মায়াজাল
ডাঃ রঞ্জন কুমার দে
অপারেশন থিয়েটারের সামনে একটা ছোট খাটো জটোলা, অপেক্ষমাণ মানুষগুলোর মধ্যে এক চাঁপা উত্তেজনা, এক অজানা আশঙ্কা যেনো ভর করেছে, রাত জাগা চোখ গুলো পলকহীন হয়ে তাকিয়ে আছে বন্ধ দরজার দিকে, যেনো বোঝার চেষ্টা করছে তাদের মরণাপন্ন রোগীর ফিরে আসার সম্ভাবনা কতটা।
এখন ভোর তিনটে বেজে দশ, কয়েক ঘণ্টা আগেই ঘটে গেছে এক মর্মান্তিক ঘটনা। রাত তখন দশটা, স্বামী স্ত্রী বেরিয়ে আসছে শহরের এক বিখ্যাত শপিং মলের দরজা ঠেলে, হাতে দুটো বড় ব্যাগ। একটু কান পাতলেই বোঝা যায় যে তারা নিজেদের মধ্যে আজ শপিং করে কতটা লাভ করতে পেরেছে সেই আত্মতৃপ্তির আলোচনা করতেই ব্যস্ত, মুখে চোখে অহংকারের অভিব্যক্তি।দেখলেই বোঝা যায় যে তারা এই চটকদারি দুনিয়ার দেখনদাড়ি তে প্রচণ্ড ভাবে অভ্যস্ত। মলের সামনেই একটা বারো চোদ্দ বছরের মেয়ে আর একটা ছোট ছেলেকে নিয়ে বসে আছে ,অভুক্ত দুজোড়া চোখ একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে মলের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসা সাজগোজ করা পুরুষ ও মহিলাদের দিকে, যেনো এক করুন আর্তি নিয়ে বলতে চাইছে দুটো ভাত দেবে গো, সারাদিন কিছুই খাবার জোটেনি।
যাইহোক আমাদের গল্পের স্বামী স্ত্রী বাকিদের মতোই এই ছোট্ট বাচ্চা দুটোকে অবহেলার চোখে দেখে পাস কাটিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে নারীটি বলে উঠলেন, এমা দেখেছো ভুলেই গেলাম, আমাদের মান্তু সোনার জন্য রোস্টেড চিকেন টাই তো নেওয়া হলো না, মেয়ে আমার চিকেন ছাড়া যে রাতে খেতে পারেনা। স্বামী সাথে সাথে ছুটলেন মলের মধ্যের রেস্তোরাঁয় তার আদরের মেয়ের খাবারের সংস্থানে। ওনারা হলের তথাকথিত স্বঘোষিত ভদ্র সমাজের লাখ টাকা মাইনে পাওয়া প্রতিনিধি, তাদের মেয়ে বলে কথা, সেতো আর ওই গাঁইয়া ভূতদের মতো ভাত আর রুটি খেয়ে মানুষ হবেনা।
আমাদের সুবিধার জন্য আমাদের গল্পের স্বামী স্ত্রীর একটা নাম দেওয়া যাক, মৃনাল সেনগুপ্ত ও মায়াময়ী সেনগুপ্ত। মৃনাল মলের মধ্যে চলে গেল আর মায়া ওখানেই দাঁড়িয়ে ফেসবুকে আজকের শপিং করার বিভিন্ন মুহুর্ত গুলোকে ক্যামেরা বন্দী করার ছবি গুলো পোস্ট করতে শুরু করলো, নিজের আরম্বরতা সবাই কে দেখাতে না পারা পর্যন্ত যেনো শান্তি নেই। একশো টা লাইক পড়বে,পঞ্চাশ জন, So cute সুলভ কমেন্ট করবে তবেই না শোলোকলা পূর্ণ হবে, নিজের ছদ্ম অহংকারের প্রতি সুবিচার করা হবে। আসলেই কি তাই। বাস্তবে কিন্তু এই মায়ার মত মহিলা রা একটা ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স এ ভোগে, অস্তিত্ব সংকটে ভোগে, ফলস্বরূপ মাঝে মাঝে এভাবে নিজেকে জাহির করে জোর করে মানুষের বাহবা কোড়াতে চায়, নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে চায়।
যেভাবে হন্তদন্ত হয়ে মৃনাল ভিতরে গিয়েছিল ঠিক সেভাবেই মেয়ের খাবার নিয়ে ছুটে বেরিয়ে এলো , তাড়াতাড়ি চলো, মেয়ে কিন্তু বেশিক্ষণ খিদে সহ্য করতে পারেনা, কান্নাকাটি শুরু করবে।ফিরে তাকিয়ে একবারও দেখার চেষ্টাই করলো না যে ওই খাবারের প্যাকেট থেকে বেরিয়ে আসা সুগন্ধে আরও দুটো অভুক্ত শিশুর পেটের জ্বালা আরো দশগুণ বাড়িয়ে দিয়ে গেলো। স্বামী স্ত্রী ছুটলো পার্কিং এর দিকে। মৃনাল তার সদ্য কেনা রোয়াল এনফিল্ড টা নিয়ে এগিয়ে এলো মায়ার দিকে, মায়াও দ্রুত উঠে বসলো, একটা সেলফি নিয়ে নিলো , এটাকে ডিপি তে দিতে হবে।
নিমেষের মধ্যে মৃণালের বাইক টা ঝড়ের বেগে ছুটতে লাগলো। রাত তখন প্রায় এগারোটা। ফাঁকা হয়ে যাওয়া রাস্তা দিয়ে মৃণালের বাইক চলেছে , কাউকে পাত্তা না দিয়ে সবার আগে যেতে পারলেই তো জেতার আনন্দ। কিন্তু ঈশ্বর যেনো আজ অন্য কিছু ভেবে রেখেছিলেন, একটা মারুতি কে ওভার টেক করতে গিয়েই সামনে থেকে হঠাৎ করেই উল্টো দিক থেকে একটা ডাম্পার ঝড়ের বেগে চলে এলো। ছিটকে পড়ল দুজনে ,মায়ার ভাগ্য টা হয়তো ভালো ছিল তাই সে ছিটকে পড়ল রাস্তার ধারে থাকা স্তুপীকৃত জঞ্জালে ,ডানহাতে সামান্য চোট ছাড়া আর কিছুই হয়নি তার। কিন্তু মৃণালের হেলমেট হিন মাথাটা ধাক্কা খেলো পাশের লাইট পোস্টে। ডাম্পারটা সজোরে ব্রেক কষায় মৃণালের দেহ টা চাকার তলায় গেলো না।
রাস্তা ভেসে যাচ্ছে লাল রক্তে, মায়া এই দৃশ্য দেখে একদম স্থবির হয়ে গেছে। আসে পাশের লোকজন ছুটে আসে। প্রায় মরণাপন্ন মৃনাল কে নিয়ে এম্বুলেন্স ছুটলো, মায়া কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে, তার চারিদিক যেনো অন্ধকারের চাদরে ঢেকে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। তারা যে কমপ্লেক্সে থাকে সেই কমপ্লেক্সের একজন পরিচিত, ভাগ্যক্রমে সেই মুহূর্তে ওখানেই ছিলেন, তিনিই সমস্ত ব্যবস্থা করলেন, বাকি আত্মীয় দের খবর দিলেন।
এম্বুলেন্স পৌঁছালো শহরের নামি হাসপাতালের Trauma Centre এর সামনে, ওখান থেকে মৃনাল কে নিয়ে সোজা অপারেশন থিয়েটার। দরজা বন্ধ হওয়ার পরই লাল লাইট টা জ্বলে উঠলো। গত তিন ঘণ্টায় মায়া একবিন্দুও বসেনি, উদভ্রান্তের মত পায়চারি করছে। মা বাবা দাদারা ছুটে এসেছে,তারাও একরাশ উদ্বেগ নিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে বন্ধ দরজার দিকে। মৃণালের দাদা ছুটেছে রক্ত আনতে, একের পর এক শহরের নামি হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংক থেকে নিরাশ হয়ে ফিরতে হচ্ছে তাকে,কারণ মৃণালের যে rare blood group ( AB negative)।এদিকে যে সময় চলে যাচ্ছে। এক্ষুনি যে রক্ত না দিলেই নয়। ওদিক থেকে সবাই বার বার ফোন করছে, একটাই প্রশ্ন,রক্ত পেলি? এদিক থেকে এখনো পর্যন্ত রক্ত না পাওয়ার খবরে একটা কান্নার রোল উঠলো। কিন্তু মায়ার চোখের জল যেনো সব শুকিয়ে গেছে।
