ফুলমনির আখ্যান
সলিল চক্রবর্ত্তী
“বাবু ছাপ এখানে আসেন, করোনা চা হবেক বটে”
শীর্ণ মলিন দেহ মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, মনে একটু আশা নিয়ে আমাদের ডাকলো। আমরা আজ সকালে এসে পৌঁছেছি পশ্চিম বর্ধমানের এক রিমোর্ট অঞ্চলে, গ্রামটির নাম সরপি। কাঁকুরে মাটির অঞ্চল, উঁচু নিচু কাঁকুরে রাস্তা। একটি বড় রাস্তা দুর্গাপুর থেকে সরপির উপর দিয়ে অন্ডাল বিমান বন্দরের দিকে চলে গেছে। এদিকটায় শুধু আগাছা আর ইউক্যালিপটাসের জঙ্গল। বর্তমানে সরপি গ্রামটা একটু উন্নতির মুখ দেখেছে। এখানে একটা স্টেডিয়াম ও একটা ইকো পার্ক আছে। আমরা বিয়ে উপলক্ষে এই ইকো পার্কে বরযাত্রী হয়ে এসেছি। এখানকার বিডিও সাহেব মৃণাল কান্তি বাগচীর মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে ইকো পার্কটি ভাড়া করা হয়েছে। মৃণাল বাবু খুবই সজ্জন মানুষ, আমাদের আতিথেয়তা ত্রুটি মুক্ত করতে উনি ব্যাস্ত হয়ে পড়েছেন।আমাদের তর সইলো না, বেরিয়ে পড়লাম চায়ের খোঁজে। দুই একটা দোকান পেলাম, কিন্তু সবই রেডি মেড দুধ চিনি চা। দুধ চিনি ছাড়া রেড টি এর সন্ধান মেলা ভার। এরই মধ্যে করোনা চা এর সন্ধান পেয়ে আমরা চারজন ভাঙা চোরা টিনের শেডের তলায় গিয়ে একটা বেঞ্চে বসলাম।
লবঙ্গ, গোলমরিচ, দারচিনি, আদা সহযোগে চা টা মন্দ করেনি। কিন্তু এত ছোট কাগজের কাপে দিলো যে খেয়ে পোষাল না। দোষ চা ওয়ালার নয়, যে ফ্যাক্টরিতে কাপ তৈরী হয় তাদের। এত ছোট কাপ বানাবার দরকার কি ,একটু বড়ো কাপ বানালে আরও দুবার ঠোঁটের স্পর্শ পেত। যাইহোক চা ওয়ালার নাম বুধন মুন্ডা, চা তৈরীর হাত যেমন ভালো মিশুকেও ততোধিক। নিজের কাজ করতে করতে আমাদের জিজ্ঞাসা করলো-” বাবু ছাপদের কুথা থেকে আসা হচ্ছে বটে?” কলকাতা শুনেই বললো-” ও বিডিও ছাপের মেয়ের বিয়েতে এসেছেন বটে”। বুধন এলাকার খোঁজ খবর দিতেও বেশ উৎসাহী । সোমনাথ বললো -” বেশ, আর এক রাউন্ড করোনা চা বেকারি বিস্কুট দিয়ে হয়ে যাক, চা আর গল্প একসাথে জমবে ভালো”। বুধন ও খুশি হয়ে সেকেন্ড রাউন্ড চা দিলো। এবং বাড়তি চা টুকু গ্লাসে ঢেলে খেতে খেতে আমাদের সাথে এলাকার গল্প শুরু করে দিলো।
এই এলাকাতে জনসংখ্যা কম হওয়ায় বাড়ি ঘরও কম। দুই একটা বড় বাড়ি আছে বটে, তবে বেশির ভাগ বাড়ি নিচু নিচু কুড়ে ঘর বিশিষ্ট। এতদ অঞ্চল ECLএর একোয়ার করা। জমি রেজিস্ট্রি টুকটাক হলেও জমির মিউটিশন একদম হয়না। আমরা ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছি কালো হীরের উপর দিযে। এইসব অঞ্চলের মাটির নিচে থেকে দুই স্তর কয়লা উত্তোলন হয়ে