আপন জন (পর্ব চতুষ্মবিংশ)
কাকলি ঘোষ
“ ওমা ! তুমি বুঝি কিছুই জানো না ? কাজ করতে এসেছ আর যে বাড়িতে এসেছ তার সম্বন্ধে কিছুই জানো না ? কেমন ধারা মেয়ে তুমি গো ?”
মাথা নামিয়ে চুপ করে থাকে রিন্টি। কী করে বোঝায় কী ভাবে কোন পরিস্থিতিতে ও এই শহরে এসেছে। এরা কি ভাবতে পারবে ওর সেই দুরবস্থার কথা ? কপাল ভালো যে শিখা বৌদি এই এতদূর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে। এর পর আবার সব জেনে বুঝে কাজে আসা ? সেসব কি ওকে মানায় ?
ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কল্পনার দয়া হয় বোধ হয়। বলে ওঠে, “ আচ্ছা আচ্ছা। অত মন খারাপ করতে হবে না। শোন।এ বাড়িতে লোক মেলা। বুড়ো বাবু, গিন্নি মা। দাদা, বৌদি, বৌদির এক মেয়ে , ওই যাকে দিদিমনি বললাম আর আছে বৌদির ছেলে। ছোট। ইস্কুলে পড়ে।”
দম নেবার জন্য থামে কল্পনা। “ এছাড়াও ধর গে বুড়ো বাবুর দেখাশোনা করার জন্য আছে মান্তি, গিন্নিমার খাস ঝি সুকি, বাজার সওদা করার জন্য কানাই, বাগান দেখাশোনা করার জন্য রাখাল আর গোপাল। দাদার গাড়ি চালাবার জন্য সুবল আর বৌদির গাড়ি চালায় ভুবন।”
ততক্ষণে মাথা বনবন করে ঘুরতে শুরু করেছে রিন্টির। বাপরে ! এত লোক ! ওর হ্যাঁ হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে আবার বলতে শুরু করে কল্পনা।
“ রান্না করি আমি আর মালতী। ও এখানে থাকে না। রান্না করে দিয়ে চলে যায়। বাসন মাজার লোক আছে কানুর মা। আর ঘর দোর ওই মান্তি আর সুকি মোছে।”
“ এই এত লোকের রান্না করতে হয় তো? তোমরা দুজনে কর ?”
“ করতে হয় তো। সব আবার আলাদা আলাদা।”
“ সে কী রকম ?” অবাক হয়ে যেন নিশ্বাস নিতে ভুলে যায় রিন্টি।
“ ভাত হয় দু রকম। একটা বাড়ির লোকেদের জন্য। সেটা বাসমতী চালের। আর সবার জন্য সাধারণ চাল। তবে সেটাও খারাপ মনে কর না। যথেষ্ট ভালো চাল। বৌদির আমাদের নজর ছোট নয়। কিছু মনে করো না বলছি বলে তুমি হয়তো অমন চালের ভাত খাও ই নি কোনদিন”
সে আর বলতে ? বিলক্ষণ জানে রিন্টি। জুটত ই না। তার আবার ভালো মন্দ।
“ তার পরেতে ধর সাধারণ জনদের জন্য ডাল একটা তরকারি কোনদিন মাছ কখনও ডিম । আবার নিরামিষও হয়। সপ্তাহে একদিন মাংস। এসব রান্না করে মালতী। সেসব রান্না নিচের রান্নাঘরে হয়।”
“ নিচেও রান্না ঘর আছে ?”
“ বাহ ! থাকবে না? এই এত গুষ্টির রান্না এত সুন্দর রান্নাঘরে করলে দুদিনেই এর হাল খারাপ হয়ে যাবে।”
ঘাড় নেড়ে সায় দেয় রিন্টি। সত্যিই তো।
“ আর তুমি বুঝি বাড়ির লোকেদের রান্না কর? এখানে এই ঘরে ?”
“ হ্যাঁ। সে অনেক ফরমাসি রান্না।”
“ তুমি সব শিখে গেছ। তাই না? খুব ভালো রান্না কর। আমি জানি।”
হেসে ফেলে কল্পনা। মেয়েটা বড্ড সরল। ওস্তাদি নেই। ওপর চাপ্পা নেই। একদম সাদা মাদা। “ তুমি কী করে জানলে ? এই তো সবে পা দিয়েছ এই বাড়িতে ”
“ বাহ ! এই যে তুমি খাওয়ালে চিঁড়ের পোলাও? কী সুন্দর খেতে ! জানো সত্যি আমি জীবনে এসব খাই নি।”
ওর মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের অজান্তেই বুকে আঁচড় পড়ে কল্পনার। ভীষন মায়া হয়। প্রথমে আবার বৌদি কাজের জন্য লোক এনেছে শুনে একটু রাগ হচ্ছিল। কে জানে কেমন হবে? রান্নাঘরে যদি ঢোকায় বৌদি সে হয়ত আবার ওর কাজের ওপর কেরামতি দেখাতে আসবে। ওসব সহ্য হবে না ওর। কিন্তু এ মেয়ে তো তেমন নয়। একেবারে মাটির ডেলা। নাহ ! একে নিয়ে চলতে কোন অসুবিধে হবে না কল্পনার। বরং একে শিখিয়ে পড়িয়ে নিলে কাজে লাগবে। এক এক সময় তো আতান্তর অবস্থা হয়।
“ তোমাকে সব শিখিয়ে দেব। দেখো। কত নতুন নতুন রান্না শিখতে পারবে।”
খুশিতে আনন্দে জ্বলজ্বল করে ওঠে রিন্টির মুখ খানা। আর সেদিকে তাকিয়ে আবারও খারাপ লাগে কল্পনার। বৌদিকে বলে মেয়েটাকে ওপরের রান্নাঘরেই কাজে লাগাবে। মালতীর কাছে দেবে না। ওকে তো মান্তি, সুকি সাহায্য করে। তাছাড়া ওদের সঙ্গে মিশলে মেয়েটার এই সরলতা টা নষ্ট হবে।
ক্রমশ: