অলস উত্তরসূরি
নবু
এই গল্পটা এক অলস মানুষকে নিয়ে—তবে সে এমন অলস, যে বিছানায় গড়িয়ে গড়িয়েই সাহিত্য করে! যাঁরা ভাবেন, সকাল সকাল বাজার করা, অফিসের ট্রেন ধরা, রাত করে ফেরা—এসব করলে নাকি অলস হওয়া যায় না, তাঁদের জন্যই এই কাহিনি।
আর যারা ভাবেন, অলস লোকেরা কিছুই পারে না—তাদের জন্য এই গল্প প্রমাণস্বরূপ উপস্থাপন করা হল।
এখানে আছে এক ভদ্রলোক, যার বউ বলেন “কুঁড়ে”, মা বলেন “কামচোর”, আর পাড়ার লোক বলেন, “ওই যে, বিছানায় চায়ের কাপ হাতে যে পড়ে থাকে!”
কিন্তু ঠিক সেই ভদ্রলোক, একদিন হয়ে ওঠেন সাহিত্যসভায় আলোচিত, পত্রিকায় প্রথম পাতায় ছাপা নাম—আর তখনই বউ-শাশুড়ি বলেন, “এ তো আমাদের গর্ব!”
তবে সাবধান—গল্পে আছে এক ‘একান্ত গোপন কথা’
যা জানলে আপনি হেসে উঠবেন, ভাববেন, আবার চুপ করে যাবেন।
এই গল্প কেবল ‘অলস’ হয়ে সফল হওয়ার নয়—এটা এক ছায়ার মানুষের কথা, যে তার বাবার স্বপ্নকে নিজের ঘামে ভিজিয়ে সত্যি করে তোলে।
তাই গল্প পড়ার আগে বিছানায় হেলান দিন, চায়ের কাপ পাশে রাখুন—
কারণ একবার পড়তে শুরু করলে, আপনি হয়তো বলবেন—
“এই অলস লোকটা তো ঠিক আমার মতোই… কিংবা আমার বাবার মতো?”
“আলস্য বাবু ও গোপন খাতা”!
বাড়িতে বউ আর মা—দুজনেই রায় দিয়েছে, আমি নাকি কুঁড়ে, কামচোর, অকর্মণ্য জাতের। যেন এই সংসারে আমি কেবল বাতাস খাই আর ঘুমোই। আমার বাবা গত হয়েছেন বহু আগেই—তাঁর দেখানো পথেই এখন সংসারের হাল ধরেছি আমি। কিন্তু কে বুঝবে!
প্রতিদিন সকালে, ঘুম থেকে উঠে বাজার—মানে যুদ্ধক্ষেত্র। মাছওয়ালার সঙ্গে দরদাম, সবজিওয়ালার সঙ্গে গলা-চড়ান চিৎকার, শেষে ঠাস করে ব্যাগ ফেলে রান্নাঘরে ঢুকিয়ে দিই। তখনই ঘড়ি বলে, “হ্যাঁ ভাই, দেরি হয়ে গেল”—আর আমায় ছুটতে হয় ট্রেন ধরতে।
ট্রেনে গাদাগাদি করে শিয়ালদা, সেখান থেকে আবার ঠাসবুনটে বাস। অফিসে গিয়ে চেয়ারটা যখন ছুঁই, তখন মনে হয়—এই বুঝি স্বর্গে এলাম!
ফেরার পথে আবার সেই ঠেলাঠেলি রথযাত্রা। রাত করে বাড়ি ফিরি। তখন শরীর বলে—“আর পারি না”, মন বলে—“চা খা”, আর আমি নিজে বিছানায় গড়িয়ে পড়ি।
এটুকুই আমার “অপরাধ”। অথচ বাড়ির আদালতে আমাকে দোষী সাব্যস্ত করে ফেলা হয়েছে। অভিযোগ: “ঘরে বসে অলসতা করা”, “চলাফেরায় অনীহা”, “চোখে চিরকালের ঝিমুনি”—ইত্যাদি ইত্যাদি।
একবার সাহস করে মাকে বলেছিলাম, “মা, তুমি না বলেছিলে, পুরুষ মানুষ ঘর সামলাক, তাই তো করছি?”
