” জীবনে আমি একবার অন্তত এ্যারোপ্লেন চাপবই চাপবো, এটা আমার প্রতিজ্ঞা “ আনারুল শেখ প্রায়শই বন্ধু মহলে কথাটা বলে থাকে। বাবা মোক্তার শেখ, ছেলের খামখেয়ালিপনায় বকা-ঝকা করতে গেলে উচ্চস্বরে বলেন,” বাপ রাজ মিস্ত্রি, ছেলে হবে পেলেনের ড্রাইভার।” আনারুলের বয়স সতেরো আঠারো হবে, পড়াশোনা কাঁধ থেকে নেমে এখন এ্যারোপ্লেনের ভুত মাথায় চেপে বসেছে। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়েই পড়াশোনায় ইতি টেনেছে। টাচস্ক্রীন ফোনের ইংরেজি হরপ এবং ইউ টিউব চ্যানেলের হিন্দি ভাষা বুঝতে এবং বলতে আনারুলের কোনো সমস্যাই হয়না। শুধু শুধু পড়াশোনার ঝামেলাটা আর মাথায় রাখে কেন? একমাত্র কাজ চব্বিশ ঘন্টা গুগল সার্চ করে এ্যারোপ্লেন সম্পর্কিত সমস্ত তথ্য ভিডিও সহ সংগ্রহ করা। এ্যারোপ্লেন সম্পর্কে খুঁটিনাটি জানেও প্রচুর। এ্যারোপ্লেন কিভাবে ওঠে, কিভাবে নামে, কোথায় তেল ভরা থাকে, ওড়ার সময় প্রতি ঘন্টায় কত লিটার তেল পোড়ে, কখন প্লেন পিছন থেকে ধোঁয়া ছাড়ে—– ইত্যাদি, ইত্যাদি। কোলকাতা বিমান বন্দরের উত্তর দিকে গৌরীপুরে আনারুলদের বাড়ি। সারাদিন মাথার উপর দিয়ে এ্যারোপ্লেন ওঠা নামা দেখতে দেখতে তার প্লেনের প্রতি এক অজানা অমোঘ আকর্ষণ জন্মে গেছে। সর্বদাই ভাবে ওই উড়ন্ত যানটার মধ্যে যদি সে-ও একটু বসবার সুযোগ পেত!! এই ভাবেই বিভোর সে, আনারুলের মা বলেন, আনারুল যখন খুব ছোট, দোলনায় ঘুমিয়ে থাকতো, তখন থেকেই প্লেনের শব্দ পেলে ঘুম ভেঙে গিয়ে এদিক ওদিক তাকাত যেন শব্দটাকে খুঁজছে। মাতৃ সোহাগে সবই তো ঠিক আছে কিন্তু বাবার সাথে আনারুলের একদম-ই বনিবনা হয়না, এক জায়গায় হলেই তর্ক বিতর্ক বেধে যায়। পড়াশোনা আগেই শিকেয় তুলেছে, মোক্তার শেখের ইচ্ছে তার সাথে কাজে গিয়ে অন্তত পক্ষে জোগাড়ের কাজটা করুক, তা নয় বরং চব্বিশ ঘন্টা বন্ধু বান্ধব আর মোবাইল ঘাঁটা। এতে অবশ্য মোক্তার শেখের স্ত্রী’র প্রশ্রয় আছে ষোলোআনা। মধ্যে একদিন বাবার সাথে বাক- বিতন্ডা চরমে উঠল। মোক্তার শেখ উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করে বললেন,” না করল লেখাপড়া, না করছে কিছু রোজগার। উনি ফোন ঘষে পেলেনের ড্রাইভার হবেন! তেমনি ওর আম্মু আবদার করল,অমনি একটা ঘষা ফোন কিনে দিল।” আনারুলও কম যায়না, সে-ও সমস্বরে বলে,” কথাটা ড্রাইভার না,পাইলট, পাইলট। আর আমি তো পাইলট হব বলিনি, আমি প্লেনে চাপব বলেছি।” মোক্তার শেখ আরও উত্তেজিত হ’য়ে বলেন-” ওই হলো, ওরে স্বপ্ন দেখতে গেলেও মুরোদের দরকার হয়।” — কেন তুমি স্বপ্ন দেখনা? আম্মুকে বলনা, “তোমাকে একটা পাকা বাড়ি করে দেব”। — হা খোদা, একে আর কি বোঝাব, ওরে জানোয়ার,একটা পাকা বাড়ি করা স্বপ্ন না প্রয়োজন। মাথার উপর তোর বু না থাকলে এতদিনে আমি পাকা বাড়ি ——–। ইতিমধ্যে তর্ক ক্ষেত্রে আনারুলের মা এসে আনারুলকে সরিয়ে দিয়ে ততোধিক চেচামেচি করে তর্ক যুদ্ধের অবসান ঘটান।
আনারুলের কাছের বন্ধু আনিসুল, একদিন তাকে বোঝাল যে, প্লেনে চাপার শুধু ইচ্ছে থাকলে হবে না, তার জন্য রোজগার করতে হবে। আব্বার সাথে তার জোগাড়ের জন্য কাজে যাওয়া উচিত। আনারুল বন্ধুকে থামিয়ে বলল,” তুই ঠিক কথাই বলেছিস, তবে আব্বার সাথে কাজ করে পোষাবে না, আমাকে তো টাকা দেবেনা। কাজ করলে অন্য কারোর কাছে কাজ করতে হবে।” —-এটা ঠিকই বলেছিস, টাকার জন্যে তো কাজ করা, না হলে প্লেনের টিকিট কাটবি কি করে! কিন্তু সে তো অনেক টাকার ব্যাপার! —- আচ্ছা আনিসুল, তোর চাচা বাইরে কোথায় রাজ মিস্ত্রির কাজ করে না? —- হ্যাঁ,অসমের মির্জাপুরে, চাচা ছুটিতে এসেছে। ভালো কথা মনে করিয়ে দিয়েছিস, দাঁড়া চাচাকে বলে দেখি।” —- তুইতো আমার জিগরি দোস্তো, দেখনা ভাই, যদি কাজটা হয়ে যায়। বাড়িতে আর ভাল্লাগে না, খালি খিচির খিচির।
