সজনেফুল (শেষ পর্ব)
ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
দাদু নেই,ঠাকুর মা নেই। দুদিনের কথা হল আর শঙ্করীর বিয়ে হয়ে গেল। কোনও সানাই বাদ্য বাজলো না। কোনও লোক সমাগম হল না। দোসরা মাঘ সর্বমঙ্গলা কালী বাড়িতে সিঁদুর পরালে সেই যুবক। একটা অনির্দেশের পথে পা দিলে শঙ্করী।
বিয়ের পর কেষ্ট চাটুজ্জের বাড়িতে এসে কান্নায় ভেঙে পড়ল শঙ্করী। এত কিছু হয়ে গেল কেউ কিছুই জানতে পারল না। তবে জামাই দেখে সবাই পছন্দ করল। ভাবলে গরীবের মেয়ে। উদ্ধার হয়ে গেছে ভালোই হয়েছে। বৌ তিনটে কিছু টাকা দিলে শঙ্করীকে। সিঁদুর পরে নববধূ শঙ্করী মহাদেবের হাত ধরে চলল।
এতক্ষণ কোনও কথা বলে নি বর বাবাজি। ট্রেন থেকে নেমে বাসে উঠল ওরা। তারপর নামলে এক জায়গাতে। শঙ্করী দেখলে কত বাউল। বললে “এখেনে এত বাউল কেন? এটা কোন জায়গা”?
বর জবার দিলে “এটা বীরভূম জেলা। এখন পৌষমেলা চলছে”।
আনন্দে চকচক করে উঠল শঙ্করীর দুই চোখ। তার মানে নিশ্চয়ই দাদু ঠাকুর মা এখানেই কোথাও আছে। এখনই যদি দেখা হয়ে যায় ওদের আশ্চর্য হতে বাকি থাকবে না। বর বললে “এই জায়গাটার নাম তারাপীঠ। এখন রিক্সা করে বাড়ি যাবো”।
রিকশার মধ্যে গুটিসুটি বসে থাকে শঙ্করী। বরটাকে আড় চোখে দেখে। মনে ভাবে “লোকটার রাগ খুব মনে হচ্ছে। কী জানি। ওর বাড়িতে কে আছে শঙ্করীর জানা নেই। কী করে লোকটা। আচ্ছা ওকে খাওয়াতে পারবে তো! দুবেলা দুমুঠো ভাত হলে আর কিছুই চায় না শঙ্করী। আর এই ভাতের কথা মনে আসতেই মা আর দুই বোন এর খাবার চিন্তা গ্রাস করে তাকে। তার দুই চোখে প্লাবন নামে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।
বরের নাম প্রতাপ। নামের সাথে কাজের মিল আছে বটে। ওর বাড়ি ডাঙা পাড়াতে। এই তারাপীঠ থেকে তিনকিমি। বাড়িতে তার বিধবা মা। একটা বোনের বিয়ে দিয়েছে গলসাতে।
রুমালটা শঙ্করীর দিকে বাড়িয়ে দিলে প্রতাপ। বললে “কেঁদো না। অসুবিধা কিছু হলে আমাকে জানাবে”।
শঙ্করী আবার চুপ করে থাকল। যে পথ দিয়ে রিকশা যাচ্ছে তার একপাশে বাঁশবাগান। আর একদিকে চাষের জমি। কত রকমের সব্জি চাষ হয়েছে। শঙ্করী দেখলে একটা নদী বাঁশবাগান এর ওদিকে। বললে “এই নদীটার কী নাম”?
প্রতাপ এবার শঙ্করীর মুখের দিকে চাইলে। কাজল সিঁদুর অশ্রুসিক্ত হয়ে এক অপরূপ শোভা ধারণ করেছে। কী অপূর্ব শান্ত শ্রী। হাত দিয়ে কপালের চুলের গোছাটা সরিয়ে দিলে প্রতাপ। বললে “এ নদীর নাম দ্বারকা”।
ডাঙাপাড়াতে ঢুকলে প্রতাপ বৌ নিয়ে। সবাই অবাক। বলা নেই কওয়া নেই প্রতাপ বিয়ে করেছে। যেন কী একটা অবাক কান্ড। সবাই নববধূকে উঁকি দিয়ে দেখছে। অবশেষে বাড়ির সামনে এসে হাঁক দিল প্রতাপ “মা। আমি বিয়ে করেছি। বৌকে বরণ করো”।
শঙ্করী দেখলে মাটির দোতলা বাড়ি। বাড়ির সামনে সজনে গাছ। কত ফুল তলা বিছিয়ে পড়ে আছে। সাদা ধবধবে।টোপা টোপা। কী অপূর্ব খেতে এই সজনেফুল।
ঘর থেকে বেরিয়ে এল এক মহিলা। চোখ কপালে তুলে বললে “এসব কী! বলা নেই কওয়া নেই একেবারে বিয়ে! আমাকে পর্যন্ত জানালি না! কেন “?
প্রতাপ বললে “অনেক টা পথ আসছি। খুব ক্লান্ত লাগছে। বরণ করলে করো নৈলে নিজেরাই উঠে যাচ্ছি ঘরে।”
আরও দুজন স্ত্রীলোক ততক্ষণ বেরিয়ে এসেছে। একজন বিবাহিত। আর একজন শঙ্করীর থেকে একটু বড়। তবে বিবাহ হয় নি। সকলেই প্রতাপের কথা শুনে হতভম্ব।
শাশুড়ি বরণ করলে । কেমন যেন একটা গুরুগম্ভীর ভাব। কারো কোনও উচ্ছ্বাস নেই। প্রতাপ ঘরে ঢুকেই আবার কোথায় বেরিয়ে গেল। আর শঙ্করীর কানে এল কান্নাকাটি।
শাশুড়ির সাথে অন্য মেয়েটার তর্ক হচ্ছিল। মেয়েটার গলা ভেসে আসছে। ও কী বলছে এসব! আর শাশুড়ি বলে চলেছে “আমি এসবের বিন্দুবিসর্গ জানি না”।
মেয়েটা তবু বলছে “তোমরা মা ছেলে মিলে আমার জীবন নষ্ট করেছ। তুমি সব জানো”।
শঙ্করীর খুব খিদে পেয়েছে। কিন্তু এরা খেতে দেওয়া তো দূরের কথা একগ্লাস জল পর্যন্ত দিলে না। শঙ্করীর মনে হচ্ছিল কোথাও কিছু একটা গড়বর হয়েছে।
কখন শঙ্করী ঘুমিয়ে পড়েছে। হঠাৎই মনে হল কে যেন তাকে ডাকছে। শঙ্করী দেখলে প্রতাপ এসেছে। হাতে অনেক গুলো ব্যাগ। বললে “তোমার পোশাক আশাক আছে এতে। হঠাৎই বিয়ে করলাম।প্রস্তুতি ছিল না। আর এই প্যাকেটে কচুরি আর মিষ্টি আছে। খেয়ে নাও। এখন এরা কিছুই খেতে দেবে না।”
শঙ্করীর প্রতাপের প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। স্বামীর দায়িত্ব আছে বটে। তবুও ওর মনে একটা প্রশ্ন উঁকি দিতে লাগল প্রতাপ কে এই বাড়ির লোক এত সমীহ করে। তাহলে সে কেন অমন করে বিয়ে করল! আর ওই যে মেয়েটার কান্না সে শুনতে পেল ও কে? প্রতাপের বিয়ে হলে ও কাঁদে কেন! আর এখন তো কোনও আওয়াজ আসছে না। তবে কী সব শান্ত হয়ে গেছে!
কোন ভোরের ট্রেনে রওনা হয়েছিল কানাইপুর থেকে। এখন ঘোর দুপুর। এরা রান্না করবে কখন? পোশাক বদলে নিল শঙ্করী। হঠাৎই তার ঘরে এল বিবাহিতাটি। বললে “তোমার সাথে ঠিক মতো আলাপ হয় নি। আমি কণিকা। তোমার একমাত্র ননদ। এই পাশের গাঁ গলসাতে আমার বিয়ে হয়েছে। আমি গতকাল এসেছি। এসেই দেখি দাদা নেই। আমরা তো বুঝতেই পারি নি ও বিয়ে করবে।”
শঙ্করী এবার একটু সাহস পেলে। বললে “আচ্ছা। আর একজন মহিলা ছিল ও আমার কে হয় গো। আর ও অমন করে কাঁদছিল কেন? ওর কী হয়েছে”?
কণিকা এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে ভাবতেই পারে নি। মুখটা বিকৃত করে বললে “ও হল আমার ননদ ।ও ওরকম ই। ছাড়া তো ওর কথা। তোমার মুখখানা খুব মিষ্টি। দাদা আমার খুঁজে খুঁজে ঠিক তোমাকে এনেছে”।
শাশুড়ির কখন আগমন হয়েছে শঙ্করী বুঝতে পারে নি। হঠাৎই আওয়াজ এল “হ্যাঁ গা মেয়ে। তোমার বাপ মা কী দিলে বিয়েতে দেখাও। গয়না টাকা পয়সা কিছু দিয়েছে না সবটাই ফোকটাই”।
শঙ্করীসম্বিত ফিরে পায়। সত্যিই তো। তাকে তো কিছুই দেয়নি বাপ মা। নিজেকে খুব ছোটো মনে হল। অস্ফূটে বললে “আমার বাবা মা দরিদ্রের দরিদ্র।তারা চেষ্টা করলেও কিছুই দিতে পারবে না। সে সামর্থ্য তাদের নেই “।
শাশুড়ির মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল “বিনি পয়সাতেই যদি বিয়ে করল তবে মিনু কী দোষ করেছিল? ও তো হাভাতে ঘরের নয়। অতদিন মেলামেশা করলে। আর নোঙর বাঁধলে অন্য ঘাটে!”
কণিকা চিৎকার করে “তুমি চুপ করো মা। কথা শুরু করলে থামতে চাও না। কথাতেই আছে জন্ম মৃত্যু আর বিয়ে/এই তিন বিধাতা নিয়ে”।
শাশুড়ির বলা কথাগুলো শঙ্করীকে ভাবিয়ে তুলল। তার মানে ডাল মে কিছুই কালা হ্যায়। কী সত্য আছে মিনু আর তার স্বামী প্রতাপের মাঝে। কী শুনছে সে এই বাড়িতে পা দিয়েই। তার ভয় করতে লাগল। ভাবলে আমার কপাল পুড়ল। প্রতাপ তো মিনুকে ভালোবাসে। সে চিরদিনের দুয়োরাণী। বিধাতা পুরুষ একচোখো। শঙ্করীর জন্য কোনও সুখ লেখেন নি।
শঙ্করীর চোখের কোণে জল চিকচিক করে উঠল। নারী পুরুষের সম্পর্কের রসায়ন সে বোঝে না। সে শুধুই সকলকে ভালোবাসে। আষ্টেপৃষ্ঠে ভালোবাসে। ঠাকুর মা বলেছিল “শঙ্করীরে। পশুপতিনাথের গলায় বেলপাতার মালা গাঁথিস তুই। তোর ভালো ঘর বর হবে”!শঙ্করীর তাই বিশ্বাস ছিল। যখন রিকশার মধ্যেই প্রতাপ তার কপাল ছুঁয়েছিল তখনও মনে হয়েছিল এই জীবনটা স্বর্গ। কিন্তু এই মুহূর্তে তার মনে হল সব মিথ্যে। সব ছলনা। পৃথিবীর মানুষ বলতে ঠাকুর আর ঠাকুর মা ছিল। কেউ তাকে ভালোবাসে না। কেউ না।
ননদ কণিকা বললে “এবার রান্না বান্না কিছু করতে হবে তো নাকি? দাদা এসে খেতে চাইলে কী হবে বলো দিকি”?