গেছে। ECL যে কোনো সময়ে তৃতীয় স্তর কয়লা উত্তোলন করতে পারে। যখনই কাজ শুরু করবে ক্ষতিপুরন দিয়ে এই এলাকা একদম জনশূন্য করে দেবে। কারণ বড়ো বড়ো ধস নেমে বাড়ি ঘর সব খাদে ঢুকে যেতে পারে। এখানকার জনসংখ্যার আশি শতাংশই দেহাতি গরীব সম্প্রদায়। গ্রানাইট পাথর সংগ্রহ, কয়লা খাদানের চোরাই কারবারের সাথে যুক্ত থাকে। সামান্য যা রোজগার হয় কোনো রকমে সংসার চলে,কিছুটা রাখতে হয় সন্ধ্যায় ভাটি খানার জন্য। হঠাৎ পরিমল বুধনকে প্রশ্ন করলো-” তোমাদের মধ্যে ডাইন অপবাদ দিয়ে শাস্তি দেওয়ার বিধান আছে না?” “আছেক বটে, তবে আমাদের এখানে লাই বুললেই চলে। সাঁওতাল পরগনায় হয় বটে। তবে পাঁচ ছ বছর আগে আমাদের এখানে একটা ঘটনা ঘটেছিল বটে”। এই বলে বুধন বিগত দিনের ঘটনা বলতে শুরু করলো।
ফুলমনি ওরাং আর চারকু ওরাং এর সুখের সংসার। দুই বছরের বাচ্চা পিঠে বেঁধে ফুলমনি কয়লা খাদানে কাজ করে। যা যেটুকু আয় হয় দুবেলা দু মুঠো জুটে যায়। চারকু যা আয় করে সব ভাটিখানায় খরচ করে ফেলে। তাতে অবশ্য দাম্পত্যের সুখ দুঃখে কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। কারণ স্বামীরা নেশা করে জীবন কাটায়, আর বউগুলো অক্লান্ত পরিশ্রম করে কোনো রকমে অন্নের সংস্থান করে, এটা ওদের রক্তে আছে। চারকু ওরাং দিনের পর দিন হাড়িয়া খেতে খেতে তার লিভার পচিয়ে ফেললো। তাছাড়া খাদানের ধুলো ময়লা নাকে ঢুকে ফুসফুস ও ড্যামেজ করে দিলো। পেট ও বুকের যন্ত্রনায় যখন ছটফট করতে থাকলো , তখন সবাই মিলে ওঝার কাছে নিয়ে গেল। বিরাট বিজ্ঞ ওঝা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বললো ওকে ডাইনে ভর করেছে। এবং সেই ডাইন আছে তার গ্রামের মধ্যে। চারকুর পেটের যন্ত্রনা পড়ে মরুক, গ্রামের লোকেরা ওঝার কথা মতো ডাইন খুঁজতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো। গোপনে খোঁজ খবর চলতে থাকলো, গ্রামের কোন মহিলার আচরণে অস্বাভাবিকতা দেখা যাচ্ছে কিনা। এদিকে চারকুর যায় যায় অবস্থা। আবার হাঁড়িয়ার নেশাও আছে। ফুলমনি শত কষ্টেও চারকুর জন্যে সাধ্য মতো প্রতিদিন হাঁড়িয়া এনে দেয়। ফুলমনি বুঝতেও পারেনা যে ভালোবাসার মানুষটাকে সে নিজে হাতে মৃত্যুর দুয়ারে ঠেলে দিচ্ছে। চারকু যত মৃত্যু যন্ত্রনায় ছটফট করতে থাকে,ফুলমনি চারকুর পরিণতি বুঝতে পেরে পাগলের মতো হয়ে যায়। পান থেকে চুন খসলেই বছর পাঁচেকের ছেলেটাকে অমানুষিক মারধোর করে। যেটুকু জোটে তাও ঠিক মতো খায় না। ছোট্ট শিশুটির অপুষ্টিতে কঙ্কালসার চেহারা, কেউ কিছু বুঝিয়ে বলতে গেলে অট্ট হেসে বলে-” মরুক মরুক