মাতৃ দিবস
কাকলি ঘোষ
“কি ? বসে থাকব মানে ?”
“ বসে থাকব মানে বসে থাকবে। বাংলা বোঝ না ? ”
“ আচ্ছা ! তো সারা সংসারের কাজগুলো হবে কি করে শুনি ?”
“ আমরা করব। আজ মাতৃ দিবস। তাই তোমার ছুটি। ”
“ আ মরণ ! এসব তোদের ওইl ফেসবুকের কান্ড তাই না ? ভালো। তো আমরাটা কে কে ?”
“ আমরা মানে আমি আর দাদা। ”
“ অ। তো তোরা দুজনে রান্না বান্না বাকি সব কাজ সামলে নিতে পারবি বলছিস ?”
“ অবশ্যই। বাবার তো আজ নেমন্তন্ন বন্ধুর বাড়ি। তো আমি তুমি আর দাদা । ও আমরা ব্যবস্থা করব। কি বলিস দাদা ! ”
“ ইয়েস্। আর শোন রান্না হয়ে গেলে একটা ভালো করে ছবি তুলতে হবে কিন্তু। “
“ ওহ ! সিওর। মার সামনে সব সাজিয়ে দিয়ে একটা ঝক্কাস পিক।”
“ আর তারপর সেটা ফেসবুক এ পোস্ট। ”
“ হুম। বুঝলাম। আমি কিন্তু দোকানের খাবার খাব না। আগেই বলে দিচ্ছি। অতই যদি শখ তাহলে রান্না করে খাওয়াও। ” কঠিন শর্ত রাখেন সুপ্রীতি।
“ Ok মম। তুম দেখতে রহো ”
“ আচ্ছা। ”
মুখ টিপে হেসে ঠাকুর ঘরে ঢুকে গেলেন সুপ্রীতি। করুক যা ভালো বোঝে। জীবনে কোনদিন রান্নাঘরে ঢুকে দেখেছে কি করে কি হয় ? আজ হঠাৎ রান্না করব বলে ক্ষেপে উঠল দুজনে। বুঝবে ঠ্যালা। জানো না তো চাঁদু কত ধানে কত চাল ! শুধু সকালে উঠেই ফরমাশ। দুজনের দুশো রকম।
“ মা — আমার লেবুর জল ”
“ উফফ ! এখনও ব্ল্যাক কফিটা দিলে না ! থাক আর আমার ব্রেকফাস্ট লাগবে না। ” এবার অভিমানে ছলছল কণ্ঠ।
“ একি ! লুচি ! মা ! কতবার বলেছি তোমাকে এসব ময়দা টয়দা আমি খাবো না আর। সেই তুমি গাদা গুচ্ছের লুচি করে সামনে ধরবে। নিয়ে যাও। শোন না। আমাকে একটু ওটস, হানি, অ্যাপল আর দই দিয়ে স্মুদি করে দাও প্লিজ। ”
যেন একশোটা হাত সুপ্রীতির। আর অনন্ত সময়। পান থেকে চুন খসলেই বাবুদের মেজাজ সপ্তমে। তবু তার মধ্যে নিজের মানুষটা একটু আলাদা। কোন বিশেষ চাহিদা নেই। ভোরবেলা উঠে ফ্লাস্কে চা রেখে ছেলে মেয়ের খিদমত খাটতে লেগে পড়েন সুপ্রীতি। তারই মধ্যে কোন রকমে একটু মাছের ঝোল ভাত আর সঙ্গে একটু ভাজা ভুজি ধরে দিলেই তৃপ্ত মুখে খেয়ে চলে যায় লোকটা। তবে গোঁফের আড়ালে সুপ্রীতির খোয়ার দেখে যে হাসে তা স্পষ্ট বুঝতে পারেন। কিন্তু বুঝেও নাচার। মা যে। উপায় কি হ্যাপা না সামলে !
