ট্রেনটা যত হাওড়া স্টেশনের কাছাকাছি আসছে ততই বুক ঢিপ ঢিপ করছে মান্তুর। ঝোঁকের মাথায় বেরিয়ে তো পড়ল ! পারবে তো ! পায়ের ফাঁকে রাখা ব্যাগ দুটোর দিকে তাকায় একবার। কি জানি ! শুধু পারা না পারার ভয়-ই নয়– অন্য আশঙ্কাও আছে। কী ভাবে নেবে ওখানকার সকলে ওকে ! যদি কিছু বলে ! যদি অপমান করে ! যদি—– ট্রেনের হুইশেলের থেকেও জোরে নিজের বুকের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল যেন। ওড়না দিয়ে চোখের কোণ দুটো মুছে নেয় একবার। জ্বালা করছে ! কাল সারারাত একফোঁটাও ঘুমোতে পারেনি। এক অজানা উত্তেজনা—অচেনা আশঙ্কা জাগিয়ে রেখেছে ওকে। মা বার বার জিজ্ঞেস করেছে—“ এ ছাড়া আর কি কোন উপায় নেই মান্তু ? পারবি তুই ?’’ না। নেই। দেখেছে তো। অনেকদিন ধরে দেখছেও। চেষ্টার কি কোন কমতি করেছে ! এ দেয়াল—ও দেয়াল মাথা কুটে মরেছে শুধু। লাভ কী হয়েছে ? শুধু দিন চলে গেছে একটার পর একটা। রাস্তাও খোলেনি কোথাও—এতটুকুও ! অনেক ভেবেছে। এ ছাড়া আর কী –ই বা করার ছিল ! হ্যাঁ যেটা ছিল তাতে মান্তুর কোন অমত ছিল না—কিন্তু মা–! সাংঘাতিক বেঁকে বসল যে ! অগত্যা। এই সোজা পথ। আগের দিন গিয়ে দেখে এসেছে। মোটামুটি বোঝেনি যে তাও নয়। তবু আতঙ্ক তো থাকবেই ! কেউ যে কিছু জানেনা ওখানে ! এই ব্যাগগুলো নিয়ে হঠাৎ গিয়ে দাঁড়ালে কী রকম প্রতিক্রিয়া হবে ওখানের—! আবার ওড়না তুলে ঘাম মোছে। আজ কি গরম বেশি ! না-কি ওর-ই বেশি লাগছে উত্তেজনায় ! হবে হয়ত। কখনো তো ভাবেনি যে এপথে যেতে হবে ! বাবা এখনো জানেনা। মাকেও নিষেধ করেছে বলতে। আগে যাক। দেখুক। তারপর সূযোগ বুঝে বললেই হবে। অসুস্থ মানুষ। শুনলে আরো অসুস্থ হয়ে পড়বে। মেনেও কি নিতে পারবে মন থেকে ! যতই যাই হোক—একটা সময় কিছু তো ছিল মানুষটার ! আজ নয়——- হু হু করে ছুটছে ট্রেন। সঙ্গে মনও। এইখানেই কাছাকাছি কোথাও একটা কারখানায় কাজ করত বাবা। বেশ বড় ফ্যাক্টরী। ভালো ব্যবসা। বিশ্বকর্মা পুজোয় কতবার এসে মাংস ভাত খেয়ে গেছে ওরা। ভালো মাইনে—পুজোয় বোনাস। এখনো মনে আছে ওইদিন-ই পুজোর বাজার করত বাবা। ওর ফ্রক—লাল্টু-ফান্টুর জামাপ্যান্ট—মার শাড়ী–। রাতে ফেরার সময় পাড়ার ধনাই কাকার দোকান থেকে রুটি ডিমতড়কা । ওই একদিন পুরো ছুটি ছিল মার। বাড়ি ফিরে নতুন কিনে আনা জামা প্যান্ট চোদ্দবার করে দেখা— বাবা –মার খুনসুটি—মেয়ের তিনটে কেনা হল – আর ছেলেদের দুটো করে ! মার কপট রাগ ! বাবার সাফ উত্তর– ওরা দুজন—মান্তু আমার একেশ্বরী ! ও বেশি পাবে না কেন ! খুশি –আনন্দ—যেন উছলে পড়ত সংসারে। বাবার আদরিনী বলে ঠেস দিত মা—এদিকে বড় মাছটা পাতে দিত মেয়ের-ই। মান্তু কতবার বলেছে –“ ভাইদের দাও না মা—’’ “ তুই খা। ওদের আছে ’’ পাতে ফেলে দিয়ে চলে গেছে মা। বুকের ভেতরটা মুচড়ে ওঠে। কোথায় হারিয়ে গেল দিনগুলো ! কারখানা বন্ধ হয়ে গেল। কোথাও কিছু নেই হঠাৎ কী যে রোগে ধরল বাবাকে—আজকাল ভালো করে চলাফেরাই করতে পারেনা। কেমন যেন বুড়িয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে ! এ দিক –ওদিক ছুটে শেষে পাড়াতেই একটা মুদিখানায় কাজ মিলেছে বটে– কিন্তু করতে পারবে আর কদিন—? শরীরের যা অবস্থা ! ভাই দুটো তো এখনো ছোট ! আর কত দেখবে মান্তু ! কত ভাববে ! যা থাকে কপালে ! লড়ে তো একবার দেখবে। দাঁত দিয়ে ঠোঁটটা চেপে ধরে ও। পেছিয়ে আসা চলবে না কোনমতেই। ইসমাইল চাচা বলেছে সাহায্য করবে। কিন্তু বুড়ো মানুষ ! কতটা কী পারবে কে জানে ? বলে তো ছিল—একটা বেঞ্চি আর বসার জন্য কাঠের টুল একটা জোগাড় করে রাখতে– –চাচা হেসে আশ্বস্ত করেছে ওকে— “ ঠিক আছে। সব হয়ে যাবে। এসো তো তুমি আগে !’’ হয়ত ! হয়ত সত্যি-ই সব ঠিক হয়ে যাবে। নইলে ইসমাইল চাচার সঙ্গে ওর হঠাৎ পরিচয়-ই বা হবে কেন ! ক-দিন আগে কেউ কাউকে তো ওরা চিনত-ই না ! অদ্ভূত ভাবে দেখা— আশ্চর্যনক ভাবে পরিচয় ! সব-কি পুর্ব-নির্ধারিত ! হবার কথা ছিল তাই–! সপ্তা দু-এক আগের কথা ! এরকম-ই ট্রেনে উঠেছে। হাওড়াতেই যাবে। একটা ঠিকানা দিয়েছে গনেশদা। বড়বাজারের কোন এক দোকানের। তাদের লোক লাগবে। পাড়ার লোক হলেও আর ছোটবেলা থেকে চিনলেও ও লোককে খুব একটা বিশ্বাস করেনা মান্তু। কেমন যেন সুবিধের মনে হয়নি কখনো-ই। তবু গায়ে পড়ে যখন ঠিকানাটা দিল– না নিয়ে পারল না । অভাব তো হাঁ করে আছে চারদিকে। নিজেরও কাজকম্ম কিছু-ই জুটছে না। এক বাসনমাজার কাজ ছাড়া। তাতে মান্তুর কিছু যায়-আসত না। কিন্তু মা যেন ক্ষেপে উঠল শুনেই। নিজে এদিকে দুবাড়ীর রান্না ধরেছে। কিন্তু মান্তুকে করতে দেবেনা ! কেঁদে কেটে –ঝগড়া-ঝাঁটি করেও মাকে রাজী করাতে পারল না মান্তু। উলটে বাবার কানে তুলে দেবার ভয় দেখালো ! বাবা যে এটা মেনে নিতে পারবে না –তা ওর থেকে ভালো আর কে জানে ! অগত্যা ! হাল ছাড়তে হল। অন্য কাজ—যে কোন ভদ্র পেশা—তখন মরীয়া হয়ে খুঁজে চলেছে ও। সেই সময়-ই গনেশদার প্রস্তাব। মা বলেছিল—সঙ্গে আসবে। পারল না। ছুটি পেল না। ফলে মান্তু একাই। লেডিজ কম্পার্টমেন্ট। অফিসের ভীড় নেই। কিন্তু ফাঁকাও একেবারে নয়। ট্রেনে বসে বসে যখন ঝিমুনি এসে যাচ্ছে—হঠাৎ-ই সামান্য একটা সোরগোল ! “ গেল—গেল। পড়ে গেল লোকটা !’’ “এই রে অজ্ঞান হয়ে গেল নাকি !’’ “ জল দে—জল দে ’’ “ আরে রাখুন তো ! ওসব নাটক ! এখুনি উঠে বসবে—দেখুন—না সিমপ্যথি কাড়ার চেষ্টা এসব ’’ কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে মুখ বাড়ায় মান্তু। একটা লোক। বয়স্ক। একমুখ দাড়িগোঁফ। সটান পড়ে আছে কম্পার্টমেন্টের মেঝেতে ! কী হল ! এদিক ওদিক চায় ও। কেউ তাকিয়েও দেখছে না। কই ! জল তো কেউ দিচ্ছে না ! বলছিল যে সব ! বাবার বয়সী একটা লোক ! এরকম পড়ে রয়েছে ! অথচ যে যার মত মুখ ফিরিয়ে গল্প করতে লেগে গেছে ! নাটক ! বলে কি এরা ! আর লোকটা উঠছেও না তো ! একটু ইতস্তত করে উঠেই পড়ল মান্তু। ওকে উঠতে দেখে অলস চোখে চাইল কয়েকজন। গুরুত্ব দিল না মান্তু। নিজের ঝোলা থেকে বোতল বে’র করে আগে ওর চোখেমুখে একটু জল ছিটিয়ে দিল। সামনে একটা মস্ত ঝোড়া। লেবু দু-তিন রকম—ধনেপাতা- ক্যাপসিকাম—কলমিশাকের আঁটি—আরো কি-কি সব। ফেরিওয়ালা ! দু একবার জলের ছিটে দিতেই নড়ল চোখ। হাঁ করে দু-এক ঢোঁক জলও গিলল। তারপর-ই ধড়মড় করে উঠে বসার চেষ্টা। আলতো স্বরে ধমক দিল মান্তু, “ না-না—উঠবেন না। শুয়ে থাকুন। আবার পড়ে যাবেন। ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢুকুক।’’ ক্লিষ্ট হেসে মান্তুর নিষেধ না শুনে হাতে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে উঠে বসে লোকটা। “ এক্ষুনি সব নামবেন গো মা। শুয়ি থাকলে বেজার হবেন গো সবাই। উটতি হবে আমারে। ঠিক আচি এখুন।’’ কিছু না বলে দরজার এক পাশে সরে দাঁড়ায় মান্তু। ট্রেন ঢুকছে। শেষেই নামবে ও। কী ভীড় প্ল্যাটফর্মে ! অত ঠেলাঠেলি করে পারবে না। অভ্যেস তো নেই। তবে করে নিতে হবে। যদি আজকে কাজটা হয়ে যায়—এইভাবেই তো আসতে হবে। সকাল ন’টার আগে ঢুকতে হবে নাকি দোকানে। গনেশদা বলছিল। দেখা যাক। একটুক্ষণ অপেক্ষা করে ভীড় কমলে নামার উদ্যোগ নেয় ও । ওমা ! লোকটা ঠায় বসেই আছে। শরীর খারাপ নাকি ! চোখ বোজা। বলবে কি বলবে না ভাবতে ভাবতে একটু ইতস্তত করে বলেই ফেলে, “ আপনি পারবেন বাবা ? না আমি ধরব ?’’ অবাক চোখে চায় লোকটা। এরকম সম্বোধন প্রথম শুনল নাকি ! বাবার বয়সী লোকটাকে আর কী বলেই বা ডাকত মান্তু! “ বাবা ! আমারে তুমি বাবা বুললে ! না মা। আমি পারব। তুমি যাও। দয়ার শরীল তোমার মা। বাবা-ই যদি বুললে তো শুদোই– ক’নে যাবা ? দেকে তো মনে হয় আসা যাওয়া বেশি নাই ইদিকে ’’ “ এই বড়বাজারের একটা দোকানে।’’ “ বড়বাজার কি এট্টুখানি জায়গা মা ? কুনখানে ?’’ ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে ঠিকানা বার করে ওর হাতে দেয় মান্তু। হেসে ফেলে লোকটা, “ পড়তি কি জানি গো মা ? তাইলে আর—’’- “ও’’, তাড়াতাড়ি কাগজটা নিয়ে দেখে দেখে নাম ঠিকানাটা বলে ও। “ অ। বুজেচি। তা চল। আমি দেখায়ে দিব অনে— ঘুর পথ। তুমি একলা পারবা না– ’’ ঝোড়া মাথায় লোকটার পিছু পিছু বেরিয়ে আসে মান্তু। একবারও মনে পড়ে না—মা বারবার বলে দিয়েছিল—কাউকে বিশ্বাস করবি না—কোথায় যাচ্ছিস কাউকে বলবি না। আর ও ! কি করল ! কেমন চেনা নেই শোনা নেই একটা হকারের সাথে কথা বলতে বলতে দিব্যি হাওড়া স্টেশানে ঢুকে পড়ল ! নিজের মনেই হেসে ফেলে মান্তু। মা জানলে কী যে করবে ! তবে লোকটাকে কিন্তু বেশ ভাল বলেই মনে হচ্ছে। মা যাই বলুক—কাকে জিজ্ঞেস করত ও ! কে পাত্তা দেবে ওকে ! তার চেয়ে –– কলকাতা যাবার বাস-স্ট্যাণ্ডে ওঠার মুখে নিজের বোঝা নামাল ইসমাইল। ততক্ষণে ওর নাম, ধাম সব জেনে গেছে মান্তু। চাচা থাকে ডানকুনি। রোজ এই বোঝা নিয়ে বেচতে আসে হাওড়ার এই সাবওয়েতে। সেদিন ইসমাইল –ই ওকে রাস্তা দেখিয়ে– বুঝিয়ে দিয়েছিল। আর কাউকে জিজ্ঞেস করার দরকার পড়েনি। কিন্তু কাজ হয়নি। ওদের লোক নেওয়া হয়ে গেছে। গনেশদা খবরটা ঠিকই দিয়েছিল—তবে দেরীতে। ফেরার পথে ঠিক এক-ই জায়গায় লোকটাকে দেখেছিল মান্তু। ঝোড়া উলটানো। মানে চাচার ব্যবসা শেষ। বেশ তো ! এইটুকু সময়েই হয়ে গেল ! আর তখন-ই বিদ্যুচ্চমকের মত বুদ্ধিটা ওর মাথায় উদয় হল। বেশ কিছুক্ষণ জিরিয়ে নেবার ছল করে চাচার কাছে বসে চারদিকটা দেখে নিয়েছিল। পরের দিন আবার গেছে। তারপর আবারও। পরপর ওকে আসতে দেখে অবাক ইসমাইলও। ততদিনে পরিচয়, জানাশোনাও এগিয়েছে। নিজের কথা বলতেও বাদ রাখেনি। তারপর ওখানে বসেই প্রস্তাবটা করেছে চাচার কাছে। অবাক চোখে তাকিয়েছে ইসমাইল। “ তুমি পারবা ?’’ এর উত্তর জানা নেই মান্তুর। শুধু জানে কিছু একটা করতেই হবে। বাবা আর বেশিদিন টানতে পারবে না। মা’রও রান্নার কাজ করা বন্ধ হয়ে যাবে। হাঁফের কষ্টে প্রাণ যায়। সপ্তাহে দু- তিন দিন শুয়েই থাকতে হয়। ভাইয়েরা ছোট। “ কিন্তু—’’ একটা চাপা আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তা ফুটে উঠেছিল ইসমাইলের চোখে। “ কিন্তু কি ?’’ ব্যগ্র চোখে প্রশ্ন করেছিল ও। “ অনেক ঝামেলা—ঝঞ্ঝাট পোয়াতি হয়গো মা – সে কি তুমি—’’ ততদিনে মন তৈরী হয়ে গেছে ওর। এই ঠিক বাঁচার রাস্তা। “ তুমি একটু সাহায্য কর চাচা। সব বুঝিয়ে দিও।আমি ঠিক পারব। তুমি –তোমরা তো আছো-ই।’’ ‘তোমরা’ শব্দটা শুনে একটা অস্বস্তি ফুটে উঠেছিল ইসমাইলের চোখেমুখে। সেটা তখন ঠিক বোঝে নি মান্তু। নিমেষে ওর চোখ ঘুরে এসেছে আশে পাশের দোকানগুলোর দিক থেকে। তারপর চোখের ওপর হাত চালিয়ে ঘাড় নেড়ে আশ্বস্ত করেছে ওকে, “ঠিক আছে, দেখা যাবে। আগে আসো তো তুমি—তাপ্পর—’’ একটা ঝাঁকুনিতে চটকা ভেঙে যায় ওর। ট্রেন দাঁড়িয়ে গেছে। ঠেলাঠেলি— হুড়োহুড়ি। তাড়া সবার। অফিসের তাড়া –বাস ধরার তাড়া। জীবন যুদ্ধে নেমে পড়ার তাড়া। লম্বা করে একটা শ্বাস নিয়ে সবার শেষে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায় ও। পায়ের কাছে রাখা চটের ব্যাগ দুটো তুলে নেয় দু হাতে। তারপর দুরুদুরু বুকে পা বাড়ায় সাবওয়ের দিকে। দুই “ এক প্লেট আলুর দম দেখি—- না –না—ওই হিং দেওয়াটা- ঝাল একটু বেশি দিও। ’’ “আমাকে এক প্লেট ঘুগনি –কাঁচা পেঁয়াজ বেশি করে ছড়াও—কিপটেপনা কর না—’’ “ পরটা কত করে ? আচ্ছা দুটো দিয়েই দাও আলুর দমের সাথে—’’ হাসিমুখে দ্রুত হাত চালাতে চালাতে আড় চোখে একবার সামনের দিকে চোখ বুলিয়ে নেয় মান্তু। ট্যারচা চোখে এদিকেই চেয়ে আছে নাসির। ওর বিক্রিবাটা দেখে চোখ টাটাচ্ছে বোধহয় ! খুব হিংসুটে। আরে বাবা তোরা তোদের মত কর না—মান্তু কি তাতে ভাগ বসাতে যাচ্ছে ? সবাই তো ক’রে –কম্মে খাবে নাকি ! তোরা একাই খাবি ! যবে থেকে এখানে বসেছে–! যেন ছিনে জোঁকের মত পিছনে লেগে আছে ওর ! প্রথম দিন তো কী হুজ্জুত ! কিছুতেই বসতে দেবে না ! ইসমাইল চাচার ওপর কি তম্বি ! “ কেন ওকে এখানে বসতে দিলে ? একে নিজেদের জোটে না—আবার লোক বাড়াচ্ছ ?’’ চাচা শান্ত লোক। ধীর স্বরে বুঝিয়েছে—মান্তু যেগুলো নিয়ে এসেছে তার একটাও ওদের জিনিস নয়। কোন অসুবিধে হবে না। ঠিক-ই তো। নয়-ই তো। ওদের সঙ্গে কোন মিল আছে ওর ! ওই তো ! দেখে দেখে তো মুখস্থ-ই হয়ে গেছে –— ওই যে ওর সামনের দিকে তাকালে ডানদিকে যেই দোকানটা—ওটা নিবারণদার। সস্তা সিন্থেটিক শাড়ী, সায়া, ব্লাউজ, সালোয়ার কামিজ। বাচ্চাদের ফ্রকও আছে। ওর পাশে ধনঞ্জয়। জিন্সের প্যান্ট—টিশার্ট—এমনি শার্ট—কমদামী—কিন্তু বেশ নজর ধরা ! আর বাঁ দিকে ওই যে নাটের গুরু ! নাসির আলি ! ওটাই পালের গোদা ! ঘড়ি-বেল্ট-ছাতা-মোবাইল নিয়ে বেশ বড় সড় একখানা ঝাঁপ ! বিক্রি-বাটা ভালো-ই তো হয় ! অনেককে-ই ভীড় ক’রে এ ক’দিনে কিনতে দেখেছে মান্তু। লোকটা বেচবার কায়দাও জানে ! কী সব কথা ব’লে লোক টানে ! যেন জাদু আছে গলায় ! লোকগুলো সব আঠার মত আটকেও যায় ওর সামনে ! ভাল ব্যবসা। তবু মান্তুর পিছনে লাগে ! কী যে রীষ ! ওকে বসতে দেবে না ! অদ্ভূত ! চাচাকেও ভড়কাতে এসেছিল “ তোমার পাশে খাবারের দোকান দিতে দিচ্ছো– ! তোমার বিক্রি বাটা আর কিছু হবে ?’’ চাচা চোখ বুজে হেসেছে। “ আরে ব্যাটা ! যে ঘুঘনি –আলুরদম খাবে সে ওটাই খুঁজবে। যার লেবু দরকার সে সেটাই কিনবে। ওতে কিছু ফিকর পড়ে না।’’ জ্বলন্ত চোখে চাচার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে নিজের জায়গায় ফিরে গেছে। যাবার আগে মান্তুর দিকে তাকিয়ে দুটো অভব্য কথা বলতেও ছাড়েনি। কান মাথা গরম হবার জন্য যথেষ্ট। চাচার দিকে চাইতেই ইশারায় শান্ত থাকতে বলেছিল। মুখ বুজেই থেকেছে। তবে এটুকুন বাদ দিলে ব্যবসা কিন্তু ওর বেশ ভালো চলছে। নিজের বুদ্ধির তারিফ না করে পারেনি। ভাগ্যিস মাথায় এসেছিল কথাটা ! মা’র হাতের এ দুটো জিনিস যে বিকোবেই—এ বিষয়ে নিশ্চিত ছিল ও। হলও তাই। প্রথম দিন থেকেই জমে গেল ওর দোকান। আর তাইতেই যেন ও বিষ হয়ে গেল বাকি লোক গুলোর চোখে ! সব যেন গিলে খাবে –এমনি করে তাকায় ! শুধু