হঠাৎ করেই অপারেশন থিয়েটারের দরজাটা খুলে, একজন সারা শরীরে গাউন পড়া, মাস্ক দিয়ে মুখ ঢাকা মহিলা মুখটা বাড়িয়ে খোঁজ নিলেন ব্লাড এসেছে কিনা। কোনো সদুত্তর না পেয়ে আবার ঢুকে গেলেন। একটু পরেই দরজা খুলে ডাক্তার বাবু বেরিয়ে এলেন। ধমকে উঠলেন, আপনারা এখনো রক্ত টা আনতে পারেননি?? পেশেন্ট এর অবস্থা তো আরও ক্রিটিক্যাল হয়ে যাচ্ছে। মায়াময়ী ছুটে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ডাক্তার বাবু আমার হাজবেন্ড বেঁচে যাবেন তো।ডাঃ ঘোষ গুরুগম্ভীর গলায় বললেন, মাথার হার ভেঙে ব্রেইন এর মধ্যে ঢুকে গেছে,অনেক টাই ক্ষতি হয়েছে। আমরা বিখ্যাত নিউরো সার্জন ডাঃ অভিরুপ গাঙ্গুলি কে অনুরোধ করেছি যাতে উনি একটু আসেন, রুগীর যা অবস্থা ,একমাত্র উনিই পারবেন এই রুগীকে জীবন দান করতে, বাকিটা সবই ওই উপরওয়ালার হাতে।
অভিরুপ গাঙ্গুলি, নামটা শুনেই মায়াময়ীর মাথা টা কেমন ঘুরে গেলো ,অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালো সে। গলার কাছ টা কেমন যেনো শুকিয়ে আসছে, একটা দম বন্ধ করা কান্না দলা পাকিয়ে আটকে গেছে, বুকের কাছটা ভারী হয়ে আসছে। দর দর করে ঘামতে লাগলো সে, এ কি সেই অভি?? না না তা কীকরে হয় ,সে তো ডাক্তার নয় , সেতো ছিল সাদামাটা একটি সাধারণ নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে।
দশটা বছর আগে যাকে ছেড়ে সে চলে এসেছিল, আরও আরও ভালো থাকার লোভে। অভির মত সাধারণ একটা ছেলের ভালোবাসার জন্য তো আর সে নিজের ভবিষ্যৎ জীবন টাকে অনিশ্চিত করতে পারে না।
ডাঃ ঘোষ চেঁচিয়ে উঠলেন এই তো ডাঃ গাঙ্গুলী এসে গেছেন, বলেই দৌড়ে গেলেন ওনার সামনে। আসুন স্যার আসুন, মনে বলল পেলাম স্যার, আপনি ছাড়া এই পেশেন্ট আমরা বাঁচাতে পারবো না স্যার । মায়াময়ী যেনো সম্বিৎ ফিরে পেলো। একি একি দেখছে সে, সেই মুখ, সেই চোখ,সেই চেহারা, সেই চলন। যেনো দশ বছর আগের সেই অতি সাধারণ ছেলেটি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। এতো বড় ডাক্তার তবু সে আগের্ মতই সাদামাটা, শুধু চুলের পাশ টা একটু পাক ধরেছে।সামান্যতমও অহংকার তাকে স্পর্শ করতে পারেনি।
দুজন মিলে এগিয়ে চললেন ওটির দিকে। অভি কি এক ঝলক তাকালো তার দিকে, চিনতে পেরে যেনো একটু থমকে দাঁড়ালো, নাকি তার মনের ভুল। দরজা দিয়ে ঢোকার মুখে অভি একবার ফিরে তাকালো মাত্র , দরজা টা বন্ধ হয়ে গেলো। অভি কি একটা ব্যাঙ্গের হাসি ছুঁড়ে দিলো। হাত পা সব অবশ হয়ে আসছে, মায়া জ্ঞান হারালো।
কিছুক্ষণ পরেই জ্ঞান ফিরল মায়ার , মায়ের কোলে মাথা দিয়ে সে ওটির সামনে মেঝে তেই শুয়ে আছে। ধড়মড়িয়ে উঠতে যেতেই মা আবার শুইয়ে দিলেন। অপারেশন কি হয়ে গেছে মা। দরজা টা বন্ধ কেনো এখনো। মা তার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, কিছু হবে না দেখিস, সব ঠিক হয়ে যাবেন, ঈশ্বর ঠিক আছেন। আজ মাকে বড্ড আপন মনে হচ্ছে, এই মাকেই একদিন মায়া অহংকারে অন্ধ হয়ে তাড়িয়ে দিয়েছিল নিজের ফ্ল্যাট থেকে। অকৃতজ্ঞের মত অস্বিকার করেছিল মাকে। আজ হয়তো তারই পাপের ফল তার জীবনে অভিশাপ হয়ে নেমে এসেছে।
বেলা প্রায় দশটা বাজে, প্রত্যেকটা মানুষ পলক হীন ভাবে এক অজানা আশঙ্কায় প্রত্যেকটা মুহুর্ত গুনছে যেনো, একেবারে শ্মশানের নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে, দেওয়ালে লাগানো ঘড়ির কাঁটা টা শুধু টক টক করে জানান দিচ্ছে,সময় হয়তো শেষ, এই বুঝি সব আশার অবসান ঘটলো।হঠাৎ করে তীব্র শব্দ করে দরজা টা খুলে গেলো, লাল বাতিটাও যে কখন নিভে গেছে কেউ খেয়াল করেননি। ডাঃ ঘোষ বেরিয়ে এলেন, মায়ার হৃদপিণ্ড টা যেনো এইবুঝি বন্ধ হয়ে যায়। সবাই দৌড়ে গেলেন ডাক্তার বাবুর দিকে। এক অধির অপেক্ষায় অনেকগুলো করুন চোখ ডাঃ ঘোষ কে ছেঁকে ধরেছে।
অপারেশন সাকসেসফুল, দ্রিপ্ত কন্ঠে জানালেন ডাঃ ঘোষ। একটা মিরাকল ঘটে গেলো, আপনাদের পেশেন্ট কে একটু বাদেই আইসিইউ বেডে দেওয়া হবে, তবে বাহাত্তর ঘণ্টা না গেলে কিছু বলা যাচ্ছে না। ডাঃ ঘোষের পায়ে লুটিয়ে পড়ল মায়া,চোখের জল এবার আর ধরে রাখতে পারল না সে। মৃণালের বৃদ্ধ বাবা ডাঃ ঘোষের হাত টা ধরে কেঁদে দিলেন। এবার ডাঃ ঘোষ বললেন, না না ধন্যবাদ আমাকে নয় , আপনার ছেলে কে বাঁচাতে স্বয়ং ভগবান যে ওটি তে ছিলেন, যমের সাধ্যি আছে তাকে নিয়ে যাবার। ডাঃ গাঙ্গুলীর হাতে জাদু আছে, উনি মরা মানুষ কেও বাঁচিয়ে দিতে পারেন। শুধু যে উনি অপারেশনটা দক্ষ হাতে সামলেছেন তাই নয়, একটা সময় এমন অবস্থা হয়েছিল যে রক্ত আর না দিলেই নয়, এদিকে আপনারা তো রক্ত জোগাড় করতে পারেননি। সেখানেও ত্রাতা তিনিই, শেষে ওটি ছেড়ে ডাঃ গাঙ্গুলী নিজে গিয়ে ব্লাড দিয়ে আসেন। উনি হলেন ইউনিভার্সাল ডোনর, উনি চাইলে সবাই কে রক্ত দিতে পারেন। মৃণালের বাবা বললেন আমরা কি ভগবানের দেখা পাবো না?? অবশ্যই পাবেন, উনি নিজে আপনাদের সাথে কথা বলবেন, তবে আপনারা একটু অপেক্ষা করুন , উনি একটু ফ্রেশ হয়েই আপনাদের ডেকে নেবেন ওনার কেবিনে। মায়া যেনো উঠে দাঁড়ানোর শক্তিটাই হারিয়ে ফেলেছে, লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছে সে।
