দৃশ্যদূষণ
শঙ্কর আচার্য্য
মানুষ চোখ দিয়ে যা দেখে, সেসব চোখেই ক্যামেরাবন্দি হয়। সেই দৃশ্য চলে যায় মাথার সেন্ট্রাল নার্ভ সিস্টেমে (CNS)। এরপর কি করনীয় CNS তার সিদ্ধান্ত রিফ্লেক্টরের মাধ্যমে বার্তা পাঠায় এবং শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো সেই নির্দেশ মতো কাজ করে।
এখন দৃশ্য যদি প্রচলিত নিয়মের বহির্ভূত হয়, তবে নার্ভ বা স্নায়ুগুলো ক্লিষ্ট হয়। এরই নাম দৃশ্যদূষণ।
পথে চলতে গেলে এমন অনেক দৃশ্য আমাদের নজরে আসে, যা আমাদের মনে অস্বস্তি জাগায় যেমন –
পথে চলতে চলতে হঠাৎ দেখা গেল একটি অবোলা জীবকে বেঁধে কোনো ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেউ গলায় পোঁচ মারছে। জীবটি অকাতরে চেষ্টা করছে বাঁচার। চিৎকার করছে। এমন দৃশ্য দেখলে পাষাণেরও মনে করুণা জাগে বৈকি। অথচ ক্রেতা হয়তো মাংস কিনতে এসেছিল। মাংস কিনে বাড়ি ফেরার সময় ওই পীড়াদায়ক দৃশ্য তার বারবার মনে পড়বে। অথচ কোতলের কাজটি পর্দার অন্তরালে করলে এমনটা ঘটতো না।
বছর দশেক আগে পুলিশের সঙ্গে এনকাউন্টারে কয়েকজন মাওবাদী মারা গেছিল। পুলিশ তাকে বাঁশে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছিল, ঠিক যেমনটি করে মৃত পশুকে নিয়ে যাওয়া হয়। তাতে তৎকালীন সময়ে পুলিশের বিরুদ্ধে প্রচন্ড সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। প্রতিটি মানুষ তথা সংবাদমাধ্যম পুলিশের এই অমানবিকতার বিরুদ্ধে এই দৃশ্যদূষণের জন্য প্রতিবাদ জানিয়েছিল।
ধূমপান কিংবা অ্যালকোহল সেবন সরকারি বিধি নিষেধের পর্যায়ে পড়ে। তথাপি মানুষ তা করে। সেসব যদি গুরুজন তথা বয়স্কদের দৃশ্যপটের সামনে করা হয়, তাহলে তা নিশ্চয়ই দৃশ্যদূষণ এর আওতায় পরিগণিত হবে।
মলমূত্র ত্যাগ জীবের প্রাত্যহিক কর্মের মধ্যেই পড়ে এবং তার জন্য নির্দিষ্ট স্থানও তৈরি করা হয়। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় পথিক জনবহুল রাস্তার ধারে কিংবা কারো বাড়ির দেয়ালকে কেন্দ্র করে, কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে সেই অপরিহার্য কাজটি সেরে নিচ্ছেন। দেখলে রাগ তো হবেই। এ নিয়ে বাদানুবাদ এমনকি হাতাহাতি পর্যন্ত ঘটে যায়। কারণ এটি যে পরিবেশ দৃশ্যদূষণের মধ্যে পড়ে এ কথা নিশ্চয়ই কাউকে বলে বোঝাতে হবে না।
ভোটের দামামা বাজলে পরে সংশ্লিষ্ট রাজনীতিবিদরা দৃশ্যদূষণের পরোয়া না করে শহরাঞ্চলে বাড়িগুলির সমস্ত দেয়ালে তাদের ভোট দেওয়ার আবেদন জানিয়ে, লিখে এবং বিকৃত ছবি এঁকে ভরে ফেলে। এটি যে দৃশ্যদূষণের পর্যায়ে পড়ে, এ বিষয়ে তারা যথেষ্ট অবগত আছেন। তবুও করেন। সেই লেখা এবং ছবি ভোট চলে যাওয়ার অনেক পরেও সেই সব জায়গায় অক্ষত থেকে যায়।
একইভাবে অস্থানে হোর্ডিং, ব্যানার, বিজ্ঞাপন প্রভৃতি পুরসভার অনুমতি ছাড়াই লাগিয়ে দৃশ্যদূষণের মাত্রা ছাড়িয়ে চলেছে বাণিজ্যিক সংস্থাগুলি। এগুলির সংখ্যা ও আয়তন ক্রমশ বেড়েই চলেছে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। তবু পুরসভার এ বিষয়ে দৃশ্যদূষণের জন্য কোন হেলদোল নেই।
ট্রেনে ভ্রমণকালে আমরা দেখতে পাই সামনের সিটে বসে থাকা লোকটি বা মহিলাটি বিপরীত দিকের খালি সিটে পা তুলে দিয়ে বসে আছেন। পাশে বসে আছেন জনৈক প্রবীণ। তাকে না দেখার ভান করেই উনি পা নাচিয়ে চলেছেন। তার এই অশোভন আচরণ দৃশ্যকে যে দূষিত করে চলেছে, সেদিকে তার বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই।
এরকম ছোট-বড় অজস্র উদাহরণ আছে যা প্রতিনিয়ত দৃশ্যের মাধ্যমে আমাদের পরিবেশকে দূষিত করে চলেছে। ঘটনা হয়তো ছোট, কিন্তু এর প্রতিক্রিয়া তীব্র এবং সুদূপ্রসারী। যেমন – এক প্রবীণের পাশে বসে তার নাতির বয়সী কোন ছোকরা সিগারেট ফুঁকে চলেছে। তিনি হয়তো পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় তাকে কোনো প্রতিবাদ জানাননি। পরবর্তীতে কোনো কারনে সেই ছোকরা প্রবীণের সাহায্যপ্রার্থী হলে প্রবীণ কিন্তু তাকে এড়িয়ে যেতে চাইবেন। এটাই স্বাভাবিক। তিনি এভাবেই তার প্রতিক্রিয়া তখন ব্যক্ত করবেন। ক্ষেত্রবিশেষে এই ধরনের দৃশ্যদূষণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলেও গণ্য হতে পারে।
অতএব দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে আমাদের উচিত দৃশ্যদূষণ পরিহার করা। কোনটা উচিত, কোনটা অনুচিত, মানুষকে মানুষের বিবেকই বলে দেয়। আমাদের উচিত চলার পথে সেইভাবে নিজেই নিজের কর্তব্য স্থির করে নেয়া।
—oooXXooo—