“আলোয় ফেরা”
☆★☆★☆★☆★☆
–:: মঞ্জুলিকা রায় ::–
ভোরের দিকে কারেন্ট অফ হয়ে যাওয়ায় পবিত্রবাবুর ঘুম ভেঙে গেলো । রাতে আজকাল তার ভালো ঘুম হয় না , এই ঘরটা উত্তর মুখো , আগে ঘরের সাথে ছোট একটা রোয়াক মতো ছিলো কিন্ত মাকে এই ঘরে শিফট করার সময় রোয়াকটাকে ঘিরে বাথরুম বানানোয় ঘরটা অসম্ভব চাপা হয়ে গিয়েছে । মা চলে যাবার পরে তিনিই এই ঘরটা ব্যবহার করছেন তাও বোধহয় বছর দশেক হতে চললো । ঘরেই একটা টেবিলের উপর স্টোভ আর চা বানানোর সরঞ্জাম রাখা থাকে । নিজেই বানিয়ে খান , অফিসের ক্যান্টিনে দুপুরের ভাত খান , রাতে অফিস থেকে ফেরার সময় তিনটে রুটি, তড়কা বা ডিমের ডালনা কিনে আনেন ভাঁড়ে করে , তাই খেয়ে শুয়ে পড়েন ।
অবশ্য সপ্তাহে তিনদিন তিনি বাড়ির জন্য বাজার করে দেন , নিজের জন্য সামান্য রেখে মাইনের প্রায় পুরোটাই সবিতাকে দিয়ে দেন । বাড়ির কোনো ব্যাপারে তার মতামত কেউ চায় না , তিনিও আগ বাড়িয়ে কিছু বলেন না । খাতায় কলমে তিনি বাড়ির কর্তা হলেও , বাড়িতে তিনি ব্রাত্য । তেইশ বছর হতে চললো তার নিজগৃহে পরবাস চলছে অথচ তার আগে তিনিই ছিলেন বাড়ির রাজা । তার বিধবা মায়ের একমাত্র অবলম্বন , মায়ের আঁধার ঘরের মানিক । বাবাকে তো তার মনেই পড়ে না , সেই কোন অবোধ বেলায় তাদের ছেড়ে চলে গেছেন ।
তারপর যা হয় , মায়ের জায়গা হলো না শ্বশুরবাড়িতে । বাপের বাড়িও বেড়াল পার করে দেওয়া মেয়েকে ঘরে নিতে নারাজ তবু প্রথমে মা সেখানেই মাথা গুঁজেছিলেন ।
শেষে মিউনিসিপালিটির চেয়ারম্যানকে ধরে মিউনিসিপালিটির ফ্রি প্রাইমারী স্কুলে চাকরিটা পান । তারপর ঘর ভাড়া করে মায়েপোয়ের সংসার । এতো সামান্য মাইনে যে তা দিয়ে মা ছেলের পেট চালানোই মুস্কিল , মা সন্ধ্যেবেলা দুচারটে টিউশনি পর্যন্ত করতেন । পড়াশোনায় অবশ্য তিনি বরাবরই ভালো ছিলেন , স্কুলে ফার্স্ট সেকেন্ড হওয়ায় ফুল ফ্রি ছিলেন তারপর টুয়েলভে ন্যাশনাল স্কলারশিপ পান । জয়েন্টে যাদবপুরে কেমিক্যাল পেলেন , তখন থেকে স্বপ্ন দেখার শুরু । চাকরি পেলেন অল ইন্ডিয়া বেসিসে এক্সাম দিয়ে একটা পাবলিক সেকটরের আর এন ডি ( রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট ) বিভাগে । তিনি আর তার মা দুজনেই হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন , ভেবেছিলেন দুঃখের সাগর পার করে ফেলেছেন । কিন্তু তখন কে জানতো যে তার ভাগ্যদেবতা অলক্ষ্যে মুচকি হাসি হাসছেন !