প্রায় ছয় ঘণ্টার প্রচেষ্টায় পেশেন্ট কে সারভাইভ করানো গেছে, একটা যুদ্ধ জয়ের পরিতৃপ্তি নিয়ে ডাঃ অভিরূপ গাঙ্গুলী তার কেবিনে এসে গা টা এলিয়ে দিলো। অসম্ভব মানসিক স্ট্রেস নিয়ে সে অপারেশন টা সফল ভাবে শেষ করতে পেরেছে। ভোর রাতে ডাঃ ঘোষের ফোন পেয়েই অভি ছুটে এসেছে, কিন্তু ওটির বাইরে এ কাকে দেখলো সে। হ্যাঁ ঠিকই দেখেছে সে , মায়াই ছিল ওটা। এতদিন পর মায়াকে ওটির বাইরে এভাবে দেখবে টা অভি কল্পনাও করতে পারেনি। ভেবেছিল আর কোনোদিন ওই বেইমান, বিশ্বাসঘাতকের মুখোদর্শন করবে না । তার জীবন টাকে তছনছ করে চলে গেছে যে মেয়েটা, আজ তাকে এভাবে অসহায়, জবুথবু হয়ে বসে থাকতে দেখে কেমন যেনো একটা অনুভুতি হলো তার। একটু যেনো তন্দ্রা টা লেগে এসেছিল, দরজায় টক টক আওয়াজে তা ভেঙে গেলো। অভির অ্যাসিস্ট্যান্ট ঘরে ঢুকে এলো, স্যার পেশেন্ট পার্টি আপনার সাথে দেখা করতে চায়। সোজা হয়ে বসলো অভি, পাঠিয়ে দাও।
দরজা ঠেলে ঢুকলেন মৃণালের বাবা ও দাদা। না মায়া আসেনি, অভির সামনে দাঁড়ানোর সাহস টা যুগিয়ে উঠতে পারেনি সে।একদিন এই অভিকেই অযোগ্য ভেবে আরো ঐশ্বর্যের লোভে ছেলেটার পবিত্র ভালবাসাকে বিসর্জন দিয়েছিল সে, কিন্তু আজ মায়া বুঝতে পারছে যে ডাঃ আভিরুপ গাঙ্গুলীর পাশে দাঁড়ানোর যোগ্যতাই তার কোনোদিনও ছিলই না। তাই আজ লজ্জায় সে পারেনি অভির সামনে আসতে। মৃণালের বাবা কাঁপা গলায় বললেন, ডাক্তার বাবু আপনাকে কি বলে যে ধন্যবাদ দেবো জানিনা, তবে এইটুকু বুঝেছি যে আমাদের কাছে ভগবানের অবতার আপনি, আমার ছেলেটাকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছেন, বৃদ্ধ মানুষ টা আর চোখের জল সামলাতে পারলেন না।ডাক্তার বাবু আপনি অপারেশন না করলে, রক্ত না দিলে তো মরেই যেত আমার ছেলেটা, শেষ কথাটা কান্নায় জড়িয়ে গেলো।
অভি তার চেয়ার ছেড়ে উঠে এলো সাথে সাথে, ওনাকে ধরে বসিয়ে দিলো সামনের চেয়ারটায়। দেখুন আপনাদের রুগীর বা দিকের খুলির হার টা ভেঙে ভিতরে ঢুকে গিয়েছিল, অনেক টা ব্রেইন ইনজুরি হয়েছে, রোগী কে যে কোমায় যাওয়া থেকে আটকাতে পেরেছি এটাই অনেক, তবে এই ব্রেইন ইনজুরির জন্য কিন্তু তার ডান দিক টা অবশ হয়ে আছে, দেখা যাক কতটা রিকভারি হয়। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করবো ,তবে শেষ কথা বলার মালিক তো আমি নই, শেষ কথা তো বলবেন ওই উপরে যে লোকটি বসে আছেন তিনি, বলেই আকাশের দিকে আঙুল তুলল অভি। এখন বাহাত্তর ঘণ্টা টা খুব ক্রিটিক্যাল।এরপর অভি ওদের কাছ থেকে সমস্ত ঘটনা টা শুনল, বুঝতে পারল আজ যাকে সে বাঁচাতে পেরেছে, ওই বেইমান মেয়েটি তারই স্ত্রী। মনে মনে বলল, হায়রে ভগবান এ তোমার কিরকম লীলাখেলা।তার হাত দিয়েই ভগবান মায়ার সিঁথির সিঁদুর অক্ষত রাখলো।
স্যার রোগীকে বেডে দিয়ে দিয়েছে, একজন সদ্য চাকরি পাওয়া নার্স এসে বলে গেলো। অভি উঠে পড়ল, অনেক বেলা হয়ে গেছে । এবার ওকে বেরোতে হবে, যাবার আগে একবার রুগী টাকে দেখে যাবে সে। আইসিউ এর বাইরে এক কোণে মায়া একদম পাথরের মত বসে আছে,মাথা টা নত হয়ে, চুলগুলো অবিন্যস্ত,দেখেই বোঝা যায় একটা ঝড় বয়ে গেছে ওর উপর দিয়ে। ওর দিকে এক ঝলক তাকিয়েই অভি ভিতরে ঢুকে গেলো, রুগী কে একবার দেখে নিল সে, নার্স কে যাবতীয় ইন্সট্রাকশন দিয়ে বেরিয়ে পড়ল অভি, মায়া এখনই একই ভাবে বসে আছে, পাশে তার মা, কেমন যেনো একটু মায়া হলো অভির, কিন্তু সেটাকে সে আর প্রশ্রয় দিতে চায় না ।
বেলা বারোটা নাগাদ অভি বেরিয়ে পড়ল। এখন সে বাড়ি যাবে । দুপুরের খাবার সে মায়ের সাথেই খাবে, নাহলে মাও না খেয়ে বসে থাকবে। অভি কতবার মাকে বলেছে যেন তার জন্য অপেক্ষা না করে ,তার কি কোনো ঠিক আছে। একবার ওটি তে ঢুকলে কখন যে বেরোবে সে নিজেও জানেনা, তবু মা শুনবে না। কিছু বলতে গেলেই বলবে ,আগে তুই একটা বিয়ে কর বউ এসে সব দায়িত্ব নিক তারপর আমার ছুটি।আর সবার মায়েরা এখন নাতি নাতনি দের সাথে খেলা করে সময় কাটায়, আর আমার হয়েছে কপাল দেখো , এখনও ধেরে ছেলের পথ চেয়ে বসে থাকতে হয়, আমার আর এই ঘরে একা একা বসে থাকতে ভালো লাগেনা। ওফ মা তুমি আবার শুরু করলে, বলেই অভি সেখান থেকে উঠে পড়ে, কারণ সে জানে যে মা সহজে থামবেন না। আর সত্যিই তো সে মায়ের প্রতিও অবিচার করছে।
নিজের ঘরে ঢুকেই অভি , জামাটা ছেড়েই বিছানায় নিজেকে এলিয়ে দিলো, মা এক কাপ চা দিও তো।মাকে নিয়েই অভির সংসার , বাবা চলে গেছেন প্রায় পনেরো বছর হয়ে গেলো। বাবা ছিলেন সামান্য একজন চাপরাশি। তবে স্বপ্ন দেখেছিলেন যে ছেলে একদিন অনেক বড় ডাক্তার হবে, অনেক নাম হবে। ছেলেও তার মর্যাদা দিয়েছিল। ভালো ছাত্র হিসাবে বরাবরই অভির কদর ছিল সবার কাছে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় জেলার মধ্যে দ্বিতীয় হয়েছিল অভি। ডাক্তারি তে সুযোগও পেয়ে গেলো পরের বছর।। ভর্তি হলো এনআরএস মেডিক্যাল কলেজে, গ্রামের নিম্নবিত্ত পরিবারের সাদাসিধে ছেলেটি পড়তে এলো কলকাতায়, প্রথম দিকে একটু অসুবিধা হলেও আস্তে আস্তে সে এই পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছিল। হঠাৎ করেই ছন্দ পতন হলো। সামনে প্রথম এমবিবিএস পরীক্ষা, হোস্টেলের ঘরে দিনরাত এক করে এনাটমি, ফিজিওলজি আর বায়োকেমিস্ট্রির সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছে সবাই,বাড়ি থেকে খবর এলো বাবার স্ট্রোক হয়ে গেছে, গ্রাম থেকে বাবা কে নিয়ে এনআরএস এ আসার পথেই সব শেষ।
