রাজা উমেশ প্রতাপ সিং বোধ হয় আর রাজ্যটাকে রক্ষা করিতে পারিলেন না। লর্ড ডালহৌসির স্বত্ববিলোপ নীতিতে তিনি আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়াইয়া পড়িয়াছেন। বৃটিশ গভর্মেন্টের উর্দিধারি ‘জুনাগড়ে’ আসিয়া তাঁহার হস্তে চুক্তিপত্রের দিনক্ষণের হলফনামা ধরাইয়া গিয়াছেন। এমতাবস্থায় প্রধান সেনাপতি মাধব সিং বৃটিশ গভর্মেন্টের হলফনামার খবর শুনিয়া কাহাকেও কিছুই না জানাইয়া কোথায় যে উধাও হইয়া গিয়াছেন সেইটাও তাঁহার অজানা। দুশ্চিন্তা,দুর্ভাবনায় বিধ্বস্ত উমেশ প্রতাপ সিং এর এই মুহূর্তে কি করনীয় সেটা কিছুতেই বুঝিতে পারিতেছেন না।
রাজ্যে যে এমন দুর্দিন মর্মান্তিক ভাবে ঘনাইয়া আসিবে রাজা উমেশ প্রতাপ সিং তাহা স্বপ্নেও ভাবিতে পারেন নাই। পাঁচ দিনের কালাজরে আক্রান্ত হইয়া আঠাশ বৎসরের যুবরাজ উদয় প্রতাপ সিং এর অকাল প্রয়ান তাঁহার আশা ভরসা গুলোকে চিরতরে লণ্ডভণ্ড করিয়া দিয়াছে। তিল তিল করিয়া গড়িয়া তোলা এই রাজ্য মৃত্যুর পর সবই যাইবে বৈদেশিক শক্তি বৃটিশ সাম্রাজ্যের হস্তে। পরাধীনতার গ্লানিকে সঙ্গি করিয়া বৈধব্য জীবনের বাকি দিনগুলি রাণী পার্বতী বৃটিশ গভর্মেন্টের দেওয়া মাসোহারায় অতি কষ্টে দিনপাত করিবে। ভবিষ্যতের বাস্তব চিত্রটি যতই তাঁহার চোখের সামনে ছবির ন্যায় ভাসিয়া উঠিতেছে, এক কালের দোর্দণ্ড প্রতাপ উমেশ প্রতাপ সিং এর দুই চক্ষু অশ্রুসিক্ত হইয়া উঠিতেছে।
মধ্য রজনী, রাজা উমেশ প্রতাপ সিং এর চোখে ঘুম নাই। ভেবেই চলেছেন পরের দিবসে সূর্য উদয় হইলে তাঁহার জন্যে কি সংবাদ অপেক্ষা করিয়া আছে।
এইটাই বোধহয় আত্ম বিশ্লেষণের উপযুক্ত সময়। অল্প বয়সে যখন শরীরে ঊষ্ণ রক্ত প্রবাহিত হইত তখন তো সর্বক্ষণই আত্মশ্লাঘাতেই বিভোর থাকিতেন। দুঃসময় না আসিলে আত্ম বিশ্লেষণ মস্তিষ্ককে ভারাক্রান্ত করেনা। ভালো হইতে মন্দ স্মৃতি গুলো তাঁকে কুরিয়া কুরিয়া খাইতে লাগিল। ললাট লিখনে আর কি আছে কে জানে!! প্রজা বৎসল রাজা হইয়াও কেন এমন করুন পরিনতি? তাহা হইলে কি তাঁহার অন্য কোনো পাপকর্মের ফল !! কথাটি ভাবিতেই মনে পড়িয়া গেল তেইশ বৎসর পূর্বের সেই রাতের ঘটনা——-
বর্ষা মুখর রজনী, নাচ মহলে চলিতেছে সুরা পানের সহিত মতীবাঈজীর স্বকন্ঠে ঠুংরি টপ্পা। আহা কি রূপ তাহার, চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িতেছে সেই অকল্পনীয় রূপের ছটা। অনিন্দ ও অনুপম তার দেহলতা, শরদিন্দু বিনিন্দিত কমল সদৃশ তার চটুল বদনখানি, যেন পক্ব বিম্ব ফলের ন্যায় রক্তিম চারু ওষ্ঠাধর। নীলোৎপলের ন্যায় দুইটি চক্ষুতে