অথ কথা নালন্দা
কাকলি ঘোষ
দ্বিতীয় পর্ব
নিজের পেশাগত কারণে একটানা এই নাটক লেখা যে সম্ভব হয় নি তা কাজল নিজেই জানিয়েছেন। কিন্তু হাল ছাড়েননি কখনো। কাজের ফাঁকে, গভীর রাত্রে, বা নিজের বিশ্রামের সময়কে সংক্ষিপ্ত করে লেখা চালিয়ে গেছেন। কিন্তু সে তো পরের কথা। শুরুটা ?
যে কোন লেখা; তা গল্প , কবিতাই হোক বা নাটক, শুরুটা খুব গুরুত্বপূর্ন। নিজে যেহেতু একটু আধটু লেখার দুনিয়ায় ঘোরা ফেরা করি তাই কাজল যখন এ ব্যাপারটা তুললেন বুঝতে অসুবিধে হয় নি এতটুকু।
দোলাচল আর দোলাচল। কাকে দিয়ে শুরু হবে এই নাটক ? আচার্য রাহুল শিরভদ্র আর নবাগত ছাত্র ধর্মস্বামীকে নিয়ে নাকি বজ্রজানের উপাসক, ভোগী, লম্পট বিকৃতিদেবের ধর্মের নামে ব্যভিচার দেখিয়ে ? কখন আসবে সেই সুন্দরী ক্রীতদাসী হোসনা যার ঘৃনা মিশ্রিত থুৎকারে দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছিল বখতিয়ারের সমস্ত দেহ মন যা আজীবন শুধু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিল তার জীবন ? আর সেই আগুনেই পুড়ে ভস্মীভূত হল শতাব্দী প্রাচীন ভারতের অহংকার , শ্রী অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞানের পদধূলি ধন্য নালন্দা মহাবিহার। কোথায় থাকবে সেই কবি গায়ক কমলা সিং রচিত অদ্ভুত নালন্দা গাথা ?
দ্বিধা অনেক কিন্তু তবু তা শেষ হয় একদিন। আর অবশেষে এসেও যায় সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। রচিত হয় “কথা নালন্দা” নাটকের প্রথম দৃশ্য। সৌভাগ্য বশত এর প্রথম শ্রোতাও ছিলাম আমি। স্তব্ধ হয়ে মুগ্ধ বিস্ময়ে শুনছিলাম আর প্রতি মুহূর্তে যেন চোখের সামনে থেকে সরে যাচ্ছিল একটার পর একটা পর্দা। মন ফিরে যাচ্ছিল সেই সুদূর অতীতে। চরিত্র চিত্রণে , ঘটনার ঘনঘটায়, সংলাপের বলিষ্ঠতায় এবং সর্বোপরি চূড়ান্ত ক্লাইম্যাক্স সৃষ্টিতে “কথা নালন্দা” যেন এক অপরূপ সৃষ্টি। এক অনবদ্য নাটক।
বৌদ্ধ ধর্মের ব্যাপারে সাধারণ মানুষের মধ্যে রয়েছে অসংখ্য ভুল ধারণা। অনেক কৌতূহল। হীনযান, বজ্রযান প্রভৃতি নানান বিষয়।অকারণ জ্ঞান দেবার প্রয়াস না দেখিয়ে নাট্যকার সুন্দরভাবে শুধুমাত্র সংলাপের মাধ্যমে প্রতিটি বিষয় পরিষ্কার করেছেন।
এই নাটকের প্রতিটি দৃশ্যে , সংলাপে রয়েছে নাট্যকারের শিক্ষা, রুচি এবং গবেষণালন্ধ জ্ঞানের পরিচয়। এ ছাড়াও রয়েছে এক অদ্ভূত পরিমিতি বোধ। কোথাও , কখনো সস্তা আবেগকে প্রশ্রয় দেন নি নাট্যকার। অথচ আগাগোড়া এক দুরন্ত আবেগপ্রবণ, মঞ্চ সফল নাটক এটি।
যারা নাটক করেন বা দেখতে ভালোবাসেন তারা জানেন প্রত্যেক দৃশ্যের সমাপ্তিতে নাটকে থাকে এক নিরুচ্চারিত প্রশ্ন। এর পর কি ? যে প্রশ্নের উত্তর পাবার জন্য মন অস্থির হয়ে ওঠে। সেখানেই নাটকের সার্থকতা। নাট্যকার কতটা সাসপেন্স সৃষ্টি করতে পারলেন বা দর্শককে কতটা একাত্ম করতে পারলেন নাটকের সঙ্গে তার উপরই নির্ভর করে নাটকের সাফল্য। সেক্ষেত্রে কাজল চক্রবর্তী রচিত “ কথা নালন্দা “ নাটক সম্পূর্ন সার্থক। কোথা দিয়ে যে দু ঘণ্টা দশ মিনিট শেষ হয়ে যায় দর্শক টের পান না। আর শেষ হবার পর মন ভরে থাকে এক অদ্ভুত বিস্ময় মাখা মুগ্ধতায়। কলমের আঁচড়ে এবং কাহিনীর নিটোল বুননে অতি অনায়াসে কাজল দর্শককে নিয়ে যান সেই দ্বাদশ শতাব্দীতে। চোখের উপর যেন মূর্ত হয়ে ওঠে চরিত্রগুলো। তাদের হাসি , কান্না, বিরহ , মিলনের সাথে একাকার হয়ে যায় মন। বখতিয়ার এবং বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ভদ্রপালের মনস্তাত্বিক লড়াই, সামসেরের হিংস্রতা, মোরিকার প্রভুভক্তি, এক গ্রাম্য যুবক শংকরের বজ্রজানের বিকৃত ব্যভিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এবং আপন ধর্মের প্রতি বলিষ্ঠতা, সব মিলিয়ে কথা নালন্দা যেন সমস্ত নাট্যমোদী দর্শককে পৌঁছে দেয় এক অপরূপ রসলোক থেকে ভাবলোকে।