বাবা চলে গেলেন, মাথার উপর যেনো আকাশ ভেঙে পড়ল। মায়ের কাছে পুঁজি বলতে কিছুই ছিল না। বাবার পেনশনের সামান্য টাকায় পেট চলে যাবে হয়তো কিন্তু অভির ডাক্তারি পড়ার খরচ, বই কেনা বা খাওয়া দাওয়ার খরচ কীকরে চলবে।অভির মাথায় তখন একটাই কথা ঘুরছে, ডাক্তারি পড়া সে ছেড়ে ফিরে যাবে গ্রামে, কিন্তু বাধ সাধলেন মা।বাবার শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে না পারলে যে সেই মানুষটার আত্মও শান্তি পাবে না, অগত্যা এই দোলাচল অবস্থাতেই পরীক্ষায় বসলো সে, কোনরকমে পাশ করলো অভি। কিন্তু আরও চারটে বছর কিভাবে সে সব কিছু সামলাবে সেই চিন্তাই অভিকে শেষ করে দিচ্ছিল।
এভাবেই কেটে গেলো আরও ছটা মাস, এখনো কিছু বই কিনে উঠতে পারেনি সে। প্যাথলজি, মাইক্রোবায়োলজি বই সিনিয়র দাদাদের কাছ থেকে নিয়ে চলে যাচ্ছে, মা ধারদেনা করে মাঝে মাঝে যা টাকা পাঠায় সেটা দিয়ে অন্তত খাওয়া খরচ টা উঠে যায়। দুটো সেমিস্টারের টাকা বাকি পড়েছ। না দিতে পারলে হয়তো দ্বিতীয় এমবিবিএস পরীক্ষায় বসতেই দেবেনা।জানেনা সে এভাবে আর কতদিন চলবে। এরই মধ্যে তার রুম মেট রজত একদিন এসে বলল, অভি তুই তো পড়াশুনায় খুব ভালো , তুই কেনো টিউশন করছিস না। এই কথা টা তো অভি কখনও ভেবে দেখেনি। প্রস্তাব টা তো মন্দ নয়। মুখে বলল,আমি তো এখানের কিছুই চিনি না ,আমাকে টিউশন কে দেবে। রজত বলল সে না হয় আমি দেখে দেবো, তুই শুধু রাজি কিনা বল। অভি আগ্রহ প্রকাশ করে বলল ,সে না হয় পড়াবো কিন্তু কাকে পড়াবো সেটা তো বলবি।
শোন আমার মাসির ননদ ,আমাকে খুব স্নেহ করেন, আমি ডাক্তারি পাওয়ার পর থেকেই আমাকে তার ছোট মেয়েটা এগারো ক্লাসে পড়ে, তার জন্য একটা ভালো মাস্টার খুঁজে দিতে বলেছেন, আমি এতদিন গরোজ করিনি । কিন্তু ভেবে দেখলাম যে তোর মত ছেলেই ওকে পড়ানোর জন্য বেস্ট, বাড়িও বেশি দূরে নয়, এই তো মানিকতলায়, হেঁটেই চলে যেতে পারবি।তারপর মাস গেলে যা দেবে তাতে তোরোও হেসে খেলে চলে যাবে। হাতে যেনো চাঁদ পেল অভি। কিছু না ভেবেই রাজি হয়ে গেলো। তাহলে ওইকোথায় রইলো , আমি একদিন তোকে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দিয়ে আসবো ক্ষণে। তবে একটা কথা বলে রাখি তোকে,তুই যে ডাক্তারি পড়ছিস সেটা কিন্তু বলবি না ওদের কে। অভি ও ভেবে দেখলো সত্যিটা না বলাই ভালো, বরং বলে দেবে যে সে গ্রাম থেকে এসেছে, চাকরির চেষ্টা করছে , তাই এখন নিজের খরচ চালানোর জন্য টিউশন করছে।
রজতের সাথে অভি প্রথম গেলো টিউশন করতে, রজত ওদের কে আগেই সব বলে রেখেছিলো। মাসিমা অমায়িক মানুষ,একেবারে তার মায়ের মত মমতাময়ী। মেসোমশাই নিজে ডাক্তার তাই তাদের স্বপ্ন যে তাদের এক মেয়ে অন্তত ডাক্তার হবে, বড়মেয়ে ডাক্তার দের একদম অপছন্দ করে , ভাবে ডাক্তার গুলো সব পাষাণ, এরা শুধুই পড়াশুনা ছাড়া কিছুই বোঝে না। তার ধারণা জীবনে ভালো ভাবে বাঁচতে গেলে ঘুরতে হবে, বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারতে হবে, জীবন টাকে এনজয় করতে হবে। তাই সে ফিজিক্স অনার্স নিয়ে এবছরই কলেজ ভর্তি হয়েছে। তাই মাসিমা এখন তার ছোট মেয়েকে ডাক্তার বানাতে উঠে পড়ে লেগেছেন। এখন মাসের শেষ প্রায়, তাই কথা হলো সামনের মাস থেকেই অভি পড়াতে শুরু করবে, মাস গেলে পাঁচশো টাকা মাইনে, শুধু তাই নয় একমাসের টাকা অগ্রিম ও দিয়ে দিলেন মাসিমা।অগ্রিম যা টাকা পেয়েছিল ,সেখান থেকেই সমস্ত ফি দিয়েও বেশ কিছুটা বেঁচে গেলো তার, মাকে বলে দিলো এইমুহুর্তে আর টাকা পাঠাতে হবে না। সকালে মন দিয়ে ক্লাস করা আর বিকালে সপ্তাহে সে তিনদিন যাবে পড়াতে আর বাকি দিন গুলো নিজের পড়াশুনা করা।
কি রে ঘুমিয়ে পরলি নাকি, দেখো ছেলের কান্ড, আমাকে চা আনতে বলে বাবু ঘুমাচ্ছেন। মায়ের ডাকে অভি ধড়ফড় করে উঠে পড়ল, চোখটা একটু লেগে এসেছিল। শরীর টা খুব টায়ার্ড লাগছে। চায়ে চুমুক দিয়ে অভি স্মৃতির ভেলায় ভাসতে থাকলো আবার। মাসিমাদের বাড়ির ছোট মেয়ে ছায়া কে অভি পড়াতে শুরু করলো। কি আপনার ছাত্রী ভালো করে পড়াশুনা করছে তো, হঠাৎ করে একটা মেয়ের গলা শুনে অভি চোখ তুলে তাকালো। মিষ্টি দেখতে একটা মেয়ে অভির সামনে দাড়িয়ে আছে, চোখে মুখে চঞ্চলতার ছাপ স্পষ্ট। নিন চা টা নিন , মা আপনার জন্য পাঠিয়ে দিলো। মেয়েটার চোখে একটা আকর্ষণ আছে ,অভি কিছুতেই তার থেকে চোখ সরাতে পারছিল না। হা করে দেখছেন কি , নিন চা টা ধরুন , মেয়েটি একটু বিরক্তি ভাব নিয়ে টেবিলে কাপ টা রেখে চলে গেলো। স্যার কিছু মনে করবেন না ,আমার দিদি একটু ওরকমই ,ছায়া বলে উঠলো। অভি আবার পড়াতে মনোনিবেশ করল, কিন্তু মেয়েটা যেনো তার মনের ভিতরে একটা আলোড়ন ফেলে দিয়ে গেলো। এরপর থেকে মায়া মাঝে মাঝেই সুযোগ পেলেই অভি কে বিরক্ত করতে শুরু করলো। গ্রামের এই সাধাসিধে ছেলেটার সারল্য তাকেও আকর্ষণ করত, কিন্তু বাইরে বাইরে একটা তাচ্ছিল্যের ভাব।
মা বলেছে আপনি নাকি ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র, অভি একটু লজ্জাই পেলো, মুখে কিছু বলতে পারলো না, আমি ফিজিক্স এর একটা সমস্যা বুঝতে পারছি না একটু বুঝিয়ে দেবেন, মায়া মনে মনে ভাবলো ,এবার এই গাঁয়ের ভূত টাকে একটু শায়েস্তা করার সুযোগ পেয়েছি। সে ভেবেছিল অভি বোঝাতে পারবে না। কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে অভি বলল ,দিন আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি। আজ অভি যেভাবে মায়াকে অনায়াসে বুঝিয়ে দিলো, এতো সুন্দর ভাবে আজ পর্যন্ত কেউ মায়াকে বোঝায়নি। অভির প্রতি যে আকর্ষণ টা মায়া অনুভব করেছিল তা আজ শতগুণ বেড়ে গেলো।এর পর থেকে অভি ছায়াকে পড়াতে আসলেই, না না অজুহাতে মায়া চলে আসতো এই ঘরে। অভিও আস্তে আস্তে আড়ষ্টতা কেটে মায়ার সাথে সহজ হয়ে কথা বলা শুরু করলো।