কাজল রেখা অঙ্কন করিয়া অতিশয় মহিমান্বিত হইয়া স্বহাস্যে রাজা উমেশ প্রতাপ সিংকে তৃপ্ত করিতে উদগ্রীব, রাজা উমেশ প্রতাপ সিং কে বাস্তব জগৎ হইতে স্বপ্নের রাজ্যে নিয়ে যাইতে বদ্ধ পরিকর। এমতাবস্থায় অবসর বিনোদনে জন্য মতীবাঈ ছাড়া রাজা উমেশ প্রতাপ সিং অন্য কাহাকেও ভাবিতেই পারেন না। কারন, যেমন তাহার রূপ, তেমনি কোকিল কন্ঠি যুবতীর যৌবন নদীর জল যেন বাঁধ মানিতে চাহে না। প্লাবিত হইয়া দুই কুল ভাসাইয়া নিয়া যায়। রাজা উমেশ প্রতাপ সিং এমনতর নদীতে একাকি-ই অবগাহন করিতে চাহেন। ফল স্বরূপ মতীবাঈকে নাচ মহলেই প্রায় বলপূর্বক বন্দী করিয়া রাখিয়াছেন। মতীবাঈ এর সখ আহ্লাদ রাজা উমেশ প্রতাপ সিং-ই পূর্ণ করিয়া থাকেন, শর্ত নাচ মহলের বাহিরে মতীবাঈ চরণ স্পর্শ করিতে পারিবে না।
মধ্য রজনী, নাচ মহল হইতে সুরাসক্ত অতিথিরা একে একে বিদায় লইয়াছেন। অন্তিম রজনীটা নিদ্রার নিমিত্তে নাচ মহলেই রাজা উমেশ প্রতাপ সিং এর শয্যা প্রস্তুত করা হইয়াছে। মতীবাঈ এর স্কন্ধে ভর করিয়া সুরাসক্ত রাজা শয়ন কক্ষের দিকে আগাইয়া চলিয়াছেন। এমতাবস্থায় বিনা ভূমিকায় মতীবাঈ মদ্যপ রাজাকে কহিলেন-” হুজুর আপনার সাথে আমার একটি কথা বলিবার ছিল।” উমেশ সিং কিছুদিন ধরিয়া বলিয়া আসিতেছিলেন যে তিনি মতীবাঈকে একটা জড়োয়ার হার উপহার দিবেন। ভাবিলেন মতীবাঈ সুযোগে তাহাই মনে করাইয়া দিতে চাহিতেছেন। ফলে টলমল অবস্থায় হাঁটিতে হাঁটিতে বলিলেন-” তোমার জড়োয়ার হার তুমি পাইবে মতীবাঈ, আমার মনে আছে।” — না হুজুর, আমি সে কথা বলিতে চাহিতেছি না। — তাহা হইলে কহ তোমাকে কি উপহার দিলে তুমি আরো খুশি হইবে? তুমি আমার চন্দ্রমুখী, ও বদনে আমি অমানিশার অন্ধকার দেখিতে চাহি না। তুমি যাহা চাহিবে আমি তাহাই——। রাজা উমেশ প্রতাপ সিং এর কথা সমাপ্ত করিতে না দিয়াই মতীবাঈ মিনতির সুরে কহিলেন-” হুজুর আপনার বংশধর যে আমার শরীরে তিলতিল করিয়া বাড়িয়া উঠিতেছে।” মতীবাঈ এর মুখে ‘আপনার বংশধর’ কথাটি কর্ণ গোচর হইতেই সুরাসক্ত উমেশ প্রতাপ সিং এর সুরার উন্মাদনা টুটিয়া গেল। তিনি চিৎকার করিয়া কহিলেন-” না না এ মিথ্যা, তুমি অধিকার লালসার মোহে অন্ধ হইয়া গিয়াছ,তুমি ঠগ,তুমি প্রবঞ্চক, তুমি মিথ্যা বলিতেছ।” নিমেষের মধ্যে মদ্যপ রাজা উমেশ প্রতাপ সিং এর রুদ্ররূপ দেখিয়া মতীবাঈ ভয়ে শিহরিত হইয়া, ক্রন্দনরত অবস্হায় ভাঙ্গিয়া পড়িয়া কহিল-” না হুজুর,এ মিথ্যা নয়, এ যে চরম সত্য।”
