মাঝে মাঝে নিজেকে আমার নিজের কাছে অচেনা লাগে। আসলেই আমি বুঝে পাই না যে আমি সত্যি সত্যিই কি চাই ? বহু বছর পর সামনাসামনি দেখা হলো প্রেরণা আর অনুরাগের । কলিং বেল বাজার পর প্রেরণা এসে দরজা খুলে দেখে অনুরাগ বাড়ির গেটে সানসেটের তলায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। বাড়ির গেটের বাইরে দাঁড়ানো অনুরাগের মুখটা অল্প আলোতে ভালো করে দেখতে পারছিলো না প্রেরণা। প্রেরণা ডাকলো ” অনুরাগ ভিতরে এসো ।” হাতের জ্বলন্ত সিগারেটটায় শেষ টান মেরে নর্দমায় ফেলে দেয় অনুরাগ। অনুরাগ বাইরে দাঁড়িয়ে উজ্জ্বল আলোতে দাঁড়িয়ে থাকা প্রেরণার পা থেকে মাথা পর্যন্ত জরিপ করে নেবার চেষ্টা করছিলো। বুঝে নেবার চেষ্টা করছিলো প্রেরণার মধ্যে কোন প্রতিশোধ নেবার বদ মতলব আছে কিনা। তারপর একটা দীপ্তিহীন হাঁসি মুখে নিয়ে অনুরাগ ইতস্তত করে ধীর গতিতে ভিতরের দিকে এগিয়ে যায়। প্রেরণা…..ইশ ভিজে গেছো তো একদম। অনুরাগ ক্ষীণ কণ্ঠে বলে…হ্যাঁ, হঠাৎ করে প্রচন্ড বেগে বজ্র বিদ্যুৎ সহ বৃষ্টি নেমে গেলো। স্টেশনটা অত্যান্ত নিরিবিলি প্যাসেঞ্জার খুব কমই নামে এখানে। আশেপাশে কোন বাড়ী ঘর নেই। দোকান পাট যা দুটো একটা আছে সেগুলো বন্ধ হয়ে গেছে বৃষ্টির জন্য। কথা মতো ড্রাইভার আগে থেকেই গাড়ি নিয়ে প্লাট ফর্মের বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলো আমার জন্য । আমি ট্রেনে বসেই গাড়িটা বুক করে রেখেছিলাম। গাড়িতে উঠে বসার পর গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায় । কিছুতেই স্টার্ট নিল না। গাড়িতে বসে থাকার সাহস পেলাম না বিদ্যুৎপৃষ্ট হবার ভয়ে। ধারে কাছে নিরাপদে দাঁড়াবার কোন জায়গাও দেখতে পেলাম না। বাধ্য হয়ে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে তোমার এখানে আসতে হলো। তাই না ভিজে উপায় ছিল না। বৃষ্টি সম্ভবত রাতে থামবে না। প্রেরণা….তুমি এই সোফাটার কাছে দাঁড়াও আমি তোমার জন্যে পোশাক নিয়ে আসছি। প্রেরণা চলে যাবার পর অনুরাগ ড্রইং রুমের চারি দিকে তাকিয়ে দেখে যে আগে যা ছিল এতো বছর পরেও তাই আছে। অনুরাগের খুব আক্ষেপ হয় প্রেরণার প্রতি অবিশ্বাসে তার দূরভী সন্ধির কথা চিন্তা করা নিয়ে। তার বুকের মধ্যে একটা শব্দহীন কান্না অনুরণিত হতে থাকে। কিন্তু তাতেও তার ক্ষত নিরাময় হয় না। তবে মনের ভিতরের ঘা আজ সুখের টানে অনেকটাই ভুলে যাচ্ছে। বিয়ের বেশ কিছু দিন পর থেকে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে খানিক শিথিলতা তো এসেই যায় তবে তার জন্য ছেড়ে যাওয়াটা সঠিক সিধান্ত না বলেই এখন অনুরাগের মনে হয়। প্রেরণা…. এই নাও ভিজে জামা কাপড় গুলো চেঞ্জ করে নাও । সব একই রকম আছে। আমি কিছু পরিবর্তন করেনি। তুমি বসো আমি তোমার জন্যে একটু চা করে আনি l চায়ে চিনি খাও তো ? অনুরাগ….. হ্যাঁ, অল্প। প্রেরণা চা করতে চলে যায়। অনুরাগ ড্রইং রুমে টাঙানো ওদের যৌথ ফটোটা দেখে কাছে এগিয়ে যায়। আবেগে আপ্লুত হয়ে পরে বার বার ভালো করে দেখতে থাকে। তার চোখে জল চলে আসে। অতি কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে আবার সোফায় গিয়ে বসে। একটু বাদে প্রেরণা দুকাপ চা নিয়ে ড্রইং রুমে আসে। একটা কাপ অনুরাগের দিকে এগিয়ে