চাকরির দ্বিতীয় বছর থেকেই মা তার বিয়ে দেবার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন । কাজের লোক তেমন পাওয়া যায় না , ছেলে হাত পুড়িয়ে খাচ্ছে সেটা মাকে কষ্ট দিচ্ছিল । মায়ের চাকরির তখনও বেশ কিছু বছর ছিলো , তাকে পড়াতে গিয়ে সামান্য পুঁজি টুকুও গেছে তাই মা তার চাকরি ছাড়তে পারছিলেন না । ছেলের চাকরি স্থল আবার বিহারে ,অতএব বিবাহ ছাড়া গতি নেই । মেজ মামা সম্বন্ধটা এনেছিলেন , ছেলের চাকরি ছাড়া কিছুই নেই তাই খুব ভালো পাত্রী জুটলো না । তিন মেয়ের ছোট , মোটামুটি দেখতে শুনতে সবিতার সাথে বিয়ে হয়ে গেলো । মা এবং তিনি পণপ্রথাকে ঘেন্না করেন তাই তারা কিছু চান নি , ওরাও কিছুই দেয় নি ।
বউভাতের দিন প্রথম যখন দুজনে একাকী হলেন তখন সবিতা প্রথম কথাই বললো ‘ বাসরে ওই ফর্সা মুটকিটার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকাচ্ছিলে কেন ?” পবিত্রবাবুর কিছু মনেই ছিলো না তাই খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন ” কোন মুটকি ? ” মুখের কেমন একটা ভঙ্গি করে সবিতা উত্তর দিল ” ন্যাকা ! হাঁ করে তো গিলছিলে সবুজ কাঞ্জিভরমকে ।” তখন মনে পড়লো বছর চল্লিশের এক মহিলা স্ত্রী আচারের সময় কিছু মজার কথা বলছিলেন আর তিনি তাতে হেসেছিলেন। তখন কিন্তু খারাপ লাগে নি, তাকে নিয়ে নতুন বউয়ের ঈর্ষা জন্মেছে সেটি তাকে একটু হলেও আনন্দ দিয়েছিল। কিছুদিনের মধ্যেই ভুল ভাঙলো , বাড়ির কাজের বউ প্রতিবেশিনী মায় আত্মীয়াদের নিয়েও সবিতার লাগামহীন বাড়াবাড়িতে তিনি অস্থির হয়ে উঠলেন। এরমধ্যে আবার বিয়ের দ্বিতীয় বছরে বাবাই জন্মালো।
ছেলে হবার পর তিনি ভেবেছিলেন সবিতা ছেলে সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকবে, তার উপর নজরদারিটা একটু হলেও কমবে কিন্তু তার বদলে আরও বেড়ে গেলো। তিনি তিতিবিরক্ত হয়ে সবিতার থেকে দূরে দূরে থাকতে লাগলেন কিন্তু তাতে সবিতার ধারণা হলো তিনি বাইরে থেকে তার চাহিদা মিটিয়ে আসছেন । আশেপাশের কোয়ার্টারের মহিলারা তাদের বাড়িকে এড়িয়ে চলেন, কেউ সবিতার মুখের ভয়ে আবার কেউবা ভাবে যা রটে তার খানিকটা সত্যি হবে নিশ্চয়ই। এক রবিবার সকালে তিনি বিছানায় বসে কাগজ পড়ছিলেন, ঝি ঘর মুছছিল, সবিতা এসে যা নয় তাই বলতে শুরু করলো ” ঝুঁকে ঝুঁকে ব্যাটাছেলেকে গতর দেখাচ্ছো, ভাবছো এইভাবে পয়সা কামাবে, এর চেয়ে লাইনে গিয়েই দাঁড়াও না। ” ঝিও ছেড়ে দেবার পাত্রী নয়, সেও দশ কথা শুনিয়ে কাজ ছেড়ে চলে গেলো। তার জের পড়লো পবিত্রবাবুর উপরেই, মেয়েমানুষের বুক দেখার অপরাধে তাকেই ঝিএর কাজ সারতে হলো। এরপর থেকে যেই নতুন ঝি কাজে আসতো তিনি রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন।
গোঁদের উপর বিষফোঁড়ার মতো লাগলো যখন