রাজা উমেশ প্রতাপ সিং পরের দিন দরবারে না আসিয়া নিভৃতে সমস্ত দিন অন্দরমহলে কাল যাপন করিলেন। ভাবিলেন কিভাবে এই পাপ হইতে নিষ্কৃতি পাওয়া যাইবে। পরিশেষে মনম্ত করিলেন এমন কিছু করিতে হইবে যাহাতে কোনোদিন জনসমক্ষে এই ঘটনা উত্থাপিত না হইতে পারে। নিজ বংশকে কালিমালিপ্ত করিতে তিনি একেবারেই প্রস্তুত নন।
সন্ধ্যার পর সেনাপতি মাধব সিং কে ডাকিয়া মতীবাঈ এর বিষয়ে সবিস্তারে বর্ণনা করিলেন, এবং এমতাবস্থায় নিজস্ব সিদ্ধান্তে অবিচল থাকিয়া হুকুম করিলেন-” আপনি আজ গভীর রজনীতেই কোনো এক অজুহাতে মতীবাঈকে নাচমহল হইতে বাহির করিয়া সাবরমতী নদীর তীরে লইয়া যাইয়া মুণ্ডচ্ছেদ করিয়া নদীর জলে ভাসাইয়া দিবেন।” সেনাপতি, উমেশ পতাপ সিং কে বুঝাইয়া বলিলেন যে নিজ স্বার্থে নরহত্যা রাজ্যে এবং নিজের পক্ষে অমঙ্গলকর। অন্য কোনো ব্যাবস্থা করা শ্রেয় নয় কি!! কিন্তু মতিভ্রম উমেশ প্রতাপ সিং যে চিরতরে প্রমান লোপ করিতে চাহিতেছেন। কোনোরূপ বিকল্প পন্থাই তাঁর কর্ণ গোচর হইল না। অগত্যা সেই হুকুমই জারি রহিল।
ঐতিহাসিক ভুল সিদ্ধান্তের স্মৃতি টি উমেশ প্রতাপ সিং এর মনকে শতগুণ নাড়াইয়া দিল।
সেনাপতি মাধব সিং, রাজা উমেশ সিং এর সর্বাপেক্ষা কাছের নির্ভরশীল মানুষ। তাঁহারি বিচক্ষণ বুদ্ধিমত্তায় রাজ্যটি বৃটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে থাকিয়াও স্বাধীন ভাবে পরিচালিত হইতেছে। বৃটিশ শক্তির সাম্রাজ্য কায়েমের নানা রকম ছলচাতুরীর হাত হইতে এই রাজ্যকে বারেবারে রক্ষা করিয়া আসিয়াছেন। আজ এমন দিন আসিল যে এ যাত্রায় আর মাধব সিং এর বুদ্ধিমত্তায় বোধহয় কাজ হইবে না।
পরদিন রাজা উমেশ প্রতাপ সিং দরবারে বসিয়াছেন বটে, তবে রাজ কার্যে একেবারেই মন বসিতেছে না। অতি প্রয়োজনীয় কিছু কাজকর্ম সারিয়া তিনি দরবার মুলতুবি করিয়া দিলেন। মনের মধ্যে চরম অস্থিরতা তিনি কিছুতেই প্রশমন করিতে পারিতেছেন না। আহার নিদ্রা পরিত্যাগ করিয়া রাজা উমেশ প্রতাপ সিং রুদ্ধদ্বারে কাল যাপন করিতে লাগিলেন। তাহার মস্তিষ্কে কোনো রকম ইতিবাচক ভাবনা চিন্তার উদয় হইতেছে না। ঐতিহাসিক ভুলের জন্য নিজেই বারেবারে নিজেকে তিরস্কৃত করিয়া চলিয়াছেন।
দিন চারেক অতিক্রান্ত করিয়া প্রধান সেনাপতি মাধব সিং প্রাসাদে ফিরিলেন। রাজা উমেশ প্রতাপ সিং সেনাপতি মাধব সিং কে দেখিয়া অন্তরে যেন স্বল্প হইলেও বল পাইলেন। মানষিক ভাবে বিধ্বস্ত রাজা, মাধব সিং কে কহিলেন-” এই কয়দিন আপনি কোথায় ছিলেন সেনাপতি! একদিকে পুত্রশোক, অন্যদিকে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের অঙ্গুলি হেলন। আজ আমি নিজ ভূমে পরবাসী।” রাজা মশাইকে আস্বস্ত করিয়া সেনাপতি মাধব সিং কহিলেন-“বিষয়টা