দমদম ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনের সন্নিকটে এক নম্বর রেলগেটে প্রচন্ড ভিড় দেখে থমকে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। সময়টা ঠিক সন্ধার পূর্ব মুহূর্ত। দিনের আলো নিভে যেতে বসেছে তাই সুউচ্চ বাতিস্তম্ভের লাইট জ্বলতেই চতুর্দিকে ঝা চকচক হয়ে উঠলো। রেলগেট সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়ায় পথ চলা মানুষের প্রচণ্ড ভিড় জমে উঠেছে। বিশাল ট্রলারে করে প্রায় ৬০ ফুট দৈর্ঘ্যর আনুমানিক ৫০ মেট্রিক টন ওজনের প্রচন্ড ভারী ঢালাই ভিমটি এনে উঁচু দুটি পিলার স্তম্ভের উপরে তোলার কাজ চলছে। অবশ্য সব ঢালাই ভিমের দৈর্ঘ্য সমান হয়না।দুটি পিলার স্তম্ভের দূরত্ব অনুযায়ী ভীমের দৈর্ঘ্য কম বেশি হয়। আজ স্বচক্ষে যেটি দেখলাম তার বর্ণনা এখানে উল্লেখ করেছি। এই মুহূর্তে নোয়াপাড়া থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত মেট্রো রেলের কাজ খুব দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। দমদম, দক্ষিণেশ্বর এবং নিউ গড়িয়ার পর এবার কলকাতা মেট্রো ও পূর্ব রেলের গুরুত্বপূর্ণ জংশন হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে চলেছে দমদম ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন। মেট্রোসূত্রে জানা যায় দমদম ক্যান্টনমেন্ট মেট্রো স্টেশনে ছয়টি স্কেলেটর, তিনটি লিফট, বাইরে সাতটি সিঁড়িও থাকবে এবং থাকবে ১৬ টি গেট। নোয়াপাড়া, বারাসাত ভায়া বিমানবন্দর রুটের অর্থাৎ কলকাতা মেট্রো লাইনের নোয়াপাড়া থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত এই বছরই অক্টোবরের মধ্যেই মেট্রো রেল চলা নিয়ে মেট্রো কর্তৃপক্ষ আশাবাদী। বনগাঁ,হাসনাবাদ লাইনের অসংখ্য নিত্যযাত্রীরা কলকাতায় যাতায়াতের জন্য এই পথ বেছে নেবেন বলে মনে করছেন।আবার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যাত্রীরা সুবিধামতো নোয়াপাড়া স্টেশন হয়ে বিমানবন্দরের দিকে বারাসাত পর্যন্ত যাতায়াত করতে পারবেন এবং বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যার যার সুবিধামতো যাত্রীরা শ্যামবাজার,রবীন্দ্র সদন, টালিগঞ্জ,কবি সুভাষ স্টেশনের দিকেও যেতে পারবেন। দমদম ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনের তিন নম্বর প্লাটফর্মের পশ্চিম দিকে বিগত বছরগুলিতে বিশাল বিশাল পিলার স্তম্ভের নির্মাণ কাজ তিন নম্বর প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন সময়ে অনেক রেলযাত্রীরা উৎসুক নয়নে দেখেছে। আমিও বাদ যাইনি। অনেকদিন দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা প্রত্যক্ষ করেছি। দিনের পর দিন আস্তে আস্তে সেই সব নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে সেখানে ইতিমধ্যে তৈরি হয়ে উঠেছে দমদম ক্যান্টনমেন্ট মেট্রো স্টেশন। এই মুহূর্তে নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলেছে এক নম্বর রেলগেট হয়ে বাগজোলা খালের দিকে। যেখানে একসময় ছিল রেলের জমিতে বসবাসকারী রেল কলোনি। মেট্রোরেল সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে রেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বস্তিবাসীদের বিভিন্ন সময়ে দফায় দফায় আলোচনার মাধ্যমে সেই সমস্যার সমাধান করা হয়।সেই সমস্ত বস্তিবাসীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয় বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে দিল্লি রোডের কাছে। তারপর মেট্রোরেলের কাজ শান্তিপূর্ণভাবে এগিয়ে যেতে থাকে নোয়াপাড়া স্টেশনের দিকে। বছরের পর বছর চলতে থাকে এই নির্মাণ কার্য। বিভিন্ন সময়ে এই নির্মাণ কান্ডের যৎকিঞ্চিত চোখে পড়লেও আজ এমন আকর্ষণীয় দৃশ্য দীর্ঘ সময় ধরে দেখবার সৌভাগ্য হ’লো। ব্যস্ত জীবন যাত্রার মাঝে খুব সতর্কতার সঙ্গে চলছে এই নির্মাণ কাজ।