দেয় আর একটা কাপ নিজের হাতে রেখে অনুরাগের পাশে আলতো করে সোফায় বসে । অনুরাগ….. এই সব পাল্টাওনি কেন ? প্রেরণা…. ইচ্ছা হয়নি। আসলে আমি যৌথ ঘরানাটা ধরে রেখেই জীবন কাটিয়ে যেতে চাইছি। তোমারও তো হাবভাব কথাবার্তা সব আগের মতোই আছে। সে রকম একটা পাল্টায় নি। অনুরাগ…. আসলে গুলো তো মানুষ পাল্টাতে পারে না। তবে আমি চেষ্টা করেছি কিন্ত পারিনি। কেন যেন আমার বার বার মনে হয়েছে যে আমি ঐ গুলোতেই স্বস্তি বোধ করি। প্রেরণা…. তোমার তো খিদে পেয়েছে। কখন বেরিয়েছো ? অনুরাগ….. বেরিয়েছি তো সেই ভোর বেলাতেই। দেরি হয়ে গেছে তাই ভাবলাম ফেরার পথে এই রাস্তা দিয়ে তাড়াতাড়ি করে বাড়ি পৌঁছে যেতে পারবো কিন্ত প্রকৃতি বাঁধ সাধলো। ফাঁকা নির্জন রাস্তা ধারে কাছে কিচ্ছু নেই। প্রেরণা…. অনেক রাত হয়ে গেছে। আমি তোমার জন্যে কিছু খাবার তৈরি করে আনি। খিদেয় পেটে ছুঁচোয় ডন মারছিলো তাই অনুরাগ কোন আপত্তি করলো না। প্রেরণার পিছনে পিছনে রান্না ঘরে এগিয়ে যায়। গিয়ে দেখে রান্না ঘরও সেই একই রকম আছে। অনুরাগ….. আমি তোমাকে একটু সাহায্য করতে পারি ? প্রেরণা….. না না, তার দরকার হবে না তুমি সোফায় গিয়ে বসো। তোমার অনেক ধকল গেছে সারা দিনে। প্রেরণা….. অনুরাগ খেতে বসো। আনুরাগ….. তুমি খাবে না ? প্রেরণা…..না, আমি তো রাতের খাবার খেয়ে নিয়েছি। অনুরাগ….. না, তোমাকেও খেতে হবে। অনুরাগ খাবারটা দু ভাগ করে এক ভাগ নিজে নিল আর অল্প পরিমানের ভাগটা প্রেরণাকে দিল। খেতে খেতে অনুরাগ এক বার তীক্ষ্ণ চোখে প্রেরণার দিকে তাকালো। একটা দীর্ঘশ্বাস গড়িয়ে এলো অনুরাগের গলার ভিতর দিয়ে। অনেক না বলা কথা বাগ্ময় হয়ে উঠছিলো খেতে বসে দুজনের মধ্যে। আজ তারা দুজন অনাত্মীয় নারী পুরুষ। ঝড় বৃষ্টির গভীর রাতে নিস্পৃয় চোখে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে মাঝে মাঝে । অনুরাগ…. তুমি এই ভাবে বিচ্ছিন্ন জীবন কাটাচ্ছ কেন ? এই কথা শুনে প্রেরণার মুখোমন্ডল পাংশু বর্ণের হয়ে যায় নিমেষের মধ্যে। প্রেরণা….তোমার মধ্যে কি অপরাধ বোধ কাজ করছে ? অনুরাগ….. না, অপরাধ বোধ ? না তো । প্রেরণা….. তবে কি করুণা আসছে আবেগ তাড়িত হয়ে ? অনুরাগের মুখটা হঠাৎ নিষ্প্রভ হয়ে গেল। বললো….. না, আসলে তুমি আমাকে মেনে নিতে পারছিলে না তাই আমাদের মধ্যে একটা অবরোধ তৈরি হয়ে গিয়েছিলো। সেই অবরোধের জীবন থেকে মুক্তি পাবার জন্য আমি সেপারেশনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তুমি তাতে নিষ্করুণ সম্মতি দেওয়ার পর আমাদের ডিভোর্স হয়ে যায়। প্রেরণা….. তুমি কি আমাকে মেনে নিতে পারছিলে ? অনুরাগ….আমি পারিনি একথা ঠিক না। তুমি আমার নানা রকম দোষ ত্রুটি খুঁজে খুঁজে বের করে তা নিয়ে যা তা বলতে শুরু করলে। আমি মানুষ কিনা সেই প্রশ্নও তুমি তুলতে ছাড়োনি। শেষে আমার দোষের পাল্লা এতো ভারী হয়ে গেল যে তুমি আমাকে আর সহ্য করতে পারলে না। তাই তো আমার মাঝে মাঝে মনে হতো আমি সত্যি সত্যিই মানুষ কিনা ? প্রেরণা….. তুমিও তো আমাকে কম আচড়াও নি, খামছাও নি। এরপর ড্রইং রুমটা জুড়ে একটা গাঢ় নৈশব্দিক পরিবেশ তৈরি হয়। কারো মুখে কোন কথা নেই। সমস্ত কথা যেন মন থেকে উৎপত্তি হয়ে বাগযন্ত্রের মধ্য দিয়ে আসতে গিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে । শব্দহীন মুখে সবাই বসে যেন নিরবতা পালন করছে।
