লেডিস-গার্মেন্টসের সেরা একটি বিপনির নাম হলো-‘কুইন্স প্যালেস’। এরকম মস্ত বিপনি কলকাতায় আরও গোটা কয়েক থাকলেও সুনামের নিরিখে এর ধারে-কাছে এখনও কেউ আসতে পারেনি!
এর আরও একটি বৈশিষ্ট্য হলো- প্রবেশদ্বারের দু-ধারে দুটো কাচের শোকেজে যে-দুটো ম্যানেকুইন রাখা আছে তাদের একটি যুবক এবং একটি যুবতী। এ-জন্যই ‘ম্যানেকুইন’ গল্প হয়ে উঠেছে!
★★★
বছর কুড়ি-পঁচিশ আগের কথা-
দোকানের মালিক ‘যদুনাথ বেপারী’ গুরুদেবের পরামর্শ মতো দোকান উদ্বোধনের দিনক্ষণ স্থির করলেন। যদিও ওই-দিন গুরুদেবের উপস্থিত থাকার সম্ভাবনা খুবই কম, তবুও…..।
কিন্তু বিকেলেই আসাম থেকে ফোন এলো – “অন্যান্য অনুষ্ঠান মুলতবি রেখে কালই গুরুদেব কলকাতায় ফিরছেন!”
এই সুখবরে চারদিকে সাজ-সাজ-রব পড়ে গেল!
সব শুনে বাবার হাতে হাত লাগাল তাঁদের একমাত্র মেয়ে ‘তনয়া’। ওর ওপর দায়িত্ব পড়ল সুন্দর দেখে দুটো ম্যানেকুইন কিনে আনার। শুধু সুন্দর হলেই হবে না, দুটি ম্যানেকুইনই মেয়ে হতে হবে।
মডেল বা পুতুল হলেও এদের গুরুত্ব কিছু কম নয়! হতে পারে তারা নির্বাক এবং নিথর, কিন্তু ওদের সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়েই একজন পথ চলতি সাধারণ মানুষ কাচের দরজা ঠেলে দোকানের ভিতরে ঢোকেন। যা-কে বলে ‘লাভ এ্যাট ফার্স্ট সাইট’!
হলো কী হবে- সেই-ই ম্যানেকুইন কেনার ক্ষেত্রে খুঁত একটা রয়েই গেল, পছন্দসই দুটো মেয়ে-ম্যানেকুইন কিছুতেই আর খুঁজে পাওয়া গেল না! শেষে বাধ্য হয়েই তনয়া একজোড়া যুবক-যুবতী কিনে নিয়ে চলে এলো!
এ-টা জেনে বাবা প্রথমে একটু অসন্তুষ্ট হলেও ভুলেও গেলেন খুব তাড়াতাড়ি। কারণ ওঁর মাথায় এখন একটাই চিন্তা -“গুরুদেবের সেবায় যেন কোনও ত্রুটি না-হয়!”
★★★
নির্দিষ্ট দিনে গুরুদেবের উপস্থিতিতে খুব জাঁকজমক করে ‘কুইন্স প্যালেস’ এর দ্বারোদঘাটন হয়ে গেল!
শুরুর দিনই রেকর্ড সেল! “সবই গুরুর কৃপা”- সকলের মুখে একটাই কথা!
সে-কথা ফলেও গেল খুব তাড়াতাড়ি, বছর ঘুরতে-না-ঘুরতেই দোকানের সুনাম চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল! প্রতিবেশী থেকে শুরু করে আত্মীয়-পরিজন সবার মুখেই যদুনাথের জয়জয়কার!
★★★
এ-ভাবে বেশ চলছিল! যদুনাথ মনে মনে ভেবে রাখলেন- আসন্ন প্রতিষ্ঠা দিবসে সবাইকে নিয়ে খুব ধুমধাম করে দোকানের জন্মদিন পালন করবেন। হাতে এখনও দিন-কুড়ি-পাঁচিশ সময় আছে।
★★★
হঠাৎ একদিন সকালবেলা সিকিউরিটি ‘হরি প্রসাদ’ মেইন গেট খুলেই চমকে ওঠে- দুটো ম্যানেকুইনই যেন নিজেদের জায়গা থেকে খানিকটা সরে গেছে! তারথেকেও আশ্চর্যের কথা হলো- মেয়ে ম্যানেকুইনটির পোশাকের বেশকিছু পরিবর্তন হয়েছে- রাতে যখন দোকান বন্ধ করা হয় তখনও ওর পরনে ছিল সামান্য কিছু পোশাক। বুক এবং পেটের অনেকটা অংশই অনাবৃত- যা দেখার জন্য অনেকেই দোকানের সামনে লোলুপ দৃষ্টিতে ‘হাঁ’ করে দাঁড়িয়ে থাকে! কিন্ত আজ এমন পূর্ণ-নারী-সাজে কে সাজালো তাকে!
হরি প্রসাদ তখনও মালিককে কিছু জানায়নি। একে একে স্টাফরা আসতে শুরু করলে সেলস- কাউন্টারের ‘বিউটি-ম্যাডাম’কে ডেকে সবকথা খুলে বলল- ম্যাডামও তক্ষুণি কাউকে কিছু জানাতে না-করলেন এবং নিজের হাতে মডেলটিকে সাজিয়ে-গুছিয়ে আবার আগের মতো দাঁড় করিয়ে রাখলেন।
সে-দিন রাতে হরি’র চোখে আর ঘুম নেই, কাল সকালে আবার কী দেখবে কে জানে!