নিয়ে আমিও চিন্তিত হুজুর, চুক্তপত্রে শিলমোহর বসাবার আগে আমাদের একটা উপায় বাহির করিতে হইবেই হইবে। আপনি মনটাকে শান্ত করুন।” — কি করিয়া শান্ত হইব সেনাপতি, চোখের সামনে আমি যে আমার ভবিষ্যৎ দেখিতে পাইতেছি। — এতটা উতলা হইবেন না হুজুর! — উতলা নয়, সেনাপতি এ আমার অনুশোচনা। — আপনার মনে আছে, তেইশ বৎসর আগের সেই রাতের ঘটনা! — ভুলি কেমনে সেনাপতি, জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ভুলটাকে কি এতো সহজে ভোলা যায় !!! সেদিন যদি মা সমেত ভ্রুনটাকে——–। — না হুজুর,
। — তাহা হইলে!! ব্যতিব্যস্ত হইয়া উঠিলেন রাজা উমেশ প্রতাপ সিং। — সেই রাতে আপনার দেওয়া মতীবাঈকে হত্যার আদেশ যখন আমি খন্ডন করিতে পারিলাম না। তখন ভাবিলাম নিজে নিসন্তান হইয়া কি প্রকারে ভ্রূণ সহ একজন ভাবি মাকে হত্যা করিব। — বলুন,বলুন,চুপ করিয়া থাকিবেন না সেনাপতি। — আপনি শান্ত হন হুজুর, চিত্ত চাঞ্চল্য আমাদের ভুল পথে চালিত করিতে পারে। — তারপর কি হইল বলুন সেনাপতি,আমার চিত্ত বিভ্রান্তি ঘটেনি, আমি শান্ত চিত্তেই আছি। — আমি মতীবাঈকে গোপনে আপনার পরিকল্পনা সবিস্তারে বলিতে বাধ্য হইয়াছিলাম। সাথে সাথে আমার সিদ্ধান্তটাও তাকে জানিয়ে বিশ্বস্ত লোক মারফত মতীবাঈকে যোধপুরের এক অজ্ঞাত স্থানে পাঠাইয়া দিয়াছিলাম। — তাহার পর, তাহার পর!!! — সেই অজ্ঞাত স্থানে জন্মনেয় আপনার কনিষ্ঠ রাজপুত্র যুবরাজ সূর্য প্রতাপ সিং। নামকরণ করিয়াছিলেন স্বয়ং মতীবাঈ। বর্তমানে তার বয়স বাইশ বৎসর পূর্ণ হইয়াছে। — আমি আর ধৈর্য্য ধরিয়া রাখিতে পারিতেছি না। বলুন কোথায় সেই অজ্ঞাত স্থান? — বলিব, কিন্তু তাহার পূর্বে আমাদের কিছু প্রয়োজনীয় কর্ম সারিয়া রাখিতে হইবে। — বুঝিতে পারিয়াছি আপনি মতীবাঈ এর নিকট গিয়েছিলেন। কিন্তু তাহাদের কি স্ব-সম্মানে সঙ্গে করিয়া লইয়া আসিয়াছেন? — না হুজুর,মতীবাঈ এর অভিমান আমি ভাঙাইতে পারিনাই। তবে তিনি তাঁহার তরফ থেকে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করিবেন বলিয়া ভরসা দিয়াছেন। কারন সন্তানটি তো আপনার। শুধু মাত্র আপনার প্রয়োজন তাহাই নহে সূর্য প্রতাপ সিং এর পরিচয়ও যে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। — আপনি তাঁর নিকট সংবাদ প্রেরণ করুন, আমি নিজে উপস্থিত হইয়া স্ব-সম্মানে তাহাদের দুইজনকে জুনাগড়ে ফিরাইয়া আনিব। — যুবরাজ সূর্য প্রতাপ সিং কে আমি সঙ্গে করিয়াই আনিয়াছি। কারন রাজ পরিবারের আদবকায়দা তাঁহাকে যতটা সম্ভব রপ্ত করিতে হইবে। — কোথায় সেই আমার শাপে বর পাওয়া বংশপ্রদীপ??