তার মাঝেই আপ এবং ডাউনে অনবরত যাতায়াত করছে যাত্রীবাহী ট্রেন। অসংখ্য দর্শক লাইনের পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে এই নির্মাণকার্য। তাদেরকে সতর্ক করতে নিযুক্ত কর্মীরা হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। সেখান থেকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিলেও ঘুরে ফিরে আবার অন্য জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছে। আসলে এমন দৃশ্যতো সব সময় দেখার সৌভাগ্য হয় না! আমিও প্রাণ ভরে এমন দৃশ্য উপভোগ করে চলেছি। তবুও মনের মাঝে একটা উৎকণ্ঠা জাগ্রত হয়ে রয়েছে। সংকীর্ণ জায়গার মাঝে অসংখ্য যাত্রীর চলাচলে কখন বুঝি অসতর্কতায় ঘটে যায় কোন অঘটন!! এই অবস্থার মধ্যেও আপ এবং ডাউনে অনবরত ট্রেন যাতায়াত করছে।সেই অবস্থার মধ্য দিয়ে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে করে চলেছি ভিডিও রেকর্ডিং সহ বিভিন্ন পোজে কিছু কিছু ছবি। প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে এপাশ ওপাশ সব ঘুরে ফিরে দেখলাম। রেলগেটের দুই পাশেই যাননিয়ন্ত্রণের জন্য নিযুক্ত রয়েছে নির্দিষ্ট কর্মীবৃন্দ। উপস্থিত রয়েছেন এই নির্মাণ কার্যে নিযুক্ত ইঞ্জিনিয়ার সহ উচ্চপদস্থ কর্মীরা। খুব সতর্কতার সঙ্গে গেট পারাপারে অপেক্ষারত যাত্রীদের কিছুক্ষণ বাদে বাদে নিজ নিজ গন্তব্যের দিকে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করে ভিড় হালকা করে চলেছে তারা। সকল কর্মীদের ভিতর প্রবল ব্যস্ততা পরিলক্ষিত হল। অযথা সময়ের অপচয় না করে দ্রুত গতিতে সতর্কতার সঙ্গে কাজ এগিয়েই চলেছে। দেখলাম নির্মাণ কার্য অব্যাহত রেখে চলেছে পথযাত্রীদের নিয়ন্ত্রণের মাঝেও সঠিক পরিষেবা। খবর নিতে গিয়ে জানলাম হঠাৎ নিম্নচাপের দরুন বৃষ্টি হওয়ায় জমাকৃত জল নিষ্কাশনে ব্যাহত হওয়ায় এলাকায় বাসিন্দাদের চরম দুর্ভোগে প্রচন্ড ক্ষোভ জমে উঠেছে। অভিযোগ পেয়ে দ্রুতগতিতে জল নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হয়। বৃহত্তর কাজের স্বার্থে সামান্য দুর্ভোগ ও কষ্ট একটু মানিয়ে অবশ্যই নিতে হয়। একথা সবাই না বুঝলেও যারা বোঝে তারা অন্যদের ক্ষোভ নিবারণের স্বপক্ষে চেষ্টা চালিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো। সমবেত উৎসুক জনতা সবাই তো সমান স্বভাব চরিত্রের হয় না! তাদের মাঝে কেউ কেউ দেয় উস্কানি কেউবা আবার বৃহত্তর স্বার্থের দিকে তাকিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করে। চলন্তাবস্থায় বিভিন্ন পথচারীর বিভিন্ন রকম মন্তব্য প্রকাশ হতে থাকে। তবুও তার মাঝে জরুরী ভিত্তিতে নির্বিঘ্নেই নির্মাণ কার্য এগিয়ে চলেছে। একত্রে দুটি ক্রেন একসঙ্গে সমানতালে আস্তে আস্তে ভীম টিকে উপরের দিকে টেনে তোলায় তখন ব্যস্ত।যারা এমন দৃশ্য কখনও দেখেনি তারা উৎসুক নয়নে তাকিয়ে রয়েছে সেদিকে। দুটি পিলার স্তম্ভের দুরত্ব প্রায় ৬০ ফুট। নিচে ঢালাইকৃত আনুমানিক ৫০ মেট্রিক টন ওজনের এই বিশাল ঢালাই ভীম দুটি বিশাল অত্যাধুনিক ক্রেনে করে সুনিপুভাবে খুব সন্তর্পনে টেনে তুলছে উপরে। ধীরে ধীরে মন্থর গতিতে এই বিশাল ঢালাই ভীমকে টেনে তুলে চলেছে দুটি ক্রেনে। দুটি পিলারের দুই পাশে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে দাঁড়িয়ে রয়েছে কর্মরত কর্মীবৃন্দ। ঢালাই পিলারের উপরে ঢালাই ভীম বসাবার আগেই উভয়ের মাঝখানে তারা চার ইঞ্চি পুরু রাবারের বিয়ারিং সেট করে দেয় যাতে ট্রেন জ্বলন্তাবস্থায় জার্কিংয়ের ফলে উভয়ের সংযোগ স্থলে কোনপ্রকার ক্ষয়প্রাপ্তি না ঘটে। উৎসুক জনতার নজর সেদিকে। আমি সমানে দেখেই চলেছি। সেই সাথে করে চলেছি রেকর্ডিং। সঙ্গে বিভিন্ন পোজে কিছু কিছু ছবি। এমতাবস্থায় ঠিক আমার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা বহু লোকজনের মধ্যে একজন বলে উঠলো- “আহা!দেখিলাম আজ যাহা -এতদিনে তাহা দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া————-!!”