চাচা আছে বলেই—টিকে আছে। কতরকম ভাবেই যে পিছনে লাগছে ! একদিন হঠাৎ লাঠি হাতে পুলিশ এসে হাজির ! সে দিনটার কথা ভাবলে আজও বুক কাঁপে ওর। মন দিয়ে পরোটাগুলো ভাঁজ করে গুনে গুনে রাখছে। প্রথম দিকে শুধু আলুর দম ঘুগনি-ই ছিল। পরে চাচাই বুদ্ধি দিল—পরোটা রাখো সঙ্গে। আলুর দমের সঙ্গে লোকে ভালো খাবে। তারপর থেকে আনছে। আর চাচার কথা সত্যি ক’রে উড়েও যাচ্ছে গোছা গোছা ! আরো আনলে আরো উঠবে ! লোকের পেটে এত ক্ষিদে থাকে এই সময়টায় জানত না বাবা ! মা’র শরীর ভালো নয়। তাই চাপ দিতে পারে না। মাঝরাত থেকে উঠে দুজনে বসে বসে আলুরদম, ঘুগনি বানায়। খারাপ যাতে না হয়ে যায়— সেদিকে চোখ রাখে। একবার বদনাম হয়ে গেলে ব্যবসা লাটে ! এসেই কৌটোগুলোর মুখ আলগা করে দেয়। আগের মত ছোট ছোট টিফিন-কৌটোয় হয়না। এখন ব্যবসা বেড়েছে। খদ্দের বেশি। বড় বড় ক্যান কিনেছে। তো সেসব-ই গোছগাছ করছে–। পিঁয়াজ ধুয়ে কেটে রাখা—-কাঁচালঙ্কা কুঁচিয়ে রাখা—শালপাতার বাটিগুলো হাতের কাছে রাখা—– ওমা ! হঠাৎ “ এই—এই—তোল—তোল—এখানে বসেছিস যে—’’ চোখ তুলে সামনে তাকিয়ে ভয়ে নীল হয়ে গেল মান্তু ! পুলিশ ! ফটাফট বাড়ি মারছে ক্যানের ওপর—-এক ধাক্কায় ছিটকে ফেলে দিল শালপাতার বাটিগুলো—পিঁয়াজ, কাঁচালঙ্কার কুচিতে ছত্রাকার চারদিক— এপাশ ওপাশ চেয়ে আতঙ্কে দিশাহারা মান্তু ! চাচা নেই ! গেল কোথায় ! ওপাশে দাঁড়িয়ে দাঁত বার করে হাসছে নাসির আলি—ধনঞ্জয়—নিবারণ। প্রায় কেঁদেই ফেলছিল —তখন-ই ভগবানের মত হাজির ইসমাইল। চোখের পলকে বুঝে নিয়েছে। হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল লোকটাকে একটু পাশের দিকে। কী কথা হল কে জানে ! তবে চাচা বলেছে –আর কোন গণ্ডগোল হবে না। মাস গেলে কিছু টাকা লাগবে। ব্যস। ও একা নয়। দিতে হয় সকলকেই। যে যার মত। শুধু ও টাকাটা চাচার হাতে দেয়। নিজে যায় না। নিষেধ আছে চাচার। তাতেও ওদের গোঁসা ! -“-তুমি কি ওর ঠেকা নিয়ে রেখেছো ? – কি ব্যাপার চাচা ? দেখো এ বয়সে আবার পা পিছলিও না—-’’ কি লজ্জা যে লেগেছে মান্তুর। এদের ধর্মজ্ঞানও নেই গো ! বাপের বয়সী লোকটাকে নিয়েও এমন কথা বলে –! তবে সেদিনের পর থেকে আর কোন গণ্ডগোল হয়নি। পরে জেনেছে। চাচাই বলেছে। ওই নাসির-ই ডেকে এনেছিল পুলিশকে। ওকে ওঠাবার মতলবে। কী সাংঘাতিক মানুষ ! তোর কোন পাকা ধানে মই দিয়েছে মান্তু ? খালি হিংসে—খালি নাকাল করার ফন্দি। বাইরের একটা কল থেকে জল নিয়ে আসে ও। সেদিন গিয়ে দেখে—এক লম্বা বোতলের লাইন পড়ে গেছে ! ও গিয়ে দাঁড়াতেই—দাঁত বার ক’রে হাসি নাসিরের। ইঃ হাসি নয়ত–যেন মুলোর দোকান ! রাগে গা জ্বলে গেছে। জল নিতে পারল না। ইচ্ছে করে বোতলের সারি বসিয়ে রেখেছে। চাচাকে বলতেই থামিয়ে দিয়েছে—“ চেপে যা। করুক না। তুই সহ্য কর। একদিন দেখবি নিজেরাই থেমে যাবে।’’ কিন্তু কবে ? এখনো ওরা ওকে নিজেদের বলে মনে করে না। কেউ কক্ষনো কিছু খায়না ওর দোকান থেকে ! এলে পাত সাজিয়ে দিত মান্তু। কিন্তু না। আসে নি। শুধু দূর থেকে জুলজুল করে ওকে দেখবে—–ওর ব্যবসা মাপবে—এত অস্বস্তি হয় ! টং করে একটা আওয়াজ হতে সম্বিত ফেরে ওর। ওঃ ভাবনায় কোথায় ডুবে গিয়েছিল ! আলুর দম শেষ। ঘুগনির ক্যানটায় চোখ ফেলে। আধাআধি আছে এখনো। পরোটাও আছে। আজ আলুরদম আগে বেরিয়ে গেল। যাক। একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে ও। এখন ফাঁকা আছে। মুড়ির ঠোঙাটা বের করে নেয়। একটু খেয়ে নিতে হবে এই সময়। চাচা টিফিন করছে। আজ মুড়ি আর চা ! দ্যাখো দিকি ! শুকনো মুড়ি যে ! একহাতা ঘুগনি তুলে চাচার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়, “ শুকনো মুড়ি কেন গো ? চাচি কিছু করে দেয়নি আজ ?’’ হাত নেড়ে হাঁ হাঁ করে ওঠে ইসমাইল, “ ব্যবসার জিনিস রোজ রোজ দিস কেন বলতো ?’’ ততক্ষণে মুড়ির ওপর ঘুগনি ঢেলে দিয়েছে মান্তু। “ সে বুড়ি কাল থেকে তো উঠতেই পারছে না। জ্বর ’’ মুড়ি মাখতে মাখতে উত্তর দেয় ইসমাইল। “ ইস ! চলছে কী করে গো ? রান্না বান্না কে করছে ?’’ “ কে আর করবে ? ’’ হাসে ইসমাইল। কথা না বলে চুপ করে যায় মান্তু। দু-দুটো জোয়ান ছেলে চাচার। অকালে চলে গেছে। এই বয়সে এখনো রোজগারের ধান্ধায় বেরোতে হয়। ছেলেদুটো মারা যাবার পর থেকে মাথাটাও ঠিকঠাক কাজ করে না চাচীর। প্রায়-ই অসুস্থ। ঘরের কাজ –বাইরের কাজ—একা লোকটা সামলায় কী করে— এটাও আশ্চর্য ! অথচ এতটুকু অভিযোগ নেই কারুর বিরুদ্ধে। একটা নিঃশ্বাস ফেলে নিজের মুড়ির ঠোঙায় পড়ে থাকা আলুরদমের ঝোলটা মাখতে মাখতে নিজের ভাগ্যের কথা ভাবে মান্তু। ওর নিজের-ই বা কি ! কত আদরের মেয়ে ও বাবা-মা’র। বাবার কত স্বপ্ন ছিল। লেখাপড়া শেখাবে— ভালো ঘরে বিয়ে দেবে–। হাঃ। সব কোথায় মিলিয়ে গেল ভোজবাজীর মত ! এই হাওড়া স্টেশানের সাবওয়েতে ঘুগনি –আলুরদম বিক্রি –ই ওর ভবিতব্য হবে –কোনদিন ভেবেছিল ! অথচ আজ—– “ ওই—ও——— হল্লাওয়ালা—– গো ’’- চীৎকার করে সামনে দিয়ে ছুটে বেরিয়ে যেতে যেতে হাঁক মেরে যায় অমর, “ তোল গো চাচা—শিগগীর পালাও— বিরাট গাড়ি —- এক দল ! ’’ মুড়ি মুখে তুলতে পারেনা মান্তু। কী হল ! ও অমন করে চেঁচাতে চেঁচাতে গেল কেন ? লোকটাকে বেশ চেনে মান্তু। অমর তো। ওদিকের সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে গামছা বেচে। লোকটা ছুটছে কেন খামোখা ! চাচার দিকে তাকিয়ে আর এক দফা চমকায়। ধড়মড় করে উঠে পড়েছে। ঝুড়ি ঢাকা দিচ্ছে। “ “কী হয়েছে চাচা ?’’ “পরে বলব। তাড়াতাড়ি জিনিসপত্র গুছিয়ে নে—‘’’ জিনিসপত্র ! মানে ! ওর এই সব ক্যান—ট্যান- ! থতমত খেয়ে অপটু হাতে দ্রুত গোছাবার চেষ্টা করে। হাত থেকে ছিটকে পড়ে যায় হাতা—ক্যানের ঢাকা—সেগুলো তুলতে তুলতেই খেয়াল করে সবাই তাই করছে। ফটাফট ঝাঁপ ফেলছে—পটাপট জিনিস বস্তাবন্দী করছে—নাসির ছুটছে পুঁটলি মাথায় করে ! — কে ! কী হল ! কেন ! বুঝে ওঠার আগেই ওর হাত ধরে টান দিয়েছে ইসমাইল, “ আয় –আয়। থাক। থাক। খালি ক্যান নিতে হবে না। আঃ আবার পিঁয়াজ কুড়োয় ! চল—চল—শিগগীর-’’ কোনমতে ঘুগনির ক্যান আর পরোটার ঠোঙা নিয়ে চাচার পিছু পিছু দৌড়োতে থাকে মান্তু। কোথায় যাচ্ছে এরা ! কোথায় যাবে ও ! ছুটতে ছুটতে পিছু ফিরে চায় আর একবার। বাকি সব বাসন কোসন যে পড়ে রইল——- আবার তাড়া দেয় চাচা–, “ আবার পিছু ফিরে দেখে ! চল চল—’’ দৌড়—দৌড়— আর কতদূর ! কোন দিকে ! অজানা আতঙ্কে ধড়ফড় করতে থাকে বুক ! তবু নিঃশ্বাস বন্ধ করে ওদের পিছু পিছু ছুটতে থাকে মান্তু। প্রাণভয়ে ! নাকি অন্য কিছু কারণে ঊর্ধশ্বাসে দৌড়োচ্ছে মানুষগুলো ! হাঁফাচ্ছে কুকুরের মত ! এখনো কি থামবে না ! আর তো পারছে না ! নিজের দিকে চেয়ে বিশ্বাস হয় না যেন ! কোথায় –কাদের সাথে কতদূরে ছুটে চলেছে ? শেষ কোথায় ? আবার ফিরে আসতে পারবে তো ওর জায়গায় ? নাকি এই ভাবেই ছুটতে হবে বাকি জীবন ! কখনো জীবনের তাগিদে –কখনো বা—-নাঃ। গতি কমছে ওদের ! থামবে বোধহয় এবার ! হ্যাঁ। ওই তো ! বোঁচকা কাঁধে নিয়ে থপ করে বসে পড়েছে নাসির। তাহলে এসে পড়েছে ওরা ! এটা কোন জায়গা ! এখানে কেন ওকে নিয়ে এল চাচা ? আবার এদের সাথে ! চাচা তো জানে ওরা কী চোখে দেখে মান্তুকে ! মুখ ফিরিয়ে পাশের দিকে চায় ও। আর পরক্ষণেই চমকে ওঠে ! ও কী ! বুকে হাত দিয়ে একেবারে গড়িয়ে পড়েছে যে চাচা ! এই বয়সে এতটা ছোটা ! একটু জল ! নিজের কথা ভুলে চাচার দিকে চেয়ে একটু জলের জন্য ছটফট করে মান্তু। ইস ! বোতলটা যদি মনে করে আনত—–! চাচা কি অজ্ঞান হয়ে গেল নাকি ! একটা অস্ফূট আওয়াজ বেরিয়ে এল ওর মুখ দিয়ে। চোখ ফিরিয়ে তাকিয়েছে সবাই। নাসিরও। কি বুঝে নিল কে জানে ! নিমেষে উঠে এল। একপলক চাচার দিকে চেয়ে আবার ফিরে গেল নিজের জায়গায়। বোঁচকা খুলছে। কী বার করছে ? উৎসুক চোখে তাকায় মান্তু ! ও ! যাক। জলটা এনেছে ও ! ছুটে গিয়ে পাশে দাঁড়াল মান্তু। থমকে গিয়েও কী ভেবে ওর হাতেই বোতলটা দিল নাসির। নাঃ। জল দেবার আগেই চোখ খুলেছে চাচা। হাত নেড়ে ইশারা করল চিন্তা না করতে। এতটা ছুটে এসেছে তো ! তাই একটু হাঁফিয়ে গেছে। জল খেল এক ঢোঁক। বাকিটা ফিরিয়ে দিল মান্তুর হাতে। পিছন ফিরতেই চমক ! এতক্ষণ ওরই দিকে চেয়েছিল নাসির ! চোখে চোখ পড়তেই মুখ ঘুরিয়ে নিল। কিছু না বলে বোতলটা সামনে রেখে চাচার কাছে এসে বসল মান্তু। বসার জায়গা কিছু নেই। এটাও সিঁড়ি একটা। কম ব্যবহার হয় ! অন্ধকার ! কী নোংরা ! তারই মধ্যে বসে “হল্লাওয়ালা কি ?’’ ফিসফিস করে প্রশ্ন করতেই বুঝিয়ে দিল ইসমাইল। পুলিশ ! পুলিশ ! এবার অবাক হবার পালা মান্তুর ! পুলিশ কেন ধরবে আর ! চাচা যে বলেছিল——কি একটা বন্দোবস্ত—! তাহলে –! হাসে ইসমাইল। বন্দোবস্ত আছে বলেই তো খবরটা পাওয়া গেল ! আর এ যে- সে পুলিশ নয় ! খোদ জায়গা থেকে আসে। আরে সাবওয়ের ভেতরে এসব করা তো বেআইনি ! তুলে দেবার অর্ডার আছে ওদের কাছে। ধরতে পারলে একেবারে হাজতে। মালপত্র সব বাজেয়াপ্ত। আর হাজত কী জায়গা জানে কি মান্তু ? একবার সে অভিজ্ঞতাও হয়েছে ইসমাইলের। ওরা পুরুষমানুষ—ওরাই পারেনা সহ্য করতে ! আর মেয়েছেলে হলে তো কথাই নেই—শকুন শিয়ালের মত ছিঁড়ে খাবে সকলে মিলে ! ভয়ে কেঁপে ওঠে মান্তু ! কী ভীষণ ! এমন কি মাঝেমাঝেই হয় ! ঘাড় নাড়ে ইসমাইল। তবে কম। তিন চার মাস বাদ বাদ একবার। অর্থাৎ এগুলো এখন সঙ্গী হয়ে যাবে মান্তুর। কতক্ষণ থাকতে হবে এখানে ! চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষগুলোর দিকে চেয়ে আকুল ভাবে প্রশ্ন করে মান্তু। আশ্বাস দেয় ইসমাইল। একটু পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে। যে যার মত জায়গায় গিয়ে বসবে আবার। চিন্তা নেই। আবার চোখ বোজে চাচা। নিঃশব্দে সময় গোনে মান্তু। বুকটা টনটন করে ওঠে ওর। সব জিনিসপত্রগুলো আছে কিনা কে জানে ! নতুন নতুন ক্যান ওর ! মোটে একটা আনতে পেরেছে। কতগুলো পিঁয়াজ ! শালপাতার বাটি ! স্টীলের হাতা ! ইস ! সব নষ্ট করে দিল ! জিনিসগুলো গেলে সব কিনতে হবে আবার ! মাকে-ই বা কী বলবে ? সত্যি বললে মা আতঙ্কেই মরে যাবে। আর ভয় নিজেরও কি কম ! কোনদিন যদি ইসমাইল চাচা না আসে—আর এমন হয়–! ও পারবে এদের সঙ্গে এমনি করে এখানে এসে এতক্ষণ থাকতে ? এরা আস্ত রাখবে ওকে ! হয়ত ইচ্ছে করেই পুলিশের সামনে তুলে দেবে ! আরো কত কী করতে পারে–! উফ ! ভাবলেই বুকের ভেতরটা যেন অসাড় হয়ে আসে ! “ এই নাসির –‘’ নিবারণের ডাকে নিস্তব্ধতা ভাঙে। “ কিছু খাওয়ার আছে রে ?’’ “ নাঃ।’’ কপালের ঘাম মুছতে মুছতে নিঃশ্বাস ছাড়ে নাসির, “ শালা খাবারের ব্যাগটাই নিয়ে আসতে পারলাম না। মাল গোছ করতে গিয়ে সরিয়ে রেখেছিলাম—আনার সময় ভুলে গেছি।’’ “ আমি শালা আজ খাবার-ই আনিনি। ভেবেছিলাম একটা পাঁঊরুটি-টুটি কিনে নেব—তো খুব হল ! তুই ? আছে কিছু ?’’ ধনঞ্জয়ের দিকে ফেরে ওদের দু-জোড়া চোখ। কাঁচুমাচু দেখায় ওর মুখ। “ খেয়ে ফেলেছি রে। আজ এমন খিদে পেল—’’ “ভালো করেছিস ’’, জবাব দেয় নাসির,” তবু পেটে গেছে।’’ “ দূর—’’, নিঃশ্বাস ছাড়ে ধনঞ্জয়, “ ও টুকুতে কী হয় ! ছোটার চোটে তো নাড়িভুঁড়ি শুদ্ধু হজম হয়ে গেছে—’’ স্থির হয়ে শুনছিল মান্তু। ওর পাশে পরোটার গোছা। তারও পাশে ঘুগনির ক্যান। বুকের ভিতর ঢেঁকির পাড় ! নিজের অজান্তেই চোখ পড়ে ইসমাইলের চোখে। হাসছে চাচা। কী বলছে ? বুঝছে না কি মান্তু ? পরিস্কার বুঝছে ! তবে আর দেরী কেন ? এই তো সময় ! নিঃশব্দে ঘুগনির ক্যানের ঢাকা সরায় মান্তু। পিঁয়াজ—রসুন—মশলার গন্ধে ম-ম করে ওঠে একটু আগের দুর্গন্ধময় জায়গাটা। চোখ তুলে একবার সবার দিকে তাকিয়ে নেয় ও। জোড়া জোড়া বুভূক্ষু দৃষ্টি ওর-ই দিকে। অল্প হেসে চামচের অভাবে ক্যান কাত করে ঢাকার ওপর বেশ খানিকটা ঘুগনি ঢেলে দেয় মান্তু। প্যাকেট খুলে বার করে পরোটার গোছা। চাচার হাতে দুখানা ধরিয়ে ফিরে তাকায় দূরের তিন মূর্তির দিকে ! পাথরের মত দাঁড়িয়ে ওরা। দৃষ্টি এদিকেই। সেদিকে চেয়ে অল্প হেসে পরোটার কোনা ছিঁড়ে হাঁক দেয় ইসমাইল। “ কই রে নাসির ! আয় ! খিদে পেয়েছে বলছিলি ! নিবারণ—ও ধনঞ্জয় –তুই-ই বা দাঁড়িয়ে রইলি কেন ? আয়—আয়। মা’র হাতের রান্নাখান কেমন —একবার চেখে-ই দ্যাখ ! ’’ কয়েক মুহূর্ত ! দুরন্ত ক্ষিদে –আর লোভনীয় খাবারের সুগন্ধ ! জেদ বুঝি হার মানে ! নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না মান্তু। আসছে ওরা ! একে একে তিনজনেই ! সামনে ! একেবারে ওর পাশে ! তারপর——- পরের দৃশ্যখানা অতি মনোহর ! চোখ যেন ফেরে না। একসাথে— এক লয়ে—উঠছে চারখানা হাত —পরোটা ছিঁড়ছে—মুখে তুলছে—আবার নামছে—আবার—আবার— —নিঃশব্দে চেয়ে আছে মান্তু। গোপন এক খুশীতে ভরাট হচ্ছে বুক। চওড়া হচ্ছে মুখের হাসি ! দেখছে। চেয়েই আছে। হয়ত এভাবে দেখেই যেত সারাক্ষণ। আর নিঃশব্দে ঢেলে দিত ঘুগনি- হাতে হাতে এগিয়ে দিত পরোটা— ক’জোড়া ক্ষুধার্ত চোখের তৃপ্ত চাহনিতে তুষ্ট হত মন ! হয়ত ! কিন্তু —হঠাৎ-ই হাত থামে নাসিরের। চোখে চোখ কয়েক পলক ! একটা অপ্রতিভ হাসি খেলে যায় ওর আপাত গম্ভীর মুখের আনাচে কানাচে। তারপর মুখে জমা খাবারের টুকরো গলার ভেতরে চালান করতে করতে অবরুদ্ধ গলায় বলে ওঠে, “ তুমি বসে রইলে যে ! খাবে না ? এসো হাত লাগাও ! নইলে কিন্তু সব শেষ হয়ে যাবে !’’ হা-হা করে হেসে ওঠে নিবারণ– ধনঞ্জয়। “ ঠিক ঠিক। চলে এসো—দেরী করে লাভ কি ? যা আছে সবাই মিলে ভাগ করে– –’’ এক লহমায় চোখে জল এসে যায়। এই তো –এইটুকু-ই তো চাওয়া ছিল ওর ! এই হাসি—এই কথা– এই আত্মজনের সান্নিধ্য ! এইটুকুর প্রতীক্ষায়ই তো ছিল এতদিন। আরো কত ––কী সব বলে যাচ্ছে ওরা ! বাকিগুলো আর কানে পৌঁছোয় না ওর। একটু আগের আতঙ্ক—অনিশ্চয়তা—সব যেন জাদুমন্ত্রে উধাও হয়ে গেছে ! ফুরফুরে হয়ে গেছে ভেতরটা ! নিজের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হয় মান্তু ! স্বজন সান্নিধ্যে দিব্যি হালকা লাগছে। আর ভয় করছে না ওর ! একটুও না।