অভি বুঝতে পারছিল এই মেয়েটার আকর্ষণ কে সে উপেক্ষা করতে পারছে না। কিন্তু মায়া কে তার মনের কথা বলার সাহস সে যুগিয়ে উঠতে পারেনি, তাছাড়া সে গ্রামের এক গরীব ছেলে ,আর মায়া হলো বড়লোক ঘরের উদ্দাম, উচ্ছল একটি পেয়ে, দুজনের মধ্যে কার ফারাক টা খুব প্রকট। তাই অভি তার মনের কথা টা মনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিলো। যদি কখনো সুযোগ হয় তবাকেবারে ডাক্তারি পাশ করে তবেই সে মায়াকে নিজের মনের কথা জানাবে। কিন্তু মায়া যেনো তার মন পড়ে ফেলছিল, কিছুতেই সে নিজের আবেগ গুলো লুকিয়ে রাখতে পারছিল না, ধরা পড়ে যাচ্ছিল মায়ার কাছে। মায়াও যেনো সুযোগের অপেক্ষায় ছিল।
প্যাথলজি প্রাকটিক্যাল ক্লাস টা শেষ হতে একটু দেরি হয়ে গেলো, অভি হোস্টেলের ঘরে ঢুকে বইপত্র রেখেই ছুটছে, একটু কিছু খাওয়ারও সময় হয়নি। ছায়াদের বাড়ির সামনের মোড়ে মায়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু অবাকই হলো সে। এই যে এসে গেছেন, আমি আপনার জন্যই দাঁড়িয়ে আছি, আজ ছায়া বাড়ি নেই। তাই আজ আর পড়াতে হবেনা, চলুন তো কোথাও একটু বসি, আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে। এক নিশ্বাসে পুরোটুকু বলে তবে থামলো মায়া। অভি কি বলবে বুঝতে না পেরে বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলো। মায়া এবার রেগে গিয়ে বলল আপনি কি যাবেন নাকি এভাবেই রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকবেন। আচ্ছা চলুন বলে অভি মায়ার পাশে হাঁটতে থাকলো। সামনেই একটা পার্কে গিয়ে ওরা বসলো, সন্ধে হয়ে আসছে তাই মানুষ জন সব ঘরমুখী। মুখচোখ তো দেখে মনে হচ্ছে সারাদিন কিছুই পড়েনি পেতে। সারাদিন না খেয়ে এভাবে চাকরির খোঁজে ঘুরে বেড়ালে তো শরীর টা অসুস্থ্য হয়ে পড়বে। অভি মাথা বে নিচু করে বসে আছে। রজতের কথা মনে পড়ল, সে মাসিমা কে বলেছিল যে অভি চাকুরীর খোঁজে গ্রাম থেকে এখানে এসেছে। অভিও চাইনি মায়াকে সত্যি টা বলতে। সত্যিটা চাপাই থাক না ,আর তো দেড়টা বছর। এখন সত্যিটা বললে আবার টিউশন টাই চলে যায় তাহলে অভির চলবে কীকরে। অগত্যা চুপ থাকাই ভালো। এদিকে মায়া বাগ থেকে একটা টিফিন বক্স বের করলো, কলেজে যাওয়ার সময় নিয়ে গিয়েছিলাম, দুজনে একসঙ্গে খাবো বলে রেখে দিয়েছি। অভি ইতস্তত করছে দেখে মায়া রেগে গিয়ে বললো, ও মশাই একটা কথা বলুন তো, আপনি কি আমাকে ভালবাসেন?? অভি লজ্জায় মাথা নত করলো। আমি জানি আপনি আমাকে ভালবাসেন, আর আমিও আপনাকে পছন্দ করি, তাই দয়া করে এসব লজ্জা, ন্যাকামো গুলো বন্ধ করে এবার খান তো দেখি, অভি কিছু বুঝে ওঠার আগেই মায়া তার মুখে খাবার তুলে দিলো। অভিও বাধ্য ছেলের মত খেতে শুরু করলো।
আজ অভির মনের মধ্যে কি চলছে তা সে ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে না, তার মতো একটা গরীব , ছাপোষা ছেলের কাছে তার স্বপ্নের নারী এভাবে আকস্মিক ভাবে নিজেকে সপে দেবে, অভি কি স্বপ্ন দেখছে নাকি সত্যিই তার ভালবাসার নারী তার পাশে বসে তাকেই নিজের হাতে খাইয়ে দিচ্ছে। অনেক কষ্টে সাহস জোগাড় করে অভি বলল আপনি কি সত্যিই আমাকে,…., অভির কথা শেষ হওয়ার আগেই মায়া বলে উঠলো, আবার আপনি, তুমি বলতে কি কষ্ট হচ্ছে? অভি মায়ার হাত টা ধরে বলেছিল, আমি জানিনা আপনি, মানে তুমি আবেগে একথা বলছ কিনা, হয়তো আবেগ চলে গেলে আবার ভুলেন যাবে আমাকে, তবে আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি ,জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত শুধু তোমাকেই ভালবাসবো। আচ্ছা সেসব দেখা যাবেক্ষণ ,এখন চলো দেখিব বাড়ি যাবো, অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। ওরা উঠে পড়ল, মায়া কে বাড়ির সামনে ছেড়ে দিয়ে অভি বাকি রাস্তা টা যেনো ঘোরের মধ্যে ছিল, হোস্টেলে ফিরেই শুয়ে পড়ল। না আজ আর পড়াশুনা হবে না, কিছু মাথায় ঢুকবে না । প্রথম ভালবাসা, প্রথম কোনো নারীর স্পর্শ এখনো তার হাতে লেগে আছে। আজ অভি নতুন করে নিজেকে উপলব্ধি করলো।
এরপর প্রায় দিনই বিকাল টা ওরা একসাথে কাটাতে থাকলো, অভির মধ্যে যে একটা পরিবর্তন এসেছে টা তার বন্ধুরাও বুঝতে পারল। একদিন রজত হেসে বলেই ফেলল, কি মামু প্রেমে পড়েছ বলে মনে হচ্ছে। অভি সাবধান হলো, না রজত কে বলা যাবে না, মুচকি হেসে এড়িয়ে গেলো।
অভি নিজে নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে লড়াই করে উঠে এসেছে তাই সে জানে যে লড়াই টা কত টা কঠিন, তবে ছোটবেলা থেকেই অভির মধ্যে একটা মনুষ্যত্ব বোধ কাজ করত। গ্রামে সময় পেলেই সে ছোট ছোট গরীব বাচ্চাদের পড়াতে বসত । তখন থেকেই অভি একটা স্বপ্ন দেখতো, তার নিজের হাতে গড়া একটা আশ্রম থাকবে, সেখানে ঐসব গরীব বা অনাথ বাচ্চাদের জন্য একটা পাঠশালা থাকবে । সেখানে পুঁথিগত বিদ্যার সাথে সাথে মানুষ হওয়ার শিক্ষায় আলোকিত হয়ে অনেক অনেক গরীব, অনাথ ছেলে মেয়ে সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত হবে। সে শুধু অপেক্ষায় আছে, কবে সে ডাক্তারি টা পাস করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে। অভি তার এই স্বপ্নের কথা মায়াকেও বলেছিল। দেখো মায়া আমাদের একটা আশ্রম থাকবে, তার নাম হবে মায়াময়ী ভবন , সেখানে অনেক অনেক অনাথ বাচ্ছা কে আমরা নিজের ছেলে মেয়ের মতো মানুষ করব, তুমি আমার পাশে থাকবে তো। মায়া খিলখিলিয়ে উঠেছিল – সে দেখা যাবেক্ষণ, আগে নিজে কিছু করে দেখাও। অভি আর কথা বাড়ায়নি।