এদিকে আনারুলের বাবা আনিসুলের চাচার সাথে দেখা হলে সৌজন্য বিনিময়ের সময় কথা প্রসঙ্গে বলেন, ” দেখো না না ভাই, আনারুলকে যদি তোমার সাথে নিয়ে যা-ও তো ভাল হয়, বাইরে গিয়ে কাজ কর্মের মধ্যে থাকলে মানুষ হবে। এখান থেকে না সরালে ছেলেটা মানুষ হবেনা। একেবারে বকে যাচ্ছে।”
বছর পঁয়তাল্লিশের করিম আলি পেশায় রাজমিস্ত্রী। কর্মসূত্রে থাকেন অসমের মির্জাপুরে। স্ত্রী ও ছোটো দুটি সন্তান থাকে কোলকাতার গৌরীপুরে। ওখানে অসম দুরদর্শনের একটা টাওয়ারের কাজ চলছে। যার দায়িত্বে আছে কোলকাতার নবীন কনস্ট্রাকশন প্রাইভেট লিমিটেড। লেবার কর্মচারী বেশিরভাগই পশ্চিম বঙ্গের মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান, উত্তর চব্বিশ পরগনার। করিম আলি তাদের মধ্যেই একজন। দক্ষ রাজ মিস্ত্রি হওয়ায় উপর মহলে তার একটু আধটু যোগাযোগ আছে।
নবীন কনস্ট্রাকশন প্রাইভেট লিমিটেডের অসম ডিভিশনের দ্বায়িত্ব প্রাপ্ত সুপারভাইজার অসীম হালদারকে ফোন করে করিম আলি আনারুলের জন্য তাদের কনস্ট্রাকশনে একটা কাজের ব্যবস্থা করে। মাহিনা ভাল, থাকার কোনো খরচ নেই।
আনারুলের মনে এ্যারোপ্লেনে চাপার অদমনীয় ইচ্ছেটা এতদিন সুপ্ত অবস্থায় ছিল, এখন সেটা প্রকট হয়ে বহিঃপ্রকাশ ঘটল। তার মনে হল সেই দিন অবশেষে এগিয়ে আসছে। বন্ধুদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ সেরে নিচ্ছে। এই প্রথম জন্মস্থান ছেড়ে বাইরে যাচ্ছে তো মনটা একটু খারাপও লাগছে।
কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের টিকিটটা মোক্তার শেখের হাতে আসতেই তার বুকের মধ্যে কোথায় যেন একটা ধাক্কা লাগল। হাজার দোষ থাকুক, আনারুল তো তাঁর সন্তান, অপত্যস্নেহ যেন মনটাকে নাড়িয়ে দিল। তিনি তো চেয়েছিলেন, আনারুল লেখাপড়া শিখে, ভাল চাকরি করে, তার পাশে দাঁড়াক। তা না হলে নিদেনপক্ষে তার সাথে থেকে রাজ মিস্ত্রির কাজটা ভাল করে শিখুক। বিদেশ বিভূঁইয়ে গিয়ে থাকুক এটা তিনি চাননি।
আনারুলের মায়ের মন কিছুতেই সাড়া দিচ্ছে না। ছেলে চোখের আড়াল হবে এটা তিনি একেবারেই মেনে নিতে পারছেন না। বিদেশ বিভূঁই বলে কথা। আনারুল মাকে বোঝায়, ” একি পাসপোর্ট ভিসা লাগছে যে তুমি বিদেশ বিভূঁই বলছ। দেশের মধ্যে, পশ্চিমবঙ্গে আছি অসমে যাব। ভালো না লাগলে ফিরে আসব। শোন আম্মু, মাইনে ভাল, আমি মনদিয়ে কাজ করে টাকা জমাব। ফিরে এসে বু’র বিয়ের জন্য একটা লাল টুকটুকে শাড়ি কিনব। তোমার জন্যেও একটা কিনব, আমি জানি তোমার তোলা কোনো ভাল শাড়ি নেই। আব্বা আর করিম চাচার জন্য দুটো লুঙ্গি কিনব। করিম চাচার জন্যেই তো আমার এত ভাল কাজটা হল।” মায়ের চোখ জলে ভরে গেল। আবেগ তাড়িত হয়ে তিনি বললেন,” সবার কথাতো ভাবলি,নিজের জন্যে কিছু বললি নাতো!” আনারুল একগাল হেঁসে গদগদ হয়ে মাকে বলল,” তুমি আব্বাকে বলবেনা কথা দাও?” — না, বলব না, বল। আনারুল অতি উৎসাহে জানাল,” ফেরার সময় আমি ফ্লাইটে ফিরব, এটা আমার বহু দিনের ইচ্ছে, তুমি কিন্তু না করো না।” আনারুলের মা আনারুলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,” সে তুই তোর সখ মেটাস, কিন্তু অচেনা অজানা জায়গা সাবধানে থাকবি। করিম চাচার কাছাকাছি থেকে কাজ করবি।
অসমের মির্জাপুরে একটা টিলার উপর দুরদর্শনের টাওয়ার বসবে। তার’ই কাজ চলছে। প্রথমে টিলার উপর বেস তৈরি হচ্ছে, সেও প্রায় চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ ফুট উঁচু। এর উপর বসবে টাওয়ারের লোহার পোল। জলের ট্যাংকের মতো উঁচু বেস, সেই বেস তৈরীর কাজেই আনারুল জয়েন করেছে।