এই যে আজ হঠাৎ মাতৃ দিবস পালন হচ্ছে। এর জের তাকে টানতে হবে না ! আলবাত হবে।কি যে সাপ ব্যঙ রান্না ঘর থেকে বেরোবে তার কি কোন হিসেব থাকবে ? মাকে রেঁধে খাওয়াবে।যা খাওয়াবে সেতো আন্দাজ করাই যায় কিন্তু তার পর তার সাধের রান্নাঘরের যে কি দুর্দশা হবে সেটা ভেবে তো এখনই গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। নাহ ! আজ আর পুজোয় মন বসবে না। একবার চুপি সাড়ে দেখবেন নাকি কি করছে দুটোতে মিলে ! মনে মনে গোপালের কাছে ক্ষমা চেয়ে একটা প্রণাম সেরে ঠাকুর ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন সুপ্রীতি।
দুই
“ আহ্ ! নারে তিন জন তো। তিন কৌটো চাল নিয়ে নে। এনাফ। ”
“ ওকে। ভাতটা তো নো প্রব্লেম। বসিয়ে দিলেই হয়ে যাবে। কিন্তু বাকি কি করবি ?”
“ সিম্পল। ডাল আলু ভাজা আর মাংস। হ্যাঁ। আর মাছ ভাজা। আই লাভ মাছ ভাজা।ফ্রিজে মাছ মাংস দুটোই আছে দেখেছি। ”
“ এ: মাছ ভাজা মাংস ডাল। তুই করতে পারিস একটাও ?”
“ কেন তুই পারিস না ? ”
“ না। আমি কোনদিন রান্না করেছি ? তবে ইউ টিউব দেখে চেষ্টা করতে পারি। ”
“ শেম। তুই একটা মেয়ে হয়ে ডাল মাছ ভাজা , মাংস রান্না করতে পারিস না ?”
“ এ্যাই। বাজে কথা বলিস না। মেয়ে হলেই রান্না পারতে হবে আর ছেলেরা কিছুই জানবে না ? ”
“ ওকে । ওকে। ঝগড়া করিস না। এখন কি করবি ভাব ”
“ শোন। ডাল মাছ ভাজা ছেড়ে দে। মাংস ভাত করে নে। ”
“ কিন্তু শুধু মাংস ভাত ? ছবিতে কি উঠবে রে ?”
“ আহ্ ! ওসব বাদ দে তো। আগে খাবার চিন্তা কর। তুই মাংসটা বার করে ধুয়ে ফেল। আমি পিঁয়াজ রসুনটা কাটি। এই রে এই রে ! ভাত টা উথলে গেল রে। ”
“ যা গ্যাস নিভে গেছে। কি হবে ?”
“ উফফ ! কি হবে আবার ? জ্বেলে দে। ইস্ ! ওভেনটার কি অবস্থা হল ! মা দেখলে না —”
“ ডোন্ট ওরি সিস্টার। সব পরিষ্কার করে দেব। আচ্ছা মাংসটা দ্যাখ তো। আর ধোব ?”
“ একি রে ! একি কাপড় ধোয়া নাকি ! রাখ রাখ হয়ে গেছে। এবার দাঁড়া দাঁড়া রেসিপিটা দেখে নি। হ্যাঁ। তেল মাখাতে হবে। একটু হলুদ দে। ইস্ ! কি করলি ? এক কাপ তেল পুরো ঢেলে দিলি ?”
“ ওহ ! কি হবে ? রান্না করার সময় কম দিবি। অ্যাডজাস্ট হয়ে যাবে। ”
“ ধ্যাত। আনাড়ি একটা। ”
“ আর তুই কি ? ওই অত পেঁয়াজ রসুন ! আমাদের ফিস্টে দশ জনের মাংস রাঁধতেও অত লাগে নি।”
“ ফ্যানটা কে গালবে ? তুই না আমি ? এ: পোড়া পোড়া গন্ধ বেরোচ্ছে রে। ”
“আরে না না।ও কিছু না। তুই রাখ। আমি করছি। শেষে আবার সোনার অঙ্গ কালি হয়ে যাবে। এই — নামালাম। এবার — উরি ফাদার ! কি গরম রে ! মাই গড !! উফফ ! ”
“ পোড়ালি তো হাতটা ! খালি বক বক। আরে লাফাচ্ছিস কেন ? একটা কাজ যদি পারে ! ”
“ আচ্ছা। দেখি তুই কেমন পারিস। পিঁয়াজ কাটতে তো নাকের জলে চোখের জলে ! এই আর কি লাগে রে ? ”
“ আচ্ছা পিয়াঁজ বলছে সোনালী রঙের হবে। কই রে হচ্ছে না তো !”
