মা
✍ ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
সত্যি!হাবুল টা যে কোথায় গেল! তে তপ্পর টোটো কোম্পানি।লেখাপড়া নেই, স্কুলে যাওয়া নেই ।আসুক আজ ।ওর একদিন কী আমার একদিন ।হাড় হাভাতে গুলো কী সব ওর কপালেই জুটতে হয় ।ওই তো ।পটলার মা ।গোবর কুড়িয়ে ঘুঁটে বেচে ।দু বাড়ি ঠিকে ঝি এর কাজ করে ।অথচ পটলা দেখো ।নক্কী ছেলে ।পরীক্ষাতে পিত্যেক বছর ফাস্টো হয় ।বলি ।পেতিভা কি বড়নোক ছোটোনোক মানে?নিজের মনেই গজগজ করতে থাকে বাসন্তী ।কপালগুণে সোয়ামীটাও জুটেছে।মাতালের হদ্দ ।রাতে অরূপ বাউনের পুকুর থেকে মিরগেল মাছ ধরলে ।সকালে মিনুর মাকে বেচলে ।মাগ্যিগন্ডার বাজার ।কুড়ি টাকায় মাছ পেলে হাতে সগ্গো পাওয়া ।বোকার হদ্দ ।তাই নিয়ে চললেন ভাটিখানায় ।ছ্যাঃ !কী নলাট লিখেছো গো বিধাতাপুরুষ ।
হাবুল পুকুর পাড় থেকেই মা এর গজগজানি শুনতে পাচ্ছিল ।ভয়ে ভয়ে খিড়কি দিয়ে ঢুকলো ।
সারা পা কাদায় ভর্তি ।হাতে দুটো ল্যাটা মাছ ।ছেলের দিকে চোখ পরতেই চরকি চরকগাছ ।বললে কোথায় পেলি রে?আমি ভাবছি কী রাদবো ।মা এর মুখের এই হাসিটা হাবুলের ভীষণ ভালো লাগে ।কী খুশি মা । মা বললে যা ।ঠ্যাং দুটো ধুয়ে আয় দিনি ।হাবুল ছুট্টে চলে যায় ।
বাসন্তী র সাথে সুনীলের বিয়ে হয়েছিল ভালোবেসে ।সুনীল তখন ইঁটভাটায় কাজ করতো ।ফুলবাবু সেজে ঘড়ি হাঁকিয়ে যেত ।ওর ছ়েঁদো কথায় ভুলে নিজের পা এ কুড়ুল মারলে বাসন্তী ।তবে মাতালদের মন ভালো ।যখন নেশা থাকে না তখন খুব মান্যি আর সুখ্যাত করে বৌ এর ।বাসন্তী ভাবে বাংলাদেশের কত মেয়েই এমন করে সংসার করে ।
রান্নাঘরে ঢুকলো বাসন্তী ।টেঁপিটা সেই বেড়িয়েছে ।কৌটো ঝেড়ে চিঁড়ে গুলো ঢাললো ।জিওল গাছটা কেটে কাঠ করে দিয়েছে হাবুল ।আহা!দুধেবালক ছেলে মেয়ে দুটো কত কাজ করে ।বলতে বলতেই টেঁপি হাজির ।বাসন্তীর একগাল হাসি ।ট়েপির কোঁচল ভর্তি সজনে ফুল ।বাহ্!