তারুণ্য কলেবরে আসুরিক শক্তি, উদ্যমেও ঘাটতি নেই, উদ্দেশ্য যে অর্থ সংগ্রহ! কারন আনারুল অ্যারোপ্লেনে চেপে বাড়ি ফিরবে। ফলে সে ভীষণ হিসাব করে চলে। গ্রুপে খাওয়ার টাকা এবং ফোন রিচার্জের টাকা ছাড়া একটি টাকাও খরচ করে না। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, আনরুল যে প্লেন পাগল সেটা কর্মস্থলের সবাই জেনে গেছে। করিম আলি সকলকে বলে দিয়েছে। করিম আলি নিজেও আনারুলের এমনতর পাগলামিকে সমর্থন করে। সখ মানুষের থাকতেই পারে, সে’তো মদ, বিড়ি, সিগারেট খায়না।
মধ্যে একদিন সাইটের কাজ চলছে, এ-রি মধ্যে একটা কালো এ্যাম্বাসাডর এসে দাঁড়াল। সুপার ভাইজার অসীম হালদার সব কাজ ফেলে গাড়ির কাছে এগিয়ে এলেন। গাড়ি থেকে নেমে এলেন শুটেড বুটেড এক ভদ্রলোক, তারপর অসীম হালদারের সাথে কথা বলতে বলতে অফিস ঘরের দিকে চলে গেলেন। পাশেই কাজ করছিল আনারুল ও তার করিম চাচা। সাহেব সরে যেতেই আনরুলের স্বগতোক্তি-” এ রকম মানুষদেরই প্লেনে চাপা মানায়।” কথাটা করিম আলি শুনে বলেন-” উনি কে জানিস? আনারুল না সূচক মাথা নাড়িয়ে বলল-” বড় মাপের মানুষ নিশ্চই হবে।” করিম আলি বলল- “ঠিকই বলেছিস, নবীন কনস্ট্রাকশনের অসম ডিভিশনের হেড, খুব বড়ো সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। নাম প্রতীক কুমার নস্কর। সবাই পি কে নস্কর বলে সম্বোধন করে। ভিষণ রাগী, রাশভারি, মেজাজী মানুষ। একটু ভুলচুক হলে আর রক্ষে নেই। ” আনারুল প্রতীক সাহেবের কথা শুনতে শুনতে বলল-” ঠিক বলছ চাচা, দেখলেই ভয় করে।” করিম আলি আনারুলকে আস্বস্ত করে বলে-” না না, ভয় পাওয়ার মতো মানুষ উনি নন। আমি’তো অনেক দিন ধরে দেখছি, মানুষটা আসলে কচ্ছপের মতো। উপরে শক্ত খোলায় মোড়া, ভীতরে নরম। দেখে মনে হয় রাগী, হাসেন কম,আবার প্রয়োজন ছাড়া একটি কথাও বলেন না। তবে না দেখলে জানতেও পারতামনা যে ওনার শরীরে এতো বড় একটা মন লুকিয়ে আছে– সেবার বর্ধমান থেকে কাজে আসা বিজনের ম্যালেরিয়া হল, পনের দিনে জ্বর সারল,বাকি পনের দিন দুর্বলতা কাটাতে বিশ্রাম নিল, এই এক মাসের মাইনে তো কাটলেনই না আবার সমস্ত চিকিৎসা খরচাও দিয়ে দিয়েছিলেন। সবথেকে বড়ো কথা উনি নিজে আমাদের ওই ঝুপড়িতে তিন চারবার ঢুকে বিজনকে দেখে এসেছিলেন। এ ছাড়া ছোটখাটো কত উপকার যে শ্রমিক কর্মচারীদের করেন তার শেষ নেই। সুপারভাইজার সাহেব অসীম হালদারের কাছে শুনেছি ছোটবেলায় ওনারা খুব গরীব ছিলেন, ভাতের ফ্যান খেয়েও দিন কেটেছে। অনেক ভাইবোন, ঘরে অসুস্থ বাবা মা, বড়দার সামান্য আয়ে আট দশ জন মানুষের পেট চলত। ওই অবস্থার মধ্যে অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া শিখে আজ এই জায়গায় এসেছেন। আনারুল, নস্কর সাহেবের উত্থানের গল্প শুনতে শুনতে করিম আলির কথা শেষ হতেই বলে-” হাতে সিগারেট পেয়েও উনি বিড়ির স্বাদ ভোলেননি।”
সেদিন প্রতীক সাহেবকে দেখে আনারুলের প্রথমে কেমন যেন রাগী মানুষ ভেবে ভয় করেছিল, কিন্তু পরক্ষণেই তাঁর চরিত্রের কথা শুনে সব ভয় ভক্তিতে পরিনত হয়ে গেছে। আজও অ্যাম্বাসেডরটা এসে দাঁড়াতেই ভীতর থেকে নস্কর সাহেব নেমে অফিস ঘরের দিকে চলে গেলেন। কালো অ্যাম্বাসাডরের গায়ে ধুলো পড়ে বিশ্রী লাগছিল। নস্কর সাহেব গাড়ি বার করার সময় নিশ্চয়ই ব্যাস্ত ছিলেন। আনারুলের হাতে ঠিক সেই সময় কোনো কাজ না থাকায়, সে মাথায় বাঁধা গামছাটা খুলে নিয়ে গাড়িটা মুছতে থাকে। করিম আলি দেখে অবাক হয়ে কারন জানতে চাইলে আনারুল বলে-” গাড়িটা ধুলো পড়ে