কঞ্জুস
✍️ শিব প্রসাদ হালদার
“কয়লা ধুলেও যায় না ময়লা, যতই কর চেষ্টা।” তাই শত চেষ্টা করেও “টাকলা”র অস্বচ্ছ স্বভাবটা স্বচ্ছ হয়ে উঠতে পারেনি। সাহিত্যে একটু আধটু দখল থাকলেও নিজেরটাই জাহির করতে সবসময়ে সচেষ্ট। অন্যের প্রতিভাকে স্বীকৃতি দিতে বড্ড কার্পণ্য দেখায়। আত্মস্বার্থটা ঠিক ষোল আনা বোঝে। অনেকেই ওকে একদম পছন্দ করে না। কেউ কেউ বলে “কুটিল”। সদ্য সখ্যতায় সখার ঢালাও স্তুতির মাঝে একটু বেশি মদত দিতে গিয়ে বড্ড বিপাকে পড়তে হয়েছে। সম্মান হানি যে ঘটেনি তা নয়। টাকলার এমন নিন্দিত স্বভাবের জন্য তাকে পরিমলের একদম পছন্দ নয়। অনেক সময় তার কোন লেখা প্রকাশ হলে পরিমলকে তার গাঁটের পয়সা খরচ করে পত্রিকাটি কিনে আনার কথা বলে। কখনো বা কোন লেখা দিলে তার জেরক্স কপিও নিজের গাঁটের পয়সায় করিয়ে নিতে বাধ্য করায়। এমন হাড়কিপটে চশমখোর এমন ব্যবহারে পরিমল অনেক সময় বিরক্তিভাব প্রকাশও করেছে তবুও তাতে তার লজ্জা নেই! তার মাঝেও সে কিছু বললে পরিমল উপেক্ষা করে না। এইতো সেদিন বাগমারিতে এক সাহিত্যসভায় তাকে নিয়ে যাবার প্রস্তাব দেয়। নির্ধারিত সময়ে টাকলার সুবিধাকে প্রাধান্য দিয়ে বেশি পয়সা খরচা করে উল্টো পথে অটো করে চলে গেল এক নম্বর এয়ারপোর্ট। সেখান থেকে সোজা বাসে করে বিধান নগর।
ভিড়ে ঠাসা বাসে উঠেই পরিমল বসবার সিট পেলেও সম্মান ও ভদ্রতার খাতিরে টাকলাকে বসিয়ে সে দাঁড়িয়ে রইলো। কেষ্টপুর যেতেই পরিমল দুইজনের ব্যবধানে সিট পেয়ে গেল। বাস ছুটে চলেছে। কন্টাকটার টিকিট কাটার কথা বলাতে টাকলা একদম নিরুত্তর। এদিক ওদিক তাকিয়ে অন্য মনস্ক ভাব দেখাতে লাগল। কন্টাকটার বারবার টিকিটের কথা বলায় বাধ্য হয়েই পরিমলকে দেখিয়ে দিল। তার কাছে শুধু একটা এক শত টাকার নোট থাকায় টাকলাকে বললো -“কাকু টিকিটটা আপনি কাটুন। আমার কাছে খুচরা টাকা নেই।একটা মাত্র একশ টাকার নোট আছে।”এ কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠলো- “আমার কাছে তো পাঁচশ টাকার নোট।” বলেই ভাবল এটা একটু বেশি বলা হয়ে গেল! উপায়ান্তর না দেখে অবশেষে রুমালের ভাঁজ খুলে খুলে একটা ময়লা কুড়ি টাকার নোট বের করে কন্ডাক্টরের হাতে দিয়ে খুব আস্তে করে বলল -ভাই! আমাকে টিকিট দিতে হবে না। হাতের পাঁচটা আঙ্গুল একবার আর দুটো আঙ্গুল একবার দেখিয়ে বুঝিয়ে দিলো -পাঁচ টাকা করে দুটো কেটে নিতে। টাকলা ভাবলো তবুওতো দুই টাকা করে চারটি টাকা বেঁচে যাবে। কন্ট্রাকটর ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। সে ভাবল সাত টাকা করে দুটি কাটতে বলেছে। টাকলা বড্ড চালাক হলেও কন্টাক্টর টাকা হাতে পেয়ে সাত টাকা করে দুটো টিকিট আর ছয় টাকা তার হাতে ধরিয়ে দিল। একটা সোনালী রঙের পাঁচ টাকার কয়েন আর একটা এক টাকার কয়েন। দুটো টিকিট কেটে নেওয়ায় মুখটা একটু বেজার করে বিরক্তিভাব দেখালেও মুখে কিছু বললো না। শুধু কন্টাকটারের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল আমি বললাম পাঁচ টাকা করে-দুটো—।টাকলার ব্যবহারে কন্টাক্টরও খুশি নয়। বিধান নগর আসতেই বলে উঠলো- নামুন-নামুন—-।ভিড়ের মাঝে ঠেলাঠেলি করে নেমে পড়তেই দ্যাখে- ফুটপাতে এক ভিখারি একটা কৌটা নিয়ে বসে পড়ে ভিক্ষা করছে। তা দেখেই টাকলার মনে জেগে উঠল- “জীবে প্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর—“
হাতে ধরা ছটি টাকা থেকে এক টাকার কয়েনটা ভিখারির কৌটায় দিতে গিয়ে আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে অসাবধানে সোনালী পাঁচ টাকার কয়েনটা কৌটায় পড়ে গেল। আর তাতেই যেন আঁতকে উঠলো। যেন কত বড় ক্ষতি হয়ে গেল! চোখে-মুখে ফুটে উঠল এক অস্বস্তির ছাপ।সঙ্গে সঙ্গেই এক টাকার কয়েনটা বা হাতে রেখে একটু নিচু হয়ে ডান হাতটা ভিখারির কৌটার মধ্যে ঢুকিয়ে দিলো। তখন দু-চারজন পথচারী পাশে দাঁড়িয়ে পড়ে দেখছে- সভ্য যুগের এমন অসভ্য কঞ্জুস মানুষের রগড়টা। পাঁচ টাকার কয়েনটা তুলে আনতেই যেন পেল পরম স্বস্তি! এবার পাঁচ টাকার কয়েনটা পকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে বা হাত থেকে একটাকার কয়েনটা ডান হাতে এনে কৌটায় ফেলে একটু পূণ্য লাভ করতে চাইলো। ভিখারী অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। এতবছর পথে পথে ভিক্ষা করছে কিন্তু এমন চরিত্রের মানুষ আজই প্রথম দেখতে পেল—! সেখানে জড়ো হওয়া পথচারীরা এমন দৃশ্য দেখে হতবাক হয়ে গেল। ভিখারীর চোখে মুখে এক বিস্ময়ের চিহ্ন! এমন ঘটনায় বড্ড ব্যথা পেয়ে ভিখারী কৌটা থেকে এক টাকার কয়েনটি তুলে হাতে ধরে বলল- “বাবু!এ পয়সা আপনি নিয়ে যান। আপনি গরীব মানুষ। আপনাকে ভিক্ষা দিতে হবে না—-।” এমন করুণ দৃশ্য দেখে পথচারীর মাঝ থেকে একজন বলে উঠল- “বেশভূষা দেখে তো ভদ্রলোক মনে হচ্ছে কিন্তু স্বভাবটা দেখে তো মনে হচ্ছে- ফুটপাতের ভিখারীর থেকেও উনি আরও ভিখারী——–!!
–~০০০XX০০০~–