যাত্রাপথের আনন্দগান
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
শেষ বসন্তের মত মেঘপ্লাবী বর্ষাকালের অন্তিম লগ্নটিও নেহাত অসুন্দর নয়। তাই অন্য সময়ের শীর্ণদেহী কোপাই নদীটি এখন যৌবনজলতরঙ্গে বেশ স্ফীতা হয়ে আকূলিতা। চারিপার্শ্বিক আম্রকুঞ্জ সহ অন্যান্য বনবীথিকাগুলিও এখন
ধারাবর্ষণের আবেশে যেন পরম মুক্তিস্নাতা।
এই ‘মুক্তিস্নাতা’ শব্দবন্ধটির মধ্যে থেকে আজ সকাল থেকেই ‘মুক্তি’ শব্দটাই থেকে থেকে যেন কানে এসে কেবল বাজছে।
তাই ওঁর মনটি কার্যত যেন উদাসী হয়ে আছে। আজকাল আশীতম ২৫শে বৈশাখের পরে এসে টের পাচ্ছেন যে তাঁর এতদিনকার শ্রবণশক্তিটিও তাঁর দুটি চোখের গভীর প্রাণময় দৃষ্টিপথের অসহজতাকে আশ্রয় করে ধীরে ধীরে যেন অশ্রুত থাকার নতুন দায়িত্বটি নিয়ে ফেলেছে বলে অনেক জাগতিক শব্দ যেন ক্রমে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে।
প্রিয় চিকিৎসক বিধান সহ আরো অনেকজন প্রাজ্ঞ চিকিৎসকের মতে এখন নাকি তাঁর কলকাতায় আসা খুব প্রয়োজন। এমনকি বন্ধুবর নীলরতন সরকারের ও এবিষয়ে সহমত হওয়াটি তাঁকে বুঝতে শিখিয়েছে যে বিজ্ঞানের নবলব্ধ প্রচেষ্টায় একটি ছোট অস্ত্রোপচারের নব উদ্যমে আবার প্রায় স্বাভাবিক করে তোলা যাবে আটটি দশক অতিক্রান্ত ক্লান্ত এই নরদেহটিকে। তবে তিনিও জানেন যেমন ‘সাবধানের মার নেই তেমনই তা অতি সহজেই ‘মারেরও সাবধান নেই’ পর্যায়ে বদলে যেতে পারে। তাই রথী -প্রতিমা সহ আর সকলের চোখে মুখে পুনর্যাপনে আশাটি একঝলক বসন্তবাতাস হয়ে বয়ে গেলেও কবি আজ থেকে থেকেই ক্রমে ভাবুক ও তন্ময় হয়ে পড়ছেন।
দেহমনের বাধা পেরিয়ে অচেনা সুদূরের নানা চেনা অচেনা ঠিকানা এসে মনের মধ্যে বারে বারে এসে লোভ দেখিয়ে যাচ্ছে পরমঘন প্রশান্তির।
…….
শান্তিনিকেতনের পালা সাঙ্গ করে অবশেষে আজ তাঁর কলকাতা যাওয়া হচ্ছে। এই ব্যাপারে সহৃদয়তা দেখিয়ে রেলকোম্পানীর একটি বিশেষ কোচও নাকি এবার জুড়ে দেওয়া হবে সপার্ষদ তাঁর কলকাতা যাত্রায়।
সবাই তাতে বেশ খুশী হলেও ভুবনডাঙার মাঠ থেকে নিজেকে বিযুক্ত করে এবারে আর জোড়াসাঁকোর সেই বিখ্যাত মহর্ষি ভবনের চেনা অলিন্দের ভিতরে নিজেকে আর নিয়ে যেতে ইচ্ছা করছেনা।
বরং ‘ওই আসনতলে…মাটির ‘পরে লুটিয়ে রব…’ এই গানটির কথাবৃত্তে থেকে যেতে ভীষণ ইচ্ছা করছে।
গাড়ী ছাড়ার আগে একবার চোখ মেললেন তিনি। দেখলেন স্টেশনের বোলপুর লেখা সাইনবোর্ডটা যেন থেকে থেকেই ভাস্বর হয়ে উঠতে উঠতে মিলিয়ে যাচ্ছে ঘনঘোর কুয়াশায়।
…….
– ” ওলো ছোঁড়া….ওঠ্ ওঠ্ ! একবার কর্তামায়ের ঘরে যা দিকি! আর বোধহয় শেষরক্ষে হবেনে…!”
দাসীর খোঁচায় ঘুমচোখে বালক বয়সে প্রথম সাক্ষাৎ তার সাথে। এখনও মনে আছে, মায়ের পায়ের আঙুলগুলির বদলে তা যেন সেদিন একরাশ জুঁইফুলের পাপড়ির স্পর্শবোধে বদলে গিয়েছিল। সেসব অনুভূতি এখনও যেন মনের মধ্যে জেগে আছে বলে শিউড়ে ওঠার সেই শীতল মন্দ্রক্ষণটি আজও যেন একইরকমের হয়ে থেকে গেছে।
তাই তো চলে যাওয়ার দিনে ছোটবৌ মৃণালিনীর পা’দুখানিকে আর ছুঁতে দেননি কিশোর বয়সী রথীন্দ্রনাথকে।
তবে আজকাল জীবনের উপান্তে এসে বুঝতে পেরেছেন যে মাধুরীলতা, বেলা আর শমী সবার চলে যাওয়ার পরেও তাদেরও একান্ত প্রিয়স্পর্শগুলি যেন সেই জুঁইফুলের পাপড়িগুলোর মত হয়ে আজও যেন মনের গভীরে জেগে আছে।
স্টেশন সংলগ্ন আকাশবাতাস “…. সব হতে আপন…” এর মূর্ছনায় প্লাবিত হতে হতে ডিসট্যান্ট সিগনালের সাথে মিলিয়ে গেল তাঁর লালিত রাঢ়ভূমির চেনা বারান্দাটিও।
…….