যা অবস্থা হয়েছিল! আচ্ছা তুমি বল চাচা সাহেবকে কি এমন গাড়িতে মানায়!!” এদিকে নস্কর সাহেব অফিস-রুম থেকে আনারুলের আনএক্সপেকটেড কাজ দেখে একটু অবাক হয়ে হালদার বাবুকে ডেকে ব্যপারটা জানতে চান। এমনতো হতে পারে হালদার বাবু ছেলেটিকে গাড়ি মুছতে বলেছেন। হালদার বাবু গাড়ি মোছার ব্যাপারে কিছু জানেনই না বলে, একটু হেসে, আনারুলের পরিচয় দিয়ে করিম আলির কাছ থেকে আনারুলের কাজে জয়েন করার যে ইতিহাসটা আগেই শুনেছিলেন। সেটাই নস্কর সাহেবকে জানালেন-” স্যার শুনেছি ফ্লাইটে না চাপলে কি হবে ফ্লাইট সম্পর্কে ওর বিরাট অভিজ্ঞতা, শুধু চাপাটাই বাকি। নস্কর সাহেবের মেজাজ ভাল থাকায় তিনি বেশ মজা করেই বললেন-” ভেরি ইন্টারেস্টিং, ছেলেটির সাথে তাহলে তো একটু আলাপ করতে হয়! ডাকুনতো ওকে।”
গাড়িটা মুছে আনারুল গামছাটা ভালো করে ঝেড়ে নিয়ে মাথায় বাঁধছে, ঠিক তখনি হালদার সাহেব এসে বললেন যে স্যার আনারুলকে ডাকছেন। হালদার সাহেবের কথা শুনে আনারুলের মুখ শুকিয়ে গেল। করিম আলিও একটু আবাক হয়ে জানতে চাইল সে কোনো ভুল করেছে কিনা!! হালদার সাহেব কোনো উত্তর দিতে পারলেন না।
অগত্যা বন্দী আসামীর মত আনারুল অফিস-রুমে এসে নস্কর সাহেবের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকল, না বলে গাড়িটা মোছা কি এতটাই আপরাধ?? স্বেচ্ছা কর্মের জন্য শাস্তির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকল। অবশেষে গুরু গম্ভীর প্রশ্ন– — নাম কি? —- আজ্ঞে আনারুল, —- বাড়ি কোথায়? —- কোলকাতার গৌরীপুর, এয়ারপোর্টের পাশে। —- আমার গাড়ি মুছতে কে বলেছিল? ( মাথা নিঁচু করে, না সূচক মাথা নাড়িয়ে) — আমার অন্যায় হয়ে গেছে স্যার। —- স্যরি বল্লে তো হবেনা, না বলে কারোর জিনিসে হাত দিলে শাস্তি তো পেতেই হবে। হালদার ওকে কি শাস্তি দেওয়া যায়?? হালদার সাহেবও ধোঁয়াশায়, কি বলবেন ঠিক বুঝতে পারছেন না। এদিকে আনারুলকে ওই অবস্থায় দেখে একে একে দুই এক জন করে শ্রমিকরা উৎসুক হয়ে এগিয়ে আসলো। নিজ কৃতকর্মের জন্য আনারুলের নিজস্ব মর্যাদা টুকু মাটিতে মিশে গেল। নস্কর সাহেব নিরবতা ভেঙে বললেন-” শাস্তি তো তোমাকে পেতেই হবে। শোনো আনারুল, আমি ফ্লাইটে কোলকাতা যাব, কিন্তু মুশকিল হল, এই প্রথম ফ্লাইটে উঠব, ফলে আমি একটু আনইজি ফিল করছি। তা শুনলাম ফ্লাইটে চাপার নিয়ম কানুন সব তুমি জানো, আমাকে বল দেখি ফ্লাইটে চড়ার সিস্টেমটা, শোনা থাকলে আমি হয়তো আর অসুবিধায় পড়ব না। এটাই তোমার শাস্তি।” স্যারের কথা শুনে সবাই হেঁসে উঠল,বুঝতে পারল নস্কর সাহেব আনারুলের সাথে মজা করছেন। হালদার সাহেব আর করিম আলি সমস্বরে বলল -“বল আনারুল ভয় কি!!!” খানিকক্ষণ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে কিছু ভেবে মাথা তুললো। একটু সাহস সঞ্চয় করে নস্কর সাহেবের দিকে তাকাতেই নস্কর সাহেব ব’লে ওঠেন -” আরে বল,এতগুলো লোক শোনার অপেক্ষায় আছে।” নস্কর সাহেবের দুষ্টুমি মিশ্রিত মুচকি হাসি দেখে আনারুলের নার্ভাসনেসটা ততক্ষণে অনেকটাই কেটে গেছে, মাথায় বাঁধা গামছাটা ঠিক করতে করতে বলা শুরু করল-” প্রথমে আপনি ল্যাপটপ অথবা সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে গুয়াহাটি টু ক্যালকাটা টিকিট কাটবেন, এয়ার এশিয়া, এ্যামিরেটস, ইণ্ডিগো ইত্যাদি যে বিমান পরিবহন সংস্থা আপনার পছন্দ। এবার যে তারিখে টিকিট কাটা হবে তার ঠিক চব্বিশ ঘন্টা আগে টিকিট কাটার মত একই ভাবে ওয়েব চেকিং করে নিতে হবে। তারপর যে সময়ে ফ্লাইট তার দুই ঘন্টা আগে অরিজিনাল আধার কার্ড, টিকিট,এবং ওয়েব চেকিং রিপোর্ট নিয়ে এয়ারপোর্টে