শঙ্করী বললে “আমি রান্না করতে পারি। যদি তোমরা বলো”
শাশুড়ি বললে “এই তো গতকাল বিয়ে হয়েছে। এরমধ্যেই কেউ আগুনের কাছে যায়। এখন আটদিন ঝাঁটা ন্যাতা ধরবে না। তারপর যা হয় দেখা যাবে”।
শঙ্করীর হাসি পায়। যার কপাল ঝাঁটামারা তার আবার মঙ্গল অমঙ্গল।
কণিকা কেমন যেন ভয়ে ভয়ে সিঁটিয়ে আছে। ওর এখন শ্যাম রাখি না কূল রাখি অবস্থা। ওর নিজের সংসার টা হয়ত ভেঙে যাবে। কেন যে দাদা এমন করলে। ওর ননদ মিনু পুরো খরিশ যেন।কণিকা র ভয় হয়। ভীষন প্রতিহিংসা মিনুর। আর তেমনি ঔদ্ধত্য। তবে এই যে মেয়েটা ওর বৌদি হয়ে এসেছে ভারী মিষ্টি স্বভাব। নামটাও সুন্দর। শঙ্করী।
শাশুড়ির চিৎকার শোনা যায়। বললে “কিছুই তো নেই। কী রাঁধব শুনি। ছেলেটার কী হল আজ চার পাঁচদিন ঘরছাড়া। এতটুকু সব্জি নেই। আলু সিদ্ধ ভাত নামিয়ে রাখি তাই গেলো তোমরা’।
শঙ্করীর মনে হল এই কঠোরতার আড়ালে শাশুড়ির মধ্যে একটা মমতাময়ী রূপ আছে। বললে “অত সজনেফুল গাছের তলায় পড়ে আছে। সজনেফুল দিয়ে তরকারি খুব সুন্দর। আমি কুড়িয়ে দেবো?”
শাশুড়ি আর ননদ তার দিকে তাকিয়ে রৈলো। বললে “ঠিক বলেছ। তবে কণি কুড়িয়ে দিক। নতুন বৌ ফুল কুড়ালে লোকে কী বলবে শুনি। আর আমার ছেলের রাগ জানো না তো।”
প্রতাপের পুরো নাম প্রতাপ ঠাকুর। জাতে নাপিত ।তবে শঙ্করীদের পালটি ঘর। একটা ব্যাপারে এদের অমিল। শঙ্করীর পূর্বপুরুষ গৈলার আর প্রতাপের পূর্বপুরুষ বিহারের। অনেক কাল আগে ওরা এই লাল মাটির দেশে বসত গড়েছিল। প্রতাপের জন্ম এখানেই। ওদের গাঁয়ের নাম ডাঙাপাড়া। বর্ষাকাল এলে এখানে জল উঠে যায়। প্রতাপের নিজের সেলুন আছে। যাকে বলা যায় জাতব্যবসা।
ডাঙাপাড়া থেকে তিন কিমি গেলে তারাপীঠ। ওখানেই পথে এক প্রান্তে প্রতাপের সেলুন। ছোট্ট থেকেই ডাকাবুকো প্রতাপ।পাড়ার কোন একটা ছেলেকে ধরে ও গুজরাটের সুরাটে গিয়েছিল। ওখানেই ফিল্মি কায়দাতে চুল কাটা শিখে এলে। ওখানে কষ্ট করে থেকে মালিকের দেওয়া বেতন জমিয়ে তারাপীঠে দোকান করলে। এই দোকান খুব চালু। সৌভাগ্য লক্ষ্মী ধরা দিলে যেন।
প্রতাপ বোনের বিয়ে দিয়ে বিয়ে করবে এটাই ভেবেছিল। কিন্তু বোনের গায়ের রঙ কালো। কেউ পছন্দ করে না। মা অস্থির হয়ে ওঠে। অবশেষে একটা সম্বন্ধ এল গলসা থেকে। চাষিভূষি মানুষ। কিন্তু ওদের আবার অন্য শর্ত। বদল বিয়ে করতে হবে। হবু জামাই এর বোন মিনু। তাকে বিয়ে করতে হবে প্রতাপ কে।
বদল বিয়ে বললে বটে তবে বোনের বিয়ের এক সপ্তাহ আগে ওরা চেয়ে বসলে নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা,গয়না আর দানসামগ্রী। প্রতাপ অনেক কষ্ট করে তা মেটালে।
এদিকে বিয়ের পর এ বাড়িতে মিনুর যাতায়াত বাড়ল। প্রতাপ কিছুই বলতো না। কারণ ওই মেয়েটাই তার বৌ হবে। মিনু বললে “যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকে তোমার ঘরে তোলো।” প্রতাপ মিনুর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে। বলে “বেশ তো। বদল বিয়ের নামে তোমার পরিবার পণ নিলে। আমি এখন নিঃস্ব। তোমার বাপ দাদাকে বলো আমাকে কিছু টাকা দিতে”।
চমকে উঠলে মিনু। যেন আঁতকে উঠলে। বললে “আমরা তো ভালোবেসেছি। বনের ফুল আর নদীর জল দিয়ে বিয়ে হবে”।
প্রতাপকে তাড়া দিতে লাগল মিনু।আর প্রেমের দেবতা তত ই রুষ্ট হলেন। প্রতাপ সময় চাইলে মিনু মানতে চায় না। কণিকার উপর অত্যাচার করতে থাকে মিনু। বোন কণিকাকে সে বলে তোমার গায়ের রঙ কালো তাই টাকা গুনতে হয়েছে। কণিকার স্বামী মিনুকে উৎসাহিত করে।
প্রতাপ বুঝতে পারে মিনু অত্যন্ত প্রতিহিংসাপরায়ণ। তাই জেদ চেপে বসে তারও। এখন যদি প্রতাপ বিয়ে করে নেয় তবে সবদিক রক্ষা হবে। আর সেই ভেবেই বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে শঙ্করীকে বিয়ে করে সে।
শঙ্করীর এসব বিন্দুবিসর্গ জানার কথা নয়। চুপ করে সে ভাবতে থাকে তার ভবিষ্যত নিয়ে। প্রতাপ কে সে জিজ্ঞেস করবে সে কী করবে। করজোড়ে সে বলবে তোমার ভালোবাসা নিয়ে সুখী হও। আমাকে শুধুই ওখানে ফিরিয়ে দাও। আমার ঠাকুর এর বাড়িতে কাজ করে আমার পেটের চাহিদা মিটে যাবে।
শাশুড়ি রান্না করেছে সজনেফুল এর ঝাল আর পেঁপে দিয়ে মুসুরির ডাল। প্রায় আড়াইটে বাজে। হঠাৎই সাইকেল এর আওয়াজ শোনা গেল। কণিকা বললে “দাদা এল”।
কথাটা শুনেই কেমন ভয়ে সিঁটিয়ে গেল শঙ্করী। প্রতাপ কে বেশ হাসিখুশি দেখাচ্ছে। বললে “দেরী যখন হয়েছে আর একটু হোক। এতে মাংস আছে আর দৈ আছে। জমিয়ে খেতে হবে আজ।”
