তোমায় পূজার ছলে
✍ কাকলি ঘোষ
দোসরা মে সত্যজিৎ রায়ের জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য। গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজা।
ঘরে ঢুকতেই দীর্ঘদেহী মানুষটি চোখ তুলে তাকালেন।
“ আসুন। বসুন।“
সোফার মধ্যে নিজেকে সঁপে দিতে দিতে শুনলাম পরের প্রশ্ন,
“ নাম কি ?”
হাত পা বিশ্রীভাবে ঘামছে। তারই মধ্যে কোনরকমে বলে ফেললুম নিজের নাম। “
“ হুম। আপনার কথা শুনলাম লালমোহন বাবুর কাছে। কফি চলে তো ?”
দুরু দুরু বুকে কৃতার্থ চোখে ঘাড় নাড়লুম। জলদ গম্ভীর কণ্ঠে হাঁক গেল,
“ প্রহলাদ দু কাপ কফি। “
চকিত চোখে তাকালাম। এতক্ষনে বুঝতে পারলাম যে দরজা খুলে দিল তাকে এত চেনা লাগছিল কেন ? আচ্ছা! এ তো প্রহ্লাদ ! এতদিন বইয়েই পড়েছি আর ছবিতে দেখেছি। উফফ ! আর কাকে কাকে দেখতে পাব কে জানে ? প্রহ্লাদ যখন এখানে তখন প্রফেসর শঙ্কুও নিশ্চয় আছেন। ইস্ ! দেখা হলে কি ভালো হয়! মিরাকিউরাল বড়ি দু চারটে চেয়ে নিতাম। আহা ! পাশের বাড়ির নকুড়বাবু বড্ড কষ্ট পাচ্ছেন হাঁপানিতে। দেওয়া যেত। সেই ডাগর চোখের, ছিপছিপে, কল্পনা বিলাসী নিশ্চিন্দিপুরের ছেলেটি কি আসে এখানে ? এখন তো অনেকই বড় হয়ে গেছে। তবু ওই চোখ দুটো ছুঁয়ে দেখার একটা ভীষণ ইচ্ছে ছিল মনে। ইচ্ছে ছিল ওর কল্পনার সঙ্গী হতে। আর একজনকেও সামনা সামনি দেখার ইচ্ছে যেমন প্রবল আতঙ্কও তেমন কম নয়। তিনি হলেন মগনলাল মেঘরাজ। এখানে অবশ্য তার দেখা পাওয়া মুশকিল। সেই ওষুধ জালিয়াতি কাণ্ডের পর তিনি যে কোথায় গা ঢাকা দিয়েছেন সেটা জানা যাচ্ছে না।
বুকের মধ্যে যেন দ্রিমি দ্রিমি ঢাক বাজছে। এমন দিন জীবনে আসবে কে ভেবেছিল ? স্বয়ং রায় মশাইয়ের ডাক এসে পৌঁছল এই নগণ্য লেখকের কাছে ! এ কি ভাবা যায়! তবে লালুবাবুর জন্যই হল ব্যাপারটা। ভাগ্যিস দেখা হয়েছিল সেদিন নিউ মার্কেটে ! আহা ! কে জানত রোজের একটা সাধারণ দিন এমন অসাধারণ হয়ে উঠবে ?
ছোট বোনের ফরমাশি লেস কিনতে গেছিলুম নিউ মার্কেটে। একেবারে ঘিঞ্জি গলির মধ্যে। আশেপাশে ঘেঁষাঘেঁষি মেলা দোকান। বেরোতে যাচ্ছি হঠাৎই সংঘর্ষ ! এক ভদ্রলোক হন্তদন্ত হয়ে পেরিয়ে যাচ্ছেন। তো ধাক্কা লাগবি তো লাগ আমার সাথেই। হাত থেকে লেসের প্যাকেটটা পড়ল গিয়ে রাস্তায়। লেস বেরিয়ে রাস্তার ধুলো কাদায় পড়ে সে একেবারে যাচ্ছেতাই কান্ড ! ভদ্রলোক অপ্রস্তুত মুখে তাকালেন আর আমি তড়িৎপৃষ্ট। স্বয়ং জটায়ু ! এ যে একেবারে অবিশ্বাস্য ! অকল্পনীয় ! শেষে ব্যাপারটা দাঁড়ালো এইরকম
যে উনি নিচু হয়ে লেস কুড়োচ্ছেন আর আমি চিত্রার্পিত চেয়ে আছি। হুঁশ ফিরলো যখন লালমোহন বাবু নিজে হাতে প্যাকেটটা তুলে দিলেন আর দুঃখ প্রকাশ করলেন।খুব লজ্জা পেলাম কিন্তু সুযোগ ছাড়লাম না। সবিনয়ে জানালাম যদি উনি দয়া করে এক কাপ চা খান আমার সাথে তাহলে কৃতার্থ হই। নিজের ভাগ্যকে বিশ্বাস হচ্ছিল না যখন জটায়ু রাজী হয়ে গেলেন। । আর সেই চা খেতে বসেই মনের ইচ্ছে প্রকাশ করে ফেললাম। একবার যদি ফেলুদার স্রষ্টার সঙ্গে দেখা করে যায় __ ।
ভ্রু কুঁচকে তাকালেন লালমোহন বাবু।
“ কেন ? ফিল্মে নামবেন নাকি ?”
