অপ্রত্যাশিত তদন্ত
নবু’র -কলমে
মিঃ সেন, কলকাতার একটি বিখ্যাত বহুজাতিক সংস্থার মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান, পরিচালনা পর্ষদ থেকে এক অদ্ভুত অনুরোধ পেলেন। সংস্থার জন্য একজন নতুন হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা নিয়োগ করা হবে, কিন্তু নিয়মিত সাক্ষাৎকার ও যোগ্যতা যাচাইয়ের বাইরেও আরও কিছু নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজন একেবারে নির্ভুল, সন্দেহহীন, নির্ভরযোগ্য এবং ঝুঁকিমুক্ত একজন কর্মী।
এই বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হল বেসরকারি গোয়েন্দা ধ্রুব গুপ্তকে। নিখুঁত বিশ্লেষণ ক্ষমতা ও সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণশক্তির জন্য তিনি পরিচিত। তবে এই তদন্ত তার জন্য কেবল আরেকটা সাধারণ কাজ ছিল না—এবারের বিষয়টা তার ভেতরের অনুসন্ধিৎসা ও নৈতিকতার জায়গাকে নাড়িয়ে দিল।
যার ব্যাপারে তদন্ত করা হবে, তিনি হলেন সঞ্জীব ধর। বয়স তিরিশের কাছাকাছি। চমৎকার শিক্ষাগত যোগ্যতা, কর্মজীবনের রেকর্ড নিখুঁত। কিন্তু প্রশ্ন ছিল—এই নিখুঁতত্বটাই কি স্বাভাবিক, নাকি এর আড়ালে কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে?
নিখুঁত মানুষ, নিখুঁত ছদ্মবেশ?
ধ্রুব যখন সঞ্জীবের জীবন সম্পর্কে খোঁজ নিতে শুরু করলেন, একটা অদ্ভুত বিষয় খেয়াল করলেন। লোকটি যেন খুব বেশি নিখুঁত! কোনো বাজে অভ্যাস নেই, অতীত সম্পর্কে কোনও ধোঁয়াশা নেই, কোনো আইনি ঝামেলায় পড়েননি, এমনকি তার ব্যক্তিগত জীবনে তেমন কোনো ঘনিষ্ঠ বন্ধুও নেই।
ধ্রুব ধীরে ধীরে বুঝতে পারছিলেন—কিছু একটা ঠিক নেই।
তাঁর সন্দেহ আরও বাড়ল, যখন তিনি জানলেন, সঞ্জীব ধর কোথাও দু’বছরের বেশি চাকরি করেননি। প্রতিবারই তিনি নিজে থেকে পদত্যাগ করেছেন, নতুন সুযোগের সন্ধানে।
তবে আরও আশ্চর্যের বিষয়, প্রতিটি প্রতিষ্ঠান তাকে প্রশংসার সঙ্গে বিদায় জানিয়েছে! কেউ অভিযোগ করেনি, বরং তাকে “অসাধারণ কর্মী” হিসেবে বর্ণনা করেছে। কিন্তু কেন? কেউই তাকে গভীরভাবে চেনেনি? নাকি চেনার সুযোগই পাননি?
গোপন সংকেত: টাকার লেনদেন
ধ্রুব যখন আরও গভীরে খোঁজ নিতে শুরু করলেন, তখনই আসল রহস্য উন্মোচিত হতে লাগল।
সঞ্জীব ধর-এর ব্যাংক লেনদেন বিশ্লেষণ করতে গিয়েই অদ্ভুত একটা বিষয় ধরা পড়ল— প্রতিটি চাকরি ছাড়ার পরই তার অ্যাকাউন্টে মোটা অঙ্কের টাকা জমা হয়েছে। কিন্তু উৎস? কোনো লেনদেন নেই সরাসরি পুরনো সংস্থাগুলোর নাম নেই।
ধ্রুবের ভেতরে উত্তেজনা বাড়তে লাগল। মনে হচ্ছিল, একটা বিশাল জাল খুলে যাচ্ছে তার সামনে।
গোপন সাক্ষাৎকার
এক সন্ধ্যায় ধ্রুব সঞ্জীবের একটি পুরনো অফিসের সুপারভাইজারকে খুঁজে বের করলেন। লোকটি খানিকটা বিরক্ত স্বরে বলল,
“এক অদ্ভুত ব্যাপার জানেন? ধর চাকরি ছাড়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আমাদের প্রতিষ্ঠানে বড় ধরনের আর্থিক সমস্যা ধরা পড়ে। কাকতালীয় হতে পারে, তবে আমি বিশ্বাস করি না কাকতালীয় বলে কিছু হয়।”
ধ্রুব এবার নিশ্চিত হলেন—সঞ্জীব ধর নিখুঁত প্রতারক!
তিনি যেখানেই চাকরি নেন, সেখানকার হিসাবরক্ষণে গোপন দুর্বলতা খুঁজে বের করেন। তারপর অতি সন্তর্পণে কিছু অর্থ সরিয়ে ফেলেন, যেন কোনোভাবেই ধরা না পড়েন। তার পরেই বিদায় নিয়ে নতুন প্রতিষ্ঠানের দিকে পা বাড়ান।
ধ্রুবের ভেতরে এক অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করছিল। একদিকে ছিল পেশাগত সাফল্যের আনন্দ, কারণ তিনি সত্যটা উন্মোচন করতে পেরেছেন। কিন্তু অন্যদিকে, মনে হচ্ছিল, সঞ্জীব ধর কি নিছকই এক প্রতারক, নাকি তার এই জীবন বেছে নেওয়ার পেছনে আরও গভীর কোনো গল্প আছে?
সামনাসামনি দ্বন্দ্ব ধ্রুব সিদ্ধান্ত নিলেন, এবার সরাসরি সঞ্জীব ধরের মুখোমুখি হতে হবে।
পরদিন, এক নির্জন ক্যাফেতে সঞ্জীবের সঙ্গে দেখা করলেন ধ্রুব। তিনি আগের মতোই শান্ত, মেপে মেপে কথা বলেন।
ধ্রুব একেবারে স্পষ্ট ভাষায় বললেন, “তুমি যে একজন অসাধারণ প্রতারক, তা আমি জানি। প্রশ্ন হচ্ছে, তুমি কেন এটা করো?”
সঞ্জীব চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর মৃদু হেসে বললেন,
“আপনি কি মনে করেন, সব চোর খারাপ? আমি যদি বলি, আমি শুধু সেই প্রতিষ্ঠানগুলোকেই টার্গেট করি, যারা সাধারণ কর্মীদের ঠকায়? যারা কোটি কোটি টাকা লুকিয়ে ফেলে কর ফাঁকি দেয়?”
ধ্রুব হতবাক। কিছু বলার আগেই সঞ্জীব উঠে দাঁড়ালেন।
“আমার কাছে ন্যায় অন্যরকম। কিন্তু আপনি যদি চান, আমাকে থামিয়ে দিতে পারেন। তবে মনে রাখবেন, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের ভেতরেই কোনো না কোনো ‘সঞ্জীব ধর’ আছে। পারলে সবাইকে থামান।”
সেই মুহূর্তে ধ্রুব বুঝতে পারলেন—এই তদন্ত কেবল একজন প্রতারকের পর্দা ফাঁস করা ছিল না। এটি ছিল এক অন্তহীন লড়াইয়ের দরজা খুলে দেওয়া।
চূড়ান্ত প্রতিবেদন
পরদিন সকালে, সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিঃ আগরওয়ালের টেবিলে এক পাতার প্রতিবেদন জমা দিলেন ধ্রুব গুপ্ত।
“সঞ্জীব ধর নিখুঁত কর্মী, কিন্তু অত্যন্ত বিপজ্জনক।
আপনারা যদি চান, সে আপনার প্রতিষ্ঠানে কাজ করুক, তবে সতর্ক থাকুন—সে যতটা দক্ষ, তার চেয়েও বেশি চালাক।”
ধ্রুব সেই অফিস থেকে বেরিয়ে এলেন। কিন্তু তার মনে হচ্ছিল, কিছুই শেষ হয়নি। সঞ্জীবের কথা গুলো যেন তার মাথার মধ্যে অনুরণিত হচ্ছিল
—”সব চোর খারাপ না!”
ধ্রুব জানতেন, সত্য সবসময় কালো-সাদায় বিভক্ত হয় না। কিছু সত্য ধূসর হয়, কিছু সত্য প্রশ্ন তোলে। আর সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই হয়তো মানুষ আরও গভীরে তলিয়ে যায়।
অপ্রত্যাশিত তদন্ত
ধ্রুব গুপ্ত অফিস থেকে বেরিয়ে এলেও তার মন তখনো অস্থির। সঞ্জীব ধরের শেষ কথাগুলো যেন মাথার মধ্যে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল—
“সব চোর খারাপ না!”
ধ্রুব জানতেন, এ ধরনের প্রতারকদের ধরে ফেলার দায়িত্ব তার। কিন্তু সঞ্জীব কি শুধুই একজন ধূর্ত প্রতারক, নাকি অন্য কিছু?