মা তখন এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “হ্যাঁ বাবা, ঘর সামলাস ঠিকই, কিন্তু একটু মানুষ হ। কাঁধে সংসার মানে গাধার মতো বোঝা টানা নয়, একটু বুদ্ধিও তো লাগায়া করিস!”
বউকে আর বলাই বাহুল্য—তিনি তো অলসতা গবেষণায় পিএইচডি করেছেন। আমার নাম শুনলেই চোখ গোল—“তোমার মত লোক ঘরে থাকলে, ঘর অচল হয় ভাই!”
ভাবি, আমি না থাকলে কার ঘাড়ে পড়ত এই বাজার, এই রেল যাত্রা, এই অফিসের প্যাঁচাল?
কিন্তু না, আমি অলস। কারণ আমি সন্ধ্যেবেলা ‘বসে থাকি’। হ্যাঁ, দাঁড়িয়ে থাকি না, ছুটে বেড়াই না, হাঁপাই না—তাই আমি অলস।
এই পৃথিবীতে সক্রিয়তা মানে নাকি হাঁ করে দৌড়ানো। ভাবনা চিন্তার দাম নাই। পা না চললে মানুষ না। ঘাম না ঝরলে কাজ না। কাঁধে সংসার থাকলেও মুখে একটু আরাম বেরোলেই ‘কামচোর’ উপাধি।
তবে হ্যাঁ, ভেবে দেখলাম, অলস হওয়ারও একটা আলাদা গরিমা আছে। কেউ যখন বলে “তুমি কুঁড়ে”, আমি মনে মনে ভাবি—”হুঁ, বুদ্ধিজীবীরা প্রায় এমনই হয়!”
“অলস থেকে অলৌকিক
সে ছিল এক বিশেষ দিন—যেদিন বউ সকালবেলায় আমায় দেখে বলেছিল,
“এই যে, আবার বিছানায় পড়ে আছো! কখনো যদি কিছু করে দেখাও—পৃথিবী থেমে যাবে!”
আমি মনে মনে বললাম, “ঠিক আছে, পৃথিবী তো নয়, অন্তত হরিদেবপুর থামিয়ে দেখাবো!” সেই শুরু। আসলে লেখালেখি আমি বহুদিন করতাম। অফিসে বসে, ফাঁকে ফাঁকে… মাঝে মাঝে বসের চোখ এড়িয়ে পকেট নোটবুকে দু’লাইন লিখতাম। কি লিখতাম কে জানে, কিন্তু সেই লেখাই একদিন এক অনলাইন পত্রিকায় পাঠিয়ে দিলাম—আলস্য নিয়ে একটা রম্যরচনা।
শিরোনাম ছিল: “অলসের আত্মজীবনী – এক চায়ের কাপ ও বিছানার মাঝে”।
দু’দিন পরে দেখি—ভাইরাল! ফেসবুকে, ইনস্টাতে, এমনকি মেসেজে আত্মীয়রা ফরওয়ার্ড করে বলছে—“পড়েছিস? যেন তোর কথাই লিখেছে!”
আমি তখন বুক ফুলিয়ে বললাম, “না গো, এ আমার কথাই… কারণ এ আমিই লিখেছি!”
তারপর থেকে আমি হয়ে উঠলাম এক কথিত “আধুনিক লেখক ত্রৈলোক্যনাথ”—যদিও পাড়ার অনুপমদা বলেন, “ত্রৈলোক্যনাথ লেখকের নাম মুখে আনিস না, একটুও মিল নাই!”
আমি হেসে বলি, “ত্রৈলোক্যনাথ স্যার এখন যদি বেঁচে থাকতেন, উনিও এখন সবার মত ব্লগ লিখতেন!”
পত্রিকায় সাক্ষাৎকার, ইউটিউবে আড্ডা, আর সর্বশেষ একদিন টেলিভিশনে লাইভ টক শো! সঞ্চালিকা বলেছেন,
“আপনি তো আলস্যকে একধরনের আর্ট বানিয়ে ফেলেছেন!”