বাবাই এর এক বছর হবার আগেই তিনি জানতে পারলেন সবিতা আবার মা হতে চলেছে এবং চার মাসের গর্ভবতী। বাবাই হবার সময়েই কপার টি লাগিয়ে সম্ভাবনা রুদ্ধ করা হয়েছিল, সবিতা যে একা কোম্পানির হাসপাতালে গিয়ে খুলে এসেছে এবং তা তাকে বলে নি সেটি তিনি কল্পনাও করতে পারেন নি , এমনকি চার মাস পর্যন্ত সেটা লুকিয়ে রেখেছে। আল্ট্রাসাউন্ড এ দেখা গেলো এবার যমজ সন্তান, কাজের লোক নেই, সবিতা ভীষণ অসুস্থ, কে রান্না করে, কে বাচ্চা দেখে, কে রোগীর সেবা করে, তিনি রাতে ঘুমাতে পারছেন না, রান্না করতে গিয়ে হাত পুড়েছে, পুরোপুরি নাজেহাল অবস্থা, তখন সবিতার কথায় মার কাছে গেলেন, ছেলের অবস্থা দেখে মা এক কথায় চাকরি ছেড়ে এই বাড়ি সামলাতে এলেন।
বাবাই এর জন্মের দেড় বছরের মধ্যে যমজ ছেলে তাতাই পাপাই জন্মালো, তিনটে খুদের দেখাশোনা করা , ঘরের প্রায় সব কাজ একার হাতে মা-ই সামলাতেন, বয়েস আর সারাজীবন ধরে সংগ্রাম মাকে অনেক কমজোর করে দিয়েছিল তবু দশভুজা হয়ে সামলেছিলেন সাত আট বছর। মা শিক্ষিতা মহিলা, তিনি বারেবারে বলতেন সবিতাকে সাইক্রিয়াটিস্ট দেখাতে কারণ সন্দেহবাতিক হলো মনের অসুখ যা আসে ইনসিকিউরিটি থেকে। দুচার বার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার পর সবিতার ধারণা হলো তাকে পাগল প্রতিপন্ন করে ডিভোর্স দেবার মতলব করেছে মা আর ছেলে , ফলে আর তাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হলো না । সবিতার প্রধান দোষ সে পাড়ার প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে বাড়ির কেচ্ছা শোনায়, সে নাম কা ওয়াস্তে শিক্ষিতা হলেও পরিশীলিতা নয়। তার সাথে বেশিক্ষণ আলাপচারিতা করা যায় না।
পবিত্র বাবু এবং তার মা আবার বাইরের লোকের কাছে ঘরের ব্যাপারে কথা বলা ভাবতেই পারেন না, তাদের রুচিতে বাধে। লজ্জায় পবিত্র বাবু কারুর সাথে কথাই বলতেন না। ধীরেধীরে মা অশক্ত হয়ে পড়লেন তখন সবিতা তার অন্য রূপ দেখালো, মাকে স্টোর রুমে নির্বাসনে পাঠালো, এক ঘরে যমজ ছেলেদের নিয়ে সবিতা অন্য ঘরে বড় ছেলের সাথে তিনি। সেই ঘরটি অবশ্য তার নয় বড়ছেলের স্টাডিরুম , পড়াবেন বলে এক কোণায় তার ঠাঁই হয়েছিল । মার ঘরে তিন নাতির কেউ যায় না, তিনি এলেও বাইরে থেকে সবিতার অম্লমধুর বাক্যবাণে মা অস্থির হয়ে তাকে আসতে নিষেধ করতেন। মা বড় দুঃখ নিয়ে মারা গেছেন, বিয়েটা যে তিনিই দিয়েছেন সেই অপরাধ বোধ তাকে কুরে কুরে খেতো।
এরপর তার জীবনে যা ঘটেছিল তার ফলে পরিবারের সাথে যেটুকু যোগাযোগ ছিলো সেটিও ছিন্ন হয়ে যায়। তারই ডিপার্টমেন্টের কেমিস্ট মিস্টার চ্যাটার্জি ক্যানসারে মারা গেলে মিসেস চ্যাটার্জি কমপ্যাশনেট গ্রাউন্ডে ডিপার্টমেন্টে রেকর্ড ক্লার্কের চাকরি পান। মিসেস চ্যাটার্জি কলকাতার মেয়ে, বেশ সুশ্রী, চোখে পড়ার মতো, তাকে নিয়ে সবিতার সন্দেহ শুরু হলো। সারা ক্যাম্পাসে ঘুরে ঘুরে মিসেস চ্যাটার্জি আর তার অ্যাফেয়ারের কথা প্রচার করতে লাগলো। এমনকি তিনটে খুদে বাচ্চা নিয়ে ডিরেক্টরের বাংলোয় গিয়ে কান্নাকাটি করে এলো। মিসেস চ্যাটার্জি জানতে পেরে তার কাছে কেঁদে ফেললেন, ওনার বড় হয়ে ওঠা দুটো বাচ্চার কতটা অসম্মান, অপমান হবে সেটাই বারেবারে বলেছিলেন। ডিরেক্টর সাহেব মিসেস চ্যাটার্জিকে অন্য ডিপার্টমেন্টে ট্রান্সফার করে দিলেন। এই নিয়ে পুরো ক্যাম্পাসে তার প্রচন্ড সম্মানহানি হলো, কেউ কেউ তাকে পাক্কা চরিত্রহীন আবার কেউ তাকে মেনিমুখো পুরুষ ভাবতে লাগলো যে বদমাশ বউকে শাসন করতে জানে না।
ছেলেদের সবিতা শাসন করতে দেয় নি ছোটবেলা থেকেই, পড়াশোনা না করায় যদি বকাবকি করতেন তাহলে অমনি এসে সবিতা মাঝখানে দাঁড়াতো, ছোঁ মেরে ছেলে উঠিয়ে নিয়ে যেত। নানাভাবে বাধা দিতো, মায়ের প্রশ্রয়ে ছেলেরাও তাকে অগ্রাহ্য করতে শিখলো, বড়টা যদিওবা কিছু পড়াশোনা শিখেছে কিন্তু ছোট দুটো টুয়েলভ পাশ করেই ক্ষান্তি দিয়েছে, তারা নাকি অ্যাক্টিং, ফিল্ম এডিটিং শিখবে। বুঝলেন সন্তান বৃদ্ধি করাটা আসলে সবিতার দলেভারী হওয়ার চাল ছিলো । ছেলেদের পকেটে মানি আর খাওয়াদাওয়াতে সবিতা সংসার খরচের টাকার প্রায় সবটাই উড়িয়ে দিতে লাগলো । নিজের পোশাকপরিচ্ছদের দিকে সে তাকায়ও না , তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে সে একজন ইঞ্জিনিয়ারের স্ত্রী। আসলে লোককে বোঝাতে চাইতো যে সে একজন অবহেলিত, নিগৃহীতা স্ত্রী । তিনটে ছেলেই অতিরিক্ত আদর পেয়ে পেয়ে ঘরে বসে কুলাঙ্গার তৈরি হয়েছে।
এইভাবে জীবনের তেইশ বছর কেটে গেছে তখন একটা ঘটনা ঘটলো। পার্সোনালের অমিত দত্ত বাঙালি, তাকে অফিসে এসে ধরলো , ওর মেয়ে রিয়া এইবার আই সি এস সি ফাইনাল দেবে। দুমাস আগে রিয়ার অঙ্কের টিউটর চাকরি পেয়ে অন্য জায়গায় চলে গেছে। ছোট জায়গায় ঠিকঠাক টিউটর পাচ্ছে না তাই তাকে এসে ধরলো মেয়েকে দেখিয়ে দেবার জন্য। তিনি অনেক বাহানা দিয়ে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু দত্ত নাছোরবান্দা, তখন বললেন ” জানো তো সবই, কোনো ঝামেলায় শেষে তোমরাই পড়বে! “। দত্ত বললো ” রিয়া তো আপনার ছেলেদের থেকেও অনেক ছোট, তাছাড়া পড়াবার সময় আমিও থাকবো। কোনো ঝামেলা হবে না আশা করি। “
সেই মতো তিনি সপ্তাহে চারদিন অফিস ছুটির পর দত্তের সাথে ওর কোয়ার্টারে যাচ্ছিলেন। কয়েকদিন কিছুই হয় নি, তিনি ভেবেছিলেন সবিতার কানে খবরটা যায় নি। সেদিন পড়ানোর সময় মিসেস দত্ত অমিতকে বলেছিলেন চা পাতা ফুরিয়েছে, অমিত বললো ” স্কুটারে যাব আর আসবো, পাঁচ মিনিটে আসছি। ” অমিত বেরতেই দরজায় বেল, সবিতা ঘরে ঢুকে যাচ্ছেতাই ভাষায় রিয়াকে আর তাকে জড়িয়ে আকথা কুকথা বলতে লাগলো, রিয়ার মা বাধা দিতে এলে তাকেও ছাড়লো না । চেঁচামেচি শুনে লোকজন জড়ো হয়েছিলো মজা দেখতে। রিয়া ভয় পেয়ে কাঁদতে শুরু করেছিল আর তার মনে হচ্ছিল ‘ ধরণী দ্বিধা হও। ‘
