তিস্তা পারের রহস্য (তৃতীয় অংশ )
সলিল চক্রবর্ত্তী
২৩/০৭/১৯৮৪
আজ যোগী তন্ত্রসাধক শশীভূষন ভট্টাচার্যের কাছে গিয়ে সন্ন্যাস নেবার বাসনা প্রকাশ করলাম। এমন একজন সর্বত্যাগী, নিঃস্বার্থ, জগতপিতার কাছ থেকে দীক্ষিত হতে পারলে আমি ধন্য হয়ে যাব। কিন্তু আমি সংসারী মানুষ বলে তিনি আমায় দীক্ষা দিতে অপারগ। আমি তাঁকে জানালাম যে আমি নিঃসন্তান, পিছুটান আমার নেই। একমাত্র সহধর্মিণী, ভ্রাতুষ্পুত্র তাঁকে মাতৃজ্ঞানে শ্রদ্ধা করে। তাঁর সাময়িক মনঃকষ্ট হবে ঠিকই তবে অর্থের নয়। শুনে তিনি বললেন -এটা নাকি আমার আবেগ, ষড়রিপুর বন্ধনে আমি আবদ্ধ, তার থেকে সমাজবদ্ধ মানুষের বেরিয়ে আসার ইচ্ছা থাকলেও পারেনা, আমি দোটানায় পড়ে যাব। সন্ন্যাস জীবন বড় কঠিন জীবন। শেষ পর্যন্ত সকলে পৌছুতে পারেনা। আমি আত্ম প্রত্যয়কে দৃঢ় করে জানালাম যে তিনি আমাকে ভুল বুঝছেন, সন্ন্যাস গ্রহণের ব্যাপারে শত প্রতিকূলতায়ও আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তারপর খানিকক্ষণ চোখ বন্ধ করে হয়তো কিছু ভাবলেন, চোখ বন্ধ রেখেই দুই সপ্তাহ পর সন্ধ্যা পাঁচটা ঊনষাট মিনিটে তাঁর সাথে দেখা করতে বললেন।
০৬/০৮/১৯৮৪
আমি গুরুদেবের সম্মুখে প্রণাম জানিয়ে দাঁড়াতেই তিনি চোখ বন্ধ রেখে বললেন যে আমার সময়ানুবর্তিতায় তিনি সন্তুষ্ট। ঘড়িতে তখন সময় পাঁচটা সাতান্ন , বুঝলাম আমার সময় জ্ঞান কতটা জানবার জন্য পাঁচটা ঊনষাট মিনিট বলেছিলেন। নির্জন কুটিরে আমাকে তাঁর পাশে বসিয়ে একান্তে কয়েকটি বিষয়ে অবগত হলেন। গুরুদেব আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন আমি জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী কিনা। আমি বিশ্বাসী জানাতে তিনি সংক্ষেপে ব্যাখ্যা চাইলেন। যতটুকু বিশ্বাস করি বললাম- আত্মা অবিনশ্বর, শুধু কলেবরই নশ্বর। মৃত্যুর সময় আত্মা তার স্বীয় জীবনের সঞ্চিত পাপ পুণ্য নিয়েই কলেবর পরিত্যাগ করে। আবার যখন নুতন শরীর লাভ করে তখন সেই পাপ পুণ্য নিয়েই ফিরে আসে। সেই জন্যেই তো একই সময়ে একটি শিশু জন্মগ্রহণ করছে সোনার চামচ মুখে দিয়ে, অন্য আরেকটি ফুটপাতে। গুরুদেব চোখ বন্ধ রেখে ইতি বাচক মাথা নেড়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি আত্মার উপস্থিতি টের পেলে ভয় পাই কি-না? আমি ভয় পাইনা জানাতে উনি আবার ব্যাখ্যা চাইলেন। আমি বললাম- মৃত্যুর পর যে সকল আত্মার অন্তেষ্টিক্রিয়া হয়নি সেই সকল আত্মা সদ্গতির আশায় ইহলোকে ঘুরে বেড়ায়। তিথি নক্ষত্র বিশেষে এদের অস্তিত্ব প্রকট হয়, তবে এরা মানুষের