উনানশালে আগুন ধরিয়ে চিঁড়ে ভাজতে বসলো বাসন্তী ।সরষের তেল দিয়ে শুকনো লঙ্কা আর জিরে দিয়ে তৈরি করলো মুখরোচক জলখাবার ।হাবুলের সামনের দুটো দাঁত পরে গেছে ।ফোকলা ছেলে হাসতে হাসতে বললে বীটনুন দিবি নে মা?টেঁপি বললে কতদিন” ল “চা করিস নি ।আদা দিয়ে এটুনি কর না মা ।
বাসন্তীর মাতৃহৃদয় পূর্ণ হয়ে ওঠে ।কতটুকুই বা চাওয়া ।ভিতরটা মোচড় দেয় যেন। মনে মনে বলে “হে ভগমান!ওদের তুমি বাঁচিয়ে রেখো ।
আলু দিয়ে সজনে ফুলের ঝাল আর কাঁচা তেঁতুল দিয়ে ল্যাটা মাছের টক রাঁধলো বাসন্তী ।চাল দুটো বেশি নিয়েছে আজ ।টেঁপি বললো আজ রান্নাগুলো খুব ভালো হয়েছে ।সকলেই থালা চেটেপুটে ভাত খেলো ।অভাব থাকলে খিদেটাও যেন বেশি হয় ।সুনীল ও এসে গেছে ।বললে “হ্যাঁ রে হাবুল,নুড়ি থেকে ল্যাটা মাছ ধরলি বুঝি” ।
হাবুল আহ্লাদে আটখানা ।বললে ব্যাঙের টোপ দিলে খুব ল্যাটা মাছ পরে বাবা ।
শঙ্করীদের পুকুর ঘাটে তেঁতুল গাছ ।ওখান থেকেই বাসন্তী সংগ্ৰহ করেছে কাঁচা তেঁতুল ।প্রকৃতি মা সবার জন্য ই দানের পসরা সাজিয়ে রেখেছেন ।আর মানুষ প্রকৃতিকে লাঞ্ছিত করে ।
এবারের শীতটা ভালো ই পরেছে ।থলে জোগাড় করে ভাঙা জানালায় এঁটে দিয়েছে বাসন্তী ।মেঝেতে খড় বিছিয়েছে ।তার উপরে পুরোনো বিছানার চাদর মেলেছে ।যতটা আরামে থাকা যায় আর কি!থাক না অভাব ।এমন গুষ্টিসুখ কজনের আছে ?
রাত যত বাড়ে চারিদিক নিথর নিথর ।শিয়াল আর ঝিঁ ঝিঁ র একটানা ডাকে বিরক্তি আসে ।ছেলে মেয়ের মুখ গুলো দেখে ।কত নিষ্পাপ আর নিষ্কলুষ ।ভালো করে কাঁথা জড়িয়ে দেয় ।ওর নাড়ি ছেঁড়া ধন ।ও তো মা ।ওদের জন্মের আগে থেকে ওদের সঙ্গে সম্পর্ক ।মনে পড়ে ছোট্ট বেলায় সেই পুতুলের মা হত ।মা ।একটাই শব্দ ।নির্ভেজাল ।সন্তানের জন্য মা যা খুশি করতে পারেন ।সন্তানের জন্য চোর হতেও প্রস্তুত ।
মাতাল সোয়ামী বেঘোরে পরে আছে ।ইস্কুলে ছেলেটাকে ভর্তি করার সময় বললে বাবার স ই লাগবে ।মরণ ।বাসন্তীর চোখে ঘুম নেই ।আজকাল বড় চিন্তা ।ছেলে মেয়ের ভবিষ্যৎ ওকেই ভাবতে হবে।
সকালে মালতী এসেছিল ।প্রস্তাবটা খারাপ নয় ।কয়েক লাখ টাকা দেবে ওরা ।কটা মাসের শুধু ব্যাপার ।ওসব নাকি আইনে আছে ।খারাপ কাজ নয় ।ক দশ কয় এক লাখ হয় বাসন্তী ভেবেই মরে ।সুনীল কে বলবে কখন ।বেহুঁশ ।যারা এই প্রস্তাব দিয়েছে তাদের অনেক টাকা ।চাইলে আরো দেবে ।শুধু রাজি হবার অপেক্ষা ।হৃষ্ট পুষ্ট মহিলা চাই ।ও নাকি সারোগেট মাদার হবে ।জীবনে এসব শোনেই নি ।শাকপাতা খেয়ে দিব্যি দুটো ছেলেমেয়ে ।বড়ো নোকরা বেশি খায় ।তাই এত রোগ ।বাসন্তী সাতপাঁচ ভাবে ।টাকাটা পেলে ঘর টা সারিয়ে নেবে ।টেঁপিটা বড় হচ্ছে ।বিয়ের হার ,দুল আর আংটি করবে ।ছেলেটাকে দুধ ভাত দেবে ।দুধ খেলে হাবুলের শরীলে বাঘের বল হবে ।এই সূবর্ণসুযোগ ।হাতছাড়া করা ঠিক হবে না ।মালতী বলেছে ।টাকা দেওয়া নেওয়া গোপনে হবে ।
