পুনর্যাপন
…………..
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
বড় রাস্তাটি যেখানে বাসস্ট্যান্ডের দিকে ঈষৎ পশ্চিমমুখী হয়, তাহারই এক প্রান্তে নন্দীকেশ্বর মহাদেবের একটি পুরাতন মন্দির ভয়াবহ জঙ্গলাকীর্ণ পরিবেশে ও তাহার প্রায় ভগ্ন অবয়বটি সহ দৃশ্যমান হইয়া থাকে।
প্রত্যহ ইস্কুলের টিফিনের পর আধঘন্টা ছুটি উপলব্ধি হয় বলিয়া প্রায়সই আমি এই পথে আসিয়া পদচারণা করিয়া থাকি।
জনশ্রুতি আছে সেন বংশীয় নৃপতি বিশ্বরূপ সেন যিনি রাজাধিরাজ লক্ষ্মণ সেনের পরবর্তীতে “গর্গযবন” বা যবন বিজয়ী উপাধিতে ভূষিত হইয়াছিলেন তিনি স্বপ্নাদিষ্ট হইয়া একটি রাতের মধ্যে দেবাদিদেবের এই মন্দিরটি নির্মাণ করিতে চাহিলেও তাহা আজ অবধি কোন যুগেই তাহা শেষ হইয়া উঠিতে পারে নাই বলিয়া মন্দিরটিতে আজও পূজাপ্রকরণ প্রচলিত নয়।
……..
ইতিমধ্যে বারোশত বৎসর কখন যে অতিক্রান্ত হইয়া গেছে তাহা কেবল মহাদেবের স্তব্ধবাক লিঙ্গমূর্তিটি ব্যাতিরেকে আজ আর তাহা কহিবার জন্য কেহ আর এই স্থানে জীবিত নাই।দেবদেউলটি আজ বহুকাল উপাসনা রহিত বলিয়া সেস্থলে বিষধর সর্পেরা বাসা বাঁধিয়াছে। এমনকি ইহাও শ্রবণগোচর হয় যে দূরের অরণ্যানী হইতে দু-একটি চিত্রিত ব্যাঘ্র অথবা শৃগাল এই অসমাপ্ত দেবকন্দরে আসিয়া রাত্রিযাপন করিয়া যায়।
তাই নিকটস্থ জনগণ এই দূর্মর ও দূর্গম দেবালয়ের পথটিকে সযত্নে পরিহার করিয়া চলে। আমি কিছুকাল কলিকাতায় ইতিহাস লইয়া পড়াশুনা করিতাম। সন-তারিখের বিশালকায় কৃষ্ণগহ্বরে সদ্যযৌবন যে কখনও পথভ্রষ্ট হইয়া পড়িত না, এমন কথা আজ বলিবার উপক্রম নাই।
……..
আমাদের কালেজে বাচস্পতি মহাশয় মূলতঃ নব্যন্যায় ও স্মৃতিশাস্ত্র পড়াইতেন বলিয়া যে ইতিহাসও জানিতে পারেন তাহা প্রথমদিকে ঠিক বুঝি নাই। সেই জ্ঞানপিপাসু পন্ডিতটি নিছক স্নেহের বশে এই অর্বাচীন ছাত্রটিকে অসময়ে গ্রন্থাগারের নিগঢ়ে পাইয়া তাহাকে যে গল্পের আবহে পূর্বজ্ঞাত কালাকালের পথে একদা হাঁটিয়া বেড়াইতে শিখাইয়াছিলেন।
একথা সত্য যে আজ যে ঘটনার কথা লিখিতেছি তাহার অভিজ্ঞতার জন্য সেই অকৃতদার বৃদ্ধটির পন্ডিতন্ম্যতার যে বৃহৎ যোগ রহিয়াছে আজ তাহা অস্বীকার করিবার কোন উপায় নেই।
……..