কোনো ক্ষতি করতে পারেনা। আত্মা তার প্রয়োজনে মানুষের কাছাকাছি আসে। মানুষ তার উপস্থিতি অনুভূতি দিয়ে উপলব্ধি করে এবং ভয় পায়। আমার মুখে কথাগুলো শুনে তিনি স্বভাবসিদ্ধ ভাবে খানিকক্ষণ নিরব থেকে বললেন- তিনি আমাকে দীক্ষা দেবেন তবে শর্ত সাপেক্ষে। শর্ত পালন-ই হল তাঁর গুরু দক্ষিণা। আমি সাত পাঁচ না ভেবে রাজি হয়ে গেলাম। উনি অবাক হয়ে আমাকে চিন্তা ভাবনা করতে বললেন। আমি জানালাম, সংসারের মায়া মন থেকে ত্যাগ করেছি। এই মুহুর্তে নিজেকে তাঁর চরণে নিবেদন করতে চাই। গুরুদেব চোখে মুখে একটা প্রশস্তি এনে বললেন, তিনি এতদিন ধরে আমার পরীক্ষা নিচ্ছিলেন। এবং তাতে আমি উত্তীর্ণ। তিনি নাকি আমার মতো একজনকে খুঁজছিলেন। আমাকে সন্ন্যাস গ্রহনের অনুমতি দিয়ে বললেন, আগামী পূর্নিমা তিথিতে আমাকে দীক্ষাদান করে হিমালয়ের কোনো এক বিশেষ স্থানে এক গুরুত্ত্বপূর্ণ কাজে পাঠাবেন। আমি যেন সংসারে মায়ার বন্ধন ছিন্ন করে গৃহত্যাগ করি।
৩০/০৮/১৯৮৪
আজ প্রত্যুষে দাম্পত্য জীবনের ইতি টেনে গাত্রোত্থান করি। সহধর্মিনীর উদ্দেশ্যে লেখা চিরকূটটা তার বালিশের তলায় রাখতে গিয়ে মনে একটা আঘাত লাগল। নিজেকে এত বড় অপরাধী আগে কখনো মনে হয়নি। তবুও মনকে দৃঢ় করে ঘুমন্ত সহধর্মিণীর মুখটা শেষ বারের মতো দেখে গৃহত্যাগ করলাম।
আজ ভরা পূর্ণিমা, সারাদিন উপবাস থেকে হোম যজ্ঞ চলল, সন্ধ্যায় গুরুদেবের হাত ধরে আমি দীক্ষিত হলাম। তন্ত্র সাধনায় সিদ্ধ পুরুষ তিনি। এখন থেকে আমাকেও কঠিন সংযম পালন করতে হবে। সামান্য কিছু আহার করার পর গুরুদেব আমাকে ডাকলেন, আমি তাঁর পাদদেশে এসে বসলে তিনি আমাকে ইহলোক পরলোকের শরীরী আত্মা এবং অশরীরী আত্মার ভারসাম্য বিষয়ে অবগত করলেন। যা শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। অবাক হয়ে গেলাম তাঁর ভাবনার গভীরতার কথা ভেবে। তিনি বললেন-” ইহলোকে লক্ষ লক্ষ অতৃপ্ত আত্মা ঘুরে বেড়ায় শুধু তাদের মুক্তির আশায়। বিভিন্ন কারণে তাদের সদ্গতি বা অন্তেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়নি। পরলোকের দ্বার তাদের জন্য রূদ্ধ। ফল স্বরূপ এদের পুনঃজন্মের পথও বন্ধ। এমন সদ্গতি না হওয়া আত্মা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। এই ভাবে অতৃপ্ত আত্মা বাড়তে থাকলে ইহলোক পরলোকের ভারসাম্য নষ্ট হবে, এমনও হতে পারে মানুষের শরীরে ইতোর প্রাণীর আত্মা প্রবেশ করতে পারে, যেটা মনুষ্য সমাজের পক্ষে ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। হচ্ছেও তাই, দেখছ না মানুষের আচরন বর্তমানে পশুরও অধম হয়ে উঠছে।”