আমি বললাম, “আলস্য নয় ম্যাডাম, এটা সাশ্রয়ী পরিশ্রম!”
সেদিন রাতে বাড়ি ফিরতেই বউ চুপচাপ আমার ব্যাগটা নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল।
মা এসে বললেন, “আজ একটু বস, এক কাপ দুধ এনে দিই।”
আমি তাকিয়ে বললাম, “মা, আজ অমাবস্যা তায় মেঘলা আকাশ, তার পরেও কি চাঁদ উঠেছে?”
মা হেসে বললেন, “তুই এখন আমাদের গর্ব… আগে ভাবতাম কি করে চলবি, এখন ভাবি—কত দূর যাবি!”
বউ আস্তে করে পাশে এসে বলল,
“আগে ভাবতাম ঘরটা আমিই চালাই… এখন বুঝি, তুমি না থাকলে এই ঘর, এই গল্প—কিছুই হত না।”
আমি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে বললাম,
“দেখো তো, এককালে যেটা অলসতা ছিল, আজ সেটাই পরিচয় হয়ে গেল… এ জীবন চা-বিছানার মাঝখানে কত দূর গড়ালো, কে বলবে?”
লেখালেখি দিয়ে নাম কামানোর পরেও আমার রুটিনে খুব একটা বদল হয়নি। সকালবেলার বাজার এখনো আমি করি, ট্রেনও ধরি—শুধু রিকগনিশনটা বদলে গেছে। আগের কুঁড়ে আমি, এখন ট্রেনের যাত্রীরা বলে ‘সাহিত্যিক বাবু’, বলে তারা আমাকে বসার জন্য যায়গা ছেড়ে দেয়।
তবে এত খ্যাতির মাঝেও একটা জিনিস চেপে গেছি—একান্ত গোপন কথা। আসুন কানে কানে বলি-
সেই রম্য রচনা গুলো আদতে… আমার লেখা নয়। অন্তত একদম নিজের বলা যাবে না। রক্তের সম্পর্ক থাকলেও সত্যি বলছি একটাও আমার মস্তিষ্ক থেকে উত্পন্ন হয়নি।
আমার কাছে একটা পুরনো খাতা আছে—আমার বাবার হাতের লেখা।
বাবা ছিলেন স্কুলশিক্ষক।
তার মৃত্যুর পরে, এক সন্ধ্যাবেলায়, তার টেবিলের ড্রয়ারে খুঁজে পেয়েছিলাম অদ্ভুত সব নোট—ছোট ছোট টুকরো হাস্যরস, প্রহসন, ব্যঙ্গাত্মক সংলাপ।
তার লেখা, ছদ্মনামে।
সেই লেখা আমার মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিল।
একজন যাকে গোটা জীবন সবাই “সাধারণ শিক্ষক” বলে জেনেছি, তিনিই যে ঘরে বসে রচনা করে গেছেন হাসির রাজত্ব—তা কে জানত?