অধীর আগ্রহ নিয়ে পরেরদিন ভিতরে ঢুকল হরি- একই ঘটনা নজরে পড়ল! সে-দিন ভয়ে ও আতঙ্কে বসে পড়ল!
একটু ধাতস্থ হতেই ফোন করল সাহেবকে-
সাহেব তখন ব্যালকনিতে বসে খবরের কাগজ হাতে নিয়ে সূর্যের আলোতে চা-য়ে চুমুক দিচ্ছেন-
এমন সময় হরির মুখে এমন একটা আজগুবি কথা শুনে বিরক্ত প্রকাশ করে বললেন-
“সকাল সকাল কীই যা-তা বলছো হরি!”
“সাব, বিসোআস করুন, সত্যি বলছি! মা কসম! সুধু আজই নয়, কালভী এয়সা হুয়া থা! হামার সাথে বিউটি’দিদিভি দেকেছেন!”
“ঠিক আছে ঠিক আছে, আমি দেখছি! শোনো হরি, এটা যেন পাঁচকান না-হয়! এ-সব কথা কানে গেলে সকলে এটা নিয়েই মশগুল হয়ে থাকবে, কাজে আর মন বসবে না!”
“জরুর সাব!”
হরিকে মুখে কিছু না-বললেও, যদুনাথও একটু ঘাবড়ে গেলেন-
নিজেও সারাদিন কাউকে কিছু বললেন না!
কাজকর্ম সেরে রাতে সিসিটিভিতে চোখ রাখলেন-
খুব একটা সময় লাগেনি, বারোটা ঊনত্রিশ নাগাদ রহস্যের উদ্ঘাটন করে ফেললেন-
“পুরুষ-ম্যানেকুইনটি পা ঘষতে ঘষতে চলে গেল মেয়েটির কাছে, তারপর অতি যত্ন সহকারে তাকে লজ্জাবতী-নারীর বেশে সাজিয়ে দিল! কয়েক সেকেন্ড তার চাঁদপনা মুখটির দিকে তাকিয়ে থেকে আবার পা ঘষতে ঘষতে নিজের জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে পড়ল….!”
যদুনাথ নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না! “এ-টাও কি সম্ভব!”
যাই হোক, নিজে নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। “এসব আর হতে দেওয়া যাবে না!”
পরদিন সকালেই একটি মহিলা-ম্যানেকুইন কিনে এনে পুরুষ-ম্যানেকুইনটির জায়গায় স্থলাভিষিক্ত করলেন।
অগত্যা ‘পুরুষটির’ জায়গা হলো গুদামঘরে।
এসব কথা যখন তনয়া’র কানে উঠল, সে ভীষণই মনঃক্ষুণ্ন হলো! অনেক করে বলেও কিছুতেই বাবার মত পরিবর্তন করাতে পারল না! বাবা নিজের সিদ্ধান্তেই অটল রইলেন- “ব্যবসার কাজে আবেগের কোনও স্থান নেই!”
কিন্তু এরপর যা ঘটল- তা আরও অবাক করে দেওয়ার মতো ঘটনা-
সে-দিনের পর থেকে ওই মেয়ে-ম্যানেকুইনটির মুখের দিকে আর তাকানো যাচ্ছিল না, বন্ধুকে হারিয়ে সে ভীষণই মর্মাহত! তার নিষ্পাপ-সুন্দর চোখ-দু’টির দিকে তাকালেই বুকে মোচড় দিচ্ছে, চোখ ভিজে আসছে!
এসব কথায় অবশ্য মালিকের মন গলেনি; উল্টে তিনি নিজের সিদ্ধান্তেই অবিচল রইলেন- রোজ রোজ এ-সব ঝামেলা পোহাতে কারই-বা ভালো লাগে!
কিন্তু এবার তো আস্ত জাহাজটাই ডুবতে বসল!
দিন যত এগোচ্ছে, বিক্রিবাটা ততই কমে আসছে! দিন পনেরো যেতে-না-যেতেই ব্যবসা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে!
“যদুনাথ, তোমার তনয়া’র সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল! ওদের আলাদা করে দিয়ে তুমি খুবই অন্যায় করেছো! আজই ওদের পুনঃস্থাপনের আয়োজন শুরু করো! যে -সাজে ওরা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে সেই সাজেই ওদের সাজিয়ে তোলো!
আর হ্যাঁ, সবটাই করবে কিন্তু তোমার তনয়া! আগামীকালই তো তোমার দোকানের জন্মদিন, তাই না?”
“হ্যাঁ গুরুদেব।”
★★★
তাই-ই করা হলো!
ধীরে ধীরে ‘কুইন্স প্যালেস’ আবার নতুন করে সেজে উঠল! হারিয়ে যাওয়া গরিমা আবার ফিরে পেলেন যদুনাথ বেপারী!
★★★
ম্যানেকুইন-যুগলের সেই প্রশান্তির হাসি আজও প্রতিফলিত হচ্ছে মালিক-কর্মচারী এবং ক্রেতা-সাধারণের মুখে!