চিরাগনামা
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
উৎসর্গ : আমার মাতৃকূলের ধারাপতনে পাওয়া মজুমদার ও সরকার পদবীর সকলের জন্যই…
(১)
” যতই ভাবি করব মানা কাম ছাড়ে না … মদনে
ও….সাঁই….তবে আমি প্রেমরসিক হব কেমনে?”
অনেকক্ষণ থেকে একটাই কলি গেয়ে এবার বৃদ্ধ ফকিরটি একটু থামল। তারপর একট মাটির বদনাতে করে খানিকটা ঠান্ডা পানি নিয়ে এরপর আরাম করে ওর গলায় ঢালে।
এখন জ্যৈষ্ঠের মাঝামাঝি। তাই পুরো এলাকার মাটি তেতে আছে দোজখের আগুনে। প্রাঋ বৈশাখের পর থেকে একটুও বৃষ্টির দেখা নেই। সেজন্য জনমনিষ্যি সব বেমালুম জ্বলতে লেগেছে। মোর্তাজা মোল্লা এই এলাকার জায়গীরদার। ক’দিন আগেই সেরেস্তাদার পদ থেকে তার হয়েছে। মোল্লার কোহিতুরের আম বাগানটিতেও এবছর যেন বেফসলী মড়ক লেগেছে। লড়াইএর পর স্বয়ং নবাবজাদা কোতল হওয়ার সাথে সাথে মুকসুদাবাদের সাথে সাথে যেন একটা অনন্ত পালাবদলের মেঘও ঘনিয়ে আসছে শাহী হিন্দুস্তানের খুশির আসমানে। অবশ্য দিল্লীরও অবস্থা যে খুব একটা ভাল তাও ঠিক নয়। সমস্ত দেশটাই তো ইদানীংকালে নানা সমস্যায় ধুঁকছে। আর সেই সুযোগে লাল রঙের বাহারি সাঁজোয়া পোশাক পড়া ফিরিঙ্গী ফৌজ ঢুকে ওলন্দাজ,আর্মানী, পোর্তুগীজ আর হিস্পানিওলাদের সবাইকে হটিয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে কায়েম করে নিচ্ছে তখত্ এ তাউসের আপাত অটল মসনদ।
……
এটা এমনিতে সিদিকপুরের কাছে একটা অজ পাড়া-গাঁ। এখান থেকে বিস্তীর্ণ একটা লালচে কাঁকুড়ে মাটির ধূলোমাখা পথ অনেকদূরপর্যন্ত চলে গিয়ে আস্তে আস্তে গিয়ে শেষ হয়েছে মদিনা মহলের সীমানাকে ছাড়িয়ে আরও দূরে সেই ‘দাফন্ বাগের ‘ পথে।
গাঁয়ের সম্ভ্রান্ত তাঁতি মিসির জোলা’র মেয়ে আসরফি এবারে একটু গুড় আর বাতাসা এনে ওই ফকির বৃদ্ধটিকে ঠান্ডা পানির সাথে খেতে দেয়। পাশের গ্রাম দেউলপুরে ওর নিজের চাচাতো ভাই মিয়াজানের বেটা ‘ নওয়াজউদ্দিন ‘ এই ক’মাস হল নবাবের পল্টনে গোলন্দাজের কাজ পেয়েছে। তাই সামনের শাহ্ওয়ালেই আসরফি’র সাথে ওর শাদীর বায়নানামা মঞ্জুর করে এসেছে মৌলবী ইমাম হোসেনের সনির্বন্ধ তদারকিতে।
…..