মালতী বিধবা ।কোলকেত্তার কোন এক ইস্কুলের পিওন ।প্রস্তাবটা তার নেবার উপায় নেই ।লোকলজ্জার সীমা থাকবে না ।বাসন্তী কে কেউ সন্দেহ করবে না ।সংসারের হাল যা ।সুনীল তো কোনো দায়িত্ব পালন ই করে না ।
বাসন্তীকে বোঝায় মালতী ।ভালো করে ভেবে দেখ ।কোনো অভাব থাকবে না ।দিনরাত নেই নেই করতে হবে না ।শুধু তোর গব্বোটা ভাড়া দিবি ।বাচ্ছা ওদের ।সন্তানের ওপর কোনো অধিকার থাকবে না ।কান খুলে শুনে নে ।বাসন্তী হাঁ করা দন্ত স হয়ে শোনে ।মালতীকে শুধোয় “হ্যাঁ গা মালতী!কোনো ফ্যাসাদ হবে না তো ।মালতী বলে “দূর!দূর!।বায়োলজিক্যাল বাবা মা তো ওরা “।তুই তো শুধু প্যাটটা ভাড়া দিবি আর টাকাটা বুঝে নিবি ।
বাসন্তী জিজ্ঞেস করে ওরা সত্যিকারের সোয়ামি ইস্ত্রি তো ।ঠিক করে জানবি ।আমি মুখ্যু সুখ্যু মানুষ ।তোর উপরে বিশ্বাস ।
মালতীর কথায় রাজী হয়েছে বাসন্তী ।কলকাতায় গিয়ে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করে এসেছে ।সুনীল সাথে ছিল ।ভালো করে বুঝিয়ে নিয়ে গেছে ।বলেছে অনেকেই এ কাজ করে ।স্বাচ্ছন্দ্য আসবে জীবনে ।কুড়ি লাখ টাকা দেবে ।ডাক্তার বাবু জিজ্ঞাসা করে নিয়েছে সব ।তার পর দিন ক্ষণ ঠিক করে এখন বাসন্তী গর্ভধারণ করেছে ।
বাসন্তীর গর্ভে একটু একটু করে বেড়ে উঠছে একটা সোনার চাঁদ ।বাসন্তী ভাবে সে যশোদা মা ।কেষ্ট ঠাকুরের মা ।আবার চকিতে বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে ।এই সন্তান ওর নয় ।তবে কী মা মানেই গর্ভধারিণী নয় ।ভূমিষ্ট হবার পর এ ওর ছেলে নয় ।টাকায় সব হয় ।
টেঁপি আর হাবুল যখন পেটে ছিল তখন সুনীলের উচ্ছ্বাস ছিল ।কত আনন্দ ছিল ।আর এখন ।বেশ ছিল না খেতে পাওয়া দিন গুলো ।পরিবারের সবাই কত সুখী আজ ।পাকা বাড়ি ।চাপা কল ।টিভি ।নিত্যিদিন মাছ ,মাংস ।সবাই সব পেয়ে গেছে ।সুনীল এখন চোলাই খায় না ।বিদেশী খায় ।
মালতীর সাথে গর্ভস্থ শিশুর পিতা মাতা আসে ।খবর নেয় সব ঠিক আছে কিনা ।তারপর একদিন শিশুর জন্ম হয় ।শিশু জন্মের জন্য কত টাকা তারা খরচ করেছে ।
বাসন্তী আর হাসে না আগের মতো ।শুধু শুনতে পায় একটা শিশু যার স্পন্দন কিছুদিন আগেও সে শরীরে অনুভব করতো সে মাআআ মাআআআ করে ডাকছে ।ঘর থেকে ছুট্টে বেরিয়ে আসে ।মনে পড়ে যায় মালতীর কথা ।ওরা তো বায়োলজিক্যাল বাবা মা ।চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়ে ।আকাশের শূণ্য বুকে শুধুই হাহাকার ।ওরা তো পেটটাকে ভাড়া নিয়েছিল
–~০০০XX০০০~–