তিনি আমাকে এটাও বললেন যে, আমার মনে স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন জাগতে পারে পশু মরলে তো অন্তেষ্টিক্রিয়া হয় না। তাহলে মানুষের মৃত্যুর পর এতো কিছু ভাবা হয় কেন? তিনি তার-ও ব্যাখ্যা করলেন–
” আসলে সমগ্র পৃথিবীর প্রাণী কুলকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়, এক ভাগে সমগ্র ইতর প্রাণী বা পশুকুল যারা বেঁচে থাকার জন্য প্রকৃতি থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে। আর অন্য ভাগে শুধুমাত্র মনুষ্য জাতি, যারা বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য,বস্ত্র, বাসস্থান অর্থের বিনিময়ে সংগ্রহ করে। এই অর্থই মানুষের জীবনে অনর্থের কারন হয়। মানুষ অর্থ সংগ্রহের মোহে পাপ পুণ্যে জড়িয়ে পড়ে। সেই পাপ পুণ্যের হিসাব মেলাতেই তো পারলৌকিক ক্রিয়াকর্মের প্রয়োজন। পরবর্তী জীবনে সেই পাপ পুণ্য সঙ্গে নিয়েই এই ধরাধামে ফিরতে হয়। পশুদের আচরনে পাপ পুণ্যও নেই, অন্তেষ্টিক্রিয়াও নেই। সেই জন্য পূনর জন্মেরও কোনো বাধা থাকেনা। অথএব ইহলোকে আত্মার ভারসাম্য রক্ষার প্রয়োজন আছে বই কি। এবং এই অবস্থার একটা প্রতিকার দরকার। হিন্দু তন্ত্রসাধনায় সম্ভব, কিন্তু তেমন তন্ত্র সাধক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তবে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী লামারা গণ অন্তেষ্টির ব্যাপারে খুব পারদর্শী। এই সমস্যাটা নিয়ে একবার উদ্যোগী হয়েছিলাম। খোঁজ খবর নিয়ে ছুটেছিলাম চীন, তিব্বত সীমান্তে নাথুলাপাস। ওখানে ‘চকজুম’ গ্রমের এক গুম্ফায়। সেখানে গিয়ে মহাপ্রাণ আচার্য ধর্ম গুরু দোঙ-জঙ-পা লামার সাক্ষাত প্রার্থনা করি। তিনিও স্বসম্মানে আমাকে অতিথি রূপে বরণ করেন। আমি ধর্মগুরু দোঙ-জঙ-পা লামার কাছে আমার অভিপ্রায় ব্যাক্ত করি। তিনি আমার ইচ্ছার কথা শুনে আমাকে সাধুবাদ জানিয়ে বললেন যে অভূতপূর্ব উদ্যোগ। বৌদ্ধ যোগ-তন্ত্র সাধনায় গণ অন্তেষ্টিক্রিয়ার বিধান আছে। কিন্তু সে যে বড়ো কঠিন পথ। আমার এই বয়সে, ভগ্ন শরীরে সেটা সম্ভব নয়। বরং আমি যেন পঞ্চাশ ঊর্ধ্বে কোনো শক্ত সামর্থ্য, স্বীয়লক্ষে অবিচল, নির্ভীক, দৃঢ়চেতা তান্ত্রিকের উপর দায়িত্ব দিয়ে ওনার কাছে পাঠাই,বাকিটা তিনি অনুশীলনে মধ্য দিয়ে তৈরী করে দেবেন।”
তারপর থেকে গুরুদেব উপযুক্ত একজন তন্ত্র সাধক খুঁজছেন। তাঁর বিশ্বাস আমিই সেই ব্যাক্তি যে কিনা তাঁর এই স্বদিচ্ছাকে বাস্তবায়িত করতে পারব। আমি গুরুদেবের চরণ স্পর্শ করে শপথ নিলাম, জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও আমি তাঁর অভিপ্রায় কে বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করব।