মাধব সিং এর আদেশে একজন দ্বাররক্ষী সূর্য প্রতাপ সিং কে রাজা উমেশ প্রতাপ সিং এর সম্মুখে আনিলেন। রাজা উমেশ প্রতাপ সিং সূর্য প্রতাপ সিং কে দেখিয়া অপত্য স্নেহে এক অপ্রত্যাশিত অনাবিল আনন্দে আলিঙ্গনরত অবস্থায় কহিলেন- ” সেনাপতি এ যে আমার বিশ বৎসর বয়সের অবয়ব!! ” — “ঠিকই বলিয়াছেন হুজুর, আপনার বিশ,ত্রিশ বৎসরের হুবহু বাহ্যিক লক্ষণ প্রাপ্ত হইয়াছে যুবরাজ সূর্য প্রতাপ সিং। ভগবানের আশীর্বাদ আছে,কারন হুবহু আপনার অল্প বয়স কালের ন্যায় দেখিতে হওয়ায় পরবর্তী পর্যায়ে আমাদের কিছুটা সুবিধাই হইবে। রাজ্যবাসির যুব রাজকে মানিয়া লইতেও কোনো প্রকার সংকোচ হইবে না।
১৮৪৮ সন হইতে ১৮৫৬ সন পর্যন্ত লর্ড ডালহৌসি বৃটিশ সাম্রাজ্যকে আরো শক্তিশালী করিবার নিমিত্তে স্বায়ত্তশাসনকে কায়েম করিবার জন্য উদগ্রীব হইয়া উঠিয়াছিলেন, বিভিন্ন অজুহাত গুলোর মধ্যে সর্বাপেক্ষা লাভবান হইয়াছিল স্বত্ব বিলোপ নীতি প্রবর্তন করিয়া। অনেক অপুত্রক রাজার রাজ্য রাজার মৃত্যুর পর বৃটিশ সাম্রাজ্যের হস্তে অর্পণ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন।
বর্তমানে লর্ড ক্যানিং এর শাসন কাল চলিতেছে। কলিকাতার মসনদ হইতে শ্যেনদৃষ্টি দিয়ে সমগ্র ভারতবর্ষের উপর নজর রাখিয়া চলিয়াছে। শুধুমাত্র আঞ্চলিক স্বশাসিত রাজ্য গুলো নয়, জমিদারদের উপরও বৃটিশ সাম্রাজ্যের তীক্ষ্ণ নজর আছে।
জুনাগড়ের যুবরাজ উদয় প্রতাপ সিং এর অকাল প্রয়ানের খবর কলিকাতার মসনদে পৌঁছাইতে যতটুকু সময় লাগিয়াছে। শমন আসিতে কালক্ষয় করা হয় নাই। চুক্তিপত্র প্রস্তুত থাকিলে রাজার অবর্তমানে রাজ্য কায়েমে সমস্যার সম্মুখীন কম হইতে হয়। নির্দয়,পাষণ্ড ইংরেজ শাসকদের মধ্যে শোক স্তব্ধ রাজ পরিবারের প্রতি কোনো প্রকার সহানুভূতির স্থান থাকে না।
হলফনামার দিনক্ষণ ধরিলে হস্তে মাত্র চার পক্ষকাল সময় আছে। সেনাপতি মাধব সিং ও রাজা উমেশ প্রতাপ সিং সিদ্ধান্ত নিলেন, যাহা করিবার দুই পক্ষ কালের মধ্যেই করিতে হইবে। এবং সেই মোতাবেক পরিকল্পনা ঠিক করিতে হইবে। বৃটিশ গভর্মেন্টেকে দুর্বল ভাবিলে নিজেদের বোকামিকে প্রাধান্য দেওয়া হইবে।
যোধপুরের এক প্রত্যন্ত গ্রামে জুনাগড়ের রাজ কর্মচারীর ছদ্মবেশে রাজা উমেশ প্রতাপ সিং আসিয়া উঠিলেন মতীবাঈ এর গৃহে। যতই ছদ্মবেশ ধারণ করুন না কেন মতীবাঈ এর চোখকে ফাঁকি দিতে পারিলেন না। শেষে মতীবাঈ এর কাছে আত্মপ্রকাশ করিয়া কাতর অনুনয়-বিনয়ের সহিত কহিলেন-” আমাকে ক্ষমা কর। সেইরাতে বংশ মর্যাদা রক্ষার্থে আমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তাহার