কিন্তু নাট্যকারকে তো শুধু ভাবলোকে বিচরণ করলে চলে না। নাটক যদি রসবোধ সম্পন্ন মানুষের দোরগোড়ায় না পৌঁছোয় তবে নাটক লেখার সার্থকতা কি ? হ্যাঁ এখানে তর্ক উঠতে পারে যিনি সৃষ্টি করেন তিনি শুধু মনের আনন্দে, নিজের তাগিদে করেন। সেখানে আবার সার্থকতা খোঁজার কি দরকার ? আমি মনে করি আছে। লেখক যখন গল্প লেখেন শুধু নিজের জন্য লেখেন না , গায়ক যখন গান করেন তিনি চান তা শ্রোতার কাছে পৌঁছোক। আপন সৃষ্টি অন্যের কাছে কতটা রসোত্তীর্ন হল তা জানার ইচ্ছে সকলেরই থাকে। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়। হ্যাঁ কাজল হয়তো ইচ্ছে করলে তার নাটক ছাপিয়ে বার করতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটা চান নি। তিনি চেয়েছেন নাটকটি কোন পেশাদার রঙ্গমঞ্চে নিয়মিত অভিনীত হোক।তার সৃষ্ট চরিত্র গুলো জীবন্ত হয়ে উঠুক কারুর না কারুর মধ্যে। কিন্তু তার পেশার সাথে এই নেশার এতটাই অমিল যে সেরকম কোন পেশাদার দলের সাথে যোগাযোগ হয়ে উঠছিল না। নাটক নিয়ে কাজল দু এক জায়গায় প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু সেভাবে সাড়া মেলেনি কোথাও।
এইভাবেই নাটক তৈরি হবার পরও আশা আশঙ্কায় কেটে গেল প্রায় দেড় বছর। অবশেষে দুহাজার পনেরো সালের নভেম্বর মাস নাগাদ কাজলের প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে এগিয়ে এলেন অভিনেতা দেবেশ রায়চৌধুরী। চলচ্চিত্র এবং মঞ্চ সবেতেই দেবেশ একজন প্রতিভাবান অভিনেতা। স্বনামধন্য বহুরূপী নাট্যদলের একজন কর্মকর্তাও বটে।
সেই দিনটির কথা নাট্যকার বার বার স্মরণ করেছেন যেদিন বহুরূপী থেকে তাকে আহ্বান করা হল নাটকটি বহুরূপীর প্রধান কার্যালয়ে ব’সে প’ড়ে শোনানোর জন্য। এ বিষয়ে নাট্যকার তার সেদিনের অভিজ্ঞতার বর্ণনা জানিয়েছেন দু এক কথায়। বহুরূপী দল ! যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে কিছু অনন্যসাধারণ নাট্য ব্যাক্তিত্ব। শভু মিত্র, অজিতেশ বন্দোপাধ্যায় , কুমার রায় এদের পদধূলি ধন্য বহুরূপীর কার্যালয়। সেখানে বসে সম্পূর্ন অখ্যাত এক নবীন নাট্যকার দুরুদুরু বুকে শোনাতে বসেছেন তার নিজের নাটক। সে এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ। যেন স্বপ্ন। প্রতি মুহূর্তে আশঙ্কা ! যদি ___
না। সমস্ত সংশয় এবং দ্বিধা মুক্ত ভাবে বহুরূপী দল সানন্দে এবং সাগ্রহে আপন করে নিলেন “কথা নালন্দা” কে। সর্ব সম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হল বহুরূপী প্রযোজিত পরবর্তী নাটক হবে “ কথা নালন্দা। “
এরপরের ঘটনা ঘটে চলল অতি দ্রুত। শুরু হল মহড়া। আর সেই উপলক্ষে কাজলের বেলুড়ের বাড়িতে প্রায়ই যাতায়াত লেগে থাকল অভিনেতা দেবেশ রায় চৌধুরীর। কখনো নাটক নিয়ে আলোচনা, কখনো সংলাপ বদল, আবার কখনো বা নিছক আড্ডা।
দেখতে দেখতে এসে পড়ল সেই দিনটি। ২০১৬ র পয়লা মে। বহুরূপীর জন্মদিন। আর সেই দিনেই প্রথম সর্ব সমক্ষে অবগুণ্ঠন উন্মোচন করল রহস্যময়ী
“ কথা নালন্দা। “