“সেই প্রভাতে নেই আমি”
*********
~~:: শ্যামাপ্রসাদ সরকার ::~~
অসুখটা এবার বোধহয় সারবেনা। আর
না সারলেও যদিও বিধাতাকে কোন দোষ দেবেন না তিনি। আশিবছরেও যদি সব কলকব্জা ঠিকমতই চলে তবে আর বয়স হবার কি মানে?
এখনো সূর্যোদয়ের আগে ঘুমটা ভাঙে নিয়ম করে। মুখহাত ধুয়ে বারান্দায় চেয়ার পাতা আছে সেখানে একটু বসে উপাসনা করেন । পুব আকাশে লালিমার আলিম্পন দেখতে দেখতে মনটা স্বাভাবিক ভূমি ছেড়ে যেন ভূমাকে খুঁজতে বের হয়। এসময়টায় প্রতিদিন একবার তাঁর নবজন্ম হয়। ঋষিকল্প পরম সত্যজ্ঞানকে শুধু উপনিষদের পাতায় নয়, দীর্ঘজীবন ধরে নিত্য জন্ম-মৃত্যুর প্রবাহপথে উপলব্ধি করেছেন। মৃত্যুর এই ভয়ংকর সংহারী বিচ্ছেদ প্রকাশের জন্য নিজের এই একাকিত্বময় দীর্ঘায়ুটিকেই মাঝেমধ্যে অভিশাপ বলে মনে হয়।
কাল রাতে আবার জ্বর এসেছিল। মরসুম বদলের শিরশিরানি বয়ে আসছে দক্ষিণের বাতাসে। ধীর পায়ে ওপরের ঘর থেকে আস্তে আস্তে নীচে নেমে এলেন। আপাতত সবাই নিদ্রামগ্ন। এখন তাঁর আম্রবীথির পথটা ধরে খুব হাঁটতে ইচ্ছা করছে।
একটি দিনের প্রাকসূচনার পরিবেশটি বড় মধুর। রাত্রির অন্ধকার আর দিনের প্রখরতার মাঝামাঝি এ এক অলীক মুহূর্ত। মোটামুটি সত্তর বছর ধরে রোজ একবার করে দেখেও আজও তা তাঁর কাছে পুরনো হয়নি। আর কলকাতা ফেরত যেতে ইচ্ছে করেনা। বাকী কটা দিন যদি এখানেই……….
সামনে বসন্তোৎসব। আশ্রমিকদের মধ্যে ব্যস্ততা তাই নিয়ে। এবারে ‘বসন্ত’ নাটকটি এরমধ্যে অভিনয় হবার কথা। মহলাঘর থেকে এইটুকুই সংবাদ এসে পৌঁছেছে তাঁর কানে। ‘বসন্ত’ নাটকটির মধ্যে তিনি আজীবন ওই বালক বীরের বেশে আসা সেই নতুন কবিটির পদধ্বনিটুকু অনুভব করেন। নজরুলকে ওটা উৎসর্গ করা নিয়েও অনেকে আপত্তি তুলেছিলন। কিন্তু তিনি সিদ্ধান্তে তবু অনড় ছিলেন। নজরুলের চিরতারুণ্য আর উচ্ছ্বাস তাঁকে বড় আনন্দ দেয়। পুত্র শমী’র হুল্লোড়ে ভাবখানা তার মধ্যে যেন খানিক দেখতে পান। ওরা বয়সে বোধহয় খুব একটা বেশী ছোট বড় হবেনা।
আম্রবীথির লালমাটি একটু একটু করে ফুটে উঠছে গোলাপী দিনের আভায়। তার ফাঁকে ফাঁকে হরিদ্রাভ মুকুলগুলিও আজ হাওয়ায় দুলে দুলে উঠছে।
” মোর শূন্য ডালে বাজিবে সেদিন তালে তালে, চরম দেওয়ায় সব দিয়েছি মধুর মধুযামিনীরে…”
এই লাইনগুলি রচনার সময় অবশ্য এতটা স্পষ্ট চোখে দেখে লেখেন নি। কিন্তু এখনকার দৃশ্যটির সাথে কিন্তু তা বেশ মিলে গেছে!
প্রসন্ন মনে হাঁটতে হাঁটতে তিনি বাম দিকে কিঙ্করকে দেখতে পেলেন। মাটির ঢেলা ঘষে ঘষে সে কি যেন একটা খুঁজছে তন্ময় ভাবে। তিনি হঠাৎ সামনে চলে এলে ও সতর্ক হয়ে উঠবে ওঁর আগমনে। তার খেয়ালী শিল্পীমন তখন দেবে ছুট। অন্যদিকের পথ ধরলেন তাই।
আকাশে আলো ফুটে গেছে এবার। সবাই এবার তাঁর খোঁজ করবে। বনমালীও তার বাবামশায়ের জলখাবার বানিয়ে রথী আর প্রতিমা’কে খবর দিতে যাবে। বিধানের কথামত এককাপ করে ওভ্যালটিন প্রত্যহ সেবন করতে হচ্ছে। সবাই চাইছে তিনি তাড়াতাড়ি এবার সুস্থ হয়ে উঠুন।
কিন্তু উপাসনা সময় টের পান যে
‘শান্তম শিবম অদ্বিতীয়ম্’ তাঁর গানে, তাঁর ধ্যানে সেই মহাস্থিতির আসন এবারে ক্রমশ দুলে উঠছে।
তাই কি দু’ চোখের কোণে কি তবে আনন্দ অশ্রুখানি একটু দেখা দিল? সেই কবে যুবাবয়সে ‘মরণ রে তুঁহু মম শ্যাম সমান’ লিখেছিলেন ঠিকই কিন্তু জীবনভর ধারাবাহিক মৃত্যুর প্রবাহে তাকে মেনে নিতে পেরেছেন কঠিন হয়ে যদিও, প্রাণ ঢেলে ভালবাসতে তো পারেন নি।
তিনি টের পান , এই তাঁর জীবনের শেষ বসন্ত।
প্রকৃতি সামনের বছরও এসে আমের বনে ঘুম ভাঙিয়ে দেবে দখিনা বাতাসের চুম্বন স্পর্শে..
কেবল তাঁর বিরামকক্ষটির জানলাপথে কোনও আয়ত চক্ষু জরা জয় করেও তা দেখতে পাবেনা।
নীরবে যেন একটু হাঁটার গতি শ্লথ হয়ে এল।
মনে পড়ে গেল যে সেই আগামীদিনের অসম্পূর্ণতাকে দূরে রেখে চির বসন্তকে তিনি আগে থেকেই বরণ করে রেখেছেন –
” দখিন হাওয়া, জাগো জাগো, জাগাও আমার সুপ্ত এ প্ৰাণ / আমার কিছু কথা আছে ভোরের বেলার তারার কাছে,সেই কথাটি তোমার কানে চুপি চুপি লও । ধীরে ধীরে বও ওগো উতল হাওয়া………” কোনও আগামী বসন্তকালে বসন্তসখের মত কূজন আর না করতে পারলেও তাঁর মনখারাপ হবার কোন কারণ রইল না।
(সমাপ্ত)