১৪/১২/১৯৮৪
বৌদ্ধ লামা দোঙ-জঙ-পাকে দেওয়ার জন্য গুরুদেবের পত্র, প্রণামি আর আমার অতি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ঝোলাটা নিয়ে ” হরি ওঁ তৎসৎ” বলে কোলকাতা ছাড়লাম।
ট্রেন পথ, ও সড়ক পথে ছাঙ্গু লেক পর্যন্ত এলাম। এখানকার তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রির কাছাকাছি। রাস্তা ঘাট সব বরফাবৃত, ছাঙ্গু লেকের জল পর্যন্ত বরফ হয়ে গেছে। শুনলাম ‘চকজুম’ গ্রাম পর্যন্ত ইয়াকের পিঠে চেপে যেতে হবে। অবলা প্রাণীর পৃষ্ঠদেশে আরোহন না করে আমি হাঁটা শুরু করলাম। গুরুদেবের আর্শীবাদ আমার মাথার উপর আছে যখন চিন্তা কিসের। ঘন্টা খানিক হেঁটে এসে পৌঁছুলাম নাথুলাপাসের ‘চকজুম’ গ্রামে। সেখান থেকে গুম্ফা পর্যন্ত আবার পায়ে হাটা পথ। এক মেষপালকের সহায়তায় বরফাচ্ছাদিত সরু তরাই উৎরাই পথ অতি কষ্টে অতিক্রম করে দুই সপ্তাহ পর দোঙ-জঙ-পা লামার গুম্ফায় পৌঁছুলাম।
গুম্ফাদ্বারে পৌঁছে এক বৌদ্ধ ভিক্ষুর দর্শন পেলাম। তাঁর কাছে আমার পরিচয় দিতেই তিনি আমাকে স্ব-সম্মানে গুম্ফার ভিতরে নিয়ে গেলেন। দুটি ছোট পাথরের প্রকোষ্ঠ অতিক্রম করে তুলনামূলক একটু বড়সড় একটা ঘরে গেলাম। ঘর গুলোতে বিশেষ কোন আসবাবপত্র নেই। শুধু একটা করে কাঠের চৌকি আছে। হিন্দু সন্ন্যাসীদের আশ্রমে সাধারণত যেটা থাকেনা। ঘর তো নয়, যেন ইগলু,চৌকি ছাড়া উপায়ও নেই। এখানে এসে সাক্ষাত হল একজন লামার সাথে। গেরুয়া বসন পরিহিত ধোপদুরস্ত ভদ্রলোক, চৌকিতে বসে মোটা একটা বই পড়ছেন। সম্ভবত ত্রিপিটক। দোঙ-জঙ-পা লামা ভেবে প্রণাম জানালাম। ভুল উনি-ই ভাঙিয়ে বললেন-” আমি ললিত বজ্র লামা। আপনি আসবেন আমি জানতাম, আচার্য দোঙ-জঙ-পা লামা ঠিক চোদ্দ দিন আগে ধ্যানযোগে জেনে আমাকে বলেছেন যে আপনি আসছেন এবং কি অভিপ্রায়ে আসছেন।” আমি স্তম্ভিত, তিনি নির্ভুল বলেছেন, আমি ১৪/১২/১৯৮৪ তারিখে কোলকাতা থেতে রওনা দিয়েছিলাম। আর-ও অবাক হলাম এই ভেবে যে যোগ ও তন্ত্রসাধনার এত ক্ষমতা!! ললিত বজ্র লামা আমাকে বললেন-” আপনি ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, ক্ষুধার্ত-ও বটে, হাত মুখ ধুয়ে আহার করুন। আমি সময় মতো আচার্য দোঙ-জঙ-পা লামার সাথে সাক্ষাৎ করিয়ে দেব।”
