ছিন্নপাতার সাজাই তরণী
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
বাইশে শ্রাবণ এখন বেশ কিছুদিন হল সদ্যঅতীত। জোড়াসাঁকোর বর্তমান প্রাণপুরুষ রবীন্দ্রনাথ চলে গেছেন মাত্র কয়েকমাস আগে। তারপর থেকেই যেন আস্তে আস্তে আলগা হতে শুরু করেছে ঠাকুরবাড়ির শিকড়। এতদিন মহর্ষি ভবনের ঠিকানা ছিল ৬ নম্বর আর নগেন্দ্রনাথ ও তাঁর পরিবরের ঠিকানা ছিল ৫ নম্বর। যুগসন্ধিক্ষণের এক প্রবল ইতিহাসের পালাবদলেই দ্বারকানাথ ঠাকুর লেনের এই দুটি বাড়ি ঘিরে এতকাল ধরে একটু একটু করে তৈরি হয়েছে ঠাকুরবাড়ির পরিচয়। আদিতে এটি প্রথমে ছিল স্বয়ং দ্বারকানাথের বৈঠকখানা বাড়ি তথা বাহিরমহল। পরবর্তীকালে ঠাকুর পরিবারের একটি শাখা পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করে এখানে।
সৃজনশীলতার চূড়ান্ত অবস্থা সর্বদা বিরাজ করে এসেছে এই ভদ্রাসন দুটিতে। মনে হত দুটি আপাত পৃথক ভদ্রাসনে একই অঙ্গে অবস্থান করে চিরচঞ্চলা কমলা ও সহোদরা বাগদেবী’র সম্মিলিত যত্নলাঞ্ছিত ঐশী আশীর্বাদ।
তবে চার এর দশকের গোড়া থেকে দ্রুত ফুরিয়ে আসছিল সেই অমলিন জয়গাথা। পিতার মৃত্যুর পরে পরেই কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ এখন সব নাগরিক সংশ্রব ছেড়ে অবস্থান করছেন হিমালয়ের কোলে সেই আলমোড়ায়! একটি নির্বাপনের অসহায়তা যে পরাক্রমে ধীরে ধীরে মাথা তুলতে করেছে, এখন যেন তার থেকে আর নিস্তার নেই।
বেলা পড়ে আসছে বলে ঘরের মেঝের ওপর সাজিয়ে রাখা হয়েছে থরে থরে বই। দেশ-বিদেশের কত দুর্লভ বই তাতে! সাহিত্য, নাটক, শিল্প – উঁকি দিলে দেখা যাবে সব বিষয়ই। লাইব্রেরির বিশাল-বিশাল আলমারিগুলো খালি হয়ে গেল প্রায়।
ঠাকুরবাড়ির আনাচ কানাচ কেঁপে উঠল শূন্যতায়।
তারপর একদিন দালাল এল। জলের দরে বিক্রি হয়ে গেল সব বই, কলেজ স্ট্রিটের এক পুরনো বইয়ের দোকানির কাছে। শূন্য দৃষ্টিতে সে-দৃশ্য তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছেন প্রবীণ শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এবারে যে চলে যেতে হবে তাঁকেও। যে-বাড়িতে তাঁদের পুরুষানুক্রমে জন্ম, বড় হওয়া, দীর্ঘ সেই সত্তর বছরের স্মৃতি জড়িয়ে আছে যে বাড়িতে, সেই জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে তাঁকে। বিক্রি হয়ে যাবে এই বাড়ি। দুই ভাই গগনেন্দ্রনাথ,সমরেন্দ্রনাথের পরিবার অন্যত্র চলে গেছেন আগেই। ফাঁকা বাড়িতে পরিবার নিয়ে থেকে গেছেন শুধু অবনীন্দ্রনাথ।
মনে আশা, হয়তো বাড়ি বিক্রি করতে হবে না। ভাগ্যের চাকা ঘুরবে। শেষ অবধি টিকে গিয়ে আবার মাথা তুলবে স্বপ্নপ্রয়াণের আঁতুড়ঘর। এতদিন এখানেই ধৈর্য্য ধরে রয়ে গিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ও তাঁর পরিবার। সারা বাড়িময় ভগ্নস্তূপ। ঝাড়পোঁছের বালাই নেই। বাড়ির সামনের বাগান ভরে উঠেছে আগাছায়। চাঙড় খসে পড়ছে দেওয়াল থেকে। বিখ্যাত সেই দক্ষিণের বারান্দা, যেখানে বসে একের পর এক শিল্পসৃষ্টি করেছিলেন তিনভাই, খাঁ খাঁ করছে তাও।
