কয়েকদিন আগে কাশী গিয়েছিলাম। বিকাল বেলা বাবা বিশ্বনাথের দর্শন করার পর হঠাৎ করেই মনে হলো একটু শ্মশানে গিয়ে বসি। এমনিতেই কুম্ভ মেলার পুরো ভিড়টাই যেনো কাশীতেও আছড়ে পড়েছে, তিল ধারণের জায়গা নেই, সমস্ত মন্দির গুলোতেই মাইল খানেক লাইন।তাই ভাবলাম একমাত্র শ্মশানেই হয়তো একটু ফাঁকা পাওয়া যাবে,শান্তি পাওয়া যাবে। মাঝে মাঝে একটু শ্মশানে যাওয়া উচিত। সাথে কোনো সঙ্গী নয়, মোবাইল নয়, পরিবারের তাড়না,কর্মের দায়বদ্ধতা , সবকিছুকে ভুলে শুধুই একাকীত্ব কে সঙ্গী করে কয়েক মুহূর্ত শ্মশানে বসলাম। নিজের অন্তিম পরিনতি টা অনুভব করার চেষ্টা করলাম।
বিশ্বনাথ মন্দিরের এক নম্বর দ্বার দিয়ে ঘাটের দিকে নেমে এলেই সেই বিখ্যাত মনিকর্নীকা ঘাট,যেখানে হাজার হাজার বছরে চিতার আগুন কখনো নেভেনি। এখানে মৃতদেহ দাহ করলে নাকি আত্মার মোক্ষ অর্জন হয়, স্বর্গ লাভ হয়। যখন আত্মা শরীরের মধ্যে ছিল, অর্থাৎ জীবিত অবস্থায় নিজের কর্মের দ্বারা মোক্ষলাভ তো অনেক দূরের কথা সামান্যতম পূণ্য অর্জন করতে না পারা মানুষ গুলো নাকি আত্মা শরীর ছেড়ে দেওয়ার পর ওই রক্ত মাংসের শরীরটাকে ওই ঘাটে পুড়িয়ে নাকি মোক্ষলাভ হবে। তাঁর আর নাকি জন্মান্তর হয় না। দূর দূর থেকে মানুষ ছুটে আসে এই বারাণসীর বুকে, জীবনের শেষ কটি দিন কাটাবে বলে! মৃত্যু এখানে শুধু সুলভ নয়, মৃত্যু এখানে কাঙ্ক্ষিতও।
মোক্ষলাভ বা স্বর্গলাভ যে এত সোজা, এত সস্তায় পাওয়া যায় সেটা আমার আগে জানা ছিল না। মহাকুম্ভে গিয়ে ত্রিবেনী সঙ্গমে ডুব দিতে গিয়ে বুঝলাম যে কোটি কোটি মানুষ সহজেই স্বর্গে যাওয়ার লোভে কিভাবে ছুটছে। কেউ কেউ আবার শুধু ডুব দিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছে না, লিটার লিটার জল বয়ে বয়ে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে, নিজের পরিবার ও পাড়ার সবাইকে মোক্ষ অর্জন করানোর দায় যেনো একাই নিয়ে নিয়েছে তারা ..এভাবেই যদি সবার আপদে বিপদেও পাশে দাঁড়াতেন সবাই তাহলে হয়তো স্বর্গ লাভের এই সস্তা পন্থা গুলো অবলম্বন করতে হতো না কাউকেই।
