গানখানি গাঁথিলাম ছন্দে
✍ কাকলি ঘোষ
স্যার বেরিয়ে গেলেন। পেছন পেছন বাকিরাও। বই খাতা গোছাতে গোছাতে একবার মনিদীপার দিকে চাইল কথাকলি। মুখ নিচু করে বসে আছে। মনে মনে ঠোঁট ওল্টায় ও। শুরু হল ঢং। ভালোবাসা ! প্রেম ! উফফ ! পারিস ও বাবা এত আদিখ্যেতা করতে ! চোখের জল ও এসে যায় ঠিক টাইম মত। এখন উনি কাঁদবেন বসে বসে। আর বিরহানলে দগ্ধ হবেন। অসহ্য ! দু চোখে দেখতে পারেনা এসব। আর সময়ও নেই এসব ন্যাকামো দেখার। পয়লা বৈশাখ দোরগোড়ায়। রিহ্যার্সাল আছে। বেরিয়ে যেতে গিয়েও আবার পেছন ফিরে তাকায় ও।
“ চলি রে। “
মুখ তুলে তাকিয়ে ঘাড় হেলায় মনীদীপা। স্পষ্ট দেখে কথাকলি। দু চোখের কোনে জল চিকচিক করছে ওর।
“ রিহ্যার্সালে যাবি ?”
“ হুম। “
“ স্যারও তো আসবেন । না ?”
“ হ্যাঁ। গান আছে তো। “ অবাক হয়েই তাকায় কথাকলি।
“ ইস্। আমি যদি তোর মত নাচতে পারতাম !”
“ তাহলে কি হোত ? রাজদীপ এর গানের সাথে নাচতিস ?” মুখ টিপে হাসে কথাকলি। “
“ হুম। তুই কতক্ষণ ওকে এখনও দেখতে পাবি ! আর আমি __” কান্নায় বুজে যায় ওর গলা।
“ উফফফ! কাঁদছিস কেন ? বললে পারতি তো “
“ কি ?”
“ কি আবার ? বলবি রাজদীপ আমি তোমায় ভালোবাসি “
“ ধ্যাৎ। তুই একটা যা তা। স্যার কে নাম ধরে এসব বলব ?”
“ উফফ ! ন্যাকামো আর করিস না। স্যারের প্রেমে পড়তে পারো আর নাম ধরতে পারো না। “ ভেংচে ওঠে কথাকলি।
“ ওসব তুই বুঝবি না। তুই কারুর প্রেমে পড়েছিস কখনো ?”
“ তা বটে। আচ্ছা। গেলাম তবে। “
ক্লাস থেকে বেরিয়ে এসে মনে মনে আরো একবার মুখ ভ্যাংচায় কথাকলি।
“প্রেমে পড়েছিস কখনো ?”
ঢং ! না। পড়িনি। তোর মত রোজ রোজ প্রেমে পড়া আমার স্বভাব না। দূর দুর ! তোর আবার প্রেম ! কথায় কথায় কান্না ! মাঝে মাঝে তো জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে এই নিয়ে কতবার হল রে মনিদীপা ? বলে না। হাজার হোক ছোটবেলার বন্ধু। চটকে যাবে বন্ধুত্বটা। তবে এটা সত্যিই ভেবে পায় না কথাকলি রোজ রোজ এই প্রেমের জোয়ার আসে কি করে ওর ? এই কদিন আগেই পাড়ার সব চাইতে ব্রিলিয়ান্ট ছেলে রক্তিমের প্রেমে পড়েছিল ও। ওহ ! সে কি অবস্থা ! খাবারে অরুচি ! রাতে আধখানা রুটি ! চোখে ঘুম নেই ! অমন সোনার বন্ন একেবারে কালি ! কথাকলি আর কি করে ? প্রাণের বান্ধবী বলে কথা। তার প্রাণ টা তো বাঁচাতে হবে । অগত্যা দিল রক্তিমের ফোন নাম্বার।ওর সাথে যোগাযোগ আছে জেনেই মনিদীপার শোক বেশি উথলে উঠেছিল সম্ভবত। মুখে বলে নি। কিন্তু কথাকলি কি আর বোঝে নি ? আবার অমন ছেলেটা মনিদীপার পাল্লায় পড়ুক সে ইচ্ছেও ছিল না। তবু দিল। কি হল ? কদিন ? রক্তিমের সাথে দুদিন প্রেম জমে উঠতে না উঠতেই আবার মন ঘুরে গেলো মনিদীপার। এবার টার্গেট ওদের কলেজের থার্ড ইয়ারের বিচ্ছু ছেলে অরিজিৎ। সেও কদিন। আবার নতুন একজন। আবার _
এ যেন মজার খেলা ওর কাছে একটা। অথচ যখন প্রেমে পড়ে, কথাগুলো বলে, বিশ্বাসই হয় না যে এগুলো সব ওর ফ্লার্ট ! ইদানিং আবার নতুন করে প্রেমে পড়েছে ও। এবার রাজদীপ স্যার।
ভাবতেই বুকের ভেতরটা কেমন খালি খালি লাগে কথাকলির। আগে তো কতজনের সাথে ফ্লার্ট করেছে মনিদীপা ! বিরক্ত হয়েছে ও। কিন্তু এমন অদ্ভুত অনুভূতি হয়নি তো কখনো !