সেদিনও তো জ্যোতিদাদা ফিরে আসতে আসতে সবটা শেষ হয়ে গেছিল। মনে পড়ছে এক ম্লান মল্লিকার মালা গলায় পরে অতি স্তিমিত এক মায়াবী আলোয় ধীরে ধীরে পা ফেলে সংসার থেকে চলে যাচ্ছেন ‘হেকেটি’ ! তাঁর নতুন বৌঠান। বাবামশায়ের সংসারে সেদিন সব অপমানের জ্বালা জুড়িয়ে তার সেই চলে যাওয়ার মলিনতাটি কি না ভুলতে পেরে আবার পরে আবার ফিরে এসেছিল, ‘রাহুর প্রেম’ লেখবার সময়ে?
“…শুনেছি আমারে ভালোই লাগে না, নাই বা লাগিল তোর । লোহার শিকল-ডোর । প্রাণের বাঁধন দিয়েছি প্রাণেতে, দেখি কে খুলিতে পারে । একবার তোরে দেখেছি যখন কেমনে এড়াবি মোরে?”
…….
আস্তে আস্তে অনেকগুলো স্টেশনের পর স্টেশন এসে ক্রমশঃ যেন কাছে ডেকে নিচ্ছে কল্লোলিনীর কালোত্তীর্ণ কোলাহলটিকে।
তবে তিনি এখন কাঁচের কালো চশমাটিতে ঢেকে নিয়েছেন বলে তাঁর সংবেদী অশ্রুস্নানের ধারাপাতটি কেউ আর দেখতে পাবেনা। এই যাত্রাপথটি আসলে তাঁর ‘যাওয়া তো নয় যাওয়া’ কথাটির মত অবশেষে নির্বাপণের এক অনলপ্রবেশের শুভ সূচনা।
…….
একবার যেন মনে হল তাঁর এই রেলের কামরাটি যেন আর কামরা নেই। সবটা যেন পালাবদলের খেলায় আজ হয়ে উঠেছে একটা জানলা বন্ধ বদ্ধ ঘরের মত। আর সেখানে তিনি যেন এক বালকের বেশে শুয়ে চিরনিদ্রার আবেশে ঘুমাতে শুয়েছেন।
দেখতে পেলেন তাঁর সামনে এখন একটি বালিকামূর্তি সলজ্জ হরিণশিশুর ছন্দে এসে বসল। সে যেন অবিকল তাঁর চেনা সুধার মত সেই বালকবীরের মাথার কাছে একগোছা সাদা রঙের ফুল এনে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে খানিক পরে উঠে কোথায় যেন চলে গেল।
মনে হচ্ছে, অবিস্মৃতির জগতে বোধহয় এভাবেই বোধহয় থেকে যাবে একেকটি তাঁর সমস্ত জীবন ধরে আহরিত সব অক্ষরবৃত্তেরা।
…….
আহ্! এখন একটু ঘুম আসছে যেন।
তার সঙ্গে মহাকালের মন্দ্রিত আহ্বান ধ্বনি তাঁকে কেবল ডেকে নিয়ে যাচ্ছে এক অবিরাম আনন্দলহরীর ভিতরমহলে।
আচ্ছা! রানী বা প্রতিমাকে কাছে ডেকে যদি অস্ফূট স্বরে হলেও তাঁর শেষ অক্ষরবৃত্তের রূপে সমর্পণের শেষতম অঞ্জলি কয়েকটি যদি দিয়ে যেতে পারেন, তাহলেও কি ওরা সেটুকূ কথা ওঁর হয়ে লিখে রাখতে পারবে না ? এসব সংশয়টির মধ্যে যেন শুনতে পাচ্ছেন একটি কন্ঠস্বর। সেটি জেগে উঠে ক্রমে খুব দূরে এসে মিলিয়ে যাচ্ছে আসছে।এ তো বাবামশায়ের কন্ঠে গীত সেই –শুক্লযজুর্বেদের প্রার্থনার মহামন্ত্রটি, ” …..পিতা নো বোধি নমস্তেহস্তু
মা মা হিংসী।। /বিশ্বানি দেব সবিতর্দুরিতানি পরাসুব/ যদ্ভদ্রং তন্ন আসুব…..॥ “
তবে মনে হচ্ছে এই ধীমান বৃদ্ধ মহর্ষিটি যেন ঠিক তাঁর বাবামশায় নন। বরং অচিনপুরের দ্বারটিতে দাঁড়িয়ে তাঁকে আহ্বান করছেন এক বৈদিক সাধক ঋত্বিক।
……..
তাঁর মনটি এবারে বেশ বড় প্রফুল্ল হয়ে উঠল । যদিও আগে হলে খুব সহজেই এরকম সময়ে হাম্বীর রাগে তিনি তেওরায় তাল ঠুকে গেয়ে উঠতে পারতেন,
“…আর কত দূরে আছে সে আনন্দধাম।
আমি শ্রান্ত, আমি অন্ধ, আমি পথ নাহি জানি ॥রবি যায় অস্তাচলে আঁধারে ঢাকে ধরণী করো কৃপা অনাথে হে বিশ্বজনজননী….”
সেই আনন্দগানটির সমস্ত কথা ও সুর এখন যেন এক সংবেদী সমর্পণের জন্য নির্বাক হয়ে থেকে নিজেকে তৈরী করছে আগামীদিনের অস্তপথের কোলে তার চিরনিবেশের জন্য।
—ooXXoo—