কয়েকদিন কেটে গেল। সংস্থার পক্ষ থেকে ধ্রুবের দেওয়া প্রতিবেদন অনুযায়ী সঞ্জীব ধরের নিয়োগ বাতিল করা হলো। কিন্তু ধ্রুব জানতেন, এটা কোনো সমাধান নয়। সে এবার অন্য কোথাও যাবে, অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে শিকার বানাবে।
কিন্তু ধ্রুবের মনে হচ্ছিল, সঞ্জীবের গল্পটা এখানেই শেষ নয়।
নতুন এক সূত্র
এক সন্ধ্যায় ধ্রুব বসেছিলেন তাঁর অফিসের ডেস্কে। সঞ্জীব ধরের গত দশ বছরের ব্যাংক লেনদেন খুঁটিয়ে দেখছিলেন। একটা অদ্ভুত বিষয় চোখে পড়ল—
সঞ্জীব কখনোই তার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে দীর্ঘ সময়ের জন্য টাকা রাখেনি।
যেখানে প্রতারকরা টাকা সরিয়ে নিজের বিলাসী জীবনের জন্য খরচ করে, সঞ্জীবের খরচের ধরন ছিল সম্পূর্ণ আলাদা!
তিনি ঠিক করলেন, আরও গভীরে অনুসন্ধান করবেন।
ধ্রুব এক পুরনো সূত্র কাজে লাগিয়ে ব্যাংকের গোপন কিছু তথ্য জোগাড় করলেন।
সঞ্জীবের অর্থের বড় অংশ প্রতিবারই এক বিশেষ সংস্থার অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরিত হয়েছে—একটি অনাথাশ্রমের নামে!
সত্যের আরও গভীরে ধ্রুব কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। এতদিন ধরে যাকে তিনি প্রতারক ভেবেছিলেন, সে কি তাহলে একটা সামাজিক ন্যায়ের মিশনে ছিল?
তিনি অনাথাশ্রমটির ঠিকানা খুঁজে বের করলেন। কলকাতার শহরতলির এক প্রত্যন্ত গ্রামে ছোট্ট একটা প্রতিষ্ঠান। ধ্রুব সেখানে গিয়ে যা দেখলেন, তাতে তার দৃষ্টিভঙ্গি পুরো বদলে গেল।
এক বৃদ্ধ মহিলা, শান্তি দেবী, তাকে স্বাগত জানালেন। তিনি ছিলেন আশ্রমটির প্রধান।
ধ্রুব কিছু না বলতেই শান্তি দেবী বললেন,
“তুমি নিশ্চয়ই সঞ্জীবের খোঁজে এসেছ? আমি জানতাম, কোনো না কোনো দিন কেউ ওর আসল কাহিনি জানতে চাইবে।”
শান্তিদেবী জানালেন, সঞ্জীব ছোটবেলাতেই অনাথ হয়েছিল। এক ভয়াবহ দাঙ্গায় তার পুরো পরিবার নিহত হয়। তখন তার বয়স মাত্র দশ। আশ্রমের করুণ পরিস্থিতি দেখে, সে শপথ নেয়—একদিন কিছু করবে এইসব নিঃসঙ্গ শিশুদের জন্য।
কিন্তু সাধারণ উপায়ে এত অর্থ উপার্জন সম্ভব ছিল না। তাই সে বেছে নেয় একটা অন্যরকম পথ।
“সে প্রতিষ্ঠানের লুকানো দুর্নীতি ধরতে শুরু করল। যে কোম্পানিগুলো সাধারণ মানুষকে ঠকাত, কর ফাঁকি দিত, সেগুলোর হিসাবের ফাঁকফোকর ধরে গোপনে টাকা সরিয়ে ফেলত। এবং সেই টাকা এখানে আসত, আমাদের বাচ্চাদের মুখে খাবার তুলে দিতে।”
ধ্রুব স্তব্ধ হয়ে গেলেন।
সঞ্জীব ধর চোর, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এই চোরকে কি সত্যিই অপরাধী বলা যায়? নাকি সে এক অন্যরকম ‘রবিনহুড’?
ফের এক দ্বন্দ্ব
ধ্রুব চুপচাপ গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরের অন্ধকার দেখতে লাগলেন। তার মনের ভেতর এখন প্রবল ঝড়।
আইনের দৃষ্টিতে সঞ্জীব অপরাধী।
কিন্তু ন্যায়ের দৃষ্টিতে?
এই সত্যটা কি সে প্রকাশ করবে? সঞ্জীব কে পুলিশের হাতে তুলে দেবে? নাকি চুপ করে থাকবে?
তার গোয়েন্দাগিরির ইতিহাসে এই প্রথমবার সে দ্বিধায় পড়ল—আইন ও ন্যায়বোধ, কোনটা বড়?
গাড়িটা চলতে থাকল, কিন্তু ধ্রুব জানতেন, কিছু প্রশ্নের উত্তর হয়তো কখনোই পাওয়া যায় না…
—শেষ—