জন্য আমি অনুতপ্ত, মর্মাহত।” মতীবাঈ বুকে পাথর চাপা দেওয়া দুঃখ নিজের মধ্যে লুকাইয়া রাখিয়া ব্যথিত মননে কহিল-” আপনি রাজা, আমি সামান্য বাইজী, অমার কাছে ক্ষমা প্রর্থনা করিয়া নিজেকে খাটো করিবেন না হুজুর। সেনাপতি মাধব সিং যদি সেই রাতে আপনার নির্দেশ পালন করিতেন তাহলে আজ কি আপনি ক্ষমা ভিক্ষা করিবার সুযোগ পাইতেন?? ” — আমি শুধুমাত্র ক্ষমা ভিক্ষা করিতে আসিনাই, আমি তোমাকে ছোট রানির মর্যাদা পূর্বক জুনাগড়ে স্বসম্মানে লইয়া যাইতে আসিয়াছি। মতীবাঈ দোর্দণ্ড প্রতাপ রাজা উমেশ প্রতাপ সিং এর ভাগ্যের পরিহাস উপলব্ধি করিয়া মৃদু হাসিয়া কহিলেন-” হুজুর, এই বয়সে আসিয়া নিজের বংশ মর্যাদা নাই বা হারাইলেন!!” উমেশ প্রতাপ সিং মতীবাঈ এর অভিমানের কারন অনুধাবন করিয়া এবং রাজ্যের স্বার্থের কথা ভাবিয়া হাত জোড় করিয়া অনুরোধ করিয়া কহিলেন-” বয়স হইয়াছে,তাহার উপর পুত্রশোকে ভাঙিয়া পড়িয়াছি। সাধের রাজ্যও বৃটিশ সাম্রাজ্যের হস্তগত হইতে চলিয়াছে, শুধুমাত্র মাধব প্রতাপ সিং এর বিচক্ষণতায় রাজ্যকে রক্ষা করিবার একটা সুযোগ আসিয়াছে। সর্বোপরি সূর্য প্রতাপ সিং তো তোমারি সন্তান,তুমি নিশ্চই তার মঙ্গল কামনা কর। এ সব কিছুই সম্ভব শুধু তোমার জীবনে যা যা ঘটিয়াছিল সেইটা অকপটে স্বীকার করিয়া লওয়া। আমি আর কতদিন বল!!”
এমতাবস্থায় মতীবাঈ চিন্তা করিলেন, হাজার হোক একজন স্বাধীন রাজ্যের রাজা তো বটে, স্ব শরীরে আসিয়াছেন তাহার নিকট, নিজ স্বার্থ যতই হউক, দেশের স্বার্থও তো বটে । মতীবাঈ রাজি হইলেন জুনাগড়ে ফিরিতে, তবে একটা অভিমানি শর্তে, জুনাগড়ে তাঁর প্রয়োজন শেষ হইলেই মতীবাঈ যোধপুরের এই পল্লিগ্রামে ফিরিয়া আসিয়া আমৃত্যু কাল অজ্ঞাত বাসেই থাকিবেন। রানী সাজিয়া এই বয়সে আর রাজ প্রাসাদে থাকিবার তাঁহার বিন্দুমাত্র অভিপ্রায় নাই।
জুনাগড়ের প্রতিটি প্রজার কাছে সুসংবাদ পৌঁছাইয়া গিয়াছে যে আগামী ২৬/০৮/১৮৫৭ তারিখে জুনাগড়ের মসনদে রাজ্যাভিষেক হইবে কনিষ্ঠ যুবরাজ সূর্য প্রতাপ সিং এর। রাজ্য জুড়িয়া উৎসব পালিত হইবে। রাজ্যের কোনায় কোনায় লঙ্গরখানা খোলা হইবে। সেইখানে রাজ্যের সমস্ত সাধারণ প্রজাগনের জন্য বিনা মূল্যে সারা দিনের আহারের ব্যবস্থা থাকিবে। সরকারি নিয়মে সেইদিন ছুটিও ঘোষনা হইবে। সেনাপতি মাধব সিং হস্তি বাহিনী, অশ্ব বাহিনী এবং পদাতিক বাহিনীকে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির ন্যায় প্রস্তুত করিয়া রাখিতে বলিয়াছেন। জুনাগড়ের প্রজাগণ মনে করিতে পারিতেছেন না যে পূর্বে এ রাজ্যে এত বড় উৎসব হইয়াছিল কিনা!