বটে, কাউকে বাইচতে হবেক নাই”। বলেই আবার উচ্চস্বরে কেঁদে ওঠে। গ্রামের কিছু ছিদ্রানেসি মানুষ ভেবে নিলো ফুলমনিই ডাইন হয়েছে। তারা ওঝা এবং মোড়লের কাছে গিয়ে তাদের মতামত জানালো। মোড়ল দলবল নিয়ে চারকুর কুড়েতে গিয়ে হাজির। ততক্ষনে সব শেষ। ফুলমনি উচ্চস্বরে কেঁদে চলেছে , দাম্পত্য জীবনের পুরোনো স্মৃতির মুহূর্ত গুলো মনে করে। ওঝা বললো ওই ডাইন, ওকে না মেরে ফেললে গ্রামে আরো ক্ষতি হবে। ফুলমনিকে মেরে ফেললে ওর বাচ্চার কি হবে, কুসংস্কারাছন্ন মোড়লদের মাথায় সেটা এলো না। ততক্ষনে দলে দলে ভিড় জমিয়ে ফেললো ডাইন দেখার জন্য। কিছু সাঁওতাল শাস্তির বিধান শুনতে অপেক্ষা করতে থাকলো,কারণ তারা শাস্তি দেওয়ায় অংশগ্রহণ করবে। তাদের মাথায় এটাই ঢোকানো হয়েছে , পাপ কে শেষ করতে পারলে ‘পুন্নি’ এমনিই হয়। মোড়লরা ওঝা কে সঙ্গে নিয়ে একটা বিচার সভা বসিয়ে সিদ্ধান্ত নিলো , ফুলমনিকে একচল্লিশ ঘা বেত মারা হবে, যার অর্থ মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। চারকুর ডেডবডি যে পচন ধরবে, সে দিকে কারোর কোনো খেয়াল নেই ফুলমনির ডাইন অপবাদ নিয়েই মোড়ল ব্যাস্ত হয়ে পড়লো। এদিকে এই খবর কোনো এক সোর্স থেকে বিডিও সাহেব মৃনাল কান্তি বাগচীর কানে পৌঁছালো। খবরটা শুনেই তিনি কাল বিলম্ব না করে পুলিশ ফোর্স নিয়ে ঘটনা স্থলে উপস্তিত হলেন। উনি পৌঁছেই পুলিশ দিয়ে আগে ভিড় সরালেন তারপর শবদাহের ব্যবস্থা করলেন। ওঝা ও মোড়ল প্রথমে তাদের সিদ্ধান্তে অনড়। মৃনাল বাবু, এবং দারোগা বাবু বুঝিয়ে বললেন যে, এগুলো কুসংস্কার,ওরা যদি সময় মতো চারকুকে হসপিটালে নিয়ে যেত তাহলে হয়তো ফুলমনি জীবনটা অন্য রকম হতো। এর পরেও যদি পুলিশের কথা না শোনে তবে পুলিশ আইন প্রয়োগ করবে।
পুলিশের ভয়ে আস্তে আস্তে সব ফাঁকা হয়ে গেল। ফুলমনি তাৎক্ষণিক শাস্তি মুক্ত হলো। স্বামীর মৃত্যু শোকে বিধস্ত ফুলমনি ,অপুষ্টিতে জর্জরিত বছর পাঁচেকের শিশুকে নিয়ে ভাঙাচোরা কুটিরে দিন গুজরান করতে থাকলো। এই ভাবে কেটে যায় বছর খানিক। হঠাৎ একদিন সাঁওতাল পাড়ার ভীতরে একটা দুর্গন্ধ ছাড়িয়ে পড়লো। প্রথম দিকে কেউ ঠিক বুঝতে পারছিলনা গন্ধটা কোথা থেকে আসছে। আস্তে আস্তে গন্ধের তীব্রতা বাড়তে, প্রতিবেশীরা খেয়াল করলো দুর্গন্ধটা আসছে ফুলমনির কুটিরের দিক থেকে।