এই প্রথম তিনি নিজের সংযম হারালেন, অন্ধ রাগে সবিতাকে এক থাপ্পড় কষিয়ে দিয়েছিলেন, তারপর ঘর ছেড়ে বাইরে বেড়িয়ে যান। উদ্দেশ্যহীন ভাবে দুই তিন ঘন্টা ঘুরে বেড়িয়ে বাড়ি ফিরতেই তার তিন ছেলে তার উপর চড়াও হয়। তিনজনের ঘুঁষি কিল চড় লাথি খেতে খেতে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিলেন। তার সন্তানরা মানুষ হয় নি তিনি জানেন তাই বলে বাপকে লাথিও মারতে পারে সেটা তিনি এতোদিন বোঝেন নি। ছেলেদের হাতে মার খেয়ে তার দুঃখের চেয়ে বেশি ঘেন্না হয়েছিল, ভাবছিলেন কার জন্য, কিসের জন্য বাঁচবেন ! যে কথাটা তিনি বহুদিন, বহুভাবে ভেবে এসেছেন কিন্তু কার্যকর করতে দ্বিধা দেখিয়েছেন আজ সেই চিন্তাই তার মাথায় চড়ে বসলো ! না , আর নয়, আর এই অসম্মানের, ভালোবাসাহীন জীবন তিনি রাখবেন না। আর লোকের কৌতুকের খোরাক তিনি কিছুতেই হবেন না।
তার বিছানার তলায় একটা সুটকেসে জামাকাপড়ের নীচে মায়ের ঘরে পরার একটা শাড়ি আছে। মাঝেমধ্যে যখন সহনাতীত যন্ত্রণা হয় তখন সেই শাড়িটায় মুখ গুঁজে তিনি সব ক্ষোভ প্রশমিত করেন। মায়ের গায়ের গন্ধ আর নেই বরং একটা ভ্যাপসা গন্ধ বের হয় কিন্তু তার মনে হয় যে শাড়িতে মায়ের পরশ লেগে আছে । আজ সেই শাড়িটিকেই তিনি উদ্ধারের পন্থা বলে বেছে নেন, একবার সিলিং ফ্যান আর একবার শাড়ির দিকে তাকান। তারপরে শাড়িতে মুখ গোঁজেন, মার খেয়ে শিশু যেমন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে মার কাছে নালিশ জানায় তেমনি তিনিও কাঁদছিলেন। সারাদিনের পরিশ্রম, ক্ষুধায়, অপমানে ক্লিষ্ট শরীরে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তা তিনি নিজেই বোঝেন নি। ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখেন মা এসে দাঁড়িয়েছেন তার শিয়রে, তিনি কেঁদে কেঁদে নালিশ জানাচ্ছেন ” মাগো বড় কষ্ট হচ্ছে মা! “। বুড়ো বয়েসের অসহায় আর রুগ্ন মা নন, তরুণী বয়েসের মা যেন তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন ” যা, একটু বাইরে ঘুরে আয়। দেখবি কতো ভালো লাগছে। “
জয়েন্ট আর হায়ার সেকেন্ডারি সময় তিনি পরীক্ষাকে জীবন-মরণ সংগ্রাম ভেবে রাতদিন এক করে পরিশ্রম করতেন। বিনা টিউটরে সফল হবার জন্য তাকে দ্বিগুণ পরিশ্রম করতে হতো, পড়তে পড়তে তার মাথা ঝিমঝিম করতো তবু তিনি বই ছেড়ে উঠতেন না তখন কিভাবে যেন মা বুঝতে পারতেন, তার হাত থেকে বই কেড়ে নিয়ে বলতেন ” যা বাইরে থেকে ঘুরে আয়। ” এক ঘন্টা ঘুরে আসার পর তার মনে হতো তার এনার্জি যেন দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আজ প্রৌঢ় বয়েসে এই স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে উঠে ঝিম মেরে বসে রইলেন। মা কি সত্যিই এসেছিলেন ! কিছু কি বোঝাতে চাইছিলেন !