আমি সেই লেখাগুলো সংরক্ষণ করতে গিয়ে বুঝলাম, প্রতিটি শব্দের ভেতর বাবার না-পাবার হাহাকার ছিল।
প্রকাশ না পাবার যন্ত্রণা, নিজের ভেতর গুমরে গুমরে মরার ইতিহাস ছিল।
আমি শুধু সেই শব্দগুলো নতুন পোশাকে সাজিয়ে পাঠিয়েছিলাম পত্রিকায়। একটাও শব্দ ছিল না যা আমি নিজে বানিয়েছ—কিন্তু গোটা আত্মা ছিল বাবার। শুধু প্ল্যাটফর্মটা বদলে দিয়েছি, এই যা।
তখন থেকেই আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম—আমার খ্যাতি যদি আসে, সেটা হবে বাবার নাম ছাড়াই।
কারণ বাবা চাইতেন না কেউ জানুক—তিনি ব্যঙ্গ লিখতেন। আসলে ব্যঙ্গ লেখক আর সার্কাসের জোকার এদের দেখতে সবাই পছন্দ করে কিন্তু নিজের ঘরের কেউ ব্যঙ্গাত্মক শীল্পের সাথে জড়িত তা এ সমাজ মেনে নিতে পারে না।
তাঁর কাছে সাহিত্যের চেয়ে সংসারের সম্মান বড় ছিল।
কিন্তু…
এই গোপন কথা বুকের মধ্যে রেখে আমি আজকাল একটু ক্লান্ত বোধ করি। মনে মনে ভাবি আমাদের বাংলায় কত মানুষ চুপি চুপি কত সাদা খাতার পাতাকে চিত্রিত করে গেছেন তাদের অভিঞ্জতা এক যায়গায় সঞ্চিত করে। আমরা যদি তার কিছু মাত্র প্রকাশ করতাম তাহলে আজ সাহিত্যের অবস্থা এমন হয়ত হোত না।
এই যে “গোপন কথা বুকের মধ্যে রেখে ক্লান্তি”— এটা একধরনের নীরব অভিশাপ ও বটে, আবার এক গভীর সম্ভাবনাও।
বাংলার প্রতিটি গলির মাথায়, কাঁচা রাস্তার পাশে, ছাদের কোণায় কিংবা অন্ধকার বারান্দায় এমন মানুষ আছেন— যারা শব্দ জানেন, অথচ বলেন না।
যারা হৃদয় দিয়ে বেঁচেছেন, অথচ কখনো কলম ধরেননি।
সাদা খাতার পাতায় অনেকেই তাদের ভালোবাসা, বঞ্চনা, হাহাকার বা আশ্চর্য সুখ এঁকে গেছেন— কিন্তু কখনো তা চোখে পড়েনি কারোর, কিংবা পড়েও প্রকাশ পায়নি।
“আমরা যদি তার কিছু মাত্র প্রকাশ করতাম…”
আজ বাংলা সাহিত্যে যা ঘাটতি, তা কেবল শব্দের নয়— তা অনুভবের। বঞ্চিত মানুষের ভাষা, চেপে রাখা কথার ভাষা, অপ্রকাশিত ক্ষোভের ভাষা— এই ভাষাগুলো যদি আমরা খুঁজে বের করতাম, সাহিত্যের শরীরে অন্য এক প্রাণ থাকত।
রাত্রে যখন বউ পা টিপে দেয়, আর মা ঘুমুতে বলেন—তখন আমি বিছানায় চুপ করে শুয়ে থাকি আর ভাবি…
আমি কি বাবার গল্প চুরি করেছি? না কি আমি বাবার অসমাপ্ত জীবন সম্পূর্ণ করেছি?
এক রাতে সাহস করে বউকে বলতে গেলাম, “শোনো, আমি যা লিখেছি তার পেছনে…”
সে মাঝপথে বলল, “শুয়ে পড়ো তো, সকালে বাজারে যেতে হবে ঘরে একদম সব্জী নেই!”
আমি থেমে গেলাম।
হয়তো একদিন বলে ফেলব সব। হয়তো একদিন পাণ্ডুলিপির ফাঁকে রেখে যাব একটা চিরকুট—
“এই লেখাগুলোতে আমার কলম আছে, কিন্তু ভাবনা… আমার বাবার।” যদিও আমি তার উত্তরাধিকারী।
সেদিন কেউ হয়তো বলবে না, “তুমি অলস”—
বরং বলবে, “তুমি উত্তরাধিকার ধরে রেখেছ।”
শেষ টুকু—চুপিচুপি বলা এক আকুল স্বীকারোক্তি।
এই গল্প এখন আর শুধু একজন অলস মানুষের নয়, এটা একজন ছায়ার আড়ালে থাকা মানুষের স্বপ্ন বহন করে চলার কাহিনি।
ত্রৈলোক্যনাথ যদি থাকতেন, হয়তো বলতেন—”এ এক আজব অলস, যে চুপচাপ এক সাহসিকতা সঙ্গে “উত্তরাধিকার” বয়ে নিয়ে চলেছে!”
(সমাপ্ত)