এই ভাবেই কেটে গেলো একটা বছর ,দুজন মিলে একসাথে অনেক স্বপ্ন দেখেছে, একে অন্যকে ছেড়ে না যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছে। মায়া সবসময় বলতো , তোমার থেকে বেশি আর কেউ আমাকে ভালবাসতে পারবে না, তুমি আমাকে কখনো ছেড়ে যাবে না তো। অভি জানে যে সে একবার যখন সম্পর্ক গড়েছে তখন কোনোদিনও সেখান থেকে বেরিয়ে আসবে না ,কারণ তার শিক্ষা দীক্ষা, চরিত্র টাই এরকম। মানুষ ঠকিয়ে, মানুষের বিশ্বাস ভেঙে কখনও ভালো থাকা যায়না।সে মায়াকে ভালবেসে যে সম্পর্কে গড়েছে, তা তার কাছে এক পবিত্র বন্ধন। কিন্তু কোথাও যেনো সারাক্ষণ মায়া কে হারিয়ে ফেলার আশঙ্কায় ভুগত। সে মায়াকে রন্ধে রন্ধে চেনে,মায়া খুব ক্যাজুয়াল চরিত্রের একটা মেয়ে। ভালবাসা বা সম্পর্কের পালন এই শব্দ গুলোর মূল্যবোধ বোঝার মত চরিত্র বা মানসিকতা কোনোটাই তার নয়। আনন্দ করো ,ফুর্তি করো , নিজের মতো থাকো ,এটাই তার জীবন। তাই আরও ভালো থাকার লোভে মায়া যখন তখন সম্পর্ক ছেড়ে পালিয়ে যেতে পারে ,এই আশঙ্কা অভির মধ্যে আস্তে আস্তে দানা বাঁধতে লাগলো। তাই অভিও আরো আরও বেশি ভালবাসা দিয়ে মায়াকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইল। কিন্তু মায়া অন্য ধাতুতে গড়া একটি মেয়ে। অভির অতিরিক্ত ভালবাসা, অতিরিক্ত যত্নশীল মনোভাব মায়ার কাছে একটা দমবন্ধ পরিবেশ মনে হতে শুরু হলো। এই নিয়ে মায়ার সাথে মনোমালিন্য হওয়া শুরু হলো। অভি প্রমাদ গুনলো।
ঘুম টা ভেঙে গেলো মায়ের ডাকে, যা বাবা স্নান টা করে নে। বেলা তিনটে বেজে গেলো, ভাত খাবি কখন শুনি। সত্যিই তো অনেক দেরি হয়ে গেছে , অভি উঠে পড়ল, তাড়াতাড়ি স্নান , খাওয়া দাওয়া করে বেরোতে হবে, বিকাল পাঁচটায় আবার চেম্বার আছে। আজ আর কোনো ওটি নেই, যদিনা কোনো ইমারজেন্সি হয়। বিকালে পেশেন্ট দেখতে বসেও ঘুরে ফিরেই মায়ার মুখ টা মনে পড়ে যাচ্ছে। রাতে একবার মায়ার স্বামী কে দেখে তবে বাড়ি ফিরবে। অভি কুড়িটার বেশি পেশেন্ট দেখেনা , তাই শেষ হতে হতে রাত আটটা বজলো। হাসপাতালে যখন পৌঁছালো তখন প্রায় রাত নটা। এতো রাতে অভি যে পেশেন্ট টাকে দেখতে আসতে পারে টা হাসপাতালের কেউ ভাবতেই পারেনি, খবর পেয়ে ডাঃ ঘোষ দৌড়ে এলেন। আইসিইউ এর সামনেটা এখন একটু ফাঁকা, এককোনে মায়া ও তার মা বসে আছে, ওদিকে তাকাতেই মাসিমার সাথে চোখাচোখি হলো, অভি সামান্য হাসলো, ছায়াও এসেছে আজ, অনেক বড় হয়ে গেছে ছায়া, ছোট্ট সেই ছাত্রী থেকে আজ সে এক বিবাহিতা নারী।মায়ার শশুর এগিয়ে এলেন।অভি চোখের ইশারায় তাদের অপেক্ষা করতে বলে ভিতরে চলে গেলো। রুগীর সমস্ত কিছু পরীক্ষা করে ডাঃ ঘোষ কে বলল, পেশেন্ট রিকভার করে যাবে মনে হচ্ছে , দেখা যাক। প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে অভি বেরিয়ে এলো, সে নিজেই মায়ার শশুরের দিকে এগিয়ে গেলো। আপনারা এবার বাড়ি যান, কোনো একজন রাতে থাকুক ,বাকিরা বাড়ী চলে যান, আমরা তো আছি। এবার সে মায়ার মায়ের দিকে এগিয়ে গেলো, স্যার ভালো আছেন,ছায়া বলে উঠলো। কোনো উত্তর না দিয়ে সে মাসিমার হাত টা ধরে বলল, চিন্তা করবেন না মাসিমা, আপনার ছেলে ঠিক আপনার জামাই কে ফিরিয়ে আনবে। মাসিমার চোখ থেকে জলের ধারা বইতে লাগলো। অভি বেরিয়ে পড়ল, একটা বারের জন্যও সে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মায়ার দিকে ফিরেও তাকাল না, হয়তো তাকালে দেখতে পেতো একজনের দুটো চোখ শুধু তার দিকেই নিবদ্ধ ছিল।
বাড়ী পৌঁছিয়ে অভি বাথরুমে ঢুকলো, অনেক্ষন ধরে স্নান করলো, একটা অজানা অস্বস্তি শরীর মনকে গ্রাস করছে। আজ এতদিন পর মায়ার করা সব বিশ্বাসঘাতকতা, মিথ্যাচারিতা আর বেইমানী গুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে। মায়ার বলা প্রত্যেক টা কথা আজও অভির কানে বাজে, আজ আবার সেই বিরক্তি ভাব গুলো ফিরে আসছে , দিনের পর দিন যে দুর্বিষহ যন্ত্রণা অভি সহ্য করেছে, সেই কষ্টের স্মৃতি গুলো যেনো আবার একবার জীবন্ত হয়ে ওর চোখের সামনে ভাসছে। স্নান করে বেরিয়ে অভি শুয়ে পড়ল, মাকে বলল আজ রাতে আর খাবো না গো, শরীর টা ভালো লাগছে না।
মানুষ কতটা বেইমান হতে পারে তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ অভি পেয়েছে। হঠাৎ করেই মায়া বদলে যেতে শুরু করলো, যে মায়া অভি কে ছাড়া বাঁচতে পারবে না বলেছিল, সেই মায়ারই অভির সব কথা তেই বিরক্তি লাগতে শুরু করলো, সব কিছুতেই অভির দোষ ধরা শুরু করলো সে। অভির সাথে দেখা করা আস্তে আস্তে কমিয়ে দিলো মায়া,না না অজুহাতে দিয়ে এড়িয়ে যেতে চাইলো। অভি বুঝল মায়া বন্ধন ছেড়ে পালাতে চাইছে। মায়াদের মত সস্তা চরিত্রের মেয়েদের কাছে হয়তো সম্পর্ক গড়া আর ভাঙা তাদের মুডের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু মায়া যে ভালবাসার জাল বুনেছিল অভির সাথে, হতে পারে টা ছদ্ম কিন্তু সেই জাল ছিড়ে বেরিয়ে আসার মন্ত্র হয়তো অভির জানা ছিল না, তাই আজও সে সেখানেই আটক হয়ে আছে।