সম্ভবত ১২০১ অব্দে তুর্কী বিজেতা বখত্-ইয়ার একদল সৈন্য গঠন করিয়া ‘বিহার-সরিফ’ হইতে ‘গয়া’ ও ‘ঝাড়খণ্ড’ জনপদ জয় করিয়া নদীয়ার দিকে অগ্রসর হইলেন। তাঁহার অধিকাংশ সৈন্য তাঁহার অনুগমন করিল। একদিন বেলা দ্বিপ্রহরে তিনি ‘আঠারোজন অশ্বারোহী সৈন্য’মাত্ৰ নিয়ে ধীরে ধীরে পথ অতিক্রম করে একেবারে গৌড়েশ্বরের রাজপ্রাসাদের দ্বারে আসিয়া পৌঁছালেন; তাঁহাকে ‘অশ্ববিক্রেতা’ মনে করিয়া কোথাও কেউ তাঁকে বাধা দান করিল না। প্রাসাদের ভিতরে ঢুকেই বখত্-ইয়ার ও তাঁর সঙ্গীরা তরবারী উন্মুক্ত করে লোকেদের ‘মুণ্ডচ্ছেদ’ করতে আরম্ভ করিলেন।
তখন দ্বিপ্রহর, মহারাজ লক্ষ্মণ সেন সবেমাত্র ভোজনে বসিয়াছিলেন; এমন সময় প্রাসাদের দরজা এবং নগরের মধ্যস্থল থেকে তুমুল আর্তনাদ ও কোলাহল উপস্থিত হইল । ততক্ষণ বখত্-ইয়ারের বাকী সৈন্যদলের একটা বড় অংশ নগরের ভিতরে জয়োল্লাস শুরু করিয়াছিল।
……..
বিপদের প্রাদূর্ভাব আনুধাবন করিয়া উঠিবার আগে ‘বখত্-ইয়ার রাজপ্রাসাদে ঢুকিয়া পড়েছিলেন ও অনেক পার্ষদ তাঁহার তরবারীর আঘাতে প্রাণ ত্যাগ করিল।
উপায়ান্তর না দেখিয়া গৌড়াধিপতি ‘প্রাসাদের খিড়কীর পথ দিয়া নগ্নপদে’ ‘সংকলাট এবং বঙ্গ’ অভিমুখে পলায়ন করিলে সমস্ত সৈন্যদল আসিয়া নদীয়া এবং তাহার পার্শ্ববর্তী সমস্ত স্থান’ অধিকার করিলে, সেদিন হইতে বঙ্গদেশ ম্লেচ্ছ শাসনাধীন হইল। গৌড়াধিপতি পলায়নপূর্বক (‘পূর্ব’) ‘বঙ্গে’ আরও কিছুকাল রাজত্ব করিবার পর অবশেষে লোকান্তর গমন করিলেন।
তবে বঙ্গদেশের আকাশে তূর্কী বিজয় ঘোষণার পরেও আরো কিছুকাল সেন নৃপতিদিগের অস্তিত্ব টিকিয়া ছিল তাহা মুসলমান পদকর্তা ‘মিনহাজের’ ‘তহ্কাত্-ই-নাসিরী’ গ্রন্থের ছত্রে বারংবার ধরিয়া উপস্থিত আছে।
……..
ইহা প্রসঙ্গে অবশ্য বাচস্পতি মহাশয় আমাকে একদিন কিছু পুঁথি হইতে উদ্ধৃত করিয়া বলিয়াছিলেন। সে সকল ঘটনা বর্ণনার কালে বৃদ্ধ বাচস্পতির চক্ষুদ্বয় অশ্রুসজল হইয়া উঠিয়া আমাকেও বঙ্গজাতির বিদীর্ণ ইতিহাসের মালিন্য কেমন করিয়া আসিয়া যেন ঠিক স্পর্শ করিত।
গৌড়াধিপতির গর্গযবনের গুরুস্থানীয় এক ব্রাহ্মণ তাঁহার কাছ হইতে দেবাদিদেব সম্পর্কিত স্বপ্নের কাহিনি শ্রবণ করিয়া একটি রাতের ভিতরে এই স্থানে উমাপতির মন্দিরটি নির্মাণ করিবার আদেশ দান করেন। তখন সেই নৃপতিটি শিবালয় নির্মাণে যে ব্রতী হন সে কথা আগে বলিয়াছি। তাঁহাদের আশা ছিল যে মহাদেব স্বয়ং এইস্থানে অধিষ্ঠান করিলে পুনরায় দেশ ম্লেচ্ছসংসর্গ মুক্ত হইবে ও ক্রমে হিন্দুরাজত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হইবে।
……..