ঢুকতে হবে। লাগেজ নিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখবেন বিভিন্ন সংস্থার কাউন্টার আছে, আপনার টিকিট কাউন্টারে আপনি যাবেন। ওখানে আপনার লাগেজ ওয়েট করে ওদের হেপাজতে নিয়ে নেবে, ওটা কোলকাতায় নেমে ফেরত পাবেন। এবং আপনাকে বোডিং পাস দিয়ে দেবে, যাতে লেখা থকবে, আপনি কত নাম্বার গেটের কাছে অপেক্ষা করবেন। বোডিং পাসে প্লেনের সিট নাম্বারও দেওয়া থাকবে। এবার পাশে বডি চেকিং জোনে যাবেন,কাছে থাকা মেটাল দ্রব্য যা কিছু থাকবে সেগুলো একটা ট্রে’তে রেখে মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে বডি চেকাপ করে ভিতরে ঢুকে চেকিং হওয়া ট্রের জিনিসগুলো নিয়ে নেবেন। তারপর গেট নাম্বারের কাছে গিয়ে সময়ের অপেক্ষায় থাকতে হবে। টাইম হলে লাউডস্পিকারে ঘোষণা হবে, আপনি প্লেনে ওঠার জন্য বোডিং পাস হাতে নিয়ে এগিয়ে যাবেন। প্লেনে উঠে আপনি সিট নিজে খুঁজে নিতে পারেন, আবার এয়ারহোস্টেজের সাহায্য ও নিতে পারেন।” নস্কর সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাত তালি দিয়ে বললেন-” ব্রাভ, ব্রাভ, (আনারুলের পিঠ চাপড়ে) হালদার আনারুলের গামছাটা নোংরা হয়ে গেছে, ওকে একটা নতুন গামছা কিনে দেবেন। এখন আনারুলের অনারে সবাই মিলে এক রাউন্ড চা হয়ে যাক।”
দেখতে দেখতে কখন যে মাস দেড়েক কেটে গেল আনারুল বুঝতেও পারলনা। বয়সে সব থেকে ছোটো, আর মিশুকে হওয়ার জন্য অল্প সময়ের মধ্যে সকলের মন জয় করে নিয়েছে। নস্কর সাহেবকে আনারুলের খুব পছন্দ, তাঁর সুবিধা অসুবিধার দিকে আনারুলের সজাগ দৃষ্টি। মায়ের সাথে রোজ ফোনে কথা হয়, কথার অর্ধেক হয় নস্কর সাহেবকে নিয়ে। নস্কর সাহেব যে মজা মশকরা করতে জানেন তা আনারুল আর নস্কর সাহেবের কথোপকথন না শুনলে বিশ্বাসই হত না। এক দিন সবাই এক জায়গায় বসে চা খাচ্ছে, এরি মধ্যে একটা এ্যারোপ্লেন তুলনামূলক নিচুস্তর দিয়ে উড়ে যাওয়ায় জোরে শব্দ হচ্ছিল, সবাই উৎসুক হয়ে প্লেনটা দেখছে, আনারুল দুম করে বলে উঠল-” বলত চাচা প্লেনটা সোজা যাবে না বাঁক নেবে? যদি বাঁক নেয় তবে কোন দিকে নেবে?” আনারুলের কথার কেউই উত্তর দিতে না পারায় আনারুল বলল-” ডান দিকে যাবে, দেখ প্লেনটার পাখা দুটো এক লেভেলে নেই, বাম পাখা সামান্য উঁচু আর ডান পাখা সামান্য নিচু।” কথা শেষ হতে না হতেই সকলে উঁচু টিলার উপর থেকে দেখল সত্যিই প্লেনটা ডানদিকে টার্ন নিল। পাশে বসে নস্কর সাহেব আনারুলের ব্যাখ্যাটা শুনলেন। আনারুলের প্লেন নিয়ে চর্চার মনে মনে প্রশংসা না করে পারলেন না। তিনি এগিয়ে এসে আনারুলকে জিজ্ঞেস করেন-” আচ্ছা আনারুল প্লেন চলে কিসে? পেট্রল না ডিজেল! আমি সব এয়ারপোর্টে ইন্ডিয়ান অয়েলের ট্রাঙ্কার বসানো দেখেছি।” আনারুল বিজ্ঞের মতো বলল-” না স্যার, পেট্রল,ডিজেল কোনোটাতেই নয়, প্লেন চলে অতি উন্নত মানের কেরোসিনে, তবে ওই কেরোসিন আরো পাতলা,অনেক বেশি রিফাইন করা। পেট্রল, ডিজেল তো মোটা, প্লেনের সূক্ষ্ম যন্ত্রাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।” নস্কর সাহেব আবার প্রশ্ন করেন-“আচ্ছা আনারুল প্লেনে ফুয়েল থাকে কোথায়? —স্যার, দুই দিকের পাখায় তেল সমান ভাবে ভরা থাকে, আবার তেল পোড়েও সমান ভাবে,কারন প্লেনের ব্যালেন্স ঠিক রাখতে হয়। তবে স্যার প্রচুর তেল খরচ হয়। ঘণ্টায় প্রায় তিন হাজার দুইশো লিটার তেল পোড়ে। — আচ্ছ আনারুল আমরা তো আকাশ দিয়ে ছোট ছোট প্লেন উড়ে যেতে দেখি, আদতে ওটা তো অমন নয়, তাহলে প্লেন কত উপর দিয়ে কেমন গতিতে যায়? সবাই চা খেতে খেতে আনারুলের বিমান সম্পর্কিত জ্ঞান গোগ্রাসে গিলছে। আনারুলও