সলজ্জে মাথা নাড়লাম। “ এই চেহারায় ফিল্ম ?”
“ তবে ?” সিঙ্গাড়ায় কামড় দিয়ে আবার প্রশ্ন করলেন লালমোহন গাঙ্গুলি।
“ আমার একটা ভালো গল্প আছে। ওনাকে শোনাতে চাই। যদি __”
“অ। ফিল্ম বানাবেন । তা চলে আসুন একদিন।আসেন তো কতজন। মনের মত না হলে তো উনি করেন না। ঠিক আছে আমি সব বলে কয়ে রাখব অখন। “
“ আসব ? দেখা করবেন উনি ?”
মাভৈ দিলেন জটায়ু। কথা বলে রাখবেন এমন ইঙ্গিতও দিলেন।
সেইমতই আজকের আসা।কিন্তু জটায়ুকে দেখছি না। ফেলুদা তোপসের দেখাও পাব আশা করেছিলাম। ঘরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলাম। অজস্র বই, খাতা , ছবি স্তূপাকার। শুধু পেন্সিল স্কেচগুলোই দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। আর তারই মধ্যে নিমগ্ন একটি সৌম্য শান্ত স্বল্পভাষী মানুষ।
“ আপনি গল্প লেখেন ?”
ওহ ! কে কাকে প্রশ্ন করছেন ? লজ্জায় যেন মরে গেলাম।
“ ওই আর কি। একটু আধটু। __”
“ হুম। নিন কফি খান। “
কখন নিঃশব্দে কফি নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে প্রহ্লাদ টের পাইনি।
এখন কাঁপা কাঁপা হাতে কফিমাগ টা টেনে নিতেই আবার প্রশ্ন করলেন,
“ কি গল্প ?”
উত্তর দেবার আগেই দরজায় নক।
“ কাম ইন। “
ভেতর থেকেই সাড়া যেতে দরজা খুলে যিনি প্রবেশ করলেন তাকে দেখেই আমার হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল। লম্বায় প্রায় ছয় ফিট। টকটকে গায়ের রঙ, অপূর্ব সুদর্শন মানুষটি সামনে এগিয়ে এলেন। এ তো প্রদোষ মিত্তির। সেই ছেলেবেলা থেকে যার সাথে পরিচয়! কত দিন কত দুঃসাহসিক অভিযান ওর সাথে করেছি মনে মনে। কতবার মনে হয়েছে __ আহা! তোপসের জায়গায় যদি আমি হতুম ! সেই আমার স্বপ্নের নায়ক আজ চোখের সামনে ! চোখ কচলে সামনে তাকালুম আবার। কথা বলছেন তিনি। যেমন মিষ্টি তেমনি ভরাট কণ্ঠস্বর।
“ মানিক দা __ একটা বিশেষ ব্যাপারে বিরক্ত করতে এলাম। কস্টিউমটা তো ____”
কি বিষয়ে কথা বলছেন ওরা, কি নিয়ে আলোচনা __তার বিন্দু বিসর্গও মাথায় ঢুকলো না। শুধু চেয়ে রইলাম বিস্ময়ে। কথা শেষ বেরিয়ে গেলো ফেলু মিত্তির। অথচ আপ্রাণ চেষ্টাতেও একটা শব্দও বেরোল না আমার মুখ দিয়ে।
“ হ্যাঁ কি গল্প ?”
প্রশ্নটা কানে যেতে সম্বিত ফিরে পেলাম,
“ ইয়ে মানে একটা রাজনৈতিক পটভূমিতে লেখা সামাজিক গল্প। “
হাসলেন উনি। “ বেশ। রেখে যান। দেখব। এখন একটু ব্যস্ত আছি। প’ড়ে নিশ্চয় জানাবো।“
একটু মনক্ষুন্ন যে হলাম সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু বলারও কিছু নেই। ব্যস্ত মানুষ। এইটুকু সময় যে দিয়েছেন এই যথেষ্ট। বড় ইচ্ছে ছিল নিজে পড়ে শোনাই। জটায়ুকে এমন কথাই বলেছিলাম। কিন্তু হবে বলে মনে হচ্ছে না। গল্পের কাগজখানা রেখে উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছি হঠাৎই ঝড়ের বেগে ঢুকলো একজন। মুখটা বড্ড চেনা। একে কোথায় যেন দেখেছি। কোথায় __?