গৃহস্থের নামে মোনাজাত জানাতে জানাতে সে বৃদ্ধটিও তা তখুনি হাতে তুলে নেয়। বড় খুশী হয়ে সে যখন চারদিন উপোসের পর সেটুকু তুলে আজ মুখে দেয় তখন তার অজস্র ভাঁজ পড়া সাদা দাড়ি গোঁফের ফাঁক দিয়ে উঠে আসা একধরণের অপার্থিব হাসি ছড়িয়ে যায় শিস্ মহলের হাজার আর্শিতে ফুটে ওঠা বিন্দু বিন্দু তৃপ্তির টুকরো টুকরো তসবিরের মতন।
জলপানের কিছুক্ষণ পরে ফকিরটি এবার পথের দিকে পা বাড়ানোর উপক্রম করতেই বছর তেরোর আসরফি তার মেহেদী রাঙানো হাতে আরও খানিটা চিঁড়ে আর গুড়ের ঢেলা নিয়ে ফকিরের নক্সীকাটা ঝুলিতে এনে ঢেলে দেয় নিশ্চুপে।বাপের হাতে মেহনতের মেজাজে চলা তাঁতের খটাংখটাং শব্দ আর বৃদ্ধ ফকিরের খটখট আওয়াজ তোলা চপ্পলের সাথে মিলিয়ে আসতেই সে আন্দাজ করে দুপুর গড়িয়ে এবারে যেন বেলাটাও পড়ে আসছে।
……
একদলা ঘুম আর স্বপ্নিল যাপনের অভ্যেসটা কাটিয়ে চোখ মেলাটা যেন নেহাৎ সহজ কাজ নয়। রবিবারে ঘুম ভেঙে মানসিক হোমের গথিক ঘরানার জানলা পথে আসা একটা তির্যক রোদের চাবুক এসে কমলিকার চোখদুটোকে ক্রমশ পুড়িয়ে দিচ্ছিল।
সিস্টার কাজরী এসে ওর মুখহাত ধুয়ে দিয়ে যেতেই কমলিকা ব্রেকফাস্টের রুটি আর দুধ না স্পর্শ করে আরো কিছুক্ষণ থম্ মেরে বসে থাকল।
এই মানসিক সেবাকেন্দ্রটি সবে দু’বছর হল খুলেছেন ফাদার অতনু হেমব্রম বলে একজন প্রবীণবয়সী মানুষ। যাজক হওয়ার পূর্বে এই মনোবিদটি ডক্টর অতনু হেমব্রম নামে খ্যাত ছিলেন। দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে দিল্লীতে থেকে সামলেছেন ভারতের শ্রেষ্ঠ মনোবিজ্ঞান সংস্থায় ডিন্ এর গুরুদায়িত্ব।
এখন সবে পাঁচবছর হল সে সমস্ত সংশ্রব ত্যাগ করে খ্রিষ্টের সেবায় নিজেকে নিয়োগ করে
‘ আপন আলয়’নামে এই হোমটি তৈরী করে পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার সিনড্রোমের চারজন রোগীকে নিয়ে চেষ্টা করছেন মূল জীবনের স্রোতে শীঘ্রই ফিরিয়ে আনতে।
এই চারজনের মধ্যে কমলিকাই সবচেয়ে কমবয়েসী ও আপাতভাবে এক অদ্ভূত রোগের শিকার। বছর কুড়ির কমলিকা হঠাৎ হঠাৎ করে মাসে দু-তিনটে রাত্রিবেলা দীর্ঘসময় ধরে ঘুমিয়ে পড়ে ও তারপর জেগে ওঠার পরে আরও বেশ কয়েকদিন ধরে সে যেন অন্য মানুষ হয়ে যায়। জাগৃতির পরেও বেশ অনেকদিন ধরে রেশ চলে তার সেই ঘুমের মধ্যে দেখা নিভৃত স্বপ্নচারণের।
আসলে জেগে ওঠার পরেও সে পরপর কয়েকদিন ধরে ওর স্বপ্নে দেখা কোন একটি চরিত্রের ভাবে তন্মধ্য থেকে অস্বস্তিকর আচরণ করতে থাকে। যেন সেই স্বপ্নময়তার মায়াকাজলটি লাগিয়ে সে হয়ে উঠতে চায় সেই চরিত্রটির মানসকন্যা বা অনুসৃতা।
……..
এখন ওর সেই অবস্থাটাই চলছে। একসপ্তাহ হয়ে গেল নিজের নাম জিজ্ঞাসা করলে সে সহজে বলেনা। আবার কখনো কখনো ” মরিয়ম”, “নানী বেগম ” বা ” রাজ কুঁয়ার” বলে চেঁচিয়ে ওঠে। তবে সব চেয়ে বেশী সে ” লুফি বেগম” নামের এক কল্পলোকের চরিত্রর সাথে আপনমনে বেশী কথা বলে আর কাঁদে। সিস্টার শুনেছেন যে কমলিক এসব কথা বলার সময় ওর মুখে আশ্চর্যভাবে বেশ কিছু অপ্রচলিত ফারসী আর উর্দু বয়েৎের আশ্চর্য সব ধ্বনি বেরতে থাকে নিজের অগোচরেই।
(এরপর ক্রমশ…)