তার নাগাল পেলে না”।
অনুভূতির কত পরিবর্তন ঘটে ।এখন মনে হয় কেউ কোনও দিন প্রাণের সুধার নাগাল পূর্ণরূপে পায় না।ওই সুধাটা ভগবানের দান।সবাই প্রাণের মানুষ ও হতে পারে না।সেও এক সাধনা।
আমার মাঝে আমাকেই আমি চিনতে ভুল করে ফেলি।এখন বড় জটিলতার মাঝে থাকি।উৎসবের দিন গুলোতে আমি চলে যাই আমার হারানো শৈশবে।সেই সরলতা,সেই মাটির গন্ধ আমার চেতনার মধ্যেই আছে।শুধুই খুঁজে চলি।
আমার মনে কত যে প্রশ্ন আসতো।কেউ তার সঠিক উত্তর বলতেই পারতো না।সপ্তমীর দিন নবপত্রিকা।কলা বৌ স্নান। আমি বলতাম ‘এই কলা বৌ কে?”
কেউ বলতো গণেশের বৌ।আবার কেউ বলতো মা দুগ্গা’।
ঠাকমা বলতো গণেশকে ভালোবেসেছিল তুলসী।একতরফা ভালোবাসা।”ছোটো মনে আবার প্রশ্ন “ভালোবেসেছিল। একতরফা।এখন বুঝি।তুলসীর মতো আমিও। শুধুই ভালোবাসি।মনে বিশ্বাস জন্মে ভালোবাসা বৃথা যায় না।
কতদিন সতী মায়ের তলায় গিয়ে কুমোর কাকুকে জিজ্ঞেস করেছি ‘তুমি তো এত ঠাকুর করো।তুমি কি ঠিক জানো কার্তিক ঠাকুর বিয়ে করে নি।তাকে দেবসেনাপতি কেনে বলে।তবে কি ওর বৌ এর নাম দেবসেনা?
ছোটবেলায় একটার বেশি দুটো জামার জো ছিল না।কেউ ই পেতো না।আর পেতে হয় এটাও জানা ছিল না।বাবা সরকারী কর্মী ছিলেন। কিন্তু জামা কেনার আইন নেই। গৃহকর্তাই সব।সত্যিই বলছি বাবাকে অতটা প্রয়োজন হোতো না।তবে কোনও কোনও দিন অফিস থেকে ফিরে আমাদের সব ভাইবোনের সাথে গল্প করতেন।পাঠ্য কবিতা গুলোর আবৃত্তি হোতো।গান করাতেন।বেশ মজা হোতো।আমাদের একান্নবর্তী পরিবারে কত ভাইবোন আমরা।আপনপরের ভেদ শিখি নি।ষষ্ঠীর দিন বিকেলে সবে ধন নীলমণি ওই একটা জামা পরে বেড় হতাম।রাত পর্যন্ত দল লুকোচুরি খেলা।রাতের মধ্যেই জামায় ধুলোর কলঙ্ক। দাদুর সেদিকেও নজর।বলতেন “মেয়ের কি ছিরি।জামাটা কেচে দাও বৌমা।আবার অষ্টমীতে পরে অঞ্জলি দেবে।কাল আগের বছরেরটা পরিস”।
ছোট্ট মনে ঢেউ খেলে যেত।কী নিষ্ঠুরতা।কেষ্ট জেলে দাদুর পুকুর চাষ করতো।সপ্তমীর দিন মাছ আসতো।আর নবমীর দিন। পুকুরের মাছ।দুটো বড়ো বালতি ভর্তি।মা যখন মাছ ভাজতেন আমার কাকারা গোল হয়ে বসে মাছ খেতো।যে যত পারে খেতে পারে।শুধুই বাড়ির সদস্য নয় কিষাণ রাখাল সবাই। ওইরকম খেয়ে খেয়েই আমার এমন অবস্থা।
অষ্টমীতে লুচি।এখনকার মতো সাদা সাদা তেল নয়।একেবারে বিশুদ্ধ ঘি ।সাথে চন্দ্রমুখী আলুর দম।আমার মা ছিলেন সাক্ষাৎ অন্নপুন্নে।মায়ের হাতে রান্নার স্বাদ যেন অমৃত।বাড়ির সদস্য সংখ্যা বেশি।তাই প্রতিদিন একটা শাকের চচ্চড়ি আর মুগডাল বাঁধাধরা ।আমার ঠাগমা সকালে পুজোপাঠ সেরে কাটতে বসতেন শাকপালা।একদিন বলে ফেলেছিলাম ‘এই শাক যমের অরুচি”।তাতে তাড়া খেয়েছিলাম।একছুট।পাখার বাঁট উঁচিয়ে ঠাগমা আসছে।কী সুন্দর ছিল সেই দিনগুলো।
আর কি ফিরে পাবো সেই জীবন। এখন তো শুধুই টাকা আনা পাই এর জীবন। বড় হিসেব করে বাঁচা।
যেটুকু পেয়েছি চেটেপুটে তার সত্তটুকু নিয়ে নিয়েছি।
—ooXXoo—