তার বয়েস এখন একান্ন বছর, আরও হয়তো কুড়ি বছর তিনি পরিশ্রম করার মতো অবস্থায় থাকবেন ! এই পৃথিবীতে সবিতা আর ওর তিন ছেলে ছাড়াও অসংখ্য মানুষ আছে, ওরা তাকে অপমান অসম্মান করেছে বলেই সারা পৃথিবীও তাই করবে তা তো নয় ! তিনি যখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছিলেন তার মা সেই চার বছর বাজার করেন নি, চার বছর দুবেলা আলু সেদ্ধ ফ্যানা ভাত খেয়ে পাইপয়সাও ছেলেকে পাঠাতেন, পাশ করার পরে মামার মুখে মায়ের কৃচ্ছসাধনের গল্প শুনে তিনি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন, কতটা মনের জোর থাকলে মানুষ এই কষ্ট ওঠাতে পারে ! আজ যদি হেরে গিয়ে, লজ্জিত অপমানিত হয়ে তিনি পৃথিবী ত্যাগ করেন তাহলে তা শুধু তার নিজের নয়, মায়েরও পরাজয় হবে ! তিনি বাঁচবেন, দুনিয়ায় কতো মানুষের কতো কষ্ট, কতো অসহায়তা আছে তিনি যদি তাদের এতোটুকু উপকারে আসতে পারেন তবেই তার মায়ের কৃচ্ছসাধন সফল হবে।
জানলা দিয়ে বাইরে তাকান, শীতের ঘন কুয়াশার চাদর চুঁইয়ে মরা জ্যোৎস্নার আলোয় অপার্থিব লাগছে চারপাশ , কালো কালো ডালপালায় মুখ ঢাকা আধখানা চাঁদ দেখা যাচ্ছে আকাশে , কোনো রাতজাগা পাখির ডানার ঝটপটানি শোনা যাচ্ছে, দূরে কোনো প্রতিবেশীর বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনতে পান । চটপট নিজের সামান্য কিছু জিনিস গুছিয়ে নেন। তিনি ততোটা ঈশ্বর বিশ্বাসী নন, কাজেই সাধুসন্ন্যাসী হওয়া তার পোষাবে না কিন্তু মানুষের সেবাব্রতে তো হাত লাগতেই পারেন । বুঝতে পারছিলেন মায়ের নির্দেশ, তার যা কিছু স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি আছে তার সবটা এরাই ভোগ করুক, তিনি রেজিগনেশন দিলে পেনসন পাবে সবিতা। যা আছে ওদের চলে যাবে একরকম, তাছাড়া ছেলেরা সবাই বড় হয়ে গেছে । পিছনের বাগানের দিকের গেট খুলে বাইরে পা বাড়ান, ভোরের ঠান্ডা বাতাসে তার শরীর জুড়িয়ে যায়, ধীরেধীরে সব ক্ষোভ প্রশমিত হতে থাকে। বহুদিন পরে কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া কয়েদীদের মতো চারপাশের জগতকে অন্য পৃথিবীর অংশ বলে মনে হয়। তেইশ বছর পরে খুশির জোয়ার আসে মনে তা যেন ঢেউ হয়ে তাকে ভাসিয়ে নিতে চাইছে । বুঝতে পারছিলেন কেউ যদি সত্যিই মুক্তি চায় তাকে আটকে রাখার ক্ষমতা কারোর নেই। তিনিও বাঁচবেন, মানুষের মতো সুখে দুখে, আনন্দ বেদনায়, প্রেমে অপ্রেমে বেঁচে থাকবেন, মাটির কাছাকাছি থাকা মানুষদের মধ্যে। রাত শেষ হয়ে নতুন প্রভাতের ইশারায় তার মন আর চারিদিকের বাতাবরণ উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে। সুটকেস হাতে নিয়ে তিনি দ্রুত স্টেশনের রাস্তা ধরেন।