এমন জায়গায় বলতে পেরে স্বচ্ছন্দ বোধ করছে। আনারুল বলতে শুরু করে — স্যার, সাধারণত যাত্রীবাহী বিমান দুরত্ব অনুযায়ী সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে তিরিশ হাজার ফুট থেকে পঁয়তাল্লিশ হাজার ফুট উপর দিয়ে চলে। আর গতিবেগও দুরত্ব অনুযায়ী ছয়শো থেকে নয়শো কিলোমিটার থাকে প্রতি ঘন্টায়। নস্কর সাহেব মুগ্ধ হ’য়ে গেলেন, স্বল্প শিক্ষিত আনারুলের বিমান সম্পর্কিত জ্ঞানে। আনারুলের পিঠ চাপড়ে বললেন-” ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়, কথাটা তুমি প্রমান করলে, তোমার হবে, উন্নতি তোমার কেউ আটকাতে পারবেনা।”
মাস দুইয়েক পর একদিন আনারুলের মা ফোন করে জানাল, আনারুলের দিদির বিয়ের ঠিক হয়ে গেছে, অর্থাৎ আনারুলকে ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। সু’খবরটা শুনে আনারুলের আনন্দ হল বটে, কিন্তু চিন্তা বাড়ল ততোধিক। কারন এখন বাড়িতে ফিরলে তাকে যে ট্রেনে চেপে ফিরতে হবে। প্লেন ভাড়া, অন্যান্য জিনিসপত্র কেনার টাকা এখনো সঞ্চয় করে উঠতে পারেনি। সুতরাং, প্লেনে চাপার স্বপ্নটা যে অপূরণই থেকে যাবে। আনারুলের মা তাকে বোঝায় যে, ” তুই না হয় পরের বার ফেরার সময় ইচ্ছে পূরণ করিস।” আনারুল বেঁকে বসে, প্রথম সুযোগ সে হাতছাড়া করতে চায় না। আনারুলের এই ছেলেমানুষী জেদের জন্যে তার বাড়ির মানুষগুলো খুবই ব্যাথিত, কারন সে যে বাড়ির এক মাত্র পুত্র সন্তান।
কথায় আছে ‘দেওয়ালেরও কান আছে’। ফলে এ কান ও কান হতে হতে শেষ পর্যন্ত নস্কর সাহেবের কানে পৌছুলো যে আনারুল একমাত্র দিদির বিয়েতে যাবেনা। কারন সে ফ্লাইট ভাড়া এখনো সঞ্চয় করে উঠতে পারেনি। নস্কর সাহেব আনারুলকে বুঝতে না দিলেও ভীষন স্নেহ করেন। ফলে তিনি আনারুলকে ডেকে নিজ কানে তার ইচ্ছের কথা শুনে বলেন যে তিনি এ্যাডভান্স পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করছেন। বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে ফিরে স্যালারি থেকে এ্যাডজাস্ট করলেই হবে। এখনকার মতো সমস্যার সমাধান তো হোক। অথএব সে যেন বাড়িতে যাওয়ার জন্যে তৈরি হয়। আনন্দে আনারুলের চোখে জল চলে এল। নস্কর সাহেবের পায়ে দুম করে একটা প্রনাম করেই সুপ্রস্তাবটা নিয়ে ছুটল করিম চাচার কাছে। করিম চাচাকে জানিয়ে মাকে ফোন করবে।
আনারুলের মা আনারুলের কাছে নস্কর সাহেবের প্রস্তাব শুনে, গোঁয়ার ছেলে দিদির বিয়েতে বাড়িতে ফিরবে এই আনন্দে বলেন-” ওরে আল্লাহতালা দোয়া না করলে অসম্ভব কে সম্ভব করা যায় না। তোর মনের ইচ্ছাকে খোদা নস্কর সাহেবের হাত দিয়ে পূরণ করবে। আল্লা ওনার ভাল করুন। যাইহোক, তুই কিন্তু ওখানে কোনো কেনাকাটা করিস নে। কোলকাতায় ফিরে —–।” –তাই হবে আম্মু, বু,তুমি পছন্দ করে শাড়ি কিনবে। আম্মু আব্বাকে লুঙ্গি, পাঞ্জাবি একটা সাদা টুপি কিনে দেব, কোনে কত্তা বলে কথা।” –ঠিক আছে, তুই বাড়ি আসার পর কেনাকাটা নিয়ে কথা হবে। তোর জিনিস পত্রগুলো মনে করে গুছিয়ে নিবি, আর পেলেনের টিকিট কাটা হলেই আমাকে জানাবি কবে আসবি।” —-শুধু জানলে হবেনা আম্মু, সময়মত তুমি,আব্বা আর বু এয়ারপোর্টে এসে দাঁড়িয়ে থাকবে। আমি বেরিয়েই যেন তোমাদের দেখে হাত নাড়তে পারি।” —- ওরে পাগল, পাগলামি করিসনে। ওখানে কত বড়বড় মানুষেরা পেলেন থেকে নামে, তাদের বড়লোক স্বজনরা আসে, ওখানে কি আমাদের মতো গরীব মানুষের——!!!” —-তার মানে? আমিও তো ফ্লাইটে ফিরব, তার দাম নেই? — ঠিক আছে, সময় হলে দেখা যাবে। এখন রাখ, হাতের অনেক কাজ পড়ে আছে।