সামান্য আহার সেরে একটা চৌকিতে শরীরটাকে এলিয়ে দিয়ে ঘুম ঘুম চোখে ভাবছি এতো ঠান্ডা কি শরীর ধারন করতে পারবে! থাকতে থাকতে নিশ্চই অভ্যস্ত হয়ে পড়ব। ট্রেন এবং সড়ক পথের যানবাহনের দুলুনির রেশটা এখনো শরীরে থেকে গেছে ফলে কখন তন্দ্রা এসে গিয়েছিল বুঝিনি। তন্দ্রা ভাঙল একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুর ডাকে। তিনি জানালেন, ললিত বজ্র লামা আমাকে ডাকছেন।
ওনার কাছে যাবার সময় দেখলাম, একটা ঘরে বসে একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু বিভিন্ন ধরনের গাছে পাতা,লতা,শিকড় ইত্যাদি হামানদিস্তায় ফেলে পেষাই করছেন। জানতে চাইলাম ব্যাপারটা। তিনি বললেন-” বিভিন্ন গাছ গাছড়ার সংমিশ্রণে শীত নিবারক ভেষজ বটিকা তৈরী হচ্ছে। সকালে একটা বটিকা সেবন করলে চব্বিশ ঘন্টায় শীত আর কাবু করতে পারে না।” বুঝলাম, কিভাবে এনারা পাতলা গেরুয়া বসনে দিব্বি আছেন। ললিত বজ্র লামা এগিয়ে এসে আমার শারীরিক কুশলতার খবর নিয়ে বললেন-চলুন আপনাকে আচার্য দোঙ-জঙ-পা লামার সাথে সাক্ষাৎ করিয়ে দেই।
তুলনামূলক ভাবে ঘরটাএকটু বড়। ছোট দুটো জানালা আছে বটে তবে দিনের আলো তেমন ঢুকছে না। আশ্রমিক আসবাবপত্রও ঘরটাতে বিশেষ কিছু নেই। মেঝেতে কম্বলের ন্যায় একটা মোটা চমরী গাই-এর চমড়ার আসনে পদ্মাসনে উপবিষ্ট বৌদ্ধ তন্ত্র সাধক দোঙ-জঙ-পা লামা। সম্মুখে একটা পাথরের বেদীতে কাঞ্চনাবৃত ভগবান বুদ্ধের ধ্যানস্থ মুর্তি। পাশে প্রজ্জ্বলিত মোমবাতির আলোয় মূর্তিটা জীবন্ত হয়ে উঠেছে। মূর্তি থেকে ঠিকরে পড়া আলোর ছটায় ঘরটা আলোকিত হয়ে আছে। ললিত বজ্র লামা তিব্বতি ভাষায় হয়ত আমার কথা বললেন। আমি নতজানু হয়ে প্রণাম করতেই উনি ‘মঙ্গল হউক’ বলে আর্শীবাদের ভঙ্গিমায় হাত তুললেন। তারপর মৃদুস্বরে চিনা ও তিব্বতি ভাষায় কিছু বললেন, যা আমি কিছুই বুঝলাম না। তবে কিছুটা অনুমান করলাম। ললিত বজ্র লামার কাছে জানলাম উনি বললেন আমার প্রতি আতিথেয়তার যেন কোনো ত্রুটি না হয়। আগামী দুই এক দিনের মধ্যে উনি আমার সাথে বসবেন। শুনলাম ওনার বয়স বর্তমানে একশ দশ বৎসর। মেদহীন গৌর বর্ণের কুঞ্চিত চর্ম খানি অস্থির উপর লেপন করা যেন জীবন্ত মমি। আরো অবাক হলাম ওনার শরীরে কোনো অসুখ এখনো বাসা বাঁধতে পারেনি। এমন কি শীত-ও এনাদের কাছে পরাজিত।
১৫/১২/১৯৮৪
প্রত্যুষে ঘন্টার ধ্বনিতে ঘুম ভাঙল। প্রাতকর্ম সেরে গুম্ফার দশ বারো জন সদস্যের সাথে দোঙ-জঙ-পা লামার কক্ষে গেলাম, সেখানে ভগবান বুদ্ধের সম্মুখে প্রার্থনায় বসলাম। প্রার্থনা শেষে ললিত বজ্র লামা আমাকে একটা ঠাণ্ডা নিবারক ভেষজ বটিকা সেবন করতে দিয়ে বললেন, যে দোঙ-জঙ-পা লামা বলেছেন আমাকে যেন গুম্ফার চারদিক ঘুরিয়ে দেখানো হয়, যাতে এখানকার বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দিনপঞ্জিটা আমার বুঝতে অসুবিধা না হয়।