“ আরে বাদ দে। কেউ কি সোনা এনে মিলিয়ে দেখবে নাকি ! এগিয়ে যা। তারপর ? ”
“ আদা হলুদ লংকা । এবার একটু জল দে তো দাদা । আর একটু কষতে হবে। আরে আরে ! উফফ ! তোকে দিয়ে যদি একটা কাজ হয় ! এই এত জল দিয়ে দিলি ! ধ্যাত ! ”
“ ঠিক আছে। একটু ঝোল বেশি হবে। ডাল তো করবি না। খাব কি দিয়ে ?”
“ ব্যস। হয়ে গেল। কিন্তু মনটা খুঁত খুঁত করছে। শুধু মাংস আর ভাত। একটু ডাল ভাজা হলে ভালো হতো। কি বলিস ?”
“ এটাই কি দাঁড়িয়েছে আগে দেখি। খোল তো ঢাকাটা। একি রে ! এ যে গামছা পরে নামতে হবে !”
“ এই তুই । তোর জন্য । বললাম অত জল দিস না। ইস্ ! কি হবে এখন ?”
“ গাধা। জল বেশি হয়েছে একটু গ্যাসটা বাড়িয়ে রাখতে পারো নি ? মরে যেত তো জল টা ?”
“ হ্যাঁ। তোর ভাতের মত। যেমন পুড়িয়ে রেখেছিস !”
“ এই খবরদার। বাজে কথা বলবি না। আমি পুড়িয়েছি ? তুই কি করছিলি ? অমন নাক উঁচু! আর গন্ধ পাও না ?”
আর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না সুপ্রীতি।
“ এই। বেরো। দুটোই বেরোবি রান্নাঘর থেকে। গেলি ?”
“ কিন্তু মা — ইয়ে – মানে –”
কথা না বলে এবার আরক্ত চোখে বাইরের দিকে আঙুল দেখান সুপ্রীতি।
তিন
“ ওয়াও ! ডাল আলু ভাজা বড়ি ভাজা মাছ ভাজা ! এরই মধ্যে সব হয়ে গেল ! ”
ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসেন সুপ্রীতি।
“ মাংস টা খুব খারাপ হয়েছে না গো মা ? ”
“ কে বলেছে ? খেয়েই দ্যাখ।”
“ ও তো তুমি ঠিক করে দিয়েছ। নইলে – —”
“ না রে। আমি শুধু একটু জলটা শুকিয়ে নিয়েছি। নে এবার খাওয়া শুরু কর।”
“ আমরা পারলাম না মা। কিছুই শিখি নি।”
ছেলে মেয়ের বিষণ্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে হাসেন সুপ্রীতি।
“ তাতে কি হয়েছে ? শিখে নিবি। আর মাকে রান্না করে খাওয়ানোই কি মাতৃ দিবস পালন ! ওরে মায়ের জন্য কোন নির্দিষ্ট দিন হয় না। ছেলে মেয়ের কাছে রোজই তাদের মাতৃ দিবস —- যদি তারা মাকে একটু বোঝে, মার জন্য ভাবে , মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে পারে। তোরা যে ভেবেছিস মার জন্য কিছু করবি — এটাই তো যথেষ্ট। মায়েদের আর কিছু লাগে না রে। পাগল দুটো আমার। নে । এবার খা তো। নইলে ওসব দিবস টিবস মানব না। বকুনি খাবি। ”
—-XX—-