খেতে বসেও শঙ্করীর উদাসীন ভাব। প্রতাপ বুঝতেই পারে মেয়েটা কিছু আঁচ করতে পেরেছে। না না। কিছুই লুকিয়ে রাখবে না সে। শঙ্করীর কাছে সে সত্য বলবে। শুধুই রাতের অপেক্ষা। তারপর নতুন সুরে নতুন ছন্দে এই মেয়েটাকে ভীষণ ভালোবাসবে। বড় মিষ্টি এই মেয়েটার স্বভাব।
সবকিছুই স্বাভাবিক হয় কালের নিয়মে। কণিকা শ্বশুর বাড়ি যায়। আর শঙ্করীর কাছে সব প্রকাশ করে প্রতাপ। চাঁদের স্নিগ্ধ আলো আর প্রতাপ এর ভালোবাসা ভরিয়ে দেয় শঙ্করীর জীবন। শঙ্করীর বাপের বাড়ির জন্য মন কাঁদে। ঠাকুর ঠাকুর মা সবার জন্য। প্রতাপ বলে “যাবো গো যাবো। তোমাকে সেখানে নিয়ে যাবো”।
বছর ঘোরে। আবার শীতকাল আসে। এবার কত সজনেফুল গাছ গুলোতে। ফলের ভারে নুইয়ে যাবে। শঙ্করীর শরীরেও ফল এসেছে। প্রতাপ বলেছে ওদের মেয়ে হবে। আর শঙ্করী বলেছে স্বপ্নে সে দেখেছে তার ছেলে হয়েছে।
সেদিন একথালা সজনেফুল এর পোস্ত রেঁধেছে শঙ্করী। প্রতাপ আজকাল ভাত নিয়ে যায় দোকানে। টিফিন কৌটো ভরে ভাত দিলে। সজনেফুল দিলে। ভোর ভোর দোকান খোলে প্রতাপ। সেদিন ও যাচ্ছিল। হবু সন্তান আসবে।তার ভবিষ্যত ভাবনা এখন থেকে। কিন্তু কে জানতো শঙ্করীর সুখের সংসার তছনছ করে দেবে প্রতিহিংসা।
প্রতাপ চলে গেলে শঙ্করী ঘরদোর পরিস্কার করছিল। হঠাৎই পাশের বাড়ির পল্টু চিৎকার করছে দেখে বেরিয়ে এল শঙ্করী। কার কী হয়েছে জানতে চায় শঙ্করী। শাশুড়ি ছুটে আসে। তারাপীঠ যাবার রাস্তায় পথে রক্তাক্ত পড়ে আছে একটা লোক। শীতের কুয়াশার অন্ধকারে কারা যেন পিছন থেকে মাথায় আঘাত করেছে লাঠি দিয়ে।
শঙ্করীর মনটা কু গাইছে। সকলকে ডেকে ডেকে জিজ্ঞেস করছে। কেউ কিছুই বলতে চাইছে না। পেটে বাচ্চাটা নড়ছে। তবু এগিয়ে চলে শঙ্করী। তখন সব শেষ। সজনেফুল এর তরকারীটা রাস্তায় পড়ে আছে। এতো খুন। কেউ ওই দেহ এখন ছুঁতে পারবে না। পুলিশের নির্দেশ।
সব কাজ মিটে গেলে শঙ্করী বললে “পল্টু। তুই আমাকে কানাইপুর দিয়ে আসতে পারবি”?
পল্টু রাজি হল। চোখের জলে বিদায় নিলে শঙ্করী শাশুড়ির কাছ থেকে।
অনেক দিন পর আবার শঙ্করীর দেখা পেলে কেষ্ট চাটুজ্জে। সাদা একটা থান পরে সজনেফুল কুড়াচ্ছে শঙ্করী। প্রথম বার যখন শঙ্করীকে দেখেছিল লাল ফ্রক ছিল। এখন সবটাই সাদা। এক আঁচল সজনেফুল নিয়ে শঙ্করী বললে “সজনেফুল খাবে দাদু?”
কেষ্ট চাটুজ্জে বললে “আজকাল সজনেফুল বড় বিস্বাদলাগে।
(সমাপ্ত)