কুরুবংশের সব থেকে কলঙ্ক জনক অধ্যায় সমাপ্ত। পাশা খেলায় পরাজিত হয়ে পান্ডব পক্ষ আজ সর্বস্বান্ত। শুধু, রাজত্ব বা ঐশ্বর্যই নয় পাণ্ডবরা হারিয়েছেন তাদের সম্মান ,প্রতিপত্তি এবং স্বাধীনতা। কুলবধু দ্রৌপদী সর্বজনসমক্ষে লাঞ্ছিতা। সভাস্থলে বসে সেই ঘৃণ্য দৃশ্য দেখেছেন ভীষ্ম, দ্রোন কৃপ প্রমুখ কুরুকুল নায়করা। সারা আর্যাবর্ত বিস্ময়ে স্তব্ধ ভ্রাতৃদ্বন্দ্বের এই চরম রূপ দেখে। আজ রাত্রি শেষে বারো বছরের জন্য বনবাসে যাবেন পাণ্ডবরা। সারা হস্তিনাপুর এবং খান্ডবপ্রস্থ শোকে মুহ্যমান। শুধু আনন্দ আর উল্লাস হস্তিনাপুর রাজপ্রাসাদে।। জয়োল্লাসে মেতেছে দূর্যোধন , শকুনিরা। অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র মুখে শোকের প্রকাশ দেখালেও অন্তরের পুলক চাপা দিয়ে রাখতে পারছেন না কোনমতেই। শির নত করে আপন আপন গৃহে ফিরে গেছেন দ্রোণ,কৃপ বিদুর। শুধু রাজপ্রাসাদের কোলাহল অসহ্য বোধ করায় একা ভাগীরথী তীরে দাঁড়িয়ে কুরুকুল রক্ষক ভীষ্ম। তার উন্নত মস্তক আজ নিম্নমুখী। একদৃষ্টিতে চেয়ে আছেন ওই প্রবাহিনীর দিকে। কোন যন্ত্রণায় ক্ষত বিক্ষত হচ্ছেন অন্তরে অন্তরে? কার কাছে জানাতে এসেছেন আপন মর্মবেদনা? আপন মন বেদনায় এতই নিমগ্ন যে লক্ষ্যই করলেন না কখন তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে এক অপূর্ব নারীমূর্তি। শ্বেত বসনা, শ্বেত স্বচ্ছ উত্তরীয় তে ঢাকা ঊর্ধ্বাঙ্গ।কে ইনি? আসুন একটু আড়াল থেকে লক্ষ্য করা যাক। “ পুত্র দেবব্রত।” “ মা । এসেছ ?আজ তোমাকেই বড় প্রয়োজন ছিল আমার।” “ প্রয়োজন আমারও আছে। কিন্তু আগে তুমি বল। হঠাৎ মাকে প্রয়োজন হল কেন?” “ এ বোঝা আমি আর বইতে পারছি না মা। আমি ক্লান্ত। ভীষণ ক্লান্ত।” “ কিসের ক্লান্তি পুত্র? তুমি তো রাজা নও।রাজ কার্যের গুরুতর দায়িত্ব তো তোমার নেই। স্বেচ্ছায় ত্যাগ করেছ রাজসুখ, সংসার সুখ। তাহলে ক্লান্তি কিসের?” “ মা। প্রতি দিন প্রতি মুহূর্তে ভ্রাতৃ বিরোধ, হানাহানি, হিংসা, বিদ্বেষ দেখে দেখে আমি ক্লান্ত। আর আজ যে চরম বিপর্যয় ঘটে গেল – আহ্ ! এই কালিমা কুরুবংশ কি কখনো মুছে ফেলতে পারবে? সারা আর্যাবর্ত আজ স্তব্ধ। কি ভীষণ ! কি মর্মান্তিক !” “ শুধু আর্যাবর্ত নয়। দেবলোকও স্তম্ভিত এই নির্লজ্জ, পৈশাচিক ঘটনায়। এই অপমান, এই নিগ্রহ শুধু একা দ্রৌপদীর নয়। এ সমস্ত নারী জাতির অবমাননা।” “ মা ! কি লজ্জা ! মহারাজ শান্তনুর বংশে আজ এই কলঙ্ক !” “ তাই তো জানতে এসেছি পুত্র এর প্রতিবিধান কি করলে ?” “ কিছু না মা। কিচ্ছু না। শুধু নির্বাক দর্শক হয়ে থাকতে হল।” “ বাহ্ ! অতি চমৎকার ! এক অসহায় বিপন্ন নারী যখন আপন সম্মান রক্ষার আশায় উন্মাদের মত একের পর এক সভাস্থ কুরু কুল মহারথীদের শরণাপন্ন ! যখন এক নির্লজ্জ পাষণ্ড তার বস্ত্র হরণ করে তাকে সর্ব সমক্ষে