নস্কর সাহেব আনারুলকে আফিস ঘরে ডেকে ফ্লাইটের টিকিট হাতে দিয়ে বললেন-” আনারুল ফিরে আসার সময় কোলকাতার রসগোল্লা আনতে হবে। অবশ্যই সেটা তোমার দিদির বিয়ের অনারে আমরা সবাই মিলে খাব।” টিকিট হাতে পেতেই আনন্দে আনারুলের চোখ ছলছল করে উঠলো। আবেগাপ্লুত হ’য়ে নস্কর সাহেবকে প্রণাম করল। নস্কর সাহেব আনারুলের হাতটা ধরে বললেন-” আমাকে নয়, প্রণাম বরং হালদারকে কর, যে টুকু সুযোগ সুবিধা পেয়েছ সব ওই হালদার সাহেবের জন্যে। আর একটা কথা, জীবনে টার্গেট থাকাটা খুবই জরুরি, না হলে জীবনে ডেভেলপমেন্ট আসেনা। ফ্লাইটে চড়ার টার্গেট তো পূরণ হচ্ছে, এবার এই লক্ষে শপথ নাও যেন আগামি দিনে লেবার থেকে ঠিকাদার হতে পার। আনারুল মাথা নিচু করেই জবাব দেয়-” মনে থাকবে স্যার।”
টাওয়ারের বেস তৈরি শেষের দিকে, বেসের বাইরের অংশে প্লাস্টারের কাজ শুরু হয়েছে। চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ ফুট উপরে বাঁশের ভারা বেঁধে কাজ চলছে। একটা ভারার উপর আনারুল ও তার করিম চাচা কাজ করছে। খুবই বিপজ্জনক কাজ। অতি সাবধানে কাজ করতে হচ্ছে। কোনো ভাবে পা স্লিপ করলেই বিপদ ঘটতে পারে। আনারুলের সে সব দিকে কোনো খেয়াল নেই, প্লেনে চড়ার দিনটার কথা ভেবে মনটা উৎফুল্ল হয়ে আছে। কাজের মধ্যেই চিন্তাভাবনার স্ফুরণ ঘটে চলেছে। — জানো চাচা, যতদিন পর্যন্ত ফ্লাইটে চাপা নিশ্চিত হয়নি,তত দিন যে আনন্দ মনের ভিতরে ছিল,আজ টিকিট হাতে পেয়ে কিন্তু সে-ই আনন্দ হচ্ছে-না। “ করিম আলি কাজ করতে করতে বলে-” ওরে পাওয়ার প্রত্যাশা অনেক, পেলে তো ফুরিয়ে যায়।” ফলে আনন্দও কমতে থাকে।” — জান চাচা, এখনো আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না যে আমি ফ্লাইটে চেপে বাড়ি যাব। তবে তুমি ছুটি পেলে আরো ভাল হত। —সবাই কি ছুটি পায়! সময়মত কাজ তুলতে হবে না! তুই বাড়ি যা, আমাদের তরফ থেকে তোর চাচী, বোনেরা থাকবে। — শুধু থাকবে বল্লে হবেনা, এক সপ্তাহ তোমাদের রান্না ঘরে তালা বন্ধ থাকবে, চাচিকে ফোন করে বলে দেবে। চাচা আমি ভাবছি দুলাভাইকে একটা সবুজ কুর্তা কিনে দেব। আবেগে অসাবধানতার জন্য বিপদ ঘটতে পারে ভেবে একটু শাষণের সুরে করিম আলি আনারুলকে বলে– — মশলা দে, সাবধানে কাজ কর, পায়ের দিকে খেয়াল রাখবি। কোম্পানিও তেমনি, এ-সব কাজে ভারার নিচে নেট বাঁধতে হয়। নিজেরা পয়সা বাঁচাতে আমাদের বিপদের মধ্যে ফেলে রেখেছে। বিপদজনক পরিস্থিতিতে কাজ করতে হচ্ছে। এদিকে আনারুলের ও-সব দিকে খেয়াল নেই। সে তো আবেগাপ্লুত হয়ে আগামী দিনের পরিকল্পনার বর্ণনা করতে ব্যাস্ত। ওদিকে দু’জনের চোখের আড়ালে ঈশান কোনে যে মেঘ জমছে দুজনের কেউ সেটা বুঝতে পারেনি। মূল যে বাঁশটার উপর ভারাটা বাঁধা হয়েছে তার একদিকের দড়ির বাঁধন হঠাৎ করে খুলে গেল। হুড়মুড় করে একটা সাইড কাত হতেই আনারুল আর করিম আলি পা স্লিপ কেটে পড়তে পড়তে ভারার বাঁশটা ভাল করে ধরে ফেলল। চারদিকে চিৎকার চেচামেচির রোল উঠল। কিন্তু ততক্ষণে চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ ফুট উপরে বাঁশ ধরে দুজনে ঝুলতে থাকে। ঝোলা অবস্থায় আনারুল খেয়াল করল বাঁশটির অপর দিকের বাঁধন আস্তে আস্তে খুলে যাচ্ছে, অর্থাৎ দুজনের ভার রাখতে পারছে না। আনারুল চিৎকার করে বলল-” চাচা আমি হাত ছেড়ে দেই, না হলে দুজনেই মরব।” —না আনারুল তোর মা তোর অপেক্ষায় আছে অমন কাজ করিস নে। মরলে দু’জনে এক——। —- না চাচা, আমি মরলে মা ছাড়া কাঁদার কেউ নেই। কিন্তু তুমি মরলে তোমার সংসার ভেসে যাবে। (কথাটা বলেই আনারুল হাত ছেড়ে দেয়।) মুহুর্তের মধ্যে সব শেষ। পাহাড় প্রমান স্বপ্নের যবনিকাদপতন ঘটল। ঠিক সেই মুহূর্তে একটা এ্যারোপ্লেন টাওয়ারের উপর দিয়ে স্বশব্দে উড়ে গেল। হয়ত প্লেনটা কোলকাতা যাচ্ছে, আনারুলের আত্মা নশ্বর দেহটাকে ছেড়ে সকলকে শেষ বিদায় জানিয়ে ওই প্লেনেই চলল তার মায়ের কাছে।