বাস্তব এই স্মৃতিভারের কল্পলোকটিকে আর মেনে নিতে পারেনি। ঋণগ্রস্ত শিল্পগুরু ও তাঁদের পরিবারের শাখার এই চরমাবস্থা ও টানাপোড়েন এখন আদালতের দূয়ারে। পরিবারের সুবিখ্যাত জামাতা প্রমথ চৌধুরী চেষ্টা করেছেন কোর্ট অফ ওয়ার্ডস-এ নিয়ে গিয়ে যদি আবার সব রক্ষা করা যায়। কিন্তু কালাকালের প্রহরী এসে ক্রমশঃ মন থেকে মুছে দিতে চাইল অজস্র রং-তুলির এলোমেলো আঁচড়গুলিকে।
চোখ বন্ধ করলে আজও যেন দেখতে পাব জীবননাট্যের একটি পরাজয়ের দৃশ্য। মলিন মুখে অবনীন্দ্রনাথ শেষ বারের মত একবার এসে দাঁড়ালেন দক্ষিণের বারান্দায়। বারান্দার বড় ফাঁকটার কাছে এসে বাগানের দিকে তাকিয়ে রইলেন খানিক। তারপর আস্তে আস্তে বসে পড়লেন পরিষ্কার ঠান্ডা মেঝের উপর। তারপর দু-দিকে দু-হাত বিছিয়ে মেঝেকে ছুঁয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন নক্শাকাটা রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে বাগানের পুরনো গাছগুলোর দিকে অনেকক্ষণ। বাড়ির কর্মচারী ও জমাদারেরাও যেন বাস্তুচ্যূত হওয়ার আশংকায় শোকস্তব্ধ। সত্যজিৎ রায়ের জলসাঘর ছবির এক বিয়োগান্তক দৃশ্যটি যেন।
অবশেষে নভেম্বরের এক হেমন্তকালীন বিকেল শেষবারের মত সপরিবার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি ছাড়লেন অবনীন্দ্রনাথ। রওনা দিলেন শেষ দিনের ঠিকানা নতুন এক আবাসের দিকে। সেখানে শিল্পচর্চার অভ্যাসটুকু থাকলেও তাতে আনন্দ মিশে থাকল পরিমাণে অনেক কম। ওদিকে নতুন ক্রেতা মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীটি বাড়িটি কিনেই, শুরু করে দিয়েছিল ভাঙাভাঙি। প্রথমেই ভাঙা পড়ল বিখ্যাত সেই দক্ষিণের বারান্দা।
আস্তে আস্তে সামনের বাগানটির জমিটিতে উঠে গেল বড়-বড় বাড়ি। তারপরই টনক নড়ে সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের। ততোদিনে বাড়িটির অবশিষ্ট অংশটি রক্ষণাবেক্ষণের ভার নিলেও অবশ্য শেষ অবধি তা বাঁচানো যায়নি পুরোপুরি। অনেকটাই নতুন করে গড়ে তুলতে হয় আবার। তবে বুক ভরা অভিমানে স্মৃতিকাতর অবনীন্দ্রনাথ অভিমানে কোনোদিন আর ফিরে আসেন নি জোড়াসাঁকোয়।
একই ফটক সমেত যে জোড়াসাঁকো নাম ছিল দুটো বাড়ির আর সেখানে একটি সাঁকোর নীচে টলটল করে যে বয়ে যেত ক্ষীণ একটি জলপ্রবাহ সেই আক্ষরিক অবয়বটিও ক্রমে নিয়মের হিসেব মেনে চাপা পড়ে গেল। যে বাড়ি একদিন অসংখ্য কৃতী মানুষদের সঙ্গ পেয়ে বেঁচে থাকত, তার প্রতিটি অলিন্দ না বোঝা অপার রহস্যে আস্তে আস্তে চাপা পড়ে গেল। হারিয়ে গেল সেই অমরাবতীর রস মাধূর্য্য।
…
— ঋণ –
জোড়াসাঁকোর ধারে – অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আপনকথা – অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ও তন্ময় ভট্টাচার্য
—oooXXooo—