কথায় আছে দেওয়ালেরও কান আছে। এতো বড় কর্মযজ্ঞ কি আর গোপনে করা সম্ভব? ঘরের শত্রু বিভীষণের মতো রাজ্যেও তো গুপ্ত শত্রুও বিদ্যমান। সেই মারফত বৃটিশ গভর্মেন্টের কানে সংবাদ পৌছাতে সময় লাগিলনা।
অবশেষে সূর্য প্রতাপ সিং এর রাজ্যাভিষেকের দিন উপস্থিত হইল। বৃটিশ গভর্মেন্টের সাথে স্বত্ববিলোপ নীতির চুক্তপত্র সাক্ষরের আর ঠিক দুই সপ্তাহ বাকি। রাজ পরিবার হইতে চুক্তি বাতিলের পত্র লইয়া রাজার দূত কোলকাতার উদ্যেশ্যে রওনা দিয়াছে। হয়ত সেই পত্র এতদিনে লর্ড ক্যানিং এর হস্তে পৌঁছাইয়াও গিয়াছে। এদিকে সমস্ত রাজ্য জুড়িয়া দুন্দুভি দামামার শব্দে মুখরিত। সমগ্র গড় আজ পুষ্প শোভায় শোভিত। পথে চলিতেছে আবিরখেলা। রাজ মহিষী পার্বতী এবার সূর্য প্রতাপ সিং এর ললাটে রাজ্যাভিষেকের মঙ্গল তিলক অঙ্কন করিবেন, রাজা উমেশ পতাপ সিং নিজের মাথার মুকুট যুব রাজের মাথায় পরাইবেন ঠিক তখনি বৃটিশ গভর্মেন্টেরের ল্যান্ড রেভিনিউ দপ্তরের সাহেবরা আসিয়া বাধা দিয়া কহিলেন-” এই প্রহসনের অর্থ কি?” সেনাপতি স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিলেন-” বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের সহিত আমরা প্রহসন করিতেছি,এটা আপনাদের মনে হইবার কারনটি জানিতে পারি কী?” — আমাদের কাছে খবর আছে এইটা সাজানো ঘটনা মাত্র। — সেইটা তো প্রমান সাপেক্ষ সাহেব। — বেশ তাহা হইলে প্রমান দিবেন। — কনিষ্ঠ রাজপুত্রের জন্ম বৃত্তান্ত লইয়া এক্ষণে রাজদূত কোলকাতায় পৌঁছাইয়াছে। আশা রাখি পত্রখানি এতক্ষণে লর্ড ক্যানিং এর হস্তে পড়িয়া গিয়াছে। তবুও আপনাদের জানিয়ে দিতে চাই, ছোট রানির পুত্র যুবরাজ সূর্য প্রতাপ সিং এর রাজ্যাভিষেক হইতে চলিয়াছে। — উত্তম খবর,কিন্তু জুনাগড়ের কাগজ পত্রে রাজা উমেশ প্রতাপ সিং এর দ্বিতীয় পুত্র সম্পর্কে তেমন কোনো উল্লেখ নাই। — উল্লেখ না থাকিলে সত্য কি মিথ্যা হইয়া যায় সাহেব?? পারিবারিক কারণে সত্যটা গোপন রাখা হইয়াছিল। এবং এইটা রাজ পরিবারের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। বর্তমানে দুই রাজ মহিষী এখানে উপস্থিত। একজন সাহেব একটু উত্তেজিত হইয়া কহিলেন-” আমরা এসব কিছুতেই মানিতে পারিব না। এ প্রহসন বন্ধ করুন, নয়ত বৃটিশ গভর্মেন্টে ব্যবস্থা নিবেন। গড়ে যখন বাকবিতন্ডা চলিতেছে গড়ের বাহিরে তখন দামামা দুন্দুভিধ্বনিতে যুবরাজ সূর্য প্রতাপ সিং এর জয়ধ্বনিতে চারদিক মুখরিত হইয়া উঠিল। রাজা উমেশ প্রতাপ সিং স্ব মহিমায় উচ্চ স্বরে বলিয়া উঠিলেন-” প্রয়োজনে আমরা যুদ্ধ করিতে প্রস্তুত আছি, কিন্তু সংকল্প হইতে এক চুলও পিছাইয়া আসিব না।”
