আপনজন (সপ্তম পর্ব)
কাকলী ঘোষ
“ কিন্তু ধনাই যে বলত শিখা ওকে পছন্দ করে। ”
“ ধুস । ওসব ওর বানানো কথা। শিখা অন্য কাউকে একটা পছন্দ করে। ”
শুনেই বুকের ভেতর কেমন যেন গুড়গুড় করে উঠল ওর। কে সে? জানার বড্ড ইচ্ছে হচ্ছে। তবে ইচ্ছেটাকে ও মনের ভেতর চাপা দিয়েই রেখেছিল। প্রকাশ করেনি। দরকার নেই বাবা ওসব মেয়েছেলের ব্যাপারে জড়িয়ে। শেষে কী থেকে কী হবে? ঝুটমুট ঝামেলায় জড়িয়ে পড়বে।
তবে বেশি দিন ওকে অপেক্ষা করতে হল না। শিখারই সঙ্গে কাজ করে একটা মেয়ে মালতী। একদিন ওই ডেকে দাঁড় করালো ওকে। তখন সন্ধ্যে সাতটা বেজে গেছে। ওভার টাইম ছিল বলে দেরীতে বেরিয়েছে সুখেন। ওর কাজে মনোযোগ দেখে প্রায়দিনই ওকে ওভারটাইম দেয় গোবিন্দদা।
ওরও ভালো হয়। এইভাবে দু চারটে পয়সাও জমেছে হাতে। নিমাইদা বারবার বলে দিয়েছে বদ সঙ্গে থাকবি না। আর ওর নিজেরও ইচ্ছে একটা আলাদা ঘর নিয়ে থাকবে। নিমাইদার ওখানে জায়গা কম। বরাবর গ্রামের বাড়িতে হাত পা ছড়িয়ে থেকেছে। এখন এক ঘরে গুঁতোগুঁতি করে চারজন খুবই অসুবিধে হয়। রান্নাটা একসাথেই হয়। সুখেন এখন বেশ ভালই শিখে গেছে রান্না করতে। যেদিন ওর পালা পড়ে সবাই বেশ তৃপ্তি করেই খায় দেখে। তাই আজকাল ও নিজেই বেশির ভাগ দিন রান্না করার প্রস্তাব দেয়। সবার তৃপ্তি মাখা মুখ দেখতে বেশ ভালো লাগে। নিমাইদা ঠাট্টা করে বলে “ রান্নায় তোর যা হাত যশ খুলছে তুই বরং কারখানা ছেড়ে রান্নাঘরে যা।”
না। সুখেন তা করবে না। কারখানার কাজটাও ওর বেশ ভালো লাগে। তবে এই পেন কারখানার কাজে নতুন কিছু শেখার নেই আর। সেদিন বিরাজদা , ওদের সঙ্গেই থাকে বলছিল কোথায় নাকি আর্মেচার তৈরির কারখানায় লোক নেবে। শুনে ও বলেছে খবর নিতে। অবিশ্যি জায়গাটা সেই কসবার দিকে। তাহলে এদের সঙ্গে আর থাকা হবে না। নিমাই দা শুনে বলেছে
“ নাই হল। কাজ শিখলে ভবিষ্যতে অসুবিধে হবে না। এই বিরাজ তুই দ্যাখ তো। যদি ব্যবস্থা হয় –”
সুখেনেরও অমত নেই। নতুন কিছু শেখার ইচ্ছে আজকাল খুব হয়। আর সত্যি বলতে কি এই ধনাই, ভুবন , কপিল এদের সঙ্গ আজকাল একদম ভালো লাগে না। ধনাই তো শিখা পাত্তা না দেবার পর থেকে যেন ক্ষেপে উঠেছে। কী সব করছে ! দুম করে বিয়ে করে ফেলল। পাতিপুকুরের কোন বস্তির মেয়েকে। ওদের নেমন্তন্নও হল। গিয়ে পেটপুরে খেয়েও এল ওরা সব। সুখেন ভেবেছিল এর পর হয়ত ওর পাগলামি কমবে। বাড়িতে নতুন বউ। মনটাও নরম আর ঠাণ্ডা হবে। কচুপোড়া। শিখাকে দেখলেই সেই ক্ষেপামো। ইদানিং আর কাছে যেতে সাহস করে না শুধু দুর থেকে আজ বাজে কথা ছুঁড়ে দেয়। শুনলে কানে আঙ্গুল দিতে হয়। সুখেন একদিন প্রতিবাদ করেছিল। তার উত্তরে ওকে সবার সামনে এমন হেনস্থা করেছিল ! আর সে কী ভাষা !
“ তোর এত আঠা কেন চাঁদ ? ওই মাগীর পাল্লায় পড়েছিস বুঝি ? গতর দেখে ভুলেছিস? ওই গতরে যদি ঘুণ ধরিয়ে না দিতে পারি আমার নামই স্লা ধনাই নয়।”
ভয়ে সরে এসেছে সুখেন। ধনাইকে বিশ্বাস নেই। ভুবন বলছিল ও সব করতে পারে। কবে নাকি কপিলের কাছে বলেছে শিখার মুখে এসিড ছুঁড়ে মারবে। কী কাণ্ড ! এসব করে পার পেয়ে যাবি তুই ! একটা মেয়েকে বিয়ে করলি। তাকে নিয়ে সুখে থাক। ! তা নয় আর একটা মেয়ের পিছনে ঘুরছে! তার জীবনটাকে নষ্ট করবে বলে ! কী সাংঘাতিক ! এসবের জন্যই আরো এই কারখানা থেকে চলে যাবার মন হয়ে গেছে ওর। আর শুধু ধনাই কেন ? বাকিদেরও যেন কেমন একটা হিংসা ওর ওপর। গোবিন্দদা ওকে পছন্দ করে। সেটা বুঝতে পারে বলেই ওদের রাগ। আশ্চর্য ! নিজের কাজও করবে না ঠিক করে আবার কেউ করলে তাকে হেনস্থা করবে।
আজকাল ছুটি হয়ে গেলেও তাই আর ওদের সঙ্গে বেরোয় না ও। নিজের মত এটা ওটা করে। জিনিসপত্র গুছোয়। পরের দিনের কাজের সব হাতের সামনে এনে সাজিয়ে রাখে। মানে যতটা দেরি ক’রে বেরোন যায় আর কি । সবাই চলে গেলে একা বেরোয়। তাতেও শুনতে হয় কত কথা। বাঁকা বাঁকা ব্যঙ্গ বিদ্রুপ।
“ গোবিন্দ ম্যানেজার জামাই করবে নাকি রে? এত কাজের ঘটা !”
“ গোবিন্দর মেয়ের মুখটা দেখেছিস ?”
“ হ্যা হ্যা হ্যা কেমন গো ধনাইদা ?”
“ কেমন ? ওই গাছের ডালে লেজ ঝুলিয়ে বসে যারা। দেখেছিস তো ? ঠিক ওদের মত।”
(ক্রমশ 🙂
অনবদ্য …. চলতে থাকুক ……