প্রার্থনা শেষে গুম্ফার বাইরে বেরিয়ে চোখে ধাঁধা লেগে যাওয়ার অবস্থা। সবেমাত্র দিনের আলো ফুটেছে, যতদূর চোখ যায় পেঁজা কার্পাস তুলোর মতো শুভ্র বরফে চারদিক আচ্ছাদিত। মনে হচ্ছে যেন একটা বরফ প্রান্তরের মাঝখানে আমি দাঁড়িয়ে। এসেছি শিবের আলয়ে, মুগ্ধ হয়ে দেখতে গিয়ে নজরে পড়ল, গুম্ফা থেকে একটা সরু পথ উত্তর দিকে চলে গেছে। সেটা আবার কিছুটা গিয়ে বরফে ঢেকে গেছে। ওটা যে রাস্তা সেটা প্রমান করছে অসংখ্য ‘তাহশিং’– লম্বা বাঁশের মাথায় বৌদ্ধ ধর্মীয় বাণী লেখা রং-বেরঙের পতাকা। সূর্য প্রণাম করে ললিত বজ্র লামার কাছে জানতে চাইলাম এই পতাকা নির্দেশিত পথটা কোথায় গিয়েছে। উনি বললেন-” দাচোকারো মনাস্টেরিতে, ভক্তরা ওখানে যায় তাদের মনস্কামনা পুরনের উদ্দেশ্য। ঘুরে আসুন ভাল লাগবে।” এই বলে তিনি একজন শ্রমনকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন, যে কিনা আমাকে গাইড করে দাচোকারো মনাস্টেরিতে নিয়ে গেল।
মরুভূমিতে হাঁটার মতো বরফাচ্ছাদিত পথ, এ-গলি ও-গলি তস্য গলি পার হয়ে পাঁচ মিনিটের পথ পঁচিশ মিনিটে অতিক্রম করে ‘দাচোকারো’ মনাস্টেরিতে পৌঁছুলাম।
এটি একটি গুহা বললে ভুল বলা হবে না। ভিতরে প্রবেশ করে আধো আলো অন্ধকারে একজন ধ্যানমগ্ন বৌদ্ধ ভিক্ষুর দর্শন পেলাম। কথিত আছে এনার বর্তমান বয়স আড়াইশ থেকে তিনশ বৎসর হবে। ইনি ধ্যানরত অবস্থায় সমাধি লাভ করেছেন। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস ওনার শরীরের ভিতরে প্রান থাকলেও জ্ঞান নেই। প্রাচিন ইতিহাস অনুযায়ী বৌদ্ধ ভিক্ষুর এই অবস্থাকে ‘দাচোকারো’ বলা হয়। সেইজন্যে কালক্রমে এই গুহার নাম হয়ে গেছে ‘দাচোকারো’ মনাস্টেরি। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের আরও বিশ্বাস, ওনার আত্মা পরমাত্মায় পরিনত হয়েছে, স্বয়ং ভগবান বুদ্ধদেব ‘দাচোকারোর’ শরীরে বিরাজমান। আমি শ্রদ্ধাশীল হয়ে প্রণাম জানিয়ে প্রার্থনা করলাম, যে মহান কাজের দায়িত্ব নিয়ে এসেছি তা যেন সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করতে পারি।
২০/০৩/১৯৮৫
দোঙ-জঙ-পা লামার বলে দেওয়া গণ অন্তেষ্টিক্রিয়ার মন্ত্র আমার প্রায় মুখস্থ। আজ ললিত বজ্র লামা আমাকে শেখালেন কি ভাবে হাজার হাজার আত্মাকে একত্রিত করতে হবে। আত্মা প্রসঙ্গ উঠতে আমি ললিত বজ্র লামার কাছে জানতে চাইলাম যে, দাচোকারো গুম্ফার ভিক্ষুর কি অন্তেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছিল? যদি না হয় তো