সন্ধ্যা নামবে নামবে এমন সময় ঘটনাটা গ্রামের মোড়লের কানে গেল। মোড়ল আগের অভিজ্ঞতা থেকে একটু সতর্ক হয়ে, ওঝাকে ডেকে নিয়ে ফুলমনির কুটিরে গিয়ে হাজির হলো। কুটিরের কাছে গিয়ে তীব্র দুর্গন্ধের জন্য কেউ দাঁড়াতে পারছিল না। একজন সাঁওতাল যুবক নাকে গামছা বেঁধে ভিতরে প্রবেশ করে সঙ্গে সঙ্গে আবার বেরিয়ে এলো। তারপর একটু দম নিয়ে বললো ফুলমনি একটা পোটলা মতো কিছু নিয়ে বসে আছে। আধা অন্ধকারে সে বিশেষ কিছু বুঝতে পারলনা। প্রতিবেশী এক সাঁওতাল মহিলা জানালো কদিন ধরে ফুলমনির ছেলেকে আর দেখা যাচ্ছেনা। মোড়ল ব্যাপারটা অনুমান করে ফেললো। ক্ষেপে গিয়ে বলল-” মাগী ডাইন, এবার ছেলেকে খাইছেক বটে। আর তো মেনে লেওয়া যাবেক না বটে। উকে গেরাম ছাড়া করতে হবেক বটে”। তারপর চার পাঁচ জন সাঁওতাল যুবক কুড়েতে ঢুকে ফুলমনির পচাগলা শিশুকে নিতে গেল। ফুলমনি তো দেবেনা, কারণ তার ধারণা তার ছেলে ঘুমিয়ে আছে। বুঝিয়ে বলায়ও তার মন বুঝলো না। কারণ ফুলমনি তখন আর স্বাভাবিক নেই। সে উন্মাদ পাগল। জোর করে শিশুটিকে ছিনিয়ে নিয়ে সাঁওতালরা গেল শ্মশানের দিকে। ফুলমনি চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে তাদের পিছু নিলো। পচাগলা দেহ বলে তাড়া ছিল, পয়সারও অভাব তারপর শিশু , ফলে না পুড়িয়ে শ্মশান সংলগ্ন সাঁড়া গাছের জঙ্গলে পুঁতে দিলো। ফুলমনির অলক্ষে পোতা হলো, কারণ দেখতে পেল মাটি খুঁড়ে শব তুলতে পারে। ফুলমনি ডাইন না হোক পাগল তো হয়েছিল,পরে সে আর গ্রামে ফিরে যায়নি।
ফুলমনিকে ডাইন করার করুন কাহিনী শুনে সবার মনে এই সম্প্রদায়ের মহিলাদের উপর ভীষণ করুণা হলো, আবার পুরুষদের উপর ততোধিক ক্রোধ ও হলো । সোমনাথ বললো “-এতো রীতিমতো ক্রিমিনাল অফেন্স। ডাইন অপবাদ দিয়ে একটা পরিবারকে শেষ করে দেওয়া হলো! পূর্ব জন্মে অনেক পাপ করলে এই জন্মে গরিব ঘরে মেয়ে হয়ে জন্মাতে হয়”। মৃনাল বাবু সাঁওতালদের চিরাচরিত প্রথা থেকে ফুলমনিকে চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারেননি।
তারক বললো-“সোমনাথদা এবার ফেরা যাক ,আমাদের হয়তো সকলে খুঁজছে”। বুধনকে সোমনাথ ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে আসছে ঠিক তখনই বুধন বললো-” বাবু ইখানে একটা মহা শ্মশান আছেক বটে, টুডের বিয়া বাড়ি থেকে একটু দূরে হবেক”। সোমনাথ দাঁড়িয়ে পড়ে অবাক হয়ে বলল-” কেন মহা শ্মশান কেন?” চা এর ছিটা পরিষ্কার করতে করতে বুধন বললো-” এক বড়ো সাধুর তৈরী শ্মশান আছেক বটে। এই খগেন ভাই ইদিকে শুনো”, এই বলে একজন বাঙালী ভদ্র লোককে ডাকলো। তিঁনি আসতেই বুধন ওনাকে আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। বছর পঞ্চাশের ভদ্রলোকের জন্ম এই সরপি গ্রামে। উনি আদিবাসীদের জীবনযাত্রা সম্মন্ধে অনেক কিছুই জানেন। খগেন বাবুর বাড়ি সরপি ছাড়িয়ে ইছাপুর গ্রামে। খগেন বাবু বললেন,রাস্তায় যেতে