“ মানিকদা। দেখুন তো ঠিক আছে ?”
গলা শুনে সঙ্গে সঙ্গে চিনে ফেললাম। আরে এতো তিনি ! এখন মেকাপে আছেন। ওঃ ! অভিনয়ে জুড়ি নেই ভদ্রলোকের। তা সে মন্দার বোসই হোক বা বৃদ্ধ ছোরা চালানো অর্জুন।
“ ঠিক আছে। কিন্তু গোঁফ টা আর একটু কম ছুঁচলো হলেই ভালো হোত। “
“ আচ্ছা।“ বলেই হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলেন ভদ্রলোক।
“ নতুন কোন ছবির শুটিং হচ্ছে বুঝি ?” কৌতূহল চাপতে না পেরে বলেই ফেললাম।
“ হ্যাঁ। জটায়ুর গল্প। আচ্ছা। আজ তাহলে উঠি। শুটিং শুরু হবে এক্ষুনি। আবার দেখা হবে। নমস্কার। “
ধীরে সুস্থে বেরিয়ে গেলেন মানুষটি। আমিও উঠতে যাব এমন সময়,
“চারখানা খুন আছে মশাই গল্পে। আর আছে অপহরন । এবং সেটাও মরুভূমির বুকে। ওহ ! “
বলতে বলতে স্বয়ং জটায়ু ঢুকলেন এবার ঘরে। বোঝা গেল কথার শেষটুকু কানে গেছে তার।
মন ভরে গেল লালুবাবুকে দেখে।
“ ওহ ! সেতো দারুন ব্যাপার। শুটিং ?”
“ শুটিং পুরোটাই হবে মরুভূমিতে। কিছু টা ইনডোরে।“
“ আর প্রখর রুদ্র ? থাকছেন তো ?”
“ হা হা হা। হাসালেন মশাই। প্রখর রুদ্র থাকবে না ? তবে ধরবে কে খুনীকে ?”
“সেতো ঠিকই। আচ্ছা বইয়ের নামটা কি সাহারায় শিহরণ ?”
“ হা হা হা। আপনি তো দারুন ইন্টেলিজেন্ট মশাই।ঠিক ধরে ফেলেছেন তো ! আপনাকে কাল্টিভেট করতে হচ্ছে __”
সবিনয়ে চুপ করে থাকি।
“তা কি হল ? কথা হল রায় বাবুর সাথে ?”
“ হল। গল্প রেখে যেতে বললেন। ডেকে নেবেন পরে। “
“ ব্যস ব্যস। অত ভাবছেন কেন মশাই ? লেখায় যদি সারবত্তা থাকে ডাক আপনি পাবেনই। এই আমাকেই দেখুন না। তিনটি বছর পরে ডাক পেলুম। “
“ বলছেন ?”
“ হ্যাঁ মশাই। চলুন। শুটিং দেখে যান এসেছেন যখন। আজ একটা ঘোড়ার পিঠে ডাকাতির সিন আছে বুঝলেন। সে এক থ্রিলিং ব্যাপার মশাই। এই ডাকাত এগোচ্ছে __পেছনে পেছনে প্রখর রুদ্র। ধরে ফেলেও ধরতে পারছে না। চলুন চলুন।“
প্রায় আমাকে বগল দাবা করেই ঘরের বাইরে নিয়ে চললেন জটায়ু।
কিন্তু একি ! আরে আরে ! জটায়ুর মুখটা অমন বদলে যাচ্ছে কেন ? কি রকম যেন অন্য কেউ ! চেনা চেনা ! আরে আরে ! এ তো !
“ আর কতক্ষন ঘুমোবি বিলু। ওঠ এবার। দুপুরে এরকম মোষের মত ঘুম ! পারিস ও বটে ! “
দাদার ডাকে ধড়মড় করে উঠে বসি। ঘুম ! ঘুমাচ্ছিলাম আমি ! ওহ !
“রোজ কত কি ঘটে যাহা তাহা
এমন কেন সত্যি হয় না আহা
ঠিক যেন এক গল্প হত তবে
শুনত যারা অবাক হত সবে”
কলমে তোমার এত কি জোর আছে
পৌঁছে যাবে একেবারে সত্যজিতের কাছে ?
–~০০০Xসমাপ্তX০০০~–