“কিছু চিহ্ন আজও অমলিন”
–:: মৌসুমী মৌ ::–
এবারেও বাড়িতে যথারীতি দেবীর কাঠামো তৈরী হচ্ছে | যেতে আসতে না দেখতে চাইলেও দেখছি … বাখারির গায়ে খড়, তার গায়ে স্মৃতির মাটি লেপে একটু একটু করে গড়ে উঠছে মৃন্ময়ী মায়ের রূপ…
আমার অভ্যস্থ চোখ বছর কয়েক আগের সেই সচিত্র দালান খুঁজছে …
এইতো সেদিন আমরা ভাই বোনেরা তোমায় ঘিরে রয়েছি,
আর তুমি ঠাকুর গড়ার ফাঁকে ফাঁকে কারুর জন্য সরস্বতী, কারুর জন্য ছোট্ট গণেশ, রাঙা দিদার জন্য মা লক্ষ্মীর মূর্তি নিমেষের মধ্যে
বানিয়ে তাক লাগিয়ে দিচ্ছ …
তখন আর্ট কলেজের শেষের দিকে, তোমার দাদুর হাত কাঁপতো| তুমিই তখন আঁকতে এ বাড়ির প্রতিমার চোখ| তোমার তুলির টানে প্রাণ পেয়ে মাটির ঠাকুর মানবী হয়ে উঠতো |
মনে আছে! সেদিন তুমি কারো সাথে কথা বলতে না…
শুধু আড়ালে আমাকে ডেকে বলতে, “অম্বালিকা আজ একটু আমার কাছে আসবে?”
আমি সম্মোহিতের মতো ঘাড় নাড়তাম!
কিন্তু মুখে বলতাম কেন?
তুমি শুধু বলতে, “চোখটা ওই চোখটা খুব মন
দিয়ে দেখবো”…
বেশ কয়েক বছর মায়ের চোখ মেয়ের চোখ মিলে মিশে একাকার|
সবাই একবাক্যে তোমার তুলির প্রশংসায় পঞ্চমুখ |স্বর্গীয় দেবী এ কোন জাদুতে এবাড়ির মেয়ে উঠেছে! বিস্ময়াবিষ্ট সকলে…
ছোটবেলার নেশা তোমাকে ঠিক টেনে আনতো এ বাড়ির প্রতিমার প্রাণ প্রতিষ্ঠায়| পরম্পরা মেনে তোমরাই ছিলে তখন দেবীমূর্তির কারিগর|
এখন সে শিল্পী গেছে বদলে…
কখন আসে কখন গড়ে মূর্তি, এখন তার খোঁজ বড় একটা কেউ নেয় না|
এখন জানো ঠাকুরদালানে মায়ের মূর্তি ঘিরে সে প্রাণ নেই… বাগানের শিউলি ফুলের ঝোপে শুঁয়োপোকার বাস, কেউ আর কমলা বোঁটার সাদা ফুলের মিক্স এন্ড ম্যাচ দেখে নিজের শাড়ির রং মেলায় না…
শরতের ছুটির দুপুর গুলো তোমাকে ঘিরে যে তন্ময়তা গ্রাস করতো আজও চোখ বুজলে সে দিন গুলোর টুকরো কোলাজ বড় পিছু টানে, মেঘলা বিষাদ আমায় আচ্ছন্ন করে, ভীষণরকম অসহায় ছটফটানি আমার বুকের ভিতর ফালাফালা করে দেয় …
সেই সময় আমাদের বাড়িতে তুমি তখন সুবল পোটোর নাতি, সুধীর পোটোর ছেলে সুব্রত পাল|
এ বাড়ীর আভিজাত্যের কাছে তোমার প্রতিভার দাম নেই কানাকড়ি…
তুমিতো সুধীর পোটোর ব্যাটা!
যতই দেশ বিদেশের মেডেল ঝুলুক তোমার গলায়| এবাড়ির অন্দরমহলের আগল খোলার অধিকার বা সাহস কোনোটাই তোমার ছিল না…
তুমি ভয় পেলে!
অম্বালিকার থেকেও তখন
তোমার মান অনেক বড় হয়ে উঠেছিল …
আর তারপর অসমাপ্ত ভালোবাসার ইতিবৃত্ত
দু মলাটের জীবনবিজ্ঞান বইয়ের ভাঁজে আজও বেলপাতার জীবাশ্মের মতো স্মৃতিচিহ্ন হয়ে আছে…
হয়ত কেউ সে চিহ্ন আগলে বেঁচে থাকে আজীবন |
○●○●○●○●○