তাঁর আত্মাও কি অন্য পাঁচটা অতৃপ্ত আত্মার মতো মুক্তির আশায় ঘুরে বেড়াচ্ছে? উনি কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করে বললেন-” আমাদের বিশ্বাস উনি দেহ রাখেননি,কারন ওনার শরীরে এতো বছরেও পচন ধরেনি, শুধু মাত্র কাষ্ঠের ন্যায় শীর্ণকায় হয়েছে, এই আত্মা পুণ্যাত্মা, ঈশ্বর সম। ওনার আত্মা স্থুল দেহ থেকে বেরিয়ে সূক্ষ্ম দেহে অন্য শরীরে প্রবেশ করে তাঁর কর্ম করে যাচ্ছেন। কর্ম শেষে আবার হয়ত এই স্থুল শরীরে প্রবেশ করবেন। এই সব আত্মা সীমাহীন বিচরন করেন, অন্তেষ্টিক্রিয়ার প্রয়োজন হয় না। দুই ধরনের আত্মা ইহলোকে ঘুরে বেড়ায়–
১. অশরীরী আত্মা—
কিছু মানুষের মৃত্যুর পর বিভিন্ন কারনে অন্তেষ্টিক্রিয়া না হলে তাদের আত্মা মুক্তির জন্যে ইহলোকে ঘুরে বেড়ায়। এই আত্মা তার উপস্তিতির জানান দেয়, তবে কিছু বুঝানোর জন্যে। এরা মানুষের কোনো ক্ষতি করতে পারেনা। এই আত্মাকে বলে অশরীরী আত্মা। যাদের মুক্তির জন্যে আপনার এই কৃচ্ছসাধন।
২. পরমাত্মা—
মনুষের পরপর কয়েকটি জীবনে পুণ্য অর্জিত আত্মাই পরমাত্মা। এই আত্মাকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি বলা হয়। এ-সব আত্মার অন্তেষ্টিক্রিয়ার প্রয়োজন হয়না। সুক্ষ্ম দেহে এদের অবাধ বিচরন। আত্মা কিভাবে ঈশ্বরে রূপান্তরিত হয়, একটা হিন্দু মন্দিরের গল্প বলি শুনুন—
১৯৬৮ সাল, অক্টোবরের ৪ তারিখ। ভারত চিন সীমান্তে পাহারারত সেনা কর্মীদের একজন, নাম হরভজন সিং। তিনি সেনাকর্মীদের জন্য খাবার রসদ নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে ডোকলা ভ্যালি থেকে ডোঙ্গাতে আসছিলেন। দুর্ভাগ্য বশত পা পিছলে তিনি ঘোড়াসহ খাদে পড়ে যান। এবং বরফ গলা ঠাণ্ডা জলে ভাসতে ভাসতে দুই কিলোমিটার পথ চলে গিয়ে ঠাণ্ডা ও পাথরের আঘাতে মারা যান। সহকর্মী সেনারা তাঁর খোঁজ না পেয়ে অনুমান করেন, হরভজন সিং ঠাণ্ডার ভয়ে কাজ ছেড়ে পালিয়ে নিজেকে রক্ষা করেছেন। এই ঘটনার সপ্তা দুয়েক পর এক সেনাকর্মীকে হরভজন সিং স্বপ্নে জানান- তিনি পালিয়ে যাননি,মারা গেছেন। কি ভাবে তিনি মারা গেছেন, এবং তাঁর নশ্বর দেহটি কোথায় পড়ে আছে তা-ও জানিয়ে দেন। স্বপ্নে তিনি এটাও বলেন,অতন্দ্র প্রহরী হয়ে তিনি সীমান্ত রক্ষা করবেন। তার এই ইচ্ছার যেন স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এরপর সীমান্তে পাহারারত সেনা কর্মীরা মাঝে মাঝেই কিছু কিছু অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী হয়, যা যুক্তি তর্ক বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। যেমন