শুধু কবিতা’র জন্য
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
(৩য় পর্ব)
তুমি
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
আমার যৌবনে তুমি স্পর্ধা এনে দিলে
তোমার দু’চোখে তবু ভীরুতার হিম।
রাত্রিময় আকাশে মিলনান্ত নীলে
ছোট এই পৃথিবীকে করেছো অসীম।
বেদনা-মাধুর্যে গড়া তোমার শরীর
অনুভবে মনে হয় এখনও চিনি না
তুমিই প্রতীক বুঝি এই পৃথিবীর
আবার কখনো ভাবি অপার্থিব কিনা।
সারারাত পৃথিবীতে সূর্যের মতন
দুপুর-দগ্ধ পায়ে করি পরিক্রমা,
তারপর সায়াহ্নের মতো বিস্মরণ-
জীবনকে, স্থির জানি, তুমি দেবে ক্ষমা
তোমার শরীরে তুমি গেঁথে রাখো গান
রাত্রিকে করেছো তাই ঝঙ্কারমুখর
তোমার ও সান্নিধ্যের অপরূপ ঘ্রাণ
অজান্তে জীবনে রাখো জয়ের সাক্ষর।
যা কিছু বলেছি আমি মধুর অস্ফুটে
অস্থির অবগাহনে তোমারি আলোকে
দিয়েছো উত্তর তার নব-পত্রপুটে
বুদ্ধের মূর্তির মতো শান্ত দুই চোখে।।
……………
অনুধ্যানের আখরে
– শ্যামাপ্রসাদ সরকার
কবি’র নামটি যখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তখন তো অমরত্বের তোয়াক্কা না করে তিনি কবিতার সাথে আসঙ্গ সহবাস করে যেতে পারেন অক্লান্ত অক্ষরবৃত্তে এটাই তো সবচেয়ে আসল কথা।
তাই এই কবিতায় যখন তিনিও বলে ওঠেন,
“বেদনা-মাধুর্যে গড়া তোমার শরীর
অনুভবে মনে হয় এখনও চিনি না
তুমিই প্রতীক বুঝি এই পৃথিবীর
আবার কখনো ভাবি অপার্থিবা কিনা।”
তখন আবার সেই কবিতা নিয়ে নির্জনে এসে বসি। কারণ তিনিই বলেছেন, ” তোমার শরীরে তুমি গেঁথে রাখো গান/ রাত্রিকে করেছো তাই ঝঙ্কারমুখর”!
একাধারে দেহজ অবয়বে আবার মুহূর্তকালে দেহোত্তীর্ণ ভাষায় যে ছান্দসিক পেয়ে যেতে পারেন জীবনের অমৃতস্বাদটিকে তিনি তো সব কবিতাপ্রেমীরই আত্মজন।
তাও অণ্বেষণের নিগড়ে যে কাব্যযাপন যশোধারার তূল্যে হৃদি-পদ্মকে মথিত করে আনে সেই তো কবিতার চরম শেষাগ্নির আলো হয়ে জেগে থাকে। যার মন্থনের প্রতিটি কায়িক শ্রম পরিশেষে অমৃতের সন্ধানী বলেই তাঁর ভাষায়
” বেঁচে থাকতে সাধ হয়”!
তাই ফেরারী বাতাস যে কাব্যময়তার ঘ্রাণ এনে বহুমূল্যের প্রতিদানে অণ্বয়সাধনায় উত্তীর্ণ হত তাকেই কবি উচ্চকন্ঠে অভিধা দিয়ে বলেন,
” যা কিছু বলেছি আমি মধুর অস্ফুটে
অস্থির অবগাহনে তোমারি আলোকে
দিয়েছো উত্তর তার নব-পত্রপুটে
বুদ্ধের মূর্তির মতো শান্ত দুই চোখে।।”
এই ধ্যানময়তাই তো অম্লান আলোকে জেগে থাকা সেই নশ্বরতা অতিক্রমণকারী প্রেম। যাকে রবীন্দ্রনাথও “শেষের কবিতা” য় বলেছেন
” ওগো বন্ধু, সেই ধাবমান কাল
জড়ায়ে ধরিল মোরে ফেলি তার জাল–
তুলে নিল দ্রুতরথে
দুঃসাহসী ভ্রমণের পথে
তোমা হতে বহু দূরে।
মনে হয়, অজস্র মৃত্যুরে
পার হয়ে আসিলাম…….”
যদিও রবিকবি এর অনেক আগেই কাব্যধর্মীতার মোড়কে জীবনদেবতাকে চিনেছেন, তাও আজকের দিনের কাঠিন্যের মধ্যেও নীললোহিত কবিটিও চকিতচপলার দৃশ্রশ্রাব্যতার পরিবর্তে সেই চিরন্তন প্রেমের আয়ত চক্ষুর শান্তলীলায় কবিতার একান্ত প্রেমিকপ্রবরটি হয়ে থেকে যান।
শেষ অঘ্রাণের হেমন্তবিকেলে আবার একটি পুরনো অথচ অনির্বাণ কবিতার আলোয় আমাদের স্নাত করিয়ে দিলেন ” প্রিয় কবি সুনীল’দা।
–:: সমাপ্ত ::–