ফাইনাল পরীক্ষার আর মাত্র দুমাস বাকি, অভি ভেবেছিল মায়া যদি কোনো রাগ বা অভিমান থেকে তার সাথে খারাপ ব্যবহার করে থাকে তো পরীক্ষার পর অভি ঠিক মায়ার মান ভাঙাবে, তার সাথে সে যে ডাক্তার হয়ে গেছে সেই সুখবর টাও দেবে। কিন্তু হঠাৎ করেই মায়া যোগাযোগ বন্ধ করে দিলো, এদিকে সামনে পরীক্ষা বলে অভিও এখন আর ছায়া কে পড়াতে যাওয়া টা বন্ধ রেখেছে। মায়ার কোনো খবর নেই দেখে অভি একদিন ছায়াকে পড়ানোর অজুহাতে ওদের বাড়ি গিয়েছিল কিন্তু মায়ার দেখা পায়নি। এরমধ্যেই হঠাৎ একদিন বিকালে মায়াকে দেখলো একটি ছেলের বাইকে করে চলে যেতে। প্রথমে অভির বিশ্বাস হয়নি , কিন্তু পরে বুঝতে পারল ওটা মায়াই ছিল।অভি বুঝতে পারছিল সম্পর্ক ছেড়ে মায়ার পালিয়ে যাওয়া টা সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
এইরকম না না আশঙ্কার মধ্যেই কোনমতে পরীক্ষা গুলো শেষ করলো অভি, কদিন বাদেই রেজাল্ট বেরোলো। সবাই আশা করেছিল হয়তো এবার অভিই টপার হবে , কিন্তু সে কোনমতে পাস করলো,এভাবে ফাঁকি দিয়ে মায়ার চলে যাওয়া টা অভির জীবনে কাল হয়ে নামলো। পাশ করার পর অভি গিয়েছিল মায়াদের বাড়ি, ওটাই শেষ যাওয়া তার । ভেবেছিল এতদিন যে খবর টা সে চেপে রেখেছিলো আজ তা জানাবে ওদের। কিন্তু গিয়ে যা দেখলো তাতে অভির নিজের প্রতি ঘৃণা ধরে গেলো। ওদের বাড়িতে হয়তো আর কেউ ছিল না , শুধুই মায়া আর সেই বাইকওলা ছেলেটিকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখে অভি রাগে, ঘৃণায় ছিটকে বেরিয়ে এলো ওখান থেকে। মায়া তার প্রতি যে এতদিন শুধুই ছলনা করেছে তা আর বুঝতে বাকি রইলো না। অভির আশঙ্কাই সত্যি হলো। মায়ার মত সস্তা মনের মেয়েরা কোনোদিনও কারোর আপন হতে পারেনা।
মায়াদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে অভি দিকভ্রান্ত হয়ে হাঁটতে থাকলো। রাগে,ঘৃণায় সে থর থর করে কাঁপছে। এতদিন যে মেয়েটাকে দেবীর স্থান দিয়ে পুজো করেছে,সারাক্ষণ আগলে রাখার চেষ্টা করেছে ,নিজের থেকেও বেশি ভালোবেসেছে , সেই মেয়েটা কি করে পারল এটা করতে। অভি শুরু থেকেই জানতো মায়া খুব ক্যাজুয়াল মনের একটা মেয়ে, কিন্তু সে যে এতটাই সস্তা চরিত্রের , ভালবাসা মানে যে তার কাছে শুধুই একটু ফুর্তি, একটু সময় কাটানো তা আজ অভি উপলব্ধি করলো। না অভি আর মায়ার সাথে কোনোরকম যোগাযোগ করার চেষ্টাই করেনি, মায়াও যে আর ফিরে আসবে না অভি সেটাও খুব ভালো করেই বুঝে গিয়েছিল। এই ধরনের মেয়েরা জমা বদলানোর মত সম্পর্ক পাল্টায়। গত একবছরে কাটান প্রত্যেকটা স্মৃতি অভি কে খেয়ে ফেলছিল। এর মধ্যেই ইন্টার্নশিপ শুরু হয়ে গেছে, কিন্তু অভির মন কোথায় যেনো হারিয়ে থাকে, কাজ করতে গিয়ে বার বার সে ভুল করতে শুরু করলো, সিনিয়র দের কাছে অপদস্থ হতে থাকলো। একদিকে দিনরাত ডিউটির চাপ আর অন্য দিকে সীমাহীন মানসিক চাপ আস্তে আস্তে অভির বেঁচে থাকাটাই দুর্বিষহ করে তুলল। জীবন কে শেষ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো সে, কিন্তু পারেনি ,মায়ের মুখটা বড্ড মনে পড়ছে আজ।
কত নিদ্রাহীন রাত সে চোখের জলে বালিশ ভিজিয়েছে তা একমাত্র অভিই জানে। কিন্তু সবকিছুরই একটা শেষ আছে, ঈশ্বর ও মনে এতটাও কঠোর হয়ে থাকতে পারলেন না অভির উপর। এ কি করছে সে,নিজের জীবন টাকে কোথায় নামিয়ে আনছে সে, আর কার জন্যই বা নিজেকে শেষ করছে, একটা বিশ্বাসঘাতকের জন্য কেনই বা সে নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যত কে গলা টিপে মারছে। এই উপলব্ধিই একদিন অভিকে চোয়াল শক্ত করে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করলো। তারপর বাকিটা ইতিহাস ,কঠিন অধ্যাবসায়ের মধ্যে দিয়ে আজ অভি তার কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছেছে, আজ সে ডাঃ আভিরূপ গাঙ্গুলী, শহরের এক নম্বর নিউরো সার্জন।
সকালে অভির ঘুম টা একটু তাড়াতাড়িই ভেঙে গেলো, কাল রাতে সমস্ত পুরানো স্মৃতি গুলো আবার নতুন করে জেগে উঠে ঠিক মত ঘুমাতে দেয়নি অভি কে। না আর প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না এদেরকে। উঠে পড়ল অভি, আজ সকালের সূর্যের তেজটা যেনো একটু বেশীই গায়ে লাগছে, যেনো ফিসফিসিয়ে বলে যাচ্ছে, অভি তুমি পেরেছো, যোগ্য জবাব ভগবান তোমার হাত দিয়েই দিয়ে দিলেন।
মায়ার স্বামী আস্তে আস্তে চিকিৎসায় সারা দিতে শুরু করলো। প্রায় কুড়ি দিন বাদে তাকে আইসিউ থেকে সাধারণ বেডে দেওয়া হলো। তবে তার ডানদিক টা অবস হয়ে রইল। অভি প্রত্যেকদিন নিয়ম করে মৃনাল কে দেখে এসেছে, নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সমস্ত পরামর্শ দিয়ে এসেছে। কিনতু একটা বারের জন্যও আর পরিবারের লোকের সাথে দেখা করেনি। ডাঃ ঘোষকেই বলা ছিল,উনিই দুবেলা করে রুগীর অবস্থা মায়া ও অন্যান্য দের ব্যাখ্যা করেছেন, আশ্বাস দিয়েছেন। আসলে অভি চাইছিল না আর মায়ার মুখোমুখি হতে, চাইছিল না কোনো বেইমান, আজ নিজের স্বার্থসিদ্ধি হয়েছে বলে অভির কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুক, সে সুযোগ অভি দেবে না আর।বড্ড ছদ্ম , লোকদেখানো হবে সেটা। যদি সত্যিই তার আন্তরিকতা , কৃতজ্ঞতা বোধ থাকতো তাহলে কি আর সে অভির ভালবাসা কে এভাবে অপমান করতে পারত, এভাবে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে পারত কি?