যেতে আমাদের শ্মশানের জন্ম ইতিহাস বলবেন। আমরা যখন চায়ের ঘুমটি থেকে বার হচ্ছি তখন বুধন মুন্ডা আমাদের সতর্ক করে বললেন-” বাবু, শ্মশানে সন্ধ্যার পর যাবেন না বটে, উখানে সন্ধ্যার পর কেউ মড়া পুড়াইতেও যায় না বটে”। বিজ্ঞান মঞ্চের লোক সোমনাথ প্রামাণিক একটু নড়ে চড়ে উঠল। একটু অবাক হয়েই বলল-” কেন কেন সন্ধের পর শ্মশানে কি হয়”? ” উখানে বাবু শাকচুন্নির কান্না শোনা যায় বটে”। একটু ভয়ার্থ মুখভঙ্গি করে বুধন সোমনাথদের বললো।
সোমনাথ একরাশ কিউরিসিটি নিয়ে বললো-“ব্যাপারটা কি একটু খুলে বলুনতো?” খগেন বাবু বললেন-“চলুন আমি যেতে যেতে সব বলছি”।
“আজ থেকে প্রায় দেড়শ বছর আগের ঘটনা। তখন এই সব অঞ্চলে কোনো লোক জনের বসবাস ছিলনা বললেই চলে। এই সব অঞ্চল ছিল জাঙ্গালাকীর্ণ, গাছে ছিল বড়ো বড়ো হনুমান। আর নীচে ছিল কিছু ছোট ছোট মাংসাশী প্রাণীর আনাগোনা। এই অঞ্চল ছিল বর্ধমানের রাজাদের আন্ডারে। পরে ইংরেজ সরকারের হাতে আসলেও সরকার উন্নতির দিকে তেমন নজর দেয়নি। তাছাড়া কোলিয়ারি অঞ্চল ঘোষিত হওয়ার পর আর কোনো প্রয়োজন আছে বলে সরকার মনে করেনি। যাইহোক যে কথা বলছিলাম, কথিত আছে, এখন যেখানে শ্মশান অবস্থিত ,তখন সেখানে গভীর জঙ্গল ছিল। সেখানে পর্ণ কুটিরে বাস করতেন এক কালী সাধক। মানুষ জন সেদিকে বেশি যেত না। আদিবাসী মহিলারা গাছের ফলমূল পেড়ে তাঁর পদতলে রেখে আসত, উনি বেশির ভাগ সময় ধ্যানমগ্ন থাকতেন। কুটিরের সামনে একটা পুকুর ছিল, তাতেই তিনি স্নান এবং জলপান করতেন। ফলফলারি যা পেতেন তাই আহার করেই দিন অতিবাহিত করতেন। এমন ভাবেই চলছিল। একবার হলকি, ওই এলাকার আদিবাসীদের সর্দ্দারের হলো এক কঠিন ব্যামো। দুই দিন অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে ,কিছুই খাওয়ানো যাচ্ছে না, জলও গিলতে পারছে না, ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে জল বেরিয়ে যাচ্ছে। সমস্যাটা ওঝার বোঝার বাইরে চলে গেল। ওঝা যখন অপারগ,তখন সর্দ্দারের বউ সর্দ্দারকে নিয়ে সাধু বাবার কাছে এসে স্বামীর প্রাণ ভিক্ষা করলো। ধ্যানস্থ সাধু মানুষের কোলাহলে ধ্যান ভঙ্গ করে উপস্থিত আদিবাসীদের আর্জি শোনেন। তারপর সর্দ্দারের দিকে তাকিয়েই বলেন-“তোমাদের সর্দ্দার মারা গেছে,এখন নয় অনেক্ষন। শরীর পচন ধরে গেছে, শীঘ্রই অন্তেষ্টির ব্যাবস্থা করো”। সূর্য তখন পাটে যায় যায় অবস্তা। শ্মশান বহুদূর জঙ্গুলে পথ, পরদিন সকাল ছাড়া কোনো উপায় নেই। শিশু হলে না হয় জঙ্গলে এক জায়গায় পুঁতে দিত, এখানে তো সে উপায় নেই। তাছাড়া দাহসংস্কারওতো আছে। সাধু বাবা