হাঁটিতে হাঁটিতে মন্দিরটির নিকটে আসিয়া কিয়ৎক্ষণ দাঁড়াইয়া ইতিহাসের সেই অসমাপ্ত কাহিনির কথা স্মরণ করিতে লাগিলাম। বঙ্গদেশের ইতিহাস দেশে সেরূপ খ্যাতি লাভ করে নাই বলিয়া পন্ডিতগণ হা’হুতাশ করিলেও আমার সম্মুখে সেই প্রাচীন অর্ধনির্মিত দেব দেউলটিকে দেখিয়া আমি বিহ্বল হইয়া পড়িলাম। স্থানে স্থানে মন্দিরের ফাটল বেশ প্রকট। বন্য শষ্পরাজির অবিরল বংশবৃদ্ধি যে মন্দিরটির করুণদশাটিকে শোচনীয় করিয়া তুলিয়াছে তাহা না বলিলেও চলিবে। তবে এই স্থানে অপর কোনও জনপ্রাণী না থাকার দরুণ এক অতি করুণ ও অসহায় তমিশ্রা, ইতিহাসের ভগ্নপ্রায় এবং অর্ধনির্মিত এই দেউলটিকে যে কারুণ্য প্রদান করিয়াছে তাহা আজ আর অস্বীকার করিবার উপায় নেই।
……..
কিয়ৎক্ষণ পরে দেখিলাম চতুর্পাশ্ব জুড়িয়া বেশ অন্ধকার নামিতেছে। নৈর্ঋত কোণ হইতে অকাল কৃষ্ণবর্ণের মেঘপুঞ্জ এইরূপ পরিবেশের কারণ বলিয়া ফিরিবার দ্বিরুক্তি না করিয়া ফিরিবার পথের উদ্দেশ্যে পা বাড়াইলাম।
……..
হঠাৎ শুনিলাম কেউ একজন অতি গম্ভীর স্বরে আমাকে উদ্দেশ্য করিয়া ডাকিতেছে। এইরূপ জনবিরল স্থানে এমত আহ্বানের তো কোন সম্ভাবনা থাকিবার কথা নহে। জলদগম্ভীর স্বরের সেই আহ্বান শুনিবামাত্র গা ছমছম করিয়া উঠিল!
দেখিলাম একজন বৃদ্ধ সাধু কোথা হইতে আসিয়া আসনে উপবিষ্ট হইয়া আছেন। এ আহ্বান তাঁহারই কন্ঠনিঃসৃত ! বৃদ্ধ সাধুটি সম্ভবতঃ বঙ্গালী নহে। তিনি ভাঙা হিন্দি ও মৈথিলীর মিশ্রণে কহিলেন যে মহারাজ গর্গদেবের সামান্য ধনরাশি তাঁর এই বেদীতলে আপাতত প্রোথিত রহিয়াছে।
যবন লুন্ঠনকারীগণ মন্দিরের গাত্র ভাঙিতে আরম্ভ করিয়াছে বটে তবুও এই ধনের হদিশ পাওয়া তাহাদের কর্ম নহে। আমি তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া অবাক হইয়া তাঁহার কথা শুনিতে লাগিলাম।
হাজার বৎসর আগের কোনও ঘটনাকে কি সহজেই বর্তমানে আনিয়া ফেলিতেছেন !
সাধুটির নিশ্চিতরূপে মস্তিষ্কবিকৃতি হইয়াছে ভাবিয়া আমি দ্রুত পদচালনা করিতে উদ্যত হইলাম।
……..