আজ অভির জীবনে এক বিশেষ দিন ,আজ অভি মাকে নিয়ে তার আশ্রমে গেছে, সারাটা দিন সে কাটাবে ওই ছোট ছোট অনাথ বাচ্চাদের সাথে। এদিকে হাসপাতালে আজ মৃনাল কে ছুটি দেওয়া হবে। অভি গতকাল রাতেই সব ছুটির পরামর্শ দিয়ে গেছে। শুধু বাকি ফর্মালিটি গুলো পূরণ করা বাকি। মায়া এসেছে ,বাড়ির সবাই এসেছে। মৃনাল কে নিয়ে যাওয়ার জন্য হুইল চেয়ার আনা হয়েছে। এখন মৃনাল অনেক টাই সুস্থ্য। ফিজিওথেরাপির মধ্যে দিয়ে হয়তো এই দুর্বলতাও আরও কিছুটা কেটে যাবে। ডাঃ ঘোষ এসে সবাই কে তার কেবিনে ডেকে নিলেন। রুগীর অবস্থা সম্পর্কে নতুন করে কিছুই আর বলার নেই। শুধু একটা কথা জিজ্ঞাসা করি আপনাদের, ডাঃ গাঙ্গুলী কি আপনাদের পূর্ব পরিচিত, মানে উনি কি আপনাদের কেউ হন?? ঘরের মধ্যে সবাই চুপ, পিন পড়ারও শব্দ শোনা যাবে। মায়ার মনের মধ্যে টা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। কেনো বলুন তো , মায়ার শ্বশুর জিজ্ঞাসা করলেন।
কেনোনা ডাঃ গাঙ্গুলী যেভাবে আপনাদের পেশেন্ট এর যত্ন নিয়েছেন, যে ভাবে নিজের হাতে সবকিছু গাইড করেছেন তা অতুলনীয়। আপনাদের পেশেন্ট আজ সুস্থ্য ভাবে বাড়ি ফিরছে তা একমাত্র তাঁরই জন্য।সব থেকে বড় কথা হলো তিনি বলে দিয়েছেন যে একটাকাও ফি তিনি নেবেন না। আসলে কি বলুন তো ডাঃ গাঙ্গুলী দের মত মানুষ গুলো আছেন বলেই হয়তো আজও মানুষ ভগবানের পরেই ডাক্তার দের স্থান দেন। আমরা কি ওনার সাথে একবার দেখা করতে পারব না, মায়ার শ্বশুর বললেন। আজ হয়তো পারবেন না, উনি আজ আসবেন না, বলেই ডাঃ ঘোষ বেরিয়ে গেলেন।
মায়া জানে অভি আসবে না, অভি তার সাথে দেখা করবে না। একদিন এই মানুষ টা তাকে সত্যিকারের ভালোবাসা দিয়ে পূর্ণতা দিয়েছিল, কিন্তু মায়াই আরো আরও ভালো থাকার লোভে পালিয়ে এসেছিল। আজ আবার সেই অভিই মায়ার সিঁথির সিঁদুর ফিরিয়ে দিয়ে তাকে পূর্ণতা দিলো। কিন্তু আজ সে পালাবে কোথায়। আজ যে তাকে অভির সাথে দেখা করতেই হবে। মায়া ছুটে গেল রিসেপশনের দিকে। না ম্যাডাম ডাঃ গাঙ্গুলী আজ আসবেন না। কিন্তু আমাকে যে দেখা করতেই হবে ওনার সাথে। ওনার ফোন নম্বর টা কি পাওয়া যাবে দয়া করে। রিসেপশনের মেয়েটি একটু বিরক্তি হয়েই বললো, আপনি ম্যাডাম ওনার এসিস্ট্যান্ট এর সাথে কথা বলুন, এই নিন ওনার নম্বর। নম্বর টা নিয়ে মায়া ইতস্তত করতে করতে ডায়াল করলো। হ্যালো আমি মায়াময়ী বলছি, আমার পেশেন্ট আজ হসপিটাল থেকে ছুটি হবে, একটু আপনার স্যারের সাথে দেখা করা যাবে। না তো ম্যাডাম আজ স্যার কে আপনি পাবেন না, আজ স্যারের এক বিশেষ দিন, এইদিনটা উনি শুধুই ওনার ছেলে মেয়েদের সাথে কাটান। ও আচ্ছা আপনার স্যার আজ কি তার স্ত্রী ও বাচ্চাদের ছাড়া কারোর সাথে দেখা করবেন না, করুন ভাবে বলল মায়া। ওদিক থেকে আওয়াজ এলো, এমা ছি ছি তা কেনো ম্যাডাম, আর উনি তো বিয়েই করেননি আজ পর্যন্ত। সজোরে কেউ যেনো ধাক্কা মারলো মায়াকে, মনে মনে বলল বিয়ে করেনি এখনো। ফোনের ওপাশের গলা বলে চলেছে, আসলে ওনার একটা অনাথ আশ্রম আছে ম্যাডাম , উনি আজ সেখানেই ওনার অনাথ বাচ্চাদের সাথে কাটান। আমি আপনাকে ঠিকানা দিতে পারি ,খুব ইমারজেন্সি থাকলে আপনি গিয়েও দেখা করে আসতে পারেন। বলে সে ঠিকানা টা বলে দিলো।
এদিকে সমস্ত ফর্মালিটি সম্পূর্ণ করে মৃনাল কে ছুটি দেওয়া হয়েছে, হুইল চেয়ারে করে সে বেরিয়ে আসছে হাসপাতালের বাইরে । আকাশটা আজ পরিষ্কার, সূর্যের আলোয় চারিদিক টা ঝলমল করছে।মায়া আজ ঠিক করেই রেখেছে অভির সাথে দেখা না করে বাড়ি যাবে না। মৃনাল কে গাড়িতে তুলে দিয়ে সে বলল তোমরা বাড়ি যাও আমি একটু আসছি একটা কাজ মিটিয়ে। মৃনাল একটু অবাক হয়ে তাকালো , মুখে কিছু বলল না। ওরা বাড়ির পথে রওনা দিলো।
মায়া একটা ট্যাক্সি নিলো আশ্রমের ঠিকানাটা শহরের কিছুটা বাইরে, তবুও আজ মায়া যাবে ,অভির সামনে দাড়িয়ে তার কাছে ক্ষমা চাইবে, নাহলে মায়ার শান্তি নেই। অভির প্রতি যে অন্যায় সে করেছে, সেই পাপ বোধ মায়াকে আজ কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। গাড়িটা ছুটে চলেছে, কখন যে শহরের বাইরে চলে এসেছে তা মায়া খেয়াল করেনি। দুদিকে শুধুই ধু ধূ প্রান্তর আর সবুজ ধান ক্ষেতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। মায়া যখন আশ্রমের সামনে পৌঁছালো, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে,এতদিনের নিদ্রাহীন চোখ আর অবিন্যস্ত চুল, মায়াকে কেমন যেনো উদভ্রান্তের মত লাগছে।
মায়া আশ্রমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।চারিদিকে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, বড় গেট টা শুধু খোলা। ভিতরে এক প্রকাণ্ড বাড়ি।কিন্তু একি, এ কি দেখছে মায়া, গেট এর উপরে বড় বড় হরফে লেখা আশ্রমের নাম,”মায়াময়ী ভবন”। সে কি ঠিক দেখলো। ভিতরের বড় উঠোনটায় মায়ার দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে অভি,পাশে দাড়ানো ছেলে টাকে একমনে বুঝিয়ে যাচ্ছে কীকরে আজ তার মায়াময়ী ভবন কে আলোকিত করতে হবে, সাজিয়ে তুলতে হবে। জনা তিরিশেক ছোট ছোট ছেলে মেয়ে খেলে বেড়াচ্ছে। বুক টা কেঁপে উঠলো মায়ার। মাথার মধ্যে যেনো বিদ্যুৎ প্রবাহ হয়ে গেলো তার, আজকের দিনেই তো মায়া আর অভির ভালবাসা শুরু হয়েছিল। মায়া তা ভুলে গেলেও অভি আজও এই দিনটাকে পালন করে আসছে।
গেট এর মুখে ঢুকতে গিয়ে পা দুটো যে আর নড়ছে না মায়ার। অভি তার স্বপ্নের মন্দির গড়ে তুলেছে, কিন্তু মায়া যে আজ সেখানে বড্ড বেমানান। সে পারবে না সেই মন্দির কে অপবিত্র করতে। বড্ড চালাক মনে করত সে নিজেকে । কিন্তু আজ ভগবান তাকে তার আসল জায়গা টা বুঝিয়ে দিয়েছে। গো হারা হেরে গেছে সে। এক ঝাঁক অপরাধ বোধ নিয়ে ফিরে চললো তথাকথিত ভদ্র সমাজের বাইরের লোকদেখানো সাজসজ্জায় সজ্জিত বিবেকহীন, মানবিকতাহীন, ছদ্ম দর্প চূর্ণ হয়ে যাওয়া এক প্রতিনিধি, মায়াময়ী সেনগুপ্ত। দুর থেকে একবার ফিরে তাকালো সে, সন্ধ্যে নেমে এসেছে। আলোয় ঝলমল করছে অভি,ডাঃ অভিরুপ গাঙ্গুলীর স্বপ্নের মায়াময়ী ভবন।
—oooXXooo—