আদিবাসীদের চরম সমস্যাটা উপলব্ধি করলেন। তারপর কিছুক্ষন ধ্যানস্থ হয়ে বললেন-“তোমরা কোলাহল পরিত্যাগ করো, আমার কুটিরের পূর্ব দিকে তৃতীয় সাঁড়া গাছটি পাশে যে ফাঁকা জায়গাটি আছে ওখানে চিতা সাজাও, দাহর পর নাভি ভস্ম এই পুকুরে ভাসিয়ে বৈতরণী কর্ম সমাধান করো”। সেই শুরু হলো দাহ কাজ, আজও চলে আসছে। শোনাযায় প্রচন্ড গরমে চারদিক যখন খটখটে শুকনো তখন ওই পুকুরে ভর্তী জল থাকতো। সবই যেন সাধু বাবার আশীর্বাদ। যদিও কালের গর্ভে সেই পুকুর মজে বুজে একাকার হয়ে গেছে। শ্মশানের পুরা কাহিনী শুনতে শুনতে আমরা শ্মশানের কাছে চলে আসলাম।
বিরাট জঙ্গল, একটা পায়ে হাটা পথ জঙ্গলের ভীতরে ঢুকে গেছে। জঙ্গলে ঢুকতেই একটা নড়বড়ে পাকা ঘর তালা দেয়া আছে, শব আসলে ঘরটি অস্থায়ী অফিস হিসাবে ব্যবহার করা হয়। আলোর ব্যবস্থা না থাকার কারণ জানতে চাইলে খগেন বাবু বললেন সন্ধ্যে নামার পর এখানে আর শব আসে না। পাশেই কালি মন্দির, মা কালীর অবয়বটা ঠিক আমাদের সচরাচর দেখা মা কালীর মতো নয়। একটু আদিবাসীদের দেবতা গোছের। মাতৃরূপ যাইহোক ভক্তিটাই আসল। “মা-গো কারোনার হাত থেকে তোমার ধরাধামকে রক্ষা করো মা”। পরিমল হাতজোড় করে উচ্চস্বরে মা কে প্রণাম করে কথাটা বললো। খগেন বাবু জানালেন ,কথিত আছে এই মা সেই মা যার সামনে বসে দেড়শ বছর আগে সাধু বাবা সাধনা করতেন। ভিতরে প্রবেশ করে দেখলাম ঘন জঙ্গেলের মধ্যে একটা ছাউনি করা বেদি। যেখান থেকে আত্মা স্বর্গের পথে পা রাখে। পাশে একটা বড়ো চৌবাচ্চা জলে ভর্তি। খগেন বাবু বললেন, শব আসলে যখন বৈতরণী পার করার জন্য পরলৌকিক কাজ করা হয়, তখন পুরোহিত মশাই চৌবাচ্চার জলে এক শিশি গঙ্গাজল ঢেলে দেন, ব্যাস গঙ্গা প্রাপ্তি হয়ে গেল। সবই তো মন। মানলে শিব, না মানলে শিলা। এবার খগেন বাবু আমাদের জানালেন, বছর পাঁচেক এখানে রাতে কেউ শব দাহ করতে আসে না। কারণ রাতের অন্ধকারে শ্মশানে এক মহিলা কণ্ঠের কান্নার আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায়। এখানকার অধিবাসীদের ধারণা শাকচুন্নি আধপোড়া শবের লোভ লালসায় শ্মশানে এসে অমন করে। সব শুনে সোমনাথ খগেন বাবুকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন “যে যাই বলুক, আপনার নিজের কি মনে হয়”? খগেন বাবু চুপ করে থাকলেন কোনো উত্তর দিলেন না। সোমনাথ বললো-“বুঝলাম, বিশ্বাস অবিশ্বাসের মাঝখানে পড়ে গেছেন। আপনিই পারবেন আমাকে সাহায্য করতে”। খগেন বাবু অবাক হয়ে বললেন-” আমি আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না”। সোমনাথ একটু হেসে বললো-‘আপনার বাড়িতে বড়ো টর্চ হবে”? “পাঁচ সেলের টর্চ হবে, কিন্তু কি হবে”? খগেন বাবু পাল্টা প্রশ্ন করলেন।