নগ্ন করার প্রচেষ্টায় রত ! সেইসময় সেইখানে উপস্থিত আর্যাবর্তের শ্রেষ্ঠ বীর, পরশুরামের যোগ্য শিষ্য, গঙ্গা পুত্র দেবব্রত সেই ঘৃণ্য নারকীয় ঘটনার এক নীরব দর্শক মাত্র ! ধিক পুত্র ! ধিক তোমাকে !” “ এ ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না মা ” “ ছিল না ? বিশ্বাস করি না।” “ কি বলছ তুমি মা ?” “ যা সত্য তাই বলছি পুত্র। পাশা খেলার নামে যেখানে নির্লজ্জ ভাবে কৈতব বাদ চলল, নারীর সম্মান যেখানে ভুলুণ্ঠিত হল সেখানে নীরব দর্শক হয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না – এ আমাকে বিশ্বাস করতে বলছ ?” “ আহ্ ! মা ! বারংবার সেই নিদারুণ দৃশ্য আমাকে স্মরণ করিয়ে দিও না। যন্ত্রণায় চূর্ণ বিচূর্ণ হচ্ছে আমার হৃদয়। ” “ অথচ প্রতিকার করার সামান্যতম ইচ্ছা টুকুও দেখালে না। নির্লজ্জ্ব ভাবে বসে বসে দেখলে সেই জঘন্য পাশবিক দৃশ্য।” “ কি ভাবে প্রতিকার করব? রাজ সিংহাসন আমার নয়। রাজ আজ্ঞা আমি দিতে পারি না। বন্ধ করতে পারি না এই পাশা খেলা। আমি শুধু এই বংশের এক রক্ষী মাত্র।” “ রক্ষী ! তো সেই কার্যই বা সঠিক ভাবে করলে কই পুত্র? চোখের সামনে ভাইয়ে ভাইয়ে হানাহানি, হিংসা দেখেও নীরব রইলে? বাধা দিলে না ? নারীর সম্ভ্রম রক্ষায় এগিয়ে এলে না ? এর জন্যই কি তোমাকে এই বংশের উপযুক্ত করে গড়ে ছিলাম?” “ মা। ধৃতরাষ্ট্র রাজা। তার আদেশেই প্রবল পান্ডব বিদ্বেষী দূর্যোধন এই সকল দুষ্কর্মের হোতা। আর তাকে চালনা করছে দুষ্ট শকুনি। রাজ আজ্ঞায় আমি বাধ্য ছিলাম ওই সভাস্থলে উপস্থিত থাকতে।” “ রাজ আজ্ঞায় দেহ বাধ্য কিন্তু মন? বিবেক? নীতি? আদর্শ ? এসব কার কাছে বন্ধক রেখেছিলে পুত্র?” “ আমি বারংবার ধৃতরাষ্ট্রকে অনুরোধ করেছি এই ভয়ংকর সর্বনাশী খেলা বন্ধ করতে। কিন্তু সে আমার কথায় কর্ণপাত করেনি। সে অন্তরে বাইরে উভয়তই অন্ধ । আহ্ ! কি নির্লজ্জ প্রকাশ তার লোভের ! এক একবার পাশার দান পড়ে আর সে উন্মত্তের মত চিৎকার করে জিজ্ঞেস করে ‘ কে জিতল? কে?’ এই নাকি হস্তিনাপুরের রাজা !” “ ধৃতরাষ্ট্রের কথা থাক। নিজের দিকে তাকাও পুত্র। নিজের কথা বল। অপরকে দোষারোপ করে নিজের দোষ স্খলন করা যায় না। ” “ মা। আমি যন্ত্রণায় ক্ষত বিক্ষত হয়ে যাচ্ছি। তোমার কাছে এসেছি একটু শান্তির প্রলেপ দিতে। আর তুমি !” “ আর্যাবর্তের শ্রেষ্ঠ বীর, দেবব্রত ভীষ্ম অন্যায়ের প্রতিকার না করতে পেরে মাতৃ অঞ্চলে আত্মগোপন করতে এসেছে। একথা যে অবিশ্বাস্য পুত্র ! সারা ভারতবর্ষ অট্টহাস্য করে উঠবে একথা শুনলে। ” “ মিথ্যে আমাকে তুমি তিরস্কার করছ মা। আমি কোনমতেই দায়ী নই পাঞ্চালীর এই অবমাননার জন্য। ” “ না। দায়ী আমি তোমাকে করছিনা দেবব্রত। শুধু জানতে এসেছি এত বড় অন্যায়, নারীর এতখানি অসম্মান তুমি সভাস্থলে বিদ্যমান থেকে সহ্য করলে কেমন