যাইহোক সবাই স্বর্গে যাক এই কামনা করি। দেবতাদের বলছি আপনারাও একটু বুঝুন যে population inflation এর মারাত্মক ফলটা কি রকম মিষ্টি হয়। এতদিন হাত পা ছড়িয়ে থেকেছেন, খেয়েছেন কম আর নষ্ট করেছেন বেশী। এবার স্বর্গেও জায়গার অভাবে সব এক বা দুই কামরার ঘরে একা একা থাকার অভ্যাস করুন। ওই যে বলে না survival of the fittest, ওটা করতে গিয়ে অন্যের পশ্চাত দেশে একটু আধটু বাঁশ দিন, নিজেকে ভাল রাখতে গিয়ে একটু আধটু বেইমানি করুন, বা অন্য কেউ আপনার সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করে বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াক,তবে না বুঝবেন এ পাড়ায় কি চলছে… অনেকদিন তো চোখ বন্ধ করে নিজেদের ফুর্তিতেই মেতে আছেন, এবার কুম্ভের effect, ও থুড়ি মহাকুম্ভের পুণ্যের ঠেলায় আপনারাই না খুব তাড়াতাড়ি নরকে বিতাড়িত হন, শুধু সময়ের অপেক্ষা, চল্লিশ কোটি পুণ্য আত্মা এক এক করে যেতে শুরু করলো বলে।
।। দেবতাগণ সাবধান ।।
যাই হোক আমি আমার বিষয়ে ফিরে আসি না হয়। আবার ফিরে আসি সেই মণিকর্ণিকা ঘাটে। সত্যিই তো একটা চুল্লিও খালি নেই , চারিদিকে শুধু আগুনের লেলিহান শিখা, আকাশে বাতাসে পোঁড়া গন্ধ আর কুন্ডলি পাঁকানো ধোঁয়ার আগ্রাসন। তার উপর আবার আমার মত পুণ্য করতে যাওয়া মানুষের ভিড়। ওই শরীর গুলো পুড়তে দেখে যদি আর একটু পুণ্য অর্জন হয় আরকি। এক দম বন্ধ করা পরিবেশ। বাধ্য হয়েই বেরিয়ে এলাম, শান্তির খোঁজে গিয়ে মনটা আরো বেশি অশান্ত হয়ে গেলো।
ঘাট ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। দশাশ্বমেধ ঘাটের ভিড় ঠেলে এগিয়ে চললাম আরো দূরে। মাঝে গৌরী কেদার দর্শন করে অবশেষে এসে পৌঁছলাম হরিশ্চন্দ্র ঘাটে। কথিত আছে রাজা হরিশ্চন্দ্র নাকি নিজের সর্বস্ব হারিয়ে এই ঘাটেই চন্ডাল হিসাবে মরা পোড়ানোর কাজে নিযুক্ত হন। নিজের সততার সাথে কখনো আপোষ করেননি তিনি। রাজত্ব, পরিবার সব হারিয়েছেন, এমনকি পয়সা ছাড়া নিজের ছেলের মৃতদেহ পর্যন্ত পোড়াতে অস্বীকার করেন তিনি। যাইহোক এখানে মানুষের সংখ্যা অনেকটাই কম, যারা আছেন তারা বেশির ভাগই মৃতের পরিজন, আর কিছু নাগা সন্ন্যাসী ছাড়া আমার মত গুটি কয়েক নেগেটিভ চিন্তার অমানুষ শ্মশানে ঘুর ঘুর করছে… কোথায় ফুর্তি করবে,তা না শ্মশানে বসে বসে শোক পালন করছে।
একটা ফাঁকা জায়গায় সিড়ির উপর বসে পরলাম। অবিশ্রান্ত ঢেউয়ের মতো ভেসে আসছে এক একটি মৃতদেহ ঘিরে পরিজনের ভীড়। নাম ছিল হয়তো তাঁর, কিন্তু এখন সে শুধুই একটা Dead ‘Body’। নেই কোনো নাম নেই কোনো যশ,খ্যাতি।সারা জীবন দায়িত্ব আর কর্তব্যে নিষ্ঠ কাঁধ আজ দায়িত্বমুক্ত, অবহেলায় পরে আছে একটা নিথর শরীর। নেই কোনো পিছুটান। ভালোবাসার মানুষকে চিরদিন ভালো রাখার অনর্থক প্রতিজ্ঞার চিরঅবসান।