সোমনাথ এবার তার প্লানটা বললো-“আপনি টর্চটা নিয়ে সন্ধ্যা সাতটায় ইকো পার্কের গেটের সামনে আসবেন, ওখানে , আমি, তারক রঘু আর পরিমল অপেক্ষা করবো। আপনি আসলে আমরা পাঁচ জনে মিলে শ্মশানে যাবো। তারপর শাকচুন্নির কান্না লক্ষ করে আমরা জঙ্গলে ঢুকবো”। খগেন বাবু প্রথমে কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। অনেক বোঝানোর পর রাজি হয়ে বললেন-“দেখি তাহলে বুধন মুন্ডাকে সঙ্গে নিতে পারলে ভালো হবে”। খগেন বাবু চলে যেতেই তারক বললো-” সোমনাথ বিয়ে বাড়িতে এসেছি, এসব বিষয়ে নাক গলানো কি ঠিক হবে’? সোমনাথ অপরাজেওতার কাঠিন্নতায় বললো-“ব্যাস, ধান ছাড়াতে গিয়ে চলে আটকালো, আরে এতগুলো লোক থাকবো,যদি সত্যিই শাকচুন্নি থাকে তো পালাবার পথ পাবে না”।
ঠিক সাতটার সময় আমরা চারজন ইকো পার্কের গেটের সামনে এসে দাঁড়ালাম। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। খগেন বাবু আর বুধন মুন্ডা একটা পাঁচ সেলের টর্চ নিয়ে সময় মতো চলে এলেন। আমরা ছয় জন অনতিদূর শ্মশানের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম।
শ্মশানে ঢুকতেই কালী মন্দির পড়ে, বুধন বললো -” বাবু এখানে দাঁড়ান বটে, কান্নার শব্দ শুনলে ভিতরে যাবোক বটে”। তারক মা কালীকে প্রণাম করে বলল-” মা গো পারলে সোমনাথের মাথায় একটু সুমতি সুবুদ্ধি দাও মা। নইলে বিয়ে বাড়িতে এসে কোথায় সেজে গুঁজে ঘুরবো ফিরবো, ভালো মন্দ খাবো তা নয় রাতের অন্ধকারে জঙ্গলে ঘুরছি ভুত দেখতে”। বুধোন ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল-” সবাই চুপ করেন , কান দিয়ে শুনেন কান্নার আওয়াজ আসছে বটে”। আমরা সতর্ক হলাম ভালো করে খেয়াল করলাম সত্যিই জঙ্গলের ভিতর থেকে একটা কান্নার চাপা আওয়াজ আসছে। আওয়াজটা আস্তে আস্তে বাড়তে লাগলো। আমরা শ্মশানে ঢুকলাম সামনে সোমনাথ, হাতে হাই পাওয়ার টর্চ লাইট। কানে আসলো খুব কাছেই মহিলা কণ্ঠের কান্নার আওয়াজ, বলছে-” তু কুথায় বাপ মুর কাছে আয় বটে”। সোমনাথ আওয়াজ লক্ষ করে টর্চ মারতেই আমরা পরিষ্কার দেখলাম জঙ্গলের মধ্যে ধূসর রঙের কি যেন একটা সরে গেল। সোমনাথ টর্চের আলো ফেলে দ্রুত পায়ে খানিকটা এগিয়ে গেলো,কিছু না দেখতে পেয়ে চিৎকার করে বললো-” এই কে তুমি? বেরিয়ে এসো”। আমাদের ভয়ে শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। সোমনাথের চিৎকারে শ্মশানের মধ্যে একটা বিভীষিখাময় পরিবেশের সৃষ্টি হলো। পেঁচা বাদুড়গুলো এমন ভাবে ডেকে উঠলো যে আমাদের