ভারতীয় সেনারা কেউ গুলি না চালিয়েও পরিষ্কার গুলির শব্দ শুনতে পেত, যেটা চিনা বাহিনীর হাত থেকে ভারত সীমান্ত রক্ষা করার নমুনা। এমন অনেক অলৌকিক ঘটনা ঘটতে থাকল। যেখানে বিজ্ঞানের ব্যাখ্যার শেষ, সেখান থেকেই ঈশ্বরের শুরু। ফলে এই ঘটনার পর ভারতীয় সেনাবাহিনীর তরফ থেকে ১৯৮২ সালের ১১ ই নভেম্বর উক্ত স্থানে তাঁর নামে ( বাবা হরভজন সিং) মন্দির স্থাপন করা হয়। বহু হিন্দু ভক্ত ওখানে পূজা দেন, মানত করেন। শুনেছি তাদের মনস্কামনা পূর্ণ হয়। আপনি-ও ওখান থেকে ঘুরে আসতে পারেন।
২৭/০৩/১৯৮৫
আজ দোঙ জঙ পা লামা আমাকে দেখা করতে বলেছেন, কারন তিনি কিছু উপদেশ দেবেন এবং কয়েকটি শতর্ক বাণী স্মরণ করিয়ে দেবেন। আমি যেন গণ অন্তেষ্টি কর্ম ঠিকঠাক সম্পন্ন করতে পারি। আমি ওনার কক্ষে প্রবেশ করে দেখি তিনি চোখ বন্ধ করে কোষ্ঠী পাথরের মালা জপছেন। চোখ বন্ধ অবস্থায় আমাকে বসতে বললেন। ললিত বজ্র লামাও আমার পাশে বসলেন।
তিব্বতি ভাষায় তিনি বললেন, প্রথমে দুটো নদীর মিলন স্থলে যেতে হবে, এবং অবশ্যই মোহনা সংলগ্ন শ্মশান থাকতেই হবে। উক্ত স্থল যত নির্জন হবে গণ অন্তেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করতে ঠিক ততোটাই সুবিধা হবে। দিনের বেলা আনুষ্ঠানিক ক্রিয়া কর্ম গুলো সেরে নিতে হবে। ভরা অমাবস্যায় রাত বারোটার পর শ্মশানের মড়া পোড়ানো জ্বলন্ত কাঠে পিণ্ডটাকে লিট্টির ন্যায় সেঁকে নিতে হবে। সূর্য অস্তের সাথে সাথেই আত্মার অস্তিত্বের টের পাওয়া যাবে, তবে পিণ্ড তৈরী থেকে দান অবদি আত্মার উপস্থিতি প্রকট হবে। তখন প্রয়োজন মতো উচ্চ স্বরে মন্ত্র উচ্চারন করতে হবে। যাতে সেই শব্দের থেকে মন্ত্র উচ্চারণের শব্দের জোর বেশি হয়। ওই সকল আত্মার মধ্যে কিছু অতৃপ্ত আত্মাও আছে যারা মুক্তি চায়না। ইহলোকের শরীরী আত্মার পাশে থেকে উপস্তিতির প্রমাণ দিতে বেশি পছন্দ করে। তারাই উৎপাত করবে, তবে পিছিয়ে পড়া যাবেনা। গণ অন্তেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হলে উপস্থিত সমস্ত অশরীরি আত্মার মুক্তি হয়ে যাবে, এবং সেটা পরিষ্কার অনুভব করা যাবে।
কাছাকাছি এমন শ্মশান সংলগ্ন মোহনা আছে রংপোতে। তিস্তা ও রঙ্গিত নদীর মোহনা। নির্জনতা বিরাজমান, সারাদিনে গুটি কতক মৃতদেহ আসে। অদূরে একটা ছোট গোর্খা কলোনি ছাড়া আর কোনো লোকজনের বসবাস নেই।
সিদ্ধান্ত হল আগামী কৌশিকী অমাবস্যায় আমি গণ অন্তেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করতে রংপো যাব। সেই মোতাবেক আমাকে প্রস্তুতি নিতে হবে।
(এর পর আগামী সংখ্যায়…)