নিথর হয়ে পড়ে আছে আনারুলের নশ্বর দেহটা। গাছ থেকে পাকা আম শুকনো পাথুরে মাটিতে পড়ে যেমন তার ভেতর থেকে শাঁস রস বেরিয়ে যায়, ঠিক তেমনি ———-। ইতি মধ্যে নেট টানিয়ে করিম আলিকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। করিম আলি নেট থেকে বেরিয়ে এসে আনারুলের নিথর ফাটা রক্তাক্ত শরীরটা জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলে-” এ তুই কি করলি আনারুল! আমার সংসার ভেসে যাবে বলে নিজের জীবন দিয়ে দিলি। আমি তোর মা বাবাকে মুখ দেখাব কি করে। তারা যে অনেক ভরসা করে আমার কাছে ছেড়ে দিয়েছিল।” সকলের চোখে জল, আকর্ষিকতার বিহবলতায় সকলে যেন পাথর হয়ে গেছে। করিম আলির হাহাকার শুধু আকাশ বাতাস বিদীর্ণ করে উচ্চারিত হচ্ছে–আ-না-রু-ল-না-রু-ল-ল, তু-ই এ-টা কি ক-র-লি!!!
নস্কর সাহেব চশমা খুলে চোখ মুছতে মুছতে ভাবছেন প্রকৃত দোষী তারাই, তাঁদেরই গাফিলতিতে আজ এত বড়ো একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। কোম্পানি না হয় টাকা দিয়ে সব ম্যানেজ করবে, বাট ছেলেটির লাইফ??? মায়ের কোল যে শূন্য হল। তিনি হালদার সাহেবকে নির্দেশ দিলেন পুলিশকে ইনফর্ম করতে। হালদার সাহেবকে জানিয়ে রাখলেন, আনারুলের বডি কফিন বন্দী হয়ে ফ্লাইটেই কোলকাতা যাবে।
আজ আনারুলের ইচ্ছে পূরণ হবে। জ্ঞান হওয়ার প্রত্যুষে সে যে ইচ্ছের বীজ বপন করেছিলো, আজ তার পরিসমাপ্তি। স্বেচ্ছায় নিঃস্বার্থভাবে একটা পরিবারকে বাঁচিয়ে বীরের সম্মানে সে আজ এ্যারোপ্লেনে চেপে বাড়িতে ফিরছে। আনারুলের মা সহ গোটা পাড়াটা আজ বিমানবন্দরে হাজির। মায়ের হাতে সাদা গোলাপের মালা। আনারুলের মা’কে দেখে হাত নাড়াবার অমোঘ ইচ্ছেটা আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সুনামির মতই আছড়ে পড়বে তার মায়ের বুকে।
শ্রী সলিল চক্রবর্তীর লেখা ছোট গল্প “ইচ্ছে পূরণ ” পড়লাম। আমি ওনার লেখা অনেক গল্প পড়েছি, গল্পকার হিসেবে ওনার প্রতিভাকে স্যালুট জানাই। এই “ইচ্ছে পূরণ ” গল্পটা একটা নতুন স্বাদের গল্প। গল্পটা পড়তে পড়তে কখনোই মনে হলোনা যে আমি একটা গল্প পড়ছি। যেন ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনার বিবরণ পড়ছি। মন্তেশ্বর গল্পের ভিতর নিবিষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। গল্পের শেষটা মর্মান্তিক লাগলো। ইচ্ছে তার সত্যিই পূরণ হলো, কিন্তু তার জীবিত অবস্থায় নয় তার কফিন বন্দী দেহটা ফ্লাইটে চড়ে “ইচ্ছে পূরণ” করলো। অতীব সমৃদ্ধ লেখা। কোনো বাহুল্যতা নেই। সলিল বাবুকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই 🙏♥️🙏
শ্রী সলিল চক্রবর্তীর লেখা ছোট গল্প “ইচ্ছে পূরণ ” পড়লাম। আমি ওনার লেখা অনেক গল্প পড়েছি, গল্পকার হিসেবে ওনার প্রতিভাকে স্যালুট জানাই। এই “ইচ্ছে পূরণ ” গল্পটা একটা নতুন স্বাদের গল্প। গল্পটা পড়তে পড়তে কখনোই মনে হলোনা যে আমি একটা গল্প পড়ছি। যেন ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনার বিবরণ পড়ছি। মন্তেশ্বর গল্পের ভিতর নিবিষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। গল্পের শেষটা মর্মান্তিক লাগলো। ইচ্ছে তার সত্যিই পূরণ হলো, কিন্তু তার জীবিত অবস্থায় নয় তার কফিন বন্দী দেহটা ফ্লাইটে চড়ে “ইচ্ছে পূরণ” করলো। অতীব সমৃদ্ধ লেখা। কোনো বাহুল্যতা নেই। সলিল বাবুকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই 🙏♥️🙏