শরীরের রক্ত ঠান্ডা হয়ে গেল। কান্নার আওয়াজ কিছুক্ষন থেমে আবার শুরু হলো। আমাদের সেনাপতি সোমনাথ বললো সামনের ঐ ঝোপের আড়ালে নিশ্চই আছে। সে ছুটে সামনের জঙ্গলের দিকে চলে গেল। আমরা ভয়ে পড়িমড়ি করে সোমনাথের পিছন পিছন ছুটলাম। জঙ্গলের ওদিকটায় গিয়ে সোমনাথ টর্চের আলো কোনো বস্তুতে ফেলে চিৎকার করে বললো-” এই নড়বে না, দাঁড়াও”। নিকষ অন্ধকারের মধ্যে টর্চের আলোতে দেখলাম একটা ছেড়া ময়লা ছোট কাপড় পরিহিতা অর্ধনগ্না মহিলা। যার চোখ দুটো শিকারি বাঘের মতো, মাথা ভর্তী রুক্ষ্ম চুল। একলা থাকলে হয়তো ছুটে এসে গলা টিপে মেরে রক্ত খেত। আমাদের মধ্যে থেকে বুধন বলে উঠলো-” উ তো ফুলমনি আছেক বটে। বুঝছি ,উ ওর বেটাকে খুঁজতে শ্মশানে আসে বটে। পাগল হয়েক গিছে ল, পাঁচ বছর ধরে খুঁজে বেড়াইছে বটে”! এদিকে ওই মহিলা কাঁদতে কাঁদতে ভাঙ্গা গলায় চিৎকার করে বললো-” তুরা শয়তান আছিস বটে, আমার বেটাকে ইখানে লুকিয়ে রাকছিস বটে”। সোমনাথ বললো -” তুমি দাঁড়াও , তোমার ছেলে আমার কাছে আছে”। আমরা সবাই মহিলার কাছে গিয়ে ঘিরে ধরলাম। মহিলা তখন কাঁদতে কাঁদতে বলে যাচ্ছে-” তুরা মিথ্যাবাদী বটে, ছেলেকে—“
হঠাৎ শ্মশানের বাইরে একটা কোলাহল শোনা গেল। এদিকে সোমনাথরা ফুলমনিকে ছেলে ফিরিয়ে দেয়ার লোভ দেখিয়ে শ্মশানের বাইরে আনার চেষ্টা করতে লাগলো।
বিয়ে বাড়িতে হাই প্রোফাইল নিমন্ত্রিত অতিথিরা একে একে এসে পড়েছেন। এসডিও, পুলিশের এসপি, লোকাল পলিটিক্যাল নেতা,এবং বেশ কিছু কবি সাহিত্যিক,কারণ মৃনাল বাবু নিজেই দুর্গাপুর অঞ্চলের একজন প্রখ্যাত কবি, বিয়ে বাড়ি যেন চাঁদের হাট হয়ে উঠলো। এরই মধ্যে মৃনাল বাবুর কানে সংবাদটি পৌঁছুল যে সোমনাথরা শ্মশানে গেছে ভৌতিক প্রচারের সত্যান্বেসনে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি পুলিশের এসপি সহ কিছু পুলিশ নিয়ে শ্মশানে এসে উপস্থিত হলেন। এদিকে সন্তান ফিরিয়ে দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ফুলমনিকে শ্মশানের বাইরে আনা হলো। তারপর সোমনাথ এসপি কে সমস্ত ঘটনা বললো। মৃনাল বাবু, এসপি, লোকাল পলিটিক্যাল লিডার দ্রুত আলোচনা করে একটা সিধান্তে আসলেন। ফুলমনিকে দ্রুত দুর্গাপুর স্টেট জেনারেল হাসপাতালে ভর্তী করার ব্যবস্থা করা হলো।
পরে সোমনাথ মৃণাল বাবুর কাছে খবর পায় , ফুলমনি এখন অনেক সুস্থ্য। সরকারি ভাবে তাকে অনেক সুযোগ সুবিধার ব্যাবস্থা করে দিয়েছেন, স্বয়ং মৃনাল কান্তি বাগচী।আরো একটা গুরুত্তপূর্ণ খবর হলো, রাতের আঁধারে শ্মশানে আর শাকচুন্নির কান্নার আওয়াজ শোনা যায় না।
–~০০০XX০০০~–