রাজা উমেশ প্রতাপ সিং এর দৃঢ় প্রত্যয় দেখিয়া সাহেবরা ভাবিলেন, ইন্ডিয়ান কিং দের মধ্যে এইরূপ অবৈধ সম্পর্ক অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়। ফলে রাজ্যবাসী এবং রাজ পরিবার যদি অবৈধ সন্তানকে যুবরাজ হিসাবে মানিয়া লয় তো তাহারা বিরোধিতা করিলে বিদ্রোহ মাথাচাড়া দিয়া উঠিবে। ফলে বর্তমান পরিস্থিতি জানাইয়া কোলকাতায় লর্ড ক্যানিং এর দপ্তরে প্রেরণ করাই শ্রেয়।
সেনাপতি মাধব সিং কহিলেন-” ফিরিয়া যান সাহেব, যুবরাজকে দেখিলে কি অনুমান করা যায় না যে তিনি রাজা উমেশ প্রতাপ সিং এর পুত্র। বড়রানী পার্বতী নিজে ছোটরানীকে মানিয়া লইয়া যুবরাজকে জয় তিলক পরাইতেছেন ইহাতেও কি প্রমান হয় না? যদি আপনাদের উপযুক্ত প্রমান মনে না হয় তো উপযুক্ত তথ্য সহকারে আপনাদের যুক্তি প্রতিস্থাপন করুন। আমাদের পারিবারিক কর্মে অহেতুক নাক গলানো কি সমীচীন হইতেছে? এক্ষণে আপনাদের অবগত করিতেছি, আমাদের শুভ রাজ্যাভিষেকে বিঘ্ন ঘটাইবেন না। তাহাতে ফল ভালো হইবে না।” একজন সাহেব প্রাসাদের বাহির হইতে ভিতরে প্রবেশ করিয়া যুদ্ধ পূর্ববর্তী পরিস্থিতির বর্ণনা করিলে, বৃটিশ গভর্মেন্টের সাহেবরা পরিস্থিতি প্রতিকূল দেখিয়া (আমরা কলিকাতায় সংবাদ পাঠাইতেছি) বলিয়া প্রাসাদ হইতে বাহির হইল। প্রাসাদের বাহিরে আসিয়া যখন দেখিল হস্তি বাহিনী, অশ্ব বাহিনী, পদাতিক বাহিনী প্রাসাদ ঘিরিয়া রাখিয়াছে, তখন বৃটিশ গভর্মেন্টের সাহেবরা দ্রুত প্রস্থান করিল।
বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের শোষণ, উৎপীড়নের ফল স্বরূপ মীরাটে প্রথম ১৮৫৭ সালের ১০ই মে সিপাহীরা বিদ্রোহ ঘোষণা করিল, এবং সেই বিদ্রোহ সংক্রামক ব্যাধির ন্যায় সমগ্র দেশে ছড়াইয়া পড়িতে থাকিল। তাহার উপর স্বায়ত্বশাসিত রাজ্য কায়েম। সমগ্র দেশে যদি বিদ্রোহের আগুন জ্বলিয়া ওঠে, তাহা হইলে হাজার কুড়ি বৃটিশদের দ্বারা কোটি কোটি ভারত বাসির সৃষ্ট বিদ্রোহের আগুন কোনো ভাবেই নেভানো সম্ভব নয়। লর্ড ক্যানিং তাঁহার বুদ্ধিমত্তা ও দুরদর্শিতার দ্বারা অনুধাবণ করিলেন,চটজলদি একটা সিদ্ধান্ত না নিতে পারিলে এই বিশাল সাম্রাজ্য চালনা করা মুশকিল হইয়া যাইবে। এমতাবস্থায় তিনি তখন বৃটিশ পার্লামেন্ট হইতে বিল পাশ করাইয়া প্রথমেই স্বত্ব বিলোপ নীতি প্রত্যাহার করিয়া লইলেন।
রক্ষা পাইল জুনাগড়, স্বাধীন থাকিল রাজ্যবাসী। জুনাগড়ে উঠিল নুতন সূর্য, উদয় প্রতাপ সিং এর হাত ধরিয়া।