অনুরাগ….আমি কি এখানে এসে তোমাকে নতুন করে সম্পর্কের মলিনতায় বিদ্ধ করলাম ? প্রেরণা….. না, এত দিন পরে নতুন করে আর বিদ্ধ ধরার কি আছে ? আসলে তুমি আমার এই শিক্ষকতা মন থেকে মেনে নিতে পারনি। তোমার পৌরুষে লেগেছিলো। অনুরাগ….দেখো এখন তো আর লুকোছাপা করার কিছু নেই। তুমি শিক্ষকতা করো আর যাই করো তাতে আমার কোন আপত্তি ছিল না। তুমি স্বাধীন ভাবে তোমার আইডেন্টিটি নিয়ে চলো তাতেও আমার আপত্তি ছিল না। আমার আপত্তি ছিল শিক্ষকতা করতে গিয়ে তোমাকে যে ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হবে সেই জায়গাটাতে। আজকাল আর কোন চাকরিই আগের মতো সহজ সরল নেই। অত্যন্ত যন্ত্রনাময়। সরকারি চাকরিও প্রাইভেট ফার্মের মতো টার্গেট বেস হয়ে গেছে। নিত্য নতুন ফরমাস জারি হয়। টার্গেট ফুলফিল করার জন্য ভীষণ চাপ আসে উপরের মহল থেকে। নানা রকম শাসানি চলতে থাকে। সারাক্ষন আতঙ্কের মধ্যে সময় কাটে। এই সব ঝামেলা পোহাতে গিয়ে তুমি বিবর্ণ মুখ নিয়ে বাড়ি ফিরবে, সব সময় আতঙ্কিত থাকবে সেটা আমি চাইনি বলেই আমি তোমার শিক্ষকতাতে আপত্তি করেছিলাম। তাছাড়া আমাদের পরিবারে অর্থনৈতিক টানাটানি নেই। কিন্তু তুমি আমাকে ভুল বুঝে আমার বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিলে। প্রেরণা…. রাত প্রায় শেষ হতে যাচ্ছে । তুমি একটু শুয়ে নাও। শোবার ঘরে তোমার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। অনুরাগ….. আর তুমি ? প্রেরণা….. আমি এই সোফাটাতেই একটু গড়িয়ে নেবো। অনুরাগ…..আমি অনাহুতের মতো এখানে এসে তোমাকে বিপদে ফেলে দিয়েছি। প্রেরণা….. তুমি এমন ভাবছো কেন ? তুমি আমার গেস্ট তাই আতিথিওতায় ত্রুটি করা ঠিক না। আর কতো দিন বাদে তুমি এলে আমার কাছে বলো তো ? সকাল বেলা অনুরাগ তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে দুকাপ চা করে নিয়ে আসে। প্রেরণাকে ডেকে তুলে বেড টি খেয়ে নিতে বলে। অনুরাগ…. তুমি আবার বিয়ে করলে না কেন ? প্রেরণা….. নতুন সম্পর্কে জড়ালে সেটাই বা কেমন হবে কে জানে। তাই ঐ সব নিয়ে ভাবতে আমার ভালো লাগলো না বলেই আমি ঐ সব নিয়ে আর ভাবিনি। অনুরাগ…. আসলে তুমি হয়তো এখনো আমাকে হারানোর জন্যে লড়াই করে যাচ্ছ। এতোটা উদার হওয়া ঠিক না। প্রেরণা…. তুমি বিয়ে করেছো ? অনুরাগ…. না,তবে করবো বলে ভাবছি। তুমি আসবে তো বিয়েতে ? প্রেরণা…. জানি না। রাতে মুষলধারে বৃষ্টি হবার পর সকালের আকাশ এখন ঝলমলে পরিষ্কার। সকাল গড়িয়ে যাওয়ায় সূর্যকিরণের তেজ বেশ বেড়ে গেছে। অনুরাগ প্রেরণার ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তা ধরে হেঁটে কিছুটা এগিয়ে গিয়েও আবার পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে প্রেরণা ছলছল চোখে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে তার চলে যাবার দিকে তাকিয়ে। প্রেরণার চোখের কোল বেয়ে জলের স্রোত নেমে আসছে বাঁধ ভেঙে। অনুরাগ পিছন দিকে ছুটে এসে দু হাত বাড়িয়ে দেয় প্রেরণার দিকে। প্রেরণাও নিজেকে সামলাতে না পেরে অনুরাগের বুকে ঝাঁপিয়ে পরে। প্রেরণা…. তুমি থেকে যাও। অনুরাগ….থাকবো বলেই তো ফিরে এসেছি।