মাত্র তিন মাস হয়েছে স্যার এসেছেন এই কলেজে পড়াতে। এরই মধ্যে সব মেয়েদেরই হার্টথ্রব। আর হবারই কথা। যেমন দেখতে তেমনি পড়ানো। সেক্ষেত্রে মনিদীপা যে হবেই এতে আর অবাক হবার কি আছে ? ওর তো প্রেমে পড়াই স্বভাব। আর সত্যি বলতে কি মুখে যতই অস্বীকার করুক ওর নিজেরও কি কিছু পরিবর্তন হয় নি ? হয়েছে তো। নাহলে এবার কলেজের বৈশাখী উৎসবে শ্যামা নৃত্যনাট্যে বজ্রসেন এর গান করবেন স্বয়ং রাজদীপ স্যার ! এটা জানা মাত্রই বুকের ভেতর অমন পেখম মেলেছিল কেন ময়ূর ? কেন যখন বজ্রসেনের আহ্বান শোনে স্যারের মুখে __
“হৃদয় বসন্ত বনে যে মাধুরী বিকাশিল
সেই প্রেম এই মালিকার রূপ নিল।“
তখন ভেতরটা এমন আকুল হয়ে ওঠে কেন ? নিজেকে কেন মনে হয় _ও যেন এই মেয়েটা নয়।এই কথাকলি নয়। সত্যি সত্যি সেই কোন আদি যুগের এক রাজনর্তকী ! যে ভালোবেসেছিল এক বনিককে! যার জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করেছিল _যাকে পাবার জন্য _
“ কথা _”
চমকে যায় কথাকলি।
‘ ক_কে”
“ কোথায় যাচ্ছিস ? কি ভাবছিস ? কখন থেকে ডাকছি জানিস ?”
ওহ ! রূপায়ণ।“ ডাকছিল নাকি ! ইস্ ! ছি ছি। কি সব ভাবছিল ও। শুনতেই পায়নি । ধ্যাত। কি যে সব মাথায় চাপে ! এ আবার হয় নাকি ! ও যেমন পাগল ! কলেজের বাঘা বাঘা সুন্দরী মেয়েরা যার জন্য পাগল ! মনিদীপার মত মেয়ে যার চোখের সামনে আছে । আর ও কিনা তার কথা ভেবে _ দূর দুর। ফালতু__
নিমেষে নিজেকে সামলে নিয়ে হাসিমুখে ঘুরে তাকায় কথা। “ কি রে ? “
“ আজ রিহ্যার্সাল হবে না রে। স্যারের গলা ঠিক নেই। সবাই বাড়ি চলে গেছে।“
“ কি ! কেন ? স্যারের গলা ঠিক নেই তো কি হয়েছে ? আমরা প্র্যাকটিস করতে পারতাম। উনি নয় একদিন নাই দিলেন রিহ্যার্সল। “
বোঝে কথাকলি অকারনেই ওর মেজাজ চড়ে যাচ্ছে।
“ হ্যাঁ। মানে __” আমতা আমতা করে রূপায়ণ।
“ তাহলে ? সবাই বাড়ি চলে যায় কি করে ? আর স্যার কি করে বলেন হবে না ! স্যার কি পরিচালনার দায়িত্বে আছেন ? নাচটা তো আমি তোলাচ্ছি। তুই তো এখনও সামান্য কটা স্টেপ রপ্ত করতে পারলি না। কোটাল কি শুধু তোর চেহারা দেখিয়ে হবে ? আর কটা দিন বাকি বল তো ?“
“ হ্যাঁ। বুঝেছি। কিন্তু _ ইয়ে _ স্যার তোকে একবার ডেকেছেন। ওই ওনার নিজের ঘরে। দ্যাখ কি বলেন ?”
“ ডেকেছেন ? আমাকে ? কেন ?”
“ জানিনা। বললেন কি আলোচনা আছে। আমি গেলাম বুঝলি। বাড়িতে প্র্যাকটিস করে নেব। কাল দেখিস। ঝক্বাস করে দেব। তুই একবার দেখা করে যাস কিন্তু।“
একটুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে স্টাফ রুমের দিকে এগোয় কথাকলি। কি আশ্চর্য ! এরকম হয় কেন ? বুকের ভেতর যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে কেউ। উফফ ! আরে সামান্য একটা দুটো কথা ওই প্রোগ্রামের ব্যাপারেই বলবেন নিশ্চয়। এতে এত চঞ্চল হবার কি আছে রে বাবা ! কলেজে একটা ছাত্র ছাত্রী আর অধ্যাপকরা মিলে এত বড় একটা প্রোগ্র্যাম হতে চলেছে তো তার সব রকম প্রস্তুতিই তো দরকার নাকি ! ও যে কেন এত বাজে কথা ভেবে মরে __ উফফ ! বিরক্তিকর। মনিদীপার রোগে ধরল নাকি ওকে।
“ আসব স্যার “
দরজার বাইরে থেকে মৃদু গলায় ডাকে কথাকলি।
“হুম। এসো। “
“ আমায় ডেকেছেন ? ওই রূপায়ণ বলল__।“
“ হুম। ডেকেছি। ব্যাপারটা কি তোমার ?”
“ কেন স্যার ?”
“ পর পর দুদিন ক্লাস কামাই করেছ কেন ?”
বিস্ময়ের শেষ সীমায় পৌঁছে যায় কথাকলি।
” কবে স্যার ?”
” গত সোমবার আর বুধবার। ”
“ আপনি _ মানে _ আপনি?”
“ কি ?”
“ মানে আমি আবসেন্ট ছিলাম আপনি সেটা খেয়াল করেছেন ? এত স্টুডেন্টদের মধ্যে ! ”
“ হুম। আরো অনেক কিছু খেয়াল করি।“
অনেককিছু ! কি ?
মুখে নয় সম্ভবত চোখেই ফুটে ওঠে অবোধ প্রশ্ন। মৃদু হাসে রাজদীপ।
“ যেমন _ কাল তুমি নীল সালোয়ার পরে অগোছালো চুলে কলেজে এসেছিলে। আর পরশু আমার ক্লাশে বসে অনর্গল কথা বলছিলে তোমার ওই বান্ধবী _ কি যেন নাম _ মনি কি _”
এতক্ষনে ধাতস্থ হয় কথাকলি। এসো বাবা পথে এসো। ওই নামটা জানার জন্যই এত কথা __! উফফ ! আরে জিজ্ঞেস করলেই তো বলে দিত। এর জন্য ওর বুকের রক্ত তোলপাড় করে দেবার কি কোন দরকার ছিল ? কি ঘোড়েল মানুষ বাবা ! যাক। তবু ঝেড়ে কেশেছে। এটাই যথেষ্ট।
“ ও। ওর নাম জানতে চাইছেন ? ও তো মনিদীপা। আমাদের কলেজের সব চাইতে সুন্দরী মেয়ে। আর ও আপনাকে __”
“ তুমি কিন্তু আসল কথাটা এড়িয়ে গেলে। absent ছিলে কেন ?”
এতক্ষনে নিজেকে বেশ আত্মস্থ লাগছে কথাকলির। বেশ একটা বেপরোয়া ভাবও। অবহেলায় উত্তর দেয় ও।
“ একটা প্রোগ্র্যাম ছিল। কিন্তু কেন বলুন তো ? অনেকেই তো absent করে। হঠাৎ আমাকে কৈফিয়ত তলব ? আর এই জন্যই কি ডেকে পাঠিয়েছেন ?”
“ হ্যাঁ। এইজন্যেই। অনেকের কথা থাক। তোমার কথা বল “
আজ কি ওর শুধু অবাক হবারই পালা ! ওর আবার কি কথা ! আর যদি সেটা থাকেও এই লোকের তো সেটা জানার কথা না ! তাহলে ! চোখ তুলে তাকায় কথাকলি। অপলকে ওর দিকে তাকিয়ে আছে রাজদীপ।
“ নেই কিছু ? কলি ? বল ?”
“ কিন্তু _ আমি _ মানে _ আপনি _”
দুহাতে মুখ ঢাকে কথাকলি। কিন্তু কতক্ষণ ! ওর স্বপ্নের রাজকুমার যে ওরই মুখের দিকে চেয়ে !
“ কলি __”
“ কিন্তু মনিদীপার কি হবে ? _ মানে _ ও আপনাকে _ বড্ড _”
“ ওহ ! ওর শৌখিন প্রেম বিলাসের কথা থাক না কলি। তোমার কথা বল না _ তুমি কি আমাকে _”
“ কিন্তু কলেজের আরো অনেকে _ মানে সবাই _”
“ উফফ ! কলি ! বড্ড কথা বল তুমি। I have to stop you __ “
চোখ তুলে তাকিয়ে আবার কিছু বলতে যায় কথাকলি। কিন্তু পারেনা। তার আগেই ওর ঠোঁট দুটো চাপা পড়ে যায় রাজদীপের পুরু ঠোঁটের আড়ালে।
–~০০০XX০০০~–