করে? কেন গর্জে উঠল না তোমার হাতের তলোয়ার? কেন এর পরেও দুঃশাসনের ওই নির্লজ্জ ক্লেদাক্ত হাত খসে পড়ল না তার দেহ থেকে? বাক রোধ হল না কেন ওই সুতপুত্র কর্ণের? জানু অটুট রইল দূর্যোধনের ? কেন পুত্র ? কেন ?” “ মা আমি রাজার বিরোধিতা করব ? সে যে রাজদ্রোহিতা ! আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আজীবন কুরু বংশের সিংহাসনের প্রতি বিশ্বস্ত থাকব। আমি আমার শপথ ভঙ্গ করতে পারি না।” “ রাজ সিংহাসনের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার অর্থ কি যথেচ্ছাচারে সম্মতি দেওয়া? পাপাচার, ব্যভিচারকে প্রশ্রয় দেওয়া?” “ আমি সম্মতি দিয়েছি? প্রশ্রয় দিয়েছি ? কি বলছ তুমি মা?” “ ঠিকই বলছি। অন্যায়ের সাহচর্যে থাকাও সমান অন্যায়। কুরুকুল বধূর অপমানের প্রতিবাদ করা, তার সন্মান রক্ষা করার বিন্দু মাত্র চেষ্টা না করে নির্বাক দর্শক হয়ে থাকাকে এ ছাড়া আর কি বলা যায় পুত্র ? শোন দেবব্রত। রাজা যদি ঘোর পাপাচারী বা ব্যভিচারী হন তাকে বিনাশ করাই যুগধর্ম। সেখানে রাজদ্রোহিতাই একমাত্র পথ।” “ জানি মা জানি। সেদিনের সেই প্রতিজ্ঞা আজ বড় অন্তঃসারশুন্য বলে মনে হয় ! মনে হয় যা করেছি সব ভুল। যে জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করলাম তা শুধু এক মরীচিকা। ” “ এখন খেদ প্রকাশ করছ? অনেক আগেই সংযত করা উচিত ছিল না কি?” “ মা। আর আমাকে তিরস্কার কর না।” “ না। এবার শেষ কথা বলে যাই শোন পুত্র। যুগে যুগে যখনই নারীর প্রতি অবিচার, অন্যায়, অসম্মাননা হয়েছে তখনই পৃথিবীতে নেমে এসেছে এক মহাপ্রলয়। টলে উঠেছে রাজ সিংহাসন, ধ্বসে পড়েছে রাজ ছত্র, রাজ ডংকা। আমি শঙ্কিত হচ্ছি আবার বুঝি আসতে চলেছে তেমনই দিন। দ্রৌপদীর এই লাঞ্ছনা, তার ওই অবমাননার অশ্রু বৃথা যাবে না। জ্বলে উঠবে আগুন। আসবে মহাপ্লাবন। ওই যে ঈশান কোনে এক টুকরো মেঘ দেখছ ? ঝড় উঠবে। ভেঙে চুরে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে সব। মহাকালের সেই নির্দয় , বজ্র কঠিন হস্ত থেকে রেহাই পাবে না কেউ। তুমিও না। সাবধান দেবব্রত। খুব সাবধান। ( প্রস্থান ) “ মা ! এ তুমি কি বলে গেলে ? এ কি তোমার ভবিষ্যত বাণী? না অভিসম্পাত? মা — একি ! বায়ু এত প্রবল বেগে বইছে কেন ? পায়ের নিচে পৃথিবী যেন কম্পিত হচ্ছে ! ঝড় উঠছে ? ওই ঈশান কোণের মেঘ শক্তি বিস্তার করছে? তবে কি সত্যিই আসছে সেই প্রলয়ংকর। যার এক হাতে ধ্বংস আর অন্য হাতে স্তৃষ্টি ! যার রুদ্র বীণায় গাওয়া হবে ধর্মের জয়গান ! তাই হোক। তবে তাই হোক। নেমে আসুক মহাকালের উদ্যত খড়্গ। যা কিছু অসুন্দর, অপবিত্র ধ্বংস হয়ে যাক। মহাপ্রলয়ের রুদ্র কঠিন হস্তে হোক সুন্দরের আবাহন। আমি অপেক্ষা করে থাকব মা। এই নিদারুণ মর্মবেদনা বুকে নিয়ে প্রতীক্ষা করব সেই মৃত্যুঞ্জয়ীর আগমনের।”