সাধুটিকে দেখিলাম বিরক্তিসহকারে আমার দিকে দ্রুত পদে ধাবিত হইয়া তাঁহার হস্তধৃত পাত্র হইতে সামান্য কর্পূরগন্ধী সবুজাভ মলম লইয়া আমার কপালে লেপিয়া দিলেন। আমি ভক্তপ্রাণ নহি, তথাপি তাহাকে এড়াইতে পারিলাম না।
মলমটির একপ্রকার মাদকতাপূর্ণ সুগন্ধে মাথা ঘুরিয়া যেতেই দেখিলাম আমি এক জনস্রোতের মাঝে দাঁড়াইয়া আছি। একদল দস্যু (সম্ভবতঃ যবন) মন্দির গাত্রে কোদাল ও কুড়ুল দিয়া সজোরে আঘাত হানিতেছে।আর ঘটনাস্থলে সেই সাধুটি যেন শূন্যে মিলিয়া গিয়াছেন। আশ্চর্যের ঘটনা এই যে, তাহারা কেহই আমাকে দেখিতে না পাইলেও আমি তাহাদের সমস্ত ক্রিয়াকলাপ দেখিতে পাইতেছে।
‘বখত্- ইয়ার খলজী জিন্দাবাদ! ‘ বলিয়া তাহাদের মধ্য হইতে কেহ বা কাহারা সজোরে চিৎকার করিয়া উঠিল। আমি আর স্থির থাকিতে পারিলাম না। মাথায় হত চাপিয়া শুইয়া পড়িলাম। সমস্ত শরীর বমনের পূর্বাভাস জনিত কারণে দুলিয়া উঠিতে লাগিল। বলাবাহূল্য আমি সংজ্ঞা হারাইলাম।
……..
কি ভাবে সে যাত্রায় রক্ষা পাইয়া ইস্কুলের অভ্যন্তরে পুনরাত ফেরত আসিলাম তাহা আর মনে পড়িতেছে না।তবে দেখিলাম আজিকার মত বিদ্যালয় ছুটি হইয়া গিয়াছে।
মধু খানসামার হাতে জলের ঘটি ও তাহার সাথে বাংলার শিক্ষক সাধন দস্তিদার মহাশয় আমার সম্মুখে দাঁড়াইয়া আছেন। আমাকে চোখ মেলিতে দেখিয়া তাঁহারা আশ্বস্ত হইলেন। সাধন বাবু আমাকে গৃহ অবধি পৌঁছাইয়া দিয়া আপন বাসায় ফিরিয়া গেলেন।
……..
শরীর দূর্বল ও শিরঃপীড়ায় কাবু হইলেও এসকল ঘটনার কার্যকারণ লইয়া ভাবিতে লাগিলাম। হাজার বৎসর পূর্বের বঙ্গাধিপ পরাজয় তথা তূর্কী বিজয়ের যে দৃশ্যটি সম্মুখে অভিনীত হতে দেখিয়াছিলাম তাহার কারণ আজও বিচার করিয়া উঠিতে পারি নাই। এমনকি সেই বৃদ্ধ সাধু, ভগ্নপ্রায় দেবালয় ও তৎসহ প্রাচীন ইতিহাসের পুনর্যাপনের দৃশ্যান্তরটিকে মনের খেয়াল বলিয়া যে উড়াইয়া দেব তাহাও যে যে আর সম্ভব নয়। আমার স্কন্ধে একখানি ঝোলা থাকিত। ইহার মধ্যে দু’একটি পুস্তক ও কলম রাখিতাম।
আজ দেখিলাম ঝোলাটির মধ্যে কি করিয়া যেন কয়েকটি মলিন অথচ রৌপ্য নির্মিত ‘দ্রম্ম ‘ জাতীয় মুদ্রা পড়িয়া আছে। তাহাদের এক পৃষ্ঠে সদাশিব অপর দিকে বৃষ/ নন্দী মূর্তি খোদিত। প্রসঙ্গত বলিয়া রাখি যে সদাশিব সেন রাজপ্রতীক রূপে প্রচলিত ছিল। যদিও খোদিত মূর্তিটির উপরাংশটি কালের প্রকোপে বিলীয়মান তবু অপর পৃষ্ঠে ‘স ন ‘/সেন আদ্যক্ষরটি স্পষ্ট খোদিত । আমি জানি, ইহাদের ইতিপূর্বে কোনভাবেই আমি সংগ্রহ করি নাই !
—oooXXooo—