সর্বগ্রাসী লেলিহান খিদে নিয়ে অনন্তকাল জ্বলছে যে আগুন তার কাছে পাপ নেই, পুণ্য নেই, নেই কোনো বিচার। যে কোনো মানবশরীরে তাঁর দৃপ্ত অধিকার। পরিবারের তাড়ায় দ্রুত চুল্লিগহ্বরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে মুছে যাবে তোমার কর্তৃত্বের আস্ফালন, লালসার উদগ্র ইঁদুরদৌড়, প্রেমের মাধুর্য, অপমানে অশ্রুপাত, সন্তানের জন্য দুশ্চিন্তা, প্রতিজ্ঞার লৌহমুষ্টি, বাইরের সৌন্দর্য ও শরীরের সম্মোহন… যাবতীয় পুতুলখেলা।
অবশেষে নদীর প্রবাহে প্লাবনে ভেসে যাবে অবশেষ নাভিমূল। এভাবেই… এভাবেই সমুদ্রে চলে যেতে হবে জানলে ভাসাবে কি ঔদ্ধত্যের পানসিখানি? গায়ে মাখবে কি জীবনের ঝড়-ঝঞ্ঝা? বসবে নাকি পাপ পুণ্যের হিসাব করতে??? বলো, এ সত্যকে এড়িয়ে কোথায় পালাবে তুমি?
এসেছিল খালি হাতে, সারা টা জীবন শুধুই হাত পেতে নিয়েছে…. কেউ আদায় করে নিয়েছে, কেউ ছিনিয়ে নিয়েছে, কেউ বা না পাওয়ার যন্ত্রণায় ইশ্বরের কাছে হাত পেতে শুধুই চেয়ে গেছে, এটা দাও, ওটা দাও, সেটা দাও… যতো দেবে তত চাইব…লোভের আর শেষ নেই। কিন্তু হাত টা ওলটানোর মানসিকতা দেখাতে পেরেছে কয়জন। মানুষ ঠকিয়ে, ছলনা করে, দুর্নীতি করে, যেনোতেনো প্রকারে ঐশ্বর্যের বৃথা আস্ফালন করেছে, সুখ কিনতে চেয়েছে,আরো আরো ভালো থাকার তাড়নায় মানুষের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করেছে, মা বাবা কে অসম্মান করেছে…. কিন্তু দেখুন দিনের শেষে এক ইঞ্চি সুতোও শরীরে নিয়ে যেতে পারেনি… বেচারা। সাথে যদি কিছু গিয়ে থাকে তো, সেটা তার কর্মফল …বাকি সব কিছুই তো অন্যেরা কেড়ে নিয়েছে, একমাত্র পাপের ভাগীদার কেউ হবে না। মহা ঋষি বাল্মীকি, হাজার হাজার পাপ করে ছিলেন নিজের স্ত্রী সন্তান দের ভালো রাখার জন্য, কিন্তু তার পাপের ভাগীদার ও হতে চায়নি কেউ, আমি আপনি তো সামান্য নড়কের কীট মাত্র ।
আস্তে আস্তে সন্ধে নেমে আসছে, আনমনা হয়ে একটা চিতার দিকে তাকিয়ে ছিলাম, হঠাৎ করেই দুজন মিশমিশে কালো দেহাতি লোক, হয়তো ডোম….. দুর হটো,দুর হটো.. বলতে বলতে একটা dead body নিয়ে একটা সাজানো চুল্লির দিকে রীতি মত দৌড়ে যাচ্ছে… বুঝলাম বেওয়ারিস লাশ….হ্যাঁ শুধুই একটা লাশ, যার কোনো নাম নেই, পরিচয় নেই, শেষ যাত্রায় নেই কোনো আপনজন। কোথায় গেলো সব??? কিছুই তো নিয়ে যেতে পারলো না।তাহলে মাঝের কয়েক টা দিন কিসের এত ইঁদুর দৌর, কিসের এত বৃথা আস্ফালন, কিসের এত স্বার্থপরের মত শুধুই নিজেকে ভাল রাখার ঠুনকো নাটক, সত্যিই কি এভাবে ভালো থাকা যায়?? তবে ভালো আছি বলে নিজেকে জাহির করা যায় বটে, নিজেকেই নিজে অনবরত বুঝিয়ে চলেছি, আমার কোনো দোষ নেই, যা করেছি আমার ভালোর জন্যই তো করেছি…. তাতে যদি কারোর ক্ষতি হয়ে থাকে তো সেটা কোনো মতেই আমার দোষ হতে পারেনা, নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার অজুহাতের ঝুলি টা সবসময় পূর্ণ হয়েই থাকে, শুধু ঠিক সময়ে সেখান থেকে একটার পর একটা অজুহাত বেরোতে থাকে, যতক্ষণ না নিজের মনকে justify করতে পারছি। নিজেকে নির্দোষ ও অন্যদের দিকে সব দায় ঠেলে দিতে পারলে এক আজব পৈশাচিক আনন্দে মন টা ভরে যায়…. আচ্ছা এটা কি কখনো ভেবেছি, আসল বিচারপতি উপরে বসে মুচকি হাসছেন ,আর ভাবছেন যে এই মূর্খ গুলো অন্য কে ঠকাতে গিয়ে নিজেকেই ঠকিয়ে ফেলেছে। ঠিক সময়ে ঠিক বিচার হবে।
তাই সময় পেলে মাঝে মাঝে শ্মশান থেকে ঘুরে আসুন!! দেখবেন কতো অহংকার ছাই হয়ে আছে।জীবনে যা অর্জন করেছিলেন সব কিছুই ওই সর্বগ্রাসী আগুনে এক লহমায় বিলীন হয়ে যাচ্ছে, রয়ে যাবে শুধু এক মুঠো ছাই। সেটাও কিছুক্ষণের মধ্যেই জলে ভেসে যাবে। কাম, ক্রোধ, লালসা, মায়া মমতা সব বৃথা হয়ে যাবে.. রয়ে যাবে শুধুই কর্মফল। সততা, মনুষ্যত্ব, মানবিকতা…মানুষের আসল পরিচয়, বাকি সবকিছুই ভালো থাকার বৃথা প্রয়াস মাত্র। বেইমানী, বিশ্বাসঘাতকতা ,ছলোনা, স্বার্থপরতার অন্ধকার থেকে বেরোতে না পারলে হয়তো মুক্তির উপায় নেই।
এ বিষয়ে শ্রী শ্রী ঠাকুরের একটা উক্তি উল্লেখ করবো
প্রাণকৃষ্ণ ——- মহাশয় ! পরলোক কিরকম ?
শ্রীরামকৃষ্ণ ——— “কেশব সেনও ওই কথা জিজ্ঞাসা করেছিল । যতক্ষণ মানুষ অজ্ঞান থাকে, অর্থাৎ যতক্ষণ ঈশ্বরলাভ হয় নাই, ততক্ষণ জন্মগ্রহণ করতে হবে । কিন্তু জ্ঞানলাভ হলে আর এ-সংসারে আসতে হয় না । পৃথিবীতে বা অন্য কোন লোকে যেতে হয় না । “কুমোরেরা হাঁড়ি রৌদ্রে শুকুতে দেয় । দেখ নাই, তার ভিতর পাকা হাঁড়িও আছে, কাঁচা হাঁড়িও আছে ? গরু-টরু চলে গেলে হাঁড়ি কতক কতক ভেঙে যায় । পাকা হাঁড়ি ভেঙে গেলে কুমোর সেগুলিকে ফেলে দেয়, তার দ্বারা আর কোন কাজ হয় না । কাঁচা হাঁড়ি ভাঙলে কুমোর তাদের আবার লয় ; নিয়ে চাকেতে তাল পাকিয়ে দেয়, নূতন হাঁড়ি তৈয়ার হয় । তাই যতক্ষণ ঈশ্বরদর্শন হয় নাই, ততক্ষণ কুমোরের হাতে যেতে